গল্প – ৩ (স্যান উপজাতি, কালাহারি)
-----------------------------
অনেক অনেক দিন আগের কথা। কৈশোরের উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে তার মায়ের হাত ধরে জীবনে প্রথমবার গ্রামের বাইরে যাচ্ছিল। কোন উত্তেজনা নয়, একরাশ ভয় কিলবিল করছে তার ছোট্ট মাথায়। সে দেখতে পেয়েছে একটা হায়না স্যাঁত করে লুকিয়ে পড়ল বুকসমান উঁচু ঘাসের জঙ্গলে। মেটে রঙের টিলাটার ওপর কিচমিচ করছে তিনটে বেবুন। একটা ধেড়ে ইঁদুর ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল তার পায়ের ওপর দিয়ে। গেল ওদিকেই যেখানে তার মা রিড ঘাসের চাটাই দিয়ে তার জন্য একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে রেখেছে। যতদিন না সে পূর্ণ নারী হয়ে ওঠে ততদিন তাকে এই ঘরেই থাকতে হবে। তার বুক ফেটে কান্না এল। ইচ্ছে হল মা ’ কে বলে, ‘ দোহাই তোমার, ফেলে যেও না এখানে আমায়। ত্রিসীমানায় মানুষ নেই কোন। কেমন করে থাকব আমি একা একা? ’ কিচ্ছুটি বলতে পারল না সে। তাদের সমাজে এমনটাই নিয়ম। এখানেই থাকতে হবে তাকে পূর্ণিমা পর্যন্ত – যতক্ষণ না সে পূর্ণতা পায়। সে দেখল আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। অ্যাকাশিয়ার জঙ্গলে মিলিয়ে যাচ্ছে তার মায়ের ছায়া।
একটা করে দিন যায়। রাতের চাঁদ একফালি বাড়ে। নিঝুম অন্ধকারে কুঁড়েঘরের দুয়োরে বসে সে আকাশের একমাত্র আলোটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলায় শোনা গল্প মনে পড়ে তার। এই চাঁদ, তারা, সূর্য, জল, জঙ্গল, মরুভূমি – সবকিছু তৈরী করেছেন ক্কাগেন – কালাহারির পবিত্র পোকা। একসময় যখন চাঁদ ছিল না, যখন সূর্য ডুবলেই নিকশ অন্ধকার, তখন ক্কাগেন তাঁর পায়ের জুতো খুলে বললেন, তোমাকে দিয়ে আমি চাঁদ বানালাম। জুতো যেমন মানুষকে নিয়ে যায় ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে মরুভূমির এপার থেকে ওপারে, তুমিও তেমন ঘুরে বেড়াবে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো নিয়ে। অন্ধকারকে তুমি ফিকে করবে।
কিন্তু ফিকে কই! অন্ধকার যে এখনও বড্ড জমাট – মেয়েটি ভাবে। ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয় আকাশে আরও একটু আলো জুড়ে দিলে কেমন হয়! সে তো জানে কোন গাছের মূলে আলো জ্বলে ভালো, কোন মূলে সুগন্ধ ছড়ায়। আধভাঙা চাঁদের ফ্যাকাশে আলোতেই সে একটা গাছের ডাল খুঁজে নেয়। মাটি খুঁড়তে থাকে। একটা-দুটো না, অনেক অনেক মূল চাই তার। অনেক অনেক আলো সে জ্বালতে চায় আকাশে – অন্ধকার তার একদম পছন্দ নয়।
একরাশ মূল জোগাড় করে কুঁড়েতে ফেরে সে। একটুকরো আগুন্ন জ্বালিয়ে গেছিল তার মা। তা এখনও জ্বলছে ধিকিধিকি। সে মূলগুলো ছুঁড়ে দেয় আগুনে। সুগন্ধী সাদা ধোঁয়ায় ঘর ভরে ওঠে। আগুন থেকে কিছুটা ছাই তুলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ‘ তোমার নাম দিলাম ক্কো – ছায়াপথ – রাতের অন্ধকারে তুমি আলো ছড়াবে, পথহারাকে পথ দেখাবে ’ – এই বলে সে মুঠোভরা ছাই ছুঁড়ে দেয় আকাশে। বিন্দু বিন্দু সাদা ছাই ছড়িয়ে পড়ে আকাশের এপার থেকে ওপারে। রাতের অন্ধকারে দ্যুতি ছড়ায়। যারা পথ চলছে একা একা, আলো দেখায় তাদের।
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago