About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Saturday, December 25, 2010

ছায়াপথের কথা - ৩

গল্প – ৩ (স্যান উপজাতি, কালাহারি)
-----------------------------

অনেক অনেক দিন আগের কথা। কৈশোরের উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে তার মায়ের হাত ধরে জীবনে প্রথমবার গ্রামের বাইরে যাচ্ছিল। কোন উত্তেজনা নয়, একরাশ ভয় কিলবিল করছে তার ছোট্ট মাথায়। সে দেখতে পেয়েছে একটা হায়না স্যাঁত করে লুকিয়ে পড়ল বুকসমান উঁচু ঘাসের জঙ্গলে। মেটে রঙের টিলাটার ওপর কিচমিচ করছে তিনটে বেবুন। একটা ধেড়ে ইঁদুর ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল তার পায়ের ওপর দিয়ে। গেল ওদিকেই যেখানে তার মা রিড ঘাসের চাটাই দিয়ে তার জন্য একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে রেখেছে। যতদিন না সে পূর্ণ নারী হয়ে ওঠে ততদিন তাকে এই ঘরেই থাকতে হবে। তার বুক ফেটে কান্না এল। ইচ্ছে হল মা ’ কে বলে, ‘ দোহাই তোমার, ফেলে যেও না এখানে আমায়। ত্রিসীমানায় মানুষ নেই কোন। কেমন করে থাকব আমি একা একা? ’ কিচ্ছুটি বলতে পারল না সে। তাদের সমাজে এমনটাই নিয়ম। এখানেই থাকতে হবে তাকে পূর্ণিমা পর্যন্ত – যতক্ষণ না সে পূর্ণতা পায়। সে দেখল আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। অ্যাকাশিয়ার জঙ্গলে মিলিয়ে যাচ্ছে তার মায়ের ছায়া।

একটা করে দিন যায়। রাতের চাঁদ একফালি বাড়ে। নিঝুম অন্ধকারে কুঁড়েঘরের দুয়োরে বসে সে আকাশের একমাত্র আলোটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলায় শোনা গল্প মনে পড়ে তার। এই চাঁদ, তারা, সূর্য, জল, জঙ্গল, মরুভূমি – সবকিছু তৈরী করেছেন ক্কাগেন – কালাহারির পবিত্র পোকা। একসময় যখন চাঁদ ছিল না, যখন সূর্য ডুবলেই নিকশ অন্ধকার, তখন ক্কাগেন তাঁর পায়ের জুতো খুলে বললেন, তোমাকে দিয়ে আমি চাঁদ বানালাম। জুতো যেমন মানুষকে নিয়ে যায় ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে মরুভূমির এপার থেকে ওপারে, তুমিও তেমন ঘুরে বেড়াবে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো নিয়ে। অন্ধকারকে তুমি ফিকে করবে।

কিন্তু ফিকে কই! অন্ধকার যে এখনও বড্ড জমাট – মেয়েটি ভাবে। ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয় আকাশে আরও একটু আলো জুড়ে দিলে কেমন হয়! সে তো জানে কোন গাছের মূলে আলো জ্বলে ভালো, কোন মূলে সুগন্ধ ছড়ায়। আধভাঙা চাঁদের ফ্যাকাশে আলোতেই সে একটা গাছের ডাল খুঁজে নেয়। মাটি খুঁড়তে থাকে। একটা-দুটো না, অনেক অনেক মূল চাই তার। অনেক অনেক আলো সে জ্বালতে চায় আকাশে – অন্ধকার তার একদম পছন্দ নয়।

একরাশ মূল জোগাড় করে কুঁড়েতে ফেরে সে। একটুকরো আগুন্ন জ্বালিয়ে গেছিল তার মা। তা এখনও জ্বলছে ধিকিধিকি। সে মূলগুলো ছুঁড়ে দেয় আগুনে। সুগন্ধী সাদা ধোঁয়ায় ঘর ভরে ওঠে। আগুন থেকে কিছুটা ছাই তুলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ‘ তোমার নাম দিলাম ক্কো – ছায়াপথ – রাতের অন্ধকারে তুমি আলো ছড়াবে, পথহারাকে পথ দেখাবে ’ – এই বলে সে মুঠোভরা ছাই ছুঁড়ে দেয় আকাশে। বিন্দু বিন্দু সাদা ছাই ছড়িয়ে পড়ে আকাশের এপার থেকে ওপারে। রাতের অন্ধকারে দ্যুতি ছড়ায়। যারা পথ চলছে একা একা, আলো দেখায় তাদের।

Friday, December 24, 2010

ছায়াপথের কথা - ২

গল্প – ২ (উৎসঃ টোবা ইন্ডিয়ান, আর্জেন্টিনা)
--------------------------------

[ টোবা ইন্ডিয়ানদের দেখা পাওয়া যাবে দক্ষিণ আমেরিকার গ্র্যান চাকো অঞ্চলে। বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে আর আর্জেন্টিনার সীমান্তবর্তী এই এলাকা দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণতম অঞ্চলগুলির একটি। টোবারা ছিল যাযাবর। পঞ্চাশ-ষাট জনের ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়াত। খরাপ্রবণ এই অঞ্চলে খাবার খুঁজে পাওয়াই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা। তাদের ছায়াপথের গল্পও তাই খিদের গল্প।

টোবাদের কল্পনায় সূর্য হল এক জরাগ্রস্ত বুড়ি। কচ্ছপের মত খসখসে ভারী শরীর সে অতি কষ্টে বয়ে নিয়ে চলে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। দিন যেন ফুরোতেই চায় না।

দক্ষিণ আমেরিকার ঐ অঞ্চলে গ্রীষ্মের দিনগুলি দীর্ঘ, অগ্নিবর্ষী – তাই কি সূর্যের তুলনা কচ্ছপের সাথে? ]


সেটা ছিল গ্রীষ্মকাল। সূর্যবুড়ি সবে ঘুম ভেঙে উঠেছে। আমাদের গল্পের নায়ক চিন্নি, একটি চাতকপাখী, মন দিয়ে খাদের ওপর বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে থাকা নড়বড়ে সাঁকোটা মেরামত করছিল। সাঁকো বলতে কিছুই না – একখানি গাছের গুঁড়ি। যেন আধশোয়া হয়ে ঠেস দিয়েছে এই পাহাড় থেকে ঐ পাহাড়ে। মধ্যিখানে গভীর খাদ। এপার থেকে ওপারের গাছগুলিকে দেখায় ঘন সবুজ। এদিকের মত ঝলসানো নয়। খাবারের আকাল পড়লে ওদিক পানে যাওয়া ছাড়া উপায় কি! অথচ দেখ, পারাপারের ধকল নিতে নিতে কেমন জীর্ণ হয়েছে সাঁকোটা। এখনই না সারালে যে কোন মুহুর্তে ভেঙে পড়বে। এইসব ভাবতে ভাবতে জলদি ঠোঁট চালায় চিন্নি। কারোব গাছের ঝুরি দিয়ে কষে বাঁধতে থাকে সাঁকোটাকে পাথরের সাথে।

এমন সময় হাসির আওয়াজ শোনা যায়। টুকটাক দুয়েকটা কথা। দীর্ঘশ্বাস। চিন্নি দেখতে পায় দশ-বারোটি মেয়ের একটি দল এদিক পানে আসছে। - ‘ সেই সকাল থেকে খুঁজে খুঁজে কি পেলাম দেখ! এক টুকরো কন্দ। তাও আবার পচা। এটা তুই কার মুখে দিবি বল! ’ – ‘ এখনই হাল ছেড়ে দিলি! সূয্যিবুড়ি তো এখনও খাপই খোলে নি ’ । - ‘ চল ঐ কারোব গাছের ছায়ায় জিরৈ দু ’ দন্ড। তারপর ঠিক করা যাবে কোন দিকে যাওয়া যায় ’ । ওরা চিন্নির পাশে এসেই বসে। খেয়ালই করে না চিন্নিকে। গ্রীষ্মকাল। এই সাত সকালেও রোদ্দুর ঠা ঠা করছে। ওরই মধ্যে একটু হাওয়া খেলে। চানার ফলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে সেই হাওয়ায়। - ‘ কি মিষ্টি বাস গো! ’ – মেয়ের দলের সবচেয়ে ছোটটি পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় খাদের দিকে – ‘ ঐ দেখ, ঐ পারে ফল ধরে আছে গাছে! কেমন রাঙা, আগুনরঙা ফল! ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে গাছটা! চল দিদি, ওপারে যাই আমরা ’ । চানার ফলের গন্ধে সকলেরই মরে থাকা খিদে চনমন করে উঠেছে। - ‘ কিন্তু যাবি কি করে? এই গভীর খাদ পেরোব কি করে আমরা? ’ – ‘ আরে! এই দেখ! এই ঝোপের আড়ালে একখানা গাছের গুঁড়ি পাতা রয়েছে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। আর চিন্তা কিসের? চল চল! ’ – ‘ না না, এখনও কাজ শেষ হয়নি আমার, এখনই উঠো না তোমরা সাঁকোতে ’ – চেঁচিয়ে ওঠে চিন্নি। কিন্তু চিন্নির ভাষা মেয়েরা বুঝতেই পারে না। তাদের চোখে তখন আগুনরঙা ফল, পেটে গনগনে খিদে। সাঁকোর ওপর ছুটতে থাকে তারা। ওপারে পৌঁছতে হবে জলদি! খাদের মধ্যে শোঁ শোঁ করে হাওয়া দেয়। পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে সে হাওয়া পাক খেতে খেতে উল্টো ধাক্কা দেয় জরাজীর্ণ সাঁকোতে। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে নড়বড়ে কাঠের গুঁড়ি সবকটা মেয়েকে নিয়ে। তাদের আর ওপারে যাওয়া হল না কোনদিন।

চিন্নি থুম মেরে বসে আছে খাদের কিনারে। সূর্যবুড়ি আগুন ঢালছে মাথার ওপর। একটু আগে যেখানে সাঁকোটা ছিল এখন সেখানে সেখানে হাঁ হাঁ করছে খাদ। ঝোপের মধ্যে খড়মড় শব্দ হয়। চিন্নি নড়চড়ে বসে। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে আসে এক সারস। - ‘ কে হে তুমি? কোত্থেকে আসছ? ’ – শুধোয় চিন্নি। - ‘ আসছি বহুদূর থেকে। সেখানে সব খাবার ফুরিয়েছে ’ । - ‘ যাবে কোথায়? ’ – ‘ আর কোথায়! যেখানে খাবার আছে সেইখানে! শুনেছি ওদিকের পাহাড়ে এখনও খরা নামে নি। কিন্তু পেরোব কি করে? কাছাকাছি কোন সাঁকো নেই? ’ – ‘ ছিল হে। এখানেই ছিল ’ – বিমর্ষ চিন্নি বলে – ‘ ভার নিতে পারল না। ভেঙে পড়ল চোখের সামনে। নড়বড় করছিল যখন সারাবার চেষ্টা করেছিলাম। নতুন সাঁকো বানাব এমন কারিগর তো আমি নই! ’ – ‘ কিচ্ছুটি ভেবো না তুমি। আমি বানিয়ে দেব নতুন সাঁকো ’ – বলল সারস। লম্বা শক্ত ঠোঁট দিয়ে কাঠ চিরে তক্তা বানাতে শুরু করে দিল। গাছের ঝুরি দিয়ে কষে বাঁধল তাদের। তারপর পাম গাছের পাতা দিয়ে সুন্দর রেলিং বানিয়ে দিল একখানা। সূর্যবুড়ি ততক্ষণে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। - ‘ কই হে চিন্নি! নতুন সাঁকোটা কেমন হল দেখে যাও একবার! ’ – হাঁক দেয় সারস। – ‘ বাহ! তুমি তো ভারি কাজের মানুষ হে! সাঁকোর মত সাঁকো হয়েছে একটা ’ – তারিফ করে চিন্নি – ‘ চলো যাওয়া যাক তাহলে ওপারে ’ । - ‘ দাঁড়াও, কাজ বাকি থেকে গেছে একটা ’ – বলল সারস – ‘ এখানে বড় ঝোপঝাড়। একটা পথ বানাতে হবে যাতে সবাই সাঁকোটা দেখতে পায়। খাবারের খোঁজে এসে সাঁকো খুঁজে না পেয়ে ফিরে যেতে হলে সে ভারী বিশ্রী ব্যাপার হবে ’ । পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। সারস সেই রঙে রঙ মিলিয়ে ঝোপে আগুন ধরিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ল গাছ থেকে গাছে। মস্ত বড় সাদা ধোঁয়ার কুন্ডলী পাক খেতে খেতে উঠতে লাগল আকাশপানে। চিন্নি দেখল অন্ধকার আকাশের বুক চিরে এগিয়ে চলছে একটা উঙ্কÄল সাদা পথ – নাগাইক – সেই পথ ধরে হাঁটলে খাওয়া-পরার আর একটুও অভাব থাকবে না।

Thursday, December 23, 2010

ছায়াপথের কথা - ১

ছায়াপথ নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে নানা গল্প আছে। তারই কিছু অনুবাদ করব।


গল্প – ১ (উৎসঃ সপ্তম শতাব্দীর জাপান। তবে আদতে নাকি গল্পটি চীন থেকে জাপানে এসেছে)
----------------------------------------------------------------

জাপানদেশে কামি নামে এক দেবতা ছিলেন। তিনি হলেন স্বর্গের রাজা। ইন্দ্র বলা চলে, তবে আমাদের ইন্দ্রের মত ফাঁকিবাজ নন মোটেই। পৃথিবীটা নিয়ম মেনে চলছে কিনা, সবাই মন দিয়ে নিজের কাজ করছে কিনা সেসব দিকে কামির কড়া নজর। কামির একটি মেয়ে। তার নাম তানাবাতা। যেমন তার রূপ, তেমনি গুণ। তার মত সুতো কাটতে আর কাপড় বুনতে আর কেউ পারত না। তার বোনা কাপড় ছাড়া কামির মনই উঠত না। রোজ ভোরে সূর্যের প্রথম আলোটি যে মুহুর্তে স্বর্গপূরীর দুয়োরে এসে কড়া নাড়ে, তানাবাতা অমনি তার তাঁতটি নিয়ে কাজে লেগে যায়। সারাদিন ধরে সূর্য চলে আকাশপথে, তানাবাতার তাঁত থামে না। সুতো ঘুরতে থাকে সামনে পিছে, তার থেকে নামে ছন্দ, ছন্দ থেকে আসে কবিতা। দিনের শেষে সূর্য যখন পরিক্রমা শেষ করে, সবাই দেখে তানাবাতা তার বাবার জন্য বানিয়ে ফেলেছে সবচেয়ে সূক্ষতম কাপড়, আর নিজের জন্য আস্ত একখানি কবিতা।

একদিন তানাবাতা নিজের ঘরে বসে তাঁত বুনছে, এমন সময় এক মানুষ এসে দাঁড়ায় তার দুয়োরে। মানুষটি বড় রূপবান। একপাল গরু-মহিষ নিয়ে সে চরাতে যাচ্ছে কোথাও। তানাবাতাকে সে বলল, ‘ আমি রোজ যাই এই পথে আর তোমাদের উঠোনে কাপড় শুকোতে দেখি। এত সুন্দর কাপড় আমি আর কোত্থাও দেখি নি। তুমি বুঝি এই কাপড় বোনো? ’ তানাবাতা ভারী লাজুক মেয়ে। সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। মানুষটি এবার বলল, ‘ আমার নাম হিকোবুশি। তোমার নামটি তো বললে না? ’ তানাবাতা চোখ তুলে হিকোবুশির দিকে তাকাল আর দেখা মাত্র মানুষটিকে খুব পছন্দ হয়ে গেল তার। কোনমতে নিজের নামটি বলল তাকে। হিকোবুশিরও ভারী ভালো লেগেছে এই মেয়েটিকে। সে সাহস করে বলল, ‘ আমি যাচ্ছি এই গরু-মহিষ চরাতে সামনের সবুজ মাঠে। হাঁটবে একটু আমার সাথে? ’ যদিও সারাদিন ধরে কাপড় বোনাই তানাবাতার কাজ, তবু তার খুব ইচ্ছে হল এই মানুষটির সাথে খানিক ঘুরে আসে। সে তার তাঁত রেখে হিকোবুশির সাথে বেরোল। সবুজ মখমলের মত মায়াবী মাঠে খরগোস ছুটে বেড়াচ্ছে, কাঠবেড়ালী তিড়িং-বিড়িং করছে ইতি-উতি, একটি ইঁদুর গর্ত থেকে মুখ বার করেই আবার লুকিয়ে পড়ল – তানাবাতা বহুদিন এভাবে বাইরে বেরোয় নি। হিকোবুশি তার কোমরবন্ধ থেকে ছোট্ট বাঁশিটি বার করে বাজাতে লাগল। সুর ভাসছে আকাশে-বাতাসে। গুচ্ছ গুচ্ছ উঙ্কÄল রঙীন ফুল ফুটে আছে। তানাবাতা ভারী যত্ন করে হিকোবুশির জন্য বুনোফুলের কোমরবন্ধ বানিয়ে দিল। কবিতা জন্মাল আবার – হিকোবুশির সুরে, সেই মায়াভরা মাঠের উঙ্কÄলতায় আর তানাবাতার যত্নে।

সন্ধ্যে নামে। হিকোবুশিকে নিয়ে তানাবাতা ঘরে ফিরল। কামির কাছে গিয়ে বলল, ‘ বাবা, আমি হিকোবুশিকে বিয়ে করতে চাই ’ । কামি অরাজি হলেন না। তানাবাতা আর হিকোবুশির বিয়ে হল। কাছেই একটি ছোট্ট কুটিরে নতুন সংসার পাতল তারা। তানাবাতার তাঁত বসল বসার ঘরে। হিকোবুশির গরু-মহিষের পাল সবুজ মাঠে চরে বেড়াতে লাগল। নবদম্পতি নিজেদের নিয়ে মগ্ন। হিকোবুশি বাঁশিতে সুর তোলে, তানাবাতার মনে কবিতারা জন্ম নেয়। সূর্যদেবতা কতবার আকাশ এপার-ওপার করল – হিকোবুশির সুর থামল না, তানাবাতার কবিতারা পথ ভুলল না। আর এদিকে তাঁতে জমল ধুলো, গরু-মহিষের দল কে কোথায় ছিটকে গেল কে জানে!

কামি বহুদিন ধরে দেখছিলেন আর ক্রমশই তাঁর রাগ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রইল না। ‘ দিনের পর দিন কাজে অবহেলা করেছ তোমরা। তাই তোমাদের আলাদা করে দেব চিরকালের মত ’ – এই বলে কামি স্বর্গের বাঁধ খুলে দিলেন আর তক্ষুনি সাপের ফণার মত উন্মত্ত জলরাশি আছড়ে পড়ল হিকোবুশি আর তানাবাতার মাঝখানে। তানাবাতা দেখল হিকোবুশি বহুদূরে সরে যাচ্ছে। আবছা হতে হতে শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেল সে। তাদের দুজনের মধ্যে যোজনবিস্তৃত অনন্ত জলধারা বয়ে চলল আজীবন। পৃথিবীর মানুষেরা তাকেই চেনে ছায়াপথ বলে।

তবে দুঃখের গল্প আমার ভালো লাগে না। জাপানীদেরও লাগত না। এই গল্পও তাই এখানেই শেষ নয়। তানাবাতার দিন চলে আগের মত। সূর্য এসে ঘুম ভাঙায়। সে তার তাঁতটি নিয়ে বসে কামির জন্য কাপড় বানাতে। হিকোবুশির কথা ভেবে মন ভারী হয়ে ওঠে, হাত চলে না। দিনের শেষে কামি এসে দেখেন তাঁর নতুন বানানো কাপড় মেয়ের চোখের জলে ভেজা। তানাবাতা বলে, ‘ বাবা, আমার কাজে ভুল হচ্ছে। আমি জানি আমার শাস্তিই প্রাপ্য। তোমার জন্য তিনভুবনের সেরা কাপড় বানাতাম আমি। কিন্তু সে কাপড় আমি আর বুনতে পারছি না। হিকোবুশি চলে যাওয়ার পর আমার মন ভেঙে গেছে। যদি আমাকে আবার আগের মত কাপড় বুনতে হয়, তাহলে এটুকু আশা অন্তত আমায় দাও যে একদিন না একদিন সামান্যতম সময়ের জন্যও আবার হিকোবুশির সাথে আমার দেখা হবে ’ । কামি দেখলেন এই প্রার্থনা মঞ্জুর করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি বললেন, ‘ বেশ তাই হবে। বছরে একবার, সপ্তম মাসের সপ্তম রাতে তুমি হিকোবুশিকে দেখতে পাবে। তবে হ্যাঁ, যদি সেই রাত মেঘমুক্ত থাকে তবেই। আমার নির্দেশে এক হাজার পাখি এসে তখন সেতু বেঁধে দেবে নদীর ওপর। সেই সেতুর ওপর দেখা হবে তোমার আর হিকোবুশির ’ ।

সেই থেকে প্রতি বছর অগাস্ট মাসের সপ্তমীতে হিকোবুশি আর তানাবাতা অপেক্ষা করে থাকে মেঘমুক্ত আকাশের জন্য। আগেকার দিনে অগাস্ট মাস পড়লেই জাপানীরা কচি সবুজ বাঁশের একটি টুকরো সাজিয়ে রাখত তাদের বাগানে। বাঁশের গায়ে রঙীন কাগজ ় এ কবিতা লিখে ঝুলিয়ে দিত। এই উৎসবের নাম ছিল তানাবাতা-সামা। অগাস্ট মাস তারাখসার মাস। গ্রীক পুরাণে যাকে আমরা পারসিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ বলে জানি, আকাশের সেই প্রান্ত থেকে অগাস্ট মাসে উল্কাবৃষ্টি হয়। সপ্তমী তিথিতে যদি আকাশ পরিস্কার থাকে, যদি তারাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদিক-ওদিক তাহলে জাপানীরা জানে কামির নির্দেশে হাজার পাখির দল সেতু গড়ছে আকাশ-নদীতে। একটু পরেই দেখা হবে হিকোবুশি আর তানাবাতার। আর যদি মেঘে ভরা থাকে আকাশ? তাহলে আবার অপেক্ষা এক বছরের জন্য। হিকোবুশি ফিরে যাবে তার গরু-মহিষের কাছে। তানাবাতা আবার বসবে তার তাঁতে। আর দিন গুনবে পরের বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনটির জন্য। জাপানী গৃহস্থ বাগানে সাজিয়ে রাখা সবুজ বাঁশটি ভাসিয়ে দেবে নদীতে। ঢেউয়ের দোলা খেতে খেতে সেটা ক্রমশ হারিয়ে যাবে চোখের আড়ালে।

Sunday, October 3, 2010

আগমনী

অক্টোবর মাস এসে গেল। আজকাল আর ভোর হলে আলো দেখা যায় না। জানলার কাঁচে ফোঁটা ফোঁটা শীত জমে থাকে। আবছা অন্ধকারে গুটিসুটি মেরে জেগে থাকা ফ্যাকাসে নক্ষত্ররা বলে, আরও ঘুমাও খানিক, কি হবে জেগে? যদিও আমি নক্ষত্রের নির্দেশ মানি না। জেগেই থাকি। দেখি কেমন করে শীতরাত ফিকে হয়। মনে পড়ে বাংলা দেশে এখন আশ্বিন মাস। বাংলার আকাশে এখন আগমনী।

পুজো নিয়ে আমার বিশেষ স্মৃতিকাতরতা নেই। প্রতি পুজোতেই ভিড় এড়াতে বাবা-মা বেড়াতে চলে যেতেন আমাদের নিয়ে। ছোটবেলায় দু-একবার অঞ্জলী দিয়েছিলাম বোধহয়। গার্ডেন সিল্কের চকচকে জামা পরে ঘামতে ঘামতে ঠাকুরও দেখেছি বারকয়েক। পায়ের নতুন জুতোয় সদ্যলব্ধ ফোস্কা। সে সব বাদ দিলে দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে আদিখ্যেতা নেই তেমন। ধূপের গন্ধ বেশ লাগে। ভালো লাগে শিউলি ফুল। রেললাইনের ধারে অনাদরে বেড়ে ওঠা কাশের ঝোপ। শরতের নীল আকাশ। আর সবচেয়ে প্রিয় মহালয়ার সকালে নতুন পূজাবার্ষিকীর গন্ধ। বছরের এই সময়টা এইসব আদেখলা অকিঞ্চিৎকর স্মৃতি পোষা বেড়ালের মত পায়ে পায়ে ঘোরে। বকে ধমকেও তাদের এড়ানো যায় না। রোদ উঠুক, ছাই না উঠুক – আগমনীর আলো পথ খুঁজে নেবেই নেবে।

গতবছর এইসময় দিদা চলে গেল। মহালয়ায় নাকি পিতৃপুরুষকে তর্পণ করতে হয়। মেয়েদেরও স্মরণ করার রীতি আছে কিনা কে জানে! মনে তো তাকে পড়েই। যখনই মুগডালে ফোড়ন দিই – জিরে, শুকনোলঙ্কা, আদাবাটা। অথবা কপি-পোস্ত রাঁধি – কড়ায় নেড়ে নেড়ে জলের ছিটে দিয়ে। ভোলার কি উপায় আছে! মানুষ চলে যায়। গন্ধগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে – জব্দ করবে বলে। আগমনীর বাতাসে আজকাল এইসব গন্ধও মিশে থাকে।

পরশু অফিসফেরতা দেখি রোড কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। খামোখা অনেক ঘুরে বাড়ি ফিরতে হল। লাভের মধ্যে ব্লুমিংটনের কিছু রাস্তা ঘোরা হয়ে গেল যেদিকে সচরাচর যাওয়া হয় না। দেখি একটি-দুটি গাছে রঙ ধরেছে। প্রহরশেষের রঙ। আমি অত গাছ চিনি না। আমার কাছে সবাই ম্যাপেল। হেমন্ত এদেশে রঙের ঋতু। পাতা ঝরানোর আগে প্রতিটি গাছ লাল, কমলা, সোনালীতে সেজে ওঠে। সেই রঙের উল্লাস দেখে বোঝার উপায় নেই এ খেলা বেলাশেষের। গোধুলীলগ্নে পরিপাটি সেজে বসে থাকা – সে আসবে। শুভ্র প্রসন্ন শীত। জীবনভোর জমানো সব রঙ নিবেদন তার কাছে। সে নতজানু হয়ে অপেক্ষা করবে তরুমূলে। শীতার্ত সম্মোহিত পাতাগুলো টুপটাপ ঝরে পড়বে তার কোলে। সাদা বালির মত নরম তুষারে ঢেকে যাবে পৃথিবী। ঝিলমিলে সূর্যের আলো সাতরঙা চাদর বিছিয়ে দেবে। তার নিচে শান্তিতে ঘুমোবে বাদামী ম্যাপেল পাতা।

এই নীল আকাশ, কাশের গুচ্ছ, সিলভার ম্যাপেলের পাতায় কমলা ছোপ সেই মোহন প্রীতমের আগমনী গাইছে। “তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর, তুঁহু মম তাপ ঘুচাও। মরণ তু আও রে আও।”

Friday, September 17, 2010

জুলিয়া

জুলিয়ার সাথে যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল তা কিন্তু নয়। জুলিয়াকে যতদিন ধরে চিনি তার পঁচানব্বই শতাংশ সময়ই আমরা আলাদা টিমে ছিলাম। ও অ্যাকুইজিশন। আমি পোর্টফোলিও। এক প্রোজেক্টে কাজ করারও সুযোগ হয় নি সেভাবে। হলওয়েতে বা রেস্টরুমে দেখা হত। টুকটাক কথা। মাঝেসাঝে এক সাথে লাঞ্চেও গেছি। জুলিয়াকে চেনা এভাবেই। তাও কি করে জানি বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কৃতিত্ব অবশ্য ওরই। এমন মিষ্টি মেয়ে – ভালো না বেসে উপায় নেই।

তখন অ্যান্টনি হবে। কাজের চাপ, শরীরের অবস্থা সব কিছু ভেবেচিন্তে আড়াই বছরের সোফিয়াকে রেখে আসা হল চায়নাতে ওর দাদু-দিদিমার কাছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় যেমন পুতুলের মত সুন্দর বাচ্চাদের দেখা যায়, সোফিয়াকে দেখতে একদম তেমনটি। রেস্টরুমে দেখা হলেই জুলিয়ার মুখে তখন সোফিয়ার কথা – জানো, আজ আমার শাশুড়ি ফোন করে বলছে, সোফিয়ার কান বিঁধিয়ে দিলাম, তোমার আপত্তি নেই তো? ভাবো তো, আমার আড়াই বছরের সোফিয়া! ওইটুকু বাচ্চার কান বেঁধালো! আর তারপর কিনা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, আপত্তি আছে কিনা! আপত্তি থাকলেই যেন শুনতো! পরিষ্কার বুঝতে পারতাম সোফিয়াকে আদর করার জন্য জুলিয়ার মনটা ছটফট করছে। ঐ টুকু মেয়ে, কান বেঁধাতে গিয়ে না জানি কত কেঁদেছে। আমরা বলি, জুলিয়া, তুমি ওকে যেতে দিলে কেন? জুলিয়ার মুখ আরও ম্লান হয়। ইচ্ছে করে কি আর মা মেয়েকে ছাড়ে!

তারপর অ্যান্টনি হওয়ার পরেও তো তাকে নিয়ে গেল ওর দাদু-দিদিমা। সোফিয়া তখন ফিরে এসেছিল ওর মা-বাবার কাছে। জুলিয়ার সাথে তখন দেখা হলেই আই-ফোনে অ্যান্টনির ভিডিও দেখাত। এই দ্যাখো, অ্যান্টনির দুটো দাঁত গজিয়েছে। জানো ও কেমন ইন্টেলিজেন্ট! এখন থেকেই সবাইকে চিনতে পারে। কাল ভিডিও চ্যাট করছিলাম, আমাকে দেখে হেসেছে, জানো! আমার মনে হয় ও সোফিয়ার থেকেও তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে যাচ্ছে। সেকেন্ড চাইল্ডরা কি এই রকমই হয়?

তা’বলে ভাবার কোন কারন নেই জুলিয়ার মন সবসময় চায়নাতে পড়ে আছে। ভীষন কাজের মেয়ে জুলিয়া। কখনও অ্যাকুইজিশন নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকলেই জুলিয়ার কাছে গেছি। দেখেছি ওর কাজ কেমন পরিষ্কার, নিখুঁত ভাবে ডকুমেন্টেড। কর্পোরেট জগতে অনেকেই মুখে মিষ্টভাষী হলেও অন্যকে সাহায্য করাটা প্রতিযোগিতার পথে বাধা হিসেবে দেখে। জুলিয়ার মধ্যে সে ধরনের কোন মালিন্য ছিল না। মাসখানেক আগে আমাদের টিম আয়তনে বাড়লো। তখন জুলিয়া আমাদের টিমে এল ক্রেডিট লাইন অ্যাসাইনমেন্টে ওর ছ’বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে। তখনই নিশ্চয় মনে মনে জানতো যে এই কাজ বেশিদিনের জন্য নয়। কারন, দুই সপ্তাহের মধ্যেই নোটিস এল জুলিয়া চায়নাতে ফিরে যাচ্ছে। ওর ননদের একটা ছোট গারমেন্টসের ব্যাবসা আছে। ওর বর ব্রায়ান ঠিক করেছে দেশে ফিরে গিয়ে বোনের সাথে ব্যাবসাটা বাড়াবে। জুলিয়াও তাই দেশে ফিরছে অ্যামেরিকার পাট চুকিয়ে, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে, আট বছরের প্রবাসকে পিছনে ফেলে।

জুলিয়ার চলে যাওয়ার খবরে মন খারাপ করার সময়টুকুও পেলাম না। যতদিন জুলিয়ার জায়গায় নতুন কেউ না আসছে ততদিন ওর বেশ কিছু কাজ আমাকে দেখতে হবে। এর আগে লাইন অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করি নি কখনও। একেবারে নতুন জিনিসপত্র। ভালো করে বোঝার আগেই হুড়মুড় করে গাদা খানেক প্রজেক্ট ঘাড়ে চেপে গেল। তখন আবার জুলিয়াকে চিনলাম। কি কাজ করতে হবে, কি রকম পড়াশোনা করতে হবে, এমনকি কি ভাবে ভাবা উচিত নতুন স্ট্রাটেজি নিয়ে – সবকিছু জুলিয়া আমাকে মোটে দু’সপ্তাহের ট্রেনিং-এ বুঝিয়ে দিল। একা আমাকে তো না। আমি আর মাইক – দুজনে মিলে ভাগ করে নেবো জুলিয়ার কাজ – দুজনকেই।

আজ ছিল জুলিয়ার শেষদিন। সকালে কফি নিয়ে ফিরছি, ওর কিউবের মানি প্ল্যান্টটার দিকে চোখ গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তো কেটে পড়ছো, মানি প্ল্যান্টটার কি হবে এখন? ও বললো, তুমি নেবে প্লীজ? – নিতে তো পারি। কিন্তু কি ভাবে পরিচর্যা করবো তা তো জানি না। - কিচ্ছু না, সপ্তাহে একবার জল দিও, তাহলেই হবে। নিয়ে এলাম জুলিয়ার মানি প্ল্যান্টকে নিজের কাছে। প্রথমবারের জলটা জুলিয়াই দিল নিজের হাতে। ওর কাছে শেষবারের মত। সব ফার্নিচার বিক্রি হয়ে গেছে। এখন মেঝেতে স্লিপিংব্যাগ পেতে শুচ্ছে ওরা। সোফিয়া বেচারি কিছুই বুঝতে পারছে না, লোকে কেন ওদের বাড়ি থেকে আজকে সোফাটা, কালকে খাটটা, পরশু টিভিটা নিয়ে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যখন ওর গোলাপি রঙের মিনির ছবি দেওয়া ডিভিডি প্লেয়ারটাও একজন এসে নিয়ে গেছে তখন খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। জুলিয়া বলছে, ওকে বললাম চলো আমরা চায়না যাই, তারপর আবার সব হবে আমাদের। সত্যি কি সব হয়! যেমনটি ছেড়ে যেতে হয় ঠিক তেমনটি কি আর কখনও ফিরিয়ে আনা যায়!

দুপুরে লাঞ্চ করলাম একসাথে। জুলিয়া শেষবারের মত মনে করিয়ে দিল, তোমার ফোনটা ইনসিওর করিয়েছ? বলা বাহুল্য, করাইনি। ভুলে মেরে দিয়েছি। আসলে ব্রায়ানের আই-ফোনটা ওদের গতবারের চায়না ট্রিপে হারিয়ে গেছে। এদেশে সার্ভিস প্রোভাইডারের সাথে কনট্রাক্টে থাকলে খুব সস্তায় ফোন পাওয়া যায়। কিন্তু কনট্রাক্টের বাইরে ফোনের ভীষন দাম। ব্রায়ানের ফোনে লস্ট অ্যান্ড স্টোলেন ইনসিওরেন্স ছিল না। তাই ফোন হারানোর পর ওকে প্রচুর দাম নিয়ে নতুন ফোন কিনতে হয়েছে। তারপর থেকেই জুলিয়া আমাদের বলে যাচ্ছে ফোন ইনসিওর করিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি যথারীতি ল্যাদ খেয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই করা হয়ে উঠছে না কাজটা। তবে এবারে করে ফেলতে হবে। জুলিয়া তো আর থাকবে না মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

যাওয়ার আগে যেটা করল তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। জুলিয়ার টেবিলে একটা বানি ছিল, একটা মিষ্টি মত খরগোস ছানা একটা ছোট ঝুড়ি ধরে আছে বুকের কাছে। ঝুড়িটাকে পেনস্ট্যান্ড বা সেল-ফোন হোল্ডার হিসেবে ব্যাবহার করা যায়। জুলিয়ার কাছে যখনই যেতাম বানিটার লম্বা লম্বা তুলতুলে কানে একটু আদর করে দিয়ে আসতাম। বেলা তিনটে নাগাদ, জুলিয়ারই কাগজপত্রগুলো তখন আরেকবার রিভিউ করছি, জুলিয়া এল আমার কিউবে। - শুচি, তুমি আমার বানিকে রাখবে? যখন প্রথম ইউ এসে এসেছিলাম, সেই ২০০২ থেকে এই বানিটা আমার কাছে আছে। তুমি নেবে একে? – অনেকদিন এতটা আবেগতাড়িত হই নি। আমি তো এর যোগ্য নই। তোমার আট বছরের প্রবাসকে তুমি আমার হাতে তুলে দিচ্ছো জুলিয়া! কিছুই বলতে পারলাম না। চুপচাপ হাসলাম শুধু।

তারপর আর কি! আমার ডেস্কে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে জুলিয়ার বানি। আমি ভাবছি আমাকেও একদিন দিয়ে যেতে হবে কাউকে। এভাবেই তো চলে রিলে রেস। এভাবেই তো বৃত্তটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আর ছড়িয়ে পড়তে থাকি পরিধি জুড়ে। কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। অথচ তাও কেমন হাতে ধরা থাকে হাত!

Thursday, September 16, 2010

অবান্তর কথামালা - ৬

এতো জানাই ছিল, নাকছাবিটা হারিয়ে যাবে। গমের ক্ষেতে খুঁজবে তাকে সারা বিকেল। হাঁটতে হাঁটতে যেই ভাবছ সূর্যকে ছুঁয়ে ফেলেছি বুঝি, অমনি আকাশ কালো করে রাশি রাশি কাক উড়ে আসে। ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে – ঠোকরায়, খুবলে নিতে চায় চোখ। তাড়াতে তাড়াতে তোমায় পাঠিয়ে দিল ফ্রেমের বাইরে।

নাকছাবিটি আটকে আছে গমের শীষের ফাঁকে। শেষ বিকেলের লালচে আভায় টলমল। রাত্রি নামলে সন্ধ্যাতারাটি হয়ে অপলক চেয়ে আছে তোমার দিকে...

Wednesday, September 15, 2010

অবান্তর কথামালা - ৫

এভাবেই শব্দেরা ঝরে। ন্যাড়া ছাদে, লাট খাওয়া ঘুড়ির মত চুপচাপ রোদ খায়। নড়ে চড়ে। কথা বলে ফিসফাস, নিজেরাই নিজেদের সাথে।
কবেকার খড়কুটো, কার্নিসে জমে থাকা ভয়, অসময়ে পিছু ডাক, আঁচড়ের দাগ, মায়াময় - বাঁধা ছিল আঁচলের খুঁটে।
এভাবেই শীতবেলা মরে।
তার অশেষ কাঁথাকানি। লাল-নীল পাড় ছেঁড়া সুতো। টুপটাপ ফোঁড় তোলে। ভাসমান বিহানবেলায়। অকারণ বিষাদে ও জ্বরে।

Tuesday, September 14, 2010

অবান্তর কথামালা - ৪

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। অল্প অল্প শীত করে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি বৃষ্টি নেমেছে। বাতিদানের তলায় জলকণাগুলোকে একটি একটি করে গোনা যায়। শান্ত নিরুত্তাপ বৃষ্টি। নিশ্চুপ রাত। থুম মেরে ভিজছে। শার্সী তুলে দিই। ভিজে হাওয়াতে ঘর ভরে যায়। গুটিসুটি মেরে বসে থাকি। বৃষ্টি পড়ে। পড়েই যায়।

সন্ধ্যাবেলায় অনেক তারা ফুটেছিল। এখন আকাশের রঙ লাল। ব্লটিং কাগজের মত ধেবড়ে গেছে এদিক ওদিক। তারাগুলি ঝরে পড়ছে অবিশ্রাম। বাদল হাওয়ায় স্যাঁতস্যাঁতে কাগজের মত নত হয়ে বৃষ্টি ধরি। নক্ষত্ররা মুছে যায়।

Monday, September 6, 2010

সত্যিকারের গল্প

[গুরুচণ্ডালী ২০১০ পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত।
http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=21&pid=jcr://content/pujo09/2010/1288018714994 ]

“সব সত্যি। মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, টারজান সত্যি, অরণ্যদেব সত্যি, ...”

এমনকি ধরো মা দুগগার শাড়ীতে অসংখ্য চুমকি, বিসর্জনের পর সেগুলোই যে কোজাগরীর আকাশে তারা হয়ে ফোটে – তাও তো সত্যিই। ভারী ইচ্ছে হয় একবার হাতে ছুঁয়ে দেখি কতটা সত্যি। ভাসানের আগে ছুঁলে দোষ নেই – সেটা আমি জানি। অনেকেই সে সময় টুকটাক পকেটে পোরে মহিষাসুরের বাজুবন্ধ কিংবা গণেশের উত্তরীয় থেকে খসে পড়া একফালি জরির পাড়। সবচেয়ে বেশী নজর থাকে অবশ্য ময়ূরের পেখমের দিকে। পাওয়া যায় যদি দু-একটা! পুজোর ছুটির পর ইশকুল খুললে বন্ধুদের অপার ঐশ্বর্য দেখে আমি ঈর্ষায় সবুজ হই। মহিষাসুরের মত? যাহ! তা কেন হবে? সে ভারী বদ লোক।

আসলে আমার কপালটাই মন্দ। পুজো আসল মানেই বেড়াতে চল। মাঝেমধ্যে দু-একবার রাজস্থান বা দিল্লী-আগ্রার মত জায়গাতে যাওয়া হলেও বেশীর ভাগ পুজোতেই আমাদের গন্তব্য শিমূলতলা। নবমীর রাতে গোছগাছ সারা। দশমীর ভোরে উদ্যান আভা তুফান। সারাটি দিনের শেষে সূর্য যখন নিভু নিভু, ছোটোনাগপুরের পাথুরে মাটিতে স্তরে স্তরে কুয়াশা জমে, দু-একটি আলো দেখা যায় স্টেশন চত্ত্বরে, ম্রিয়মান, গোধূলিতে প্রায় হারিয়ে গেছে তারা – আমরা তখন ট্রেন থেকে নামি। ইস্টার্ণ রেলের পুকুরটাতে তখন দুগগা ঠাকুর ভাসান যাচ্ছে। ঢাকের আওয়াজ শোনা যায় আবছা মত। বাংলাদেশের মত আহ্লাদী বোল নয়। বেশ খটখটে। সেই খটখটে বোল ছাপিয়ে আসন্ন সন্ধ্যার বিষন্নতাকে লবডঙ্কা দেখিয়ে ভক্তিগীতি ভেসে আসে – “দূর্গা হ্যায় মেরি মা, অম্বে হ্যায় মেরি মা”। বাবা কুলির সাথে দরাদরি করে। আমি আর ভাই একচ্ছুট্টে ওভার ব্রীজের মাথায় উঠে যাই। দেখতে পাই স্টেশন রোড ধরে সাইকেল হাতে হাঁটছে দেহাতি যুবক। পরিপাটি চুল তেল দিয়ে আঁচড়ানো। পাশে মেরুন জরিদার শাড়ী পরা নতুন বউ। ঘোমটার আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি টুকটুকে মুখখানি – কমলা সিঁদুরে ডগমগ। বিহারের এই ছোট গ্রামে দশেরা, রাবণ পোড়ানো – এইসব বড়সড় ব্যাপার-স্যাপার হয় না। ঠাকুর ভাসান, লাড্ডু বিতরণ। ব্যস, এইটুকুই। এককালে বাঙালিরা যখন পশ্চিমে ছুটি কাটাতে আসত তখন এইসব পুজো-টুজোর সূত্রপাত। এখন আর কেউ আসে না। পুজোটা থেকে গেছে।

আমরা হাঁটি কুঞ্জ কুটীরের দিকে। বাবা কুলির সাথে গল্প জোড়ে। “কি গো এবারে বৃষ্টি কেমন হল... পুজোতে লোকজন আসা শুরু হয়েছে... কৈলাস ডাক্তারের খবর কি... আর মনীন্দর, তার বৌয়ের অসুখ সারল?” একে একে পেরিয়ে যাই তারামঠ, বিহারী বাবুকা বাংলা, মধুরাশ্রম। আশীর্বাদের বুড়ি ঠাকুমা সিঁড়িতে বসে আছেন। ভিতর বারান্দার একখানি ল্যাম্পের আলো তাঁর মুখে তেরচা ভাবে লেগে থাকে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে ডাকেন, কে যায়? আমরা গিয়ে প্রণাম করি। বিজয়ার প্রথম প্রণাম। বাবার মুখখানি ধরে বলেন, গোপাল এলি? দাঁড়া দাঁড়া, আমার ঘরের গোপালকে আজ ভোগ দিয়েছি। খেয়ে যা। আমরা শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসে নিখুঁতি খাই। টুকটাক কথা হয়, কে কেমন আছে, আম কেমন হল – এই সব। তারপর আসি কুঞ্জ কুটীরে। কুঞ্জ কুটীরের মালি উল্লাসদা, কাঁচা-পাকা চুল, চৌকো মত চেহারা – মালিকদের অনুপস্থিতিতে ওই ঘর ভাড়া দেয়, গোছগাছ করে, আতার সিজনে পাহারা বসায় আতা গাছে, শীতের শুরুতে খেজুর রসের বন্দোবস্ত করে। আমাদের আসার কথা জানানোই ছিল। উল্লাসদা যদিও পড়তে পারে না। পোস্টাপিসের ওরাই পড়ে-টড়ে দেয় আর কি!

উল্লাসদা ঘর খুলে দেয়। বিছানা পেতে দেয় তক্তপোষের ওপর। কুয়ো থেকে জল তোলা দেখতে আমাদের ভারি ভাল লাগে। মায়ের বারণ অগ্রাহ্য করে কুয়োপাড়ে যাই। উল্লাসদা বালতি ডোবায়। গুবগুব শব্দ হয় জলে। কুয়োর আলসেতে সন্তর্পণে ভর দিয়ে দেখি চকচকে অন্ধকারে এক ফোঁটা চাঁদের আলো নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। উল্লাসদা জোর করে ঘরে টেনে নিয়ে যায়। বাবা ততক্ষণে হারিকেনের পলতে কেটে আলো জ্বালিয়ে ফেলেছে। কুঞ্জ কুটীরের দেওয়ালে আমাদের ছায়াগুলি ছোট বড় হাল্কা গাঢ় হয়ে ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। আমরা আঙুলের ভাঁজে কুকুর বানাই, হরিণ বানাই, টিয়াপাখি বানাই। আরো অনেক কিছু বানিয়ে ফেলি যাদের নাম জানি না। আমাদের আশ্চর্য বাড়ি আশ্চর্য সব জীবজন্তুতে ভরে যেতে থাকে। রাত্তিরে যখন হ্যারিকেনের আলো নিভে যায়, দশমীর চাঁদের আলো তখনও জেগে থাকে। পেয়ারা গাছের পাতাগুলি অবিরাম ছবি এঁকে যায় আমাদের দেওয়ালে। অনেক রাতে কুটুর-কুটুর শব্দে ঘুম ভাঙে। মা বলে, ও কিছু না, ইঁদুর। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে ইঁদুর তখন কুট কুট করে মাটি কেটে পথ বানায়। কোথায় যায় সে পথ? কে জানে! আমাদের দেওয়াল জোড়া অনেক ছায়া, আমাদের চন্দ্রগ্রস্ত রাত, ঝুরো ঝুরো মাটির গর্ভে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে। ঘুমের ওপার থেকে আবছা শুনি – কুট কুট। খুট খুট। দে ছুট! দে ছুট! দলছুট? দলছুট? রং রুট! রং রুট!

পরের দিন সকাল হতেই বেড়াতে বেরোই। অক্টোবরের মাঝামাঝি ছোটনাগপুরের এইসব অঞ্চলে হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা থাকে ভোরের দিকে। হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে আমরা দৌড়ে বেড়াই বিহারীবাবুদের বাগানে। চটাস চটাস করে শিশিরের দানা ঠিকরে এসে পায়ের গোছ ভিজিয়ে দেয়। কুয়াশা কাটিয়ে ফিকে কমলা রঙের সূর্য ওঠে। মা বেসুরো গলায় গুনগুন করে – ‘শুভ্র আসনে বিরাজ অরুণ কিরণ মাঝে’। সুর লাগে না, তবু সকালটা কেমন সুরেলা হয়ে থাকে। অনিলকাকুর দোকানে গরম কচুরী আর খোসাওলা আলুর তরকারী দিয়ে জলখাবার সারা হয়। আমি সবসময় দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসি। দেওয়ালে অনেক পোস্টার লাগানো। আমি আড়চোখে, যেন সামনে বসা মা’কেই দেখছি এমনিভাবে, পোস্টার দেখি। গোলাপফুল আঁকা সাদা চুড়িদার পরা একটা মেয়ে, আমি জানি ওর নাম ভাগ্যশ্রী, এবার পুজোয় ঐ জামাটা খুব উঠেছে।

খাওয়ার পর বাজারের দিকে যাই। মা-বাবা মিলে মাছের দরদাম করে। আমরা দুটিতে গুটি গুটি মন্দির চত্বরের দিকে হাঁটি। আসলেতে বজরং বলীর মন্দির। কমলা রঙের মোটাসোটা বজরং বলী গাল ফুলিয়ে গদা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশেই মাঠের মধ্যে একটু জায়গা করে দূর্গা পুজো হয়। ঠাকুর ভাসান গেছে কাল। টুকটাক ছেঁড়া ফুল, পাতা, নারকেলের ছোবড়া – এইসব চিহ্ন পড়ে আছে। আমি আর ভাই সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঘুরি। যদি কিছু পাওয়া যায়, রাংতা, জরির টুকরো, যা হোক! লাডলীকি মায়ী, আমাদের বাসন মাজে, সে দেখতে পেয়ে বলে, তোমরা এখানে? বউদি তোমাদের বুলাচ্ছে। বেজার মুখে আমরা মন্দির থেকে বেরোই। ভাই বলে, দিদি ওই দেখ! সিঁড়ির খাঁজে আলো পড়ে ঝিলিক মারছে ময়ূরকন্ঠী রঙ। কাল ভাসানের সময় খসে পড়েছে কোনভাবে কার্তিকের বাহনটির থেকে। গোটা নয় অবশ্য। ছেঁড়া ময়ূরের পালক। তা একখানা সত্যিকারের ছেঁড়া ময়ূরের পালকই বা কবে হাতে ছুঁয়ে দেখেছি আমরা! নাচতে নাচতে ঘরে ফিরি সাত রাজার ধন এক মাণিকটিকে নিয়ে। সত্যি সত্যি ময়ূরের পেখম! ভাবা যায়!

একটু বেলা চড়লে বাবা সাইকেল নিয়ে মনীন্দর কাকুর সাথে ঘি আনতে যায়। সে ভারী দূরের পথ। তিনখানা পাহাড় পেরিয়ে, রাজবাড়ি পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে, মনীন্দর কাকুর গাঁওঘরে খাঁটি ঘি তৈরী হয়। সেই ঘি নিয়ে আসবে বাবা। অত দূরে আমাদের যাওয়া বারণ। পাহাড় অবশ্য শুনতেই, আসলে বড়সড় টিলা। আমি আর ভাই ইউক্যালিপটাসের মসৃণ সাদা গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আনন্দমেলা পড়ি। ঝিরি ঝিরি বাতাস দেয়। উল্লাসদা একরাশ পেয়ারা পেড়ে দেয় মা’কে। মা পেয়ারার ক্কাথ জ্বাল দিয়ে দিয়ে জ্যাম বানায়। একটা আঠালো মিষ্টি গন্ধে আমাদের বাড়িটা ভরে থাকে। দুপুর নাগাদ কৈলাস কাকু দেখা করে যায় একবার। স্টেশনের কাছে কৈলাস কাকুর একটা কাপড়ের দোকান আছে। সেই দোকানেই সন্ধ্যের দিকে হোমিওপ্যাথি ওষুধও পাওয়া যায়। বেশ নামডাক কৈলাস ডাক্তারের। কৈলাস কাকু মায়ের রান্নার ভারী ভক্ত। একবার বলেছিল, বৌদি বড় ভালো কুকার আছে। বৌদির ‘কুকার’ হতে আপত্তি ছিল বিলক্ষণ, কিন্তু তাতে কৈলাস কাকুর আপ্যায়নের ত্রুটি হয় নি।

বিকেল হলে রেলের পুকুরের দিকে হাঁটতে বেরোই। কিছু ছেঁড়া ফুলের মালা, পচে যাওয়া পাতা জমে আছে ঘাটের কাছে। ঠাকুরের ভাসান হয়েছে সবে একদিন হল। কদিন পরে মাটি গলে যাবে। খড়ের কাঠামোটা ভেসে থাকবে একাবোকা। একটা মা হাঁস তার ছানাপোনাদের নিয়ে জল সইছিল। অনিলকাকুর দোকানে চায়ের গেলাস ধোয় টুনটুন। এরা হল সেই টুনটুনের মায়ের হাঁস। নিজেরা কট্টর নিরামিশাষী। তবে পুজোর সময় লোকজনের আনাগোনা। তখন ডিম বেচতে বাধা নেই। আমরা হাঁসগুলোকে মুড়ির লোভ দেখিয়ে নিয়ে চলি পুকুরের এ মাথা থেকে ও মাথা। মা হাঁসটির মাথায় একটি বড়ি খোঁপা। ওর গলায় টুনটুনের মা একটা ঘন্টি ঝুলিয়ে দিয়েছে। নড়লে চড়লেই আওয়াজ হয় রুন ঝুন। সন্ধ্যে নামে। একরাশ বক ডানা ছড়িয়ে ঝগড়া করতে করতে উড়ে যায়। টুনটুনের মা বলে, কবে এলে বৌদি? আমার থিকে ডিম নিবে তো? মুরগা লাগবে না? মা হাঁস তার ছানাদের নিয়ে হেলতে দুলতে ঘরে ফেরে। আমরাও বাড়ির পথ ধরি। বিহারী বাবুদের বাগানে রাতপোকারা ঝুম ঝুম শব্দে জেগে ওঠে। আমরা সন্দেহের চোখে অন্ধকারের দিকে তাকাই। বাবা বলে, ও তো ঝিঁঝি পোকা। অন্য প্রজাতির। আমরা ভাবি, বললেই হল! এ তো সেই ঝুঁটিওয়ালা হাঁসবুড়ি। ছানাদের ঘুম পাড়াচ্ছে। ঝুম ঝুম। রুম ঝুম। কই ঘুম? আয় ঘুম। নিঃঝুম। নেই ঘুম!

আমাদের দিনগুলি কাটে ইউক্যালিপটাসের গন্ধ নিয়ে। পেয়ারা গাছের মগডালে বসে আনন্দমেলা পড়তে পড়তে। ভোর হতেই বান্ধুরামের ঝুপড়িতে ছুটি। মোটা কাঁচের গেলাসে খেজুর রস খাই। ফেরার পথে বুড়ো লছমনের ডেরাতে গিয়ে দুধ দোয়া দেখি। লছমনের ঠাকুর্দা ওকে শিখিয়েছিল দুধে জল মেশালে গরু মরে যায়। লছমন তাই ঘন ক্ষীরের মত দুধ জুগিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। শুক্রবার করে টেলুয়ার হাট বসে। আমরা টাঙায় চেপে হাট দেখতে যাই। টিনের ওপর রঙ করা চকচকে টিপ কিনি। কাঁচের চুড়ি কেনার ইচ্ছে হয় খুব। কিন্তু হাত কেটে যাবে বলে মা কিনতে দেয় না। বিকেলবেলা বেড়াতে বেড়াতে রাজবাড়ির দিকে যাই। পাহাড়ের মাথায় রাজবাড়ি। কেউ থাকে না। পলেস্তারা খসে পড়েছে। আগাছা জন্মেছে। তবু রাজবাড়ি তো বটে! পথের পাশে জমে থাকা অভ্রের চাঙড়ে সূর্যের লালচে আভা ঝলমল করে। আমরা দিব্যি দেখতে পাই শোলাঙ্কির রাজকুমারী ছুটে বেড়ায় হাতিশাল থেকে ঘোড়াশালে। সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে উঠে যায় প্রাসাদ শীর্ষে। সন্ধ্যাতারার দিকে মুখ করে বসে।

দেখতে দেখতে কোজাগরী চলে আসে। পরিত্যক্ত রাজবাড়িটি হলদে চাঁদের আলো মেখে রূপসী হয়। মাধবীভিলায় এখনও একঘর বাঙালী থাকে। পুজো হয় তিথি মেনে। দূর থেকে কাঁসরের আওয়াজ ভেসে আসে। আমাদের ইউক্যালিপটাস গাছে রাশি রাশি জোনাকি ভর করে। মনে হয় তারারা নেমে এসেছে। ছোট জনতা স্টোভটিতে মা লুচি ভাজতে বসে। গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ নিতে আমরা বসে থাকি রান্নাঘরের চৌকাঠে। নতুন আলুর দম আর লুচি খেয়ে আমরা কলঘরের ধরে রাখা জলে মুখ ধুয়ে নিই। মা কুয়োতলায় যায় এঁটো বাসন রেখে আসতে। হ্যারিকেনের আলোয় আবার আনন্দমেলা নিয়ে বসেছি, জানলা দিয়ে মা ডাকে নিচু স্বরে, এসো একবার। কোন আওয়াজ না করে বাইরে বেরিয়ে এসো। তোরাও আয় পা টিপে টিপে। আমরা চুপিসাড়ে বেরোই। কোজাগরী রাতে দুধসাদা আলোয় চান করছে অফসলী জমি, লাট্টু পাহাড়, ইউক্যালিপটাসে বাসা বাঁধা অসংখ্য জোনাকি। মা আঙুল তুলে দেখায়, কুঞ্জ কুটীরের কার্নিসে কোথা থেকে উড়ে এসে বসেছে এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা। নিশ্চুপ। স্থবির। ভাবলেশহীন। যেন আলোর প্রাবল্যে জ্বরাক্রান্ত। আমরা চারজন আড়াল থেকে সেই নৈঃশব্দকে ছুঁই।

জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে আমাদের বিছানায় কোজাগরী ভেসে বেড়ায়। মা বলে, কোজাগরীর রাতে যে বাড়িতে লক্ষ্মী প্যাঁচা এসে বসে, সেই বাড়িতে লক্ষ্মীঠাকুর আসেন। আমরা বলি, যাহ! তাও কি হয়? মা বলে, হয় তো! লক্ষ্মীঠাকুর ছোট্ট একটা মেয়ে, ঘুরে বেড়ান এ ঘর থেকে ও ঘরে। আমরা মেয়েটিকে দেখার আশায় এদিক ওদিক তাকাই। চোখ যায় জানলায় আটকে থাকা কোজাগরী চাঁদে। আমরা বলি, সত্যি? চাঁদের বুড়ি মুচকি হেসে বলে, সত্যি বইকি! দেখতে পাই লক্ষ্মীপ্যাঁচা তার সাদা ডানায় আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে উড়ে গিয়ে বসে আতা গাছের ডালে। তার পালক থেকে সম্মতি ঝরে পড়ে – সত্যি! সত্যি! ঠিক তখনই তক্তপোষের পায়ের কাছে শব্দ হয় – কুট কুট কুট – ঠিক ঠিক ঠিক! এক পশলা হাওয়া দেয়। দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছেঁড়া ময়ূরের পেখমটি পূর্ণিমা চাঁদে চান করে ভারী এক প্রশ্রয়ের হাসি হাসে।

Monday, August 30, 2010

উরশিমা নামের জেলেটি

[একটি জাপানী রূপকথার ছায়ানুসারে। দিয়ালা ২০১০ পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত।
http://diyala.kochisamsad.com/godyo/urshima-namer-jeleti.html]

অনেক অনেক দিন আগে জাপান দেশে উরশিমা নামে এক জেলে থাকত। সারাদিন ধরে সে সমুদ্রে মাছ ধরে বেড়ায়। ঢেউয়ের পিঠে চেপে মাছের পিছু পিছু সে চলে যায় বহু বহু দূর। একবার হয়েছে কি, দিনের পর দিন যায়, মাছের বড় আকাল। উরশিমা সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল ডুবে রাত – সারাবেলা জাল বিছিয়ে বসে থাকে, কিচ্ছুটি পায় না। এইভাবে অনেক দিনের পর উরশিমা দেখে এক পাঁচরঙা কাছিম গুটি গুটি উঠে এসেছে তার জালে। মাছের বদলে কাছিম, তো তাই সই! পাঁচরঙা কাছিমটিকে নৌ্কোর খোলে রেখে, অনেক রাত পর উরশিমা খুব ঘুমোল।

ঘুম থেকে উঠে উরশিমা তো তাজ্জব। কোথায় কাছিম! এতো এক পরমাসুন্দরী কন্যে বসে আছে তার শিয়রের কাছে! কন্যে মিষ্টি হেসে বলল,


- “আকাশ থেকে দেখতে পেলাম অথৈ সাগর জলে
ডিঙি চেপে বেড়ায় ঘুরে একলাটি এক ছেলে
তোমার সাথে কইতে কথা ইচ্ছে হল ভারী
মেঘে চড়ে, হাওয়ায় উড়ে এলাম তাড়াতাড়ি”

- “দাঁড়াও দাঁড়াও। মেঘে চড়ে? হাওয়ায় উড়ে? সে আবার হয় নাকি? সত্যি করে বল দেখি, কন্যে তুমি কে?”

- “আমি হলাম আকাশলীনা, মেঘের দেশে বাস
অজর অমর সবাই সেথায়, ফাগুন বারোমাস
আমার সাথে যাবে ছেলে, দেখবে নাকি ভেবে?
থাকব সাথে যদ্দিন না চন্দ্র-সূর্য নেভে।”

এমন সুন্দরী কন্যে! সে থাকে আকাশপারে! প্রস্তাব শুনে উরশিমার তো চোখে পলক পড়ে না। সে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবিশ্যি অবিশ্যি। নিশ্চয়ই যাব তোমার সাথে”। এই বলে সে আকাশলীনার হাতটি ধরে দুই চোখের পাতা বন্ধ করল। আর নিমেষের মধ্যেই তারা দুজনে পৌঁছে গেল মেঘের দেশে।

এমন দেশ উরশিমা কখনও দেখে নি। সে দেশের মাটি জেড পাথরের মত হাল্কা সবুজ আভায় উজ্জ্বল। সে দেশের আকাশ বর্ণনাতীত। তারা পৌঁছনো মাত্র পরীর মত সুন্দর ছ’টি মেয়ে ছুটে এল তাদের দিকে। “আকাশলীনার বর এসেছে। শুনছ সবাই, আকাশলীনার বর এসেছে” – বলতে বলতে তারা কলকল করে ছুটে গেল জেড পাথরের শোভায় স্নিগ্ধ, সবুজ এক প্রাসাদের দিকে।

- “এরা কারা?” উরশিমা জানতে চাইল।

- “বুঝলে না? কৃত্তিকারা ছ’বোন। একই সাথে সারাটি দিন এবং রাতের স্বপন।”

উরশিমা ভাবে বাহ রে! আকাশের ছ’টি তারা – কৃত্তিকা – তারাও কিনা আকাশলীনার বন্ধু! বলতে বলতেই এক ভারী সুন্দর সৌম্য দর্শন পুরুষ আর তেমনই সুন্দর এক মহিলা বেরিয়ে এলেন প্রাসাদ থেকে। তাঁরা আকাশলীনার মা-বাবা। আকাশপারের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীর মানুষের মিলন – এ ভারী বিরল ঘটনা। আকাশলীনার মা-বাবা বার বার বলতে লাগলেন কত খুশী হয়েছেন তাঁরা উরশিমাকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে। দেখতে দেখতে আরো লোক জড়ো হল। সকলেরই দিব্যকান্তি। এদেশে বার্ধক্য নেই। সকলেই ভারী হাসিখুশি। আকাশলীনা আর উরশিমার বিয়ে উপলক্ষ্যে সক্কলে মিলে খুব আনন্দ করল। নাচে-গানে, অপূর্ব সব খাদ্য-পানীয়ে মেঘের দেশে উরশিমার প্রথম দিনটি ঝলমল করতে লাগল।

* * * * * * * * * * *

দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেছে। উরশিমা আর আকাশলীনা মনের সুখে সংসার করছে। জেড পাথরের দেশটি তার সবুজ দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে উরশিমার সবুজ মনে, মেঘে মেঘে, আকাশলীনার চোখের তারায়। তিনটি বছর পরে উরশিমার হঠাৎ একদিন ফেলে আসার গ্রামের কথা, পৃথিবীর কথা মনে পড়ল। আহা, সেখানে বিকালগুলি কেমন হলুদ! সাগরের ঢেউয়ে নাচতে নাচতে মাছ ধরতে যাওয়ার সেই দিনগুলি! রাতের আঁধারে সাগরের ফেনা কেমন আলেয়ার মত জ্বলে! সেইসব পুরোনো কথা ভারী মনে পড়ে উরশিমার। তার গভীর দুই চোখে কুয়াশা ঘিরে আসে।

উরশিমার মনের ভাব আকাশলীনার নজর এড়াল না। সে জানতে চাইল কি হয়েছে। উরশিমা বলল, “গ্রামের কথা, আমার সেই ফেলে আসা পৃথিবীর কথা বড্ড মনে পড়ছে। সে দেশ এমন ঝলমলে নয়। এমন সবুজ আভা ছড়ায় না সেখানে। মানুষেরাও নয় এমন দেবতার মত সুন্দর। তবু তার কথা বড় মনে পড়ছে। খুব ইচ্ছে করছে নিজের বুড়ো বাপ-মাকে একটিবার দেখি।”

আকাশলীনা বুঝল উরশিমাকে বাধা দিয়ে কোনও লাভ হবে না। দুটিতে মিলে হাত ধরে অনেকক্ষণ হাটঁল চুপচাপ। মেঘের দেশে তখন দিন শেষের ঝিকিমিকি বেলা। অস্ত সূর্যের গোলাপী আলো যখন সন্ধ্যাতারার নীলে মুখ লুকালো তখন আকাশলীনা তার প্রিয়তম উরশিমার হাতে হীরে-মানিক গাঁথা একটি ছোট্ট কৌটো তুলে দিয়ে বলল,

- “উরশিমা, সবুজ ছেলে, নিজের ঘরে যাও
সাগরজলে ভাসাও গিয়ে ফেলে আসা নাও!
আকাশপারের দেশের কথা পড়েই যদি মনে
ফিরতে যদি ইচ্ছে করে জেড পাথরের বনে,
কৌটো ছুঁয়ে আমার কথা একটুখানি ভেবো
মেঘে চড়ে, হাওয়ায় উড়ে ঠিক পৌঁছে যাব।
কিন্তু বলি একটি কথা, দোহাই তোমার শুনো,
কোনমতেই এই কৌটো খুলবে না কক্ষনো ”

আকাশলীনার বাবা-মা ভারী দুঃখ পেলেন উরশিমার চলে যাওয়ার সংবাদে। কৃত্তিকারা ছ’বোন সেদিনের মেঘে ঢাকা আকাশে ম্লান আলোর ইশারা হয়ে জেগে রইল। আকাশলীনা হাসি মুখে উরশিমাকে তুলে দিল তার পুরোনো নৌকায়। বুজিয়ে দিল তার চোখের পাতা। নিমেষের মধ্যে আকাশের দেশ ফিকে হয়ে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগল সবুজ পৃথিবী। উরশিমার ফেলে আসা গ্রাম। নীল সাগরের ঢেউ তার কিনারে আছড়ে পড়ছে।

কিন্তু সব কেমন নতুন লাগে। যে পাথরটিতে বসে উরশিমা তার চাঁদের আলোর মত চিকণ জালের পরিচর্যা করতো সেটা সমুদ্রের কত কাছে চলে এসেছে! রাস্তাগুলোও কেমন বদলে গেছে। এই বাড়িগুলোই বা এখানে এল কোথা থেকে! উরশিমা ভাবে ভুল জায়গায় এসে পড়েছে নাকি! কিন্তু সমুদ্রের গন্ধ যে নির্ভুল বলে দিচ্ছে এ তারই গ্রাম।

- “আচ্ছা, উরশিমাদের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো আমায়? ওর বুড়ো বাপ, ওর মা – কেমন আছে তারা? আমায় সন্ধান দিতে পারো তাদের?”

সাগরপারে জটলা করা কিছু ছেলে উরশিমার প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকায়। দূরে এক শ্যাওলা ধরা পাথরের ওপর বসে ছিল এক বুড়োমত লোক। গোলমাল শুনে সে তার জীর্ণ হাতখানি তুলে উরশিমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।

- “তুমি কে হে বাপু? কোত্থেকে আসছ? এসব পুরোনো দিনের কথা জানলেই বা কেমন করে? শুনেছি বটে আমার বাপ-ঠাকুর্দার কাছে উরশিমা নামের এক জেলের কথা। সে নাকি সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে হারিয়ে গেছিল। তাকে আর কেউ কোনদিন দেখেনি। কিন্তু সে তো প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। এতদিন পর উরশিমার খোঁজ করছো, কে হে তুমি?”

তিনশো বছর! তিনশো বছর কেটে গেছে! উরশিমা ঘাড় নেড়ে বুড়োর কাছ থেকে চলে আসে। ঘুরে বেড়ায় তার পুরোনো গ্রামের পথে পথে। কিচ্ছুটি আর আগের মত নেই। একটা চেনা মানুষ নেই। চেনা বাড়ি নেই। তার ফেলে যাওয়া দেশটি সম্পূর্ন বদলে গেছে। শুধু সমুদ্রটা সেই আগের মতই সশব্দে আছড়ে পড়ছে পাথরের বুকে। দেখতে দেখতে দশটা দিন, দশটা রাত কেটে গেল। উরশিমা বসে আছে সাগরতীরে। হঠাৎ তার মনে পড়ল আকাশলীনার দেওয়া কৌটোটার কথা। আকাশলীনা কথা দিয়েছিল ওই কৌটো ছুঁয়ে তার কথা ভাবলেই সে চলে আসবে উরশিমার কাছে। আর তাহলেই তো আকাশলীনার সাথে উরশিমা আবার চলে যেতে পারবে মেঘের পারে। এই আত্মীয়-স্বজনহীন নির্বান্ধব দেশে আর থাকতে হবে না তাকে। আনন্দের চোটে উরশিমা ভুলেই গেল আকাশলীনা তাকে কৌটোটা খুলতে বারন করেছিল। সে তড়িঘড়ি হীরে-মানিক জড়ানো সেই মহামূল্যবান কৌটো খুলে বসলো। আর খোলা মাত্রই আকাশলীনার আবছায়া অবয়ব ধূপের ধোঁয়ার মত পাক খেতে খেতে মিশে গেল হাওয়ায় হাওয়ায়, মেঘে মেঘে।


উরশিমা বুঝল নিজের দোষেই সে চিরকালের মত হারালো আকাশলীনাকে। আর কোনদিন সে আকাশলীনার হাত ধরে মেঘের রাজ্যে হাঁটতে পারবে না, জেড পাথরের আভা মাখা সেই আকাশপারের দেশ তার কাছে আর নেমে আসবে না।

* * * * * * * * * * * * * * *

অনেক দিন কেটে গেছে। সাগরপারের ছেলে উরশিমা তার প্রিয় পাথরটিতে বসে তিনশো বছরের পুরোনো গ্রামটির কথা ভাবে। ছেলেবেলার কথা ভাবে। ঘোর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা ভাবে। একবার কেমন মাছের আকাল হয়েছিল আর তার জালে ধরা পড়েছিল এক পাঁচরঙা কাছিম – সেই কথা ভাবে। মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত মায়াবী আলোয় আকাশ ভরে যায়। নীলচে ধূসর মেঘের ফাঁক দিয়ে এক ফালি আলো এসে উরশিমার কপাল ছোঁয়। ঝোড়ো সমুদ্রও সেই আলো পেয়ে জেড পাথরের মত সবজে আভায় মসৃণ হয়ে ওঠে। উরশিমা বুঝতে পারে মেঘের ওপার থেকে আকাশলীনার তাকে মনে পড়েছে। সে গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠে। সবজেটে সমুদ্র শোঁ শোঁ শব্দে সঙ্গত করতে থাকে তার সাথে।

Sunday, August 29, 2010

নিষাদ

আমার এই একটি মাত্র গলি
সপাট ওষ্ঠাঘাতে
বাঁশিওলা, তুমি ডেকে যাও
আমি সেই পথে চলি।

আমার এই একটি মাত্র সুর
অলীক নিষাদ রাতে
উদাসীন, করো ছেলেখেলা
জেগে থাকি, ক্ষণভঙ্গুর।

আমার এই একটি মাত্র ঘর
শিথিল বিস্মৃতিতে
আকিঞ্চন, আমি কড়া নাড়ি
পাশ ফেরো, বিলাসী ঈশ্বর!

Sunday, August 22, 2010

অবান্তর কথামালা - ৩

আমার খুব ইচ্ছে করছে কিছু লিখতে। কিন্তু আমার মনে কোন ভাবনা নেই – ব্লটিং পেপারের মত নিদাগ। কবিতা লিখব ভাবি। শব্দেরা দেখা দিয়েই পালিয়ে যায়। তাদের গাঁথা যায় না। ধরা যায় না। ইচ্ছে হয় চাবুকের মত গদ্য লিখি। আমার তূণে কোন অস্ত্র নেই। আমার খিড়কি দোরে দিন শেষের আলো তেরছা ভাবে বিছিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি অসহায়। চাকা বসে যাওয়া সৈনিকের মত। দিন বয়ে যায়। দিন বয়ে যায়। আমার লেখা হয় না। কতিপয় শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করি শুধু। সামনে আনি, পিছনে আনি। সাজাই গোছাই। পণ্ডশ্রম খালি। একটি লাইনও তার পূর্ণ রূপ নিয়ে আমার সামনে মুখোস খোলে না।

চাকা বসে যাওয়া সৈনিকের মহাভারতীয় উপমা হঠাৎ কেন মনে এল কে জানে! আমার ছোট থেকেই বীরপূজায় মন। মহাভারতেও আমি অর্জুনকেই ভালোবেসেছি। কর্ণের পরিণতি নিয়ে ভাবি নি কখনও। কর্ণকে প্রথম ভালো লেগেছিল পিটার ব্রুকের মহাভারত দেখে। কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতার ঘন কালো চোখ – এক বুক শূন্যতা নিয়ে সেই চোখ তাকিয়েছিল – কিসের দিকে – শূন্যতার দিকেই বোধহয়। দেখার মত আর কিই বা ছিল! সেই চোখ দেখে প্রথম কর্ণের কথা ভাবলাম। পিটার ব্রুকের মহাভারতে আবহসঙ্গীত ভারী সুন্দর। শর্মিলা রায় পোমোর গাওয়া – “অন্তর মম বিকশিত কর, অন্তরতর হে”। আজ মনে হচ্ছে এই গান বোধহয় কর্ণের কথা, দ্রৌপদীর কথা, যুধিষ্ঠিরেরও কথা। কিন্তু অর্জুনের কথা কি? তার কি অন্তর নিয়ে বিশেষ মাথাব্যাথা ছিল? সে তো সারাজীবন ধরে নিয়মনিষ্ঠ সৈনিক, নিয়মনিষ্ঠ সন্তান, নিয়মনিষ্ঠ ভাই; এমন কি তার প্রেমও নিক্তিমাপা। বস্তুত তার চেয়ে দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মহাভারতে দ্বিতীয়টি নেই। পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, ভাইদের রক্ষা করা – এই তার জীবনের স্থির উদ্দেশ্য। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ – কিচ্ছুটি তাকে স্পর্শ করে না। এমনকি অনুশোচনাও নয়। সে যেন মানুষ নয়, যেন প্রোগ্রাম করা একটি অ্যান্ড্রয়েড।

যুধিষ্ঠির নিজেকে নিয়ে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। সে রাজা হতে চায় নি, তবু রাজা হওয়ার দায় তার। আচারে সে ক্ষত্রিয়, যদিও তার মনটি ব্রাহ্মণের, পড়ুয়ার। আবারও ঋণ পিটার ব্রুকের কাছে। ধর্মের সাথে কথোপকথনের দৃশ্যটি না দেখলে হয়ত যুধিষ্ঠিরের স্বরূপ এভাবে বুঝতাম না। সারাজীবন তাকে নিজের বুদ্ধি আর ভবিতব্যের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হল। এদিক দিয়ে সে কর্ণের সাথে তুলনীয়। “দেখিয়াছি শান্তিময় শূন্য পরিণাম” – দুজনেই দেখেছিল। আর দেখার পরেও তার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। তাই আড়াই হাজার (কি জানি মহাভারতের সঠিক বয়েস কত! এ নিয়ে তো অনেক দ্বিমত আছে) বছর পরের পাঠকের চিন্তায় তারা বারবার ফিরে আসে। “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় – আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত, ক্লান্ত করে”- যতবার উচ্চারণ করি এই দুটি লাইন, যুধিষ্ঠিরকে মনে পড়ে, মনে পড়ে কর্ণের শূন্য দৃষ্টি। কিন্তু অর্জুন? সে জন্ম থেকেই একটি বলিপ্রদত্ত পবিত্র পশু। মাংস, শুধু মাংসের জন্য বড় করা। ভরণ-পোষন, যত্ন-আত্তি, সোহাগ-আহ্লাদ – সব কিছুই শেষের দিনটির কথা মনে রেখে। আর সেও উৎসর্গ হওয়াতেই জীবনের চরম সিদ্ধি জেনে এসেছে। শুধুমাত্র অভিমন্যু বধের সন্ধ্যাটুকু ছাড়া আমরা অর্জুনকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখি না। একমাত্র ঐ খণ্ডমূহুর্তে তাকে মানুষ মনে হয়। বাকি জীবন ধরে সে ধর্মাচরণের মত যুদ্ধবৃত্তি করে গেছে। যদি বা কিছু সংশয় ক্কচিৎ কদাচিৎ ছায়া ফেলেছে মনে, তার প্রবল কর্তব্যবোধের সামনে তা খড়কুটোর মত ভেসে গেছে। মহাভারতের সব চেয়ে বড় বীর – সব চেয়ে তুচ্ছ বোড়ের মত জীবন তার। কর্ণ নয়, যুধিষ্ঠির নয়, দ্রৌপদী নয় – মহাভারতকার সব চেয়ে বড় ফাঁকিবাজিটা তার সাথেই খেলেছেন। অন্তরের মাঝে যে অন্তরতর – যার সন্ধান কর্ণ পেয়েছে তার হতাশা দিয়ে, যুধিষ্ঠির পেয়েছে বিপন্নতা দিয়ে, দ্রৌপদী পেয়েছে ক্রোধ দিয়ে, এমনকি ভীম, যে ভীমকে তামসিক মানুষ বলেই জানি, সেও তাঁকে ছুঁয়েছে তার প্রেম দিয়ে – সেই অন্তরতর-র আভাসটুকুও অর্জুনকে দিলেন না মহাভারতকার। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় বঞ্চনা আর কি হতে পারে!


পিটার ব্রুকের মহাভারতঃ
যুধিষ্ঠির ও ধর্মঃ http://www.youtube.com/watch?v=uiMpjoL5Yws&feature=related
অন্তর মম বিকশিত করঃ http://www.youtube.com/watch?v=JpaT14XddKk&feature=related
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রঃ http://www.youtube.com/watch?v=IGvpq6vV3lI&feature=related

Saturday, August 21, 2010

সত্যি-মিথ্যের গপ্পো

[অনুবাদ। গুগল বুকসে বই সার্চ করতে গিয়ে এই লোককথাটি পেলাম। ইংরিজি নাম "The Old Lady in the Cave" , তবে লোককথাটি কোন দেশের তার উল্লেখ ছিল না। ঈষৎ মেল-শভিনিজম আছে। কি আর করা যাবে। লোককথা এমনই হয়]

এক যে ছিল ছেলে। আর ছিল এক মেয়ে। গোলা ভরা ধান, দীঘি ভরা মাছ, অতিথ-স্বজন, ভজন-পূজন, সাত-মহলা বাড়ি – তাদের কিচ্ছুটি নেই অভাব। তবুও ছেলের বাউন্ডুলে স্বভাব। একলা বসে দীঘির পাড়ে আকাশ-পাতাল ভাবে। মনেতে নাই সুখ। দেখে মেয়ের ভয়েই কাঁপে বুক।

“আচ্ছা শুনি, ব্যাপারটা কি তোমার?”, শুধোয় মেয়ে, “সারাটা দিন আপন মনে অতই বা কি ভাবো? এমন বাড়ি, জমিদারী, লোকে মান্যি করে কত! কোথায় তোমার মন? মুখের কাছে খাবার ধরি – মাছের মুড়ো, মন্ডা-মেঠাই, গব্য ঘৃতে তপ্ত ভাজা লুচি। কিচ্ছুতে নেই রুচি! মেজাজ যেন লাট সাহেবের নাতি! গা জ্বলে যায় দেখলে এমন উলটপানা বাতিক!”

“একটি কথাই ঘুরে ফিরে আসে আমার মনে।”, বললে ছেলে, “‘সত্য’ কোথায় থাকে? তার মুখের কেমন আদল? কোন দেশেতে বসত বারোমাস? কেমন ধরন, কেমন চলন, কেমন বেশবাস? জানতে বড় সাধ হয় রে মেয়ে! কে জানে কোথায় লুকিয়ে আছে পথের বাঁকে! অথবা কোন দীঘির মায়ায়, স্তব্ধ নিবিড় হিজল ছায়ায় পাতার ফাঁকে! ছুঁতে গেলেই হারিয়ে যায় শিশিরফোঁটা! তার খোঁজেতেই আমার ছোটা।”

“মরনরোগে ধরছে তোমায় ছোঁড়া! খণ্ডাবে কে লিখন তোমার পথে পথেই ঘোরা! তবে যাওয়ার আগে হিসেব-নিকেশ চোকাও ষোলোআনা। টাকা-কড়ি, গয়না-গাঁটি, জমির মালিকানা – প্রাপ্য বুঝে নেবো। তারপরেতে যাও যেখানে খুশী। খোঁজ নেবো না মোটে। কপাল আমার! এমন মানুষ আমার ঘরেই জোটে!”

যেমন কথা, সেইমত কাজ। তালুক-তুলুক, মালুক-মুলুক – যা কিছু তার ছিল, লিখে দিয়ে মেয়ের নামে, ছেলে বেরোয় পথের টানে। কুয়াশালীন পাহাড়ি পথ, তরুণ উপত্যকা, আলো-ছায়ার মায়াবী দিন, রামধনুতে ঢাকা – পেরিয়ে গেল। তারপরেতে মস্ত শহর, ব্যাস্ত সবাই ভারী, ঝলমলানো আলোর মালা, আকাশ-ছোঁয়া বাড়ি – দেখলো তাও। তবুও ছেলে সত্য পায় না খুঁজে। পথ দেখাল সাঁঝের পিদিম, সবুজ মোড়া মখমলী গ্রাম, ছোট্ট নদী খামখেয়ালী, বেগুনী ফুল অচেনা নাম – যেইখানে যায় – সবজেটে-নীল বনের ধারে, ঝিনুক-ছেঁচা সাগরপারে, জোছনাহীন অন্ধকারে ঢেউ আছড়ায় খরস্রোতা – কোত্থাও নেই, যার খোঁজেতে এতটা পথ, সেই মেয়েটা কোত্থাও নেই!

দিনের পর দিন কাটে। মাসের পর মাস। পথের পর পথ বয়ে যায়। ছেলের মলিন বেশবাস। এইভাবেতে অনেক দিনের, অনেক পথের শেষে, সন্ধ্যা যখন তারার আলোয় মেশে, ক্লান্ত ছেলে থামল এসে পাহাড়চুড়োয়। একলা সে দেশ নিথর কালো আকাশ ছোঁয়া। পাথর ঘেরা অপরিসর ছোট্ট গুহা। সেই গুহাতে বাস করে এক বুড়ি। ফোকলা বুড়ি, একখানি দাঁত মোটে। শনের নুড়ি চুলের গুছি পিঠ ছাপানো, জোলো হাওয়ায় উড়ছে এলোমেলো। হাড় ক’খানি চামড়া দিয়ে ঢাকা, তীক্ষ্ণ সে মুখ – ছেলে দেখতে পেল। কে এই বুড়ি! কুদর্শনা, দৃষ্টি কেমনতর! ভাবছে ছেলে। এমন সময় বাড়িয়ে হাত, শীর্ণ আঙুল, হলদেটে নখ দীর্ঘ অতি – বুড়ি তাকে ডাকছে ইশারাতে। ছেলেও তখন বেভুল কেমন, চলছে বুড়ির পিছু পিছু, গুহার পথে। আনমুনি গান গাইছে বুড়ি, অবাক সে সুর, শোনেনি কেউ কোথাও। বলছে কথা ছেলের সাথে, গলার আওয়াজ নদীর স্বরের মত, নিখাদ নিটোল, জগতে যা কিছু খাঁটি, বুড়ির গলায় পড়ছে ঝরে, অটুট পরিপাটি। একেই খুঁজতে আসা – বুঝল ছেলে। পাহাড়-নদী-অরন্যপথ, অথই সাগর, নীল জনপদ – অনেক ঘোরার পরে, এবার পেলাম দেখা। ‘সত্য’ বলেই চিনছি তাকে। নিখুঁত স্বরলেখা।

ছেলে ক’দিন সেইখানেতেই থাকে। প্রশ্ন যত জমাট ছিল মনে, চলা-ফেরায় আনা-গোনায় একলা ঘরের কোণে, শুধোয় তাকে। সত্য-বুড়ি যত্ন করে বোঝায়। ছেলের মনে পোষ মেনেছে ঝড়, শুনে কাঁচের মত স্বচ্ছতোয়া, অপূর্ব সে স্বর। দিন কেটে যায়, মাস কেটে যায়। বছর ঘোরার পরে, ভাবছে ছেলে, এবার বাড়ি টানে, ফিরব দেশে। বিদায় নিতে বুড়ির কাছে আসে।

“অনেক কিছু শিখেছি তোমার কাছে”, বলছে ছেলে, “এবার ঘরে ফেরা। ফেরার আগে আমায় বল বুড়ি, যদি কোন ইচ্ছে থাকে তোমার, যদি কোন কাজে লাগতে পারি?”

ফোকলা বুড়ি ঘাড় বেঁকিয়ে ভাবে। প্রাচীন নখের ইশারাতে আবার তাকে ডাকে। “শোনো হে ছেলে, ফিরবে যবে ঘরে, বলবে যখন আমার কথা বন্ধু-স্বজনেরে, সেসব কথা কেমন হবে বুঝতে ভালোই পারি। আমার কেমন মুখের গড়ন, চামড়া কোমল কিনা, হাসলে পরে মুক্তো ঝরে নাকি, এসব নিয়ে চলবে বাড়াবাড়ি। দোহাই ছেলে, এই কথাটি রেখো”, সত্য-বুড়ি কাতর হেসে বলে, তীক্ষ্ণ চোখে আবেশ জড়ায় ভারী, জানায় মনের ইচ্ছে গভীর গোপন, “বোলো তাদের, সত্য হল চিকন, সুদর্শনা লাবণ্যময় যুবতী এক নারী।”

Sunday, August 15, 2010

সাত বুড়োর দেশ

আজ পনেরোই অগাস্ট। যদিও আমার কোন দায় নেই স্বাধীনতা দিবসের দিন ডায়েরী লিখতে বসার, তবু আজ রবিবার, হাতে কিছু উদ্বৃত্ত সময়, তাই কাটলাম নাহয় কিছু আঁকিবুকি। নাহ, আজ সারাদিনে একবারও ‘জনগনমন’ বা ‘বন্দেমাতরম’ শুনি নি। বরং দিন কেটেছে ষাট দশকের স্বাধীনতায় উন্নয়নের অগ্রগতির কিছু পরিসংখ্যান দেখে। তাতে মন বিক্ষিপ্তই হয়েছে বেশী। তবু দিনের শেষে আমার খিড়কি দোরের সিঁড়িটিতে বসতেই নাকে ভেসে এল বাপুজী কেকের গন্ধ। প্রভাতফেরী, পতাকা উত্তোলন, ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ আর ফেরার পথে একটি কাগজের বাক্সে গোটা দুই দানাদার, একখানি বাপুজী কেক – এই তো আমার স্বাধীনতা দিবস! যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, পনেরোই অগাস্টের দুপুর বেলায় ডিডি টু-তে দিল তামিল ছবি ‘রোজা’। ‘রোজা’র হিন্দী ভার্সান তখন রমরম করে চলছে। কিন্তু আমাদের ঘোরতর রাবীন্দ্রিক বাড়িতে হিন্দী মানেই অপসংস্কৃতি। দেশপ্রেমের ছুতোয় সেবারের পনেরোই অগাস্টে আমার অপসংস্কৃতিতে হাতেখড়ি হয়ে গেল। খোলা আকাশের নিচে মধু গাইছে – ‘ইয়ে হাসিন ওয়াদিয়া, ইয়ে খুলা আসমান’ – আহ, সে কি মুক্তি! রাবীন্দ্রিক রক্ষণশীলতা থেকে মুক্তি, নব্বই দশকের হিন্দী সিনেমার স্থবিরতা থেকে মুক্তি, সুরের মুক্তি! এরই কি নাম স্বাধীনতা?

স্বাধীন অবশ্য হলাম তার পরের বছরেই। সেই যে পনেরো বছর বয়েসে বাড়ি ছেড়ে বেরোলাম, আর তো ফেরা হল না। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লী, অ্যামেরিকা – যে বয়সে বাড়ি ছেড়েছি আরো ততগুলি বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আর দেশ বলতে কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক বৈচিত্র, কিছু বিশেষ মুখের সারি মনে ভাসে না। পাসপোর্টে যে দেশের ছাপ আছে, সেই ভূখন্ড তো দেশ বটেই; কিন্তু ঠিক ততটুকুতেই সে সীমাবদ্ধ নয়। যেখানে জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে, আমার সেই মফস্বল, সেই রেললাইন, কচুরীপানায় ঢাকা সেই সবুজ পুকুর – মনের ভেতরে ছবিটা এখনও অক্ষুণ্ণই আছে। আমার এই সিঁড়িতে বসেই দিব্যি দেখতে পাই পঞ্চাননতলার শিব-মন্দিরে ফাটল ধরেছে, বৈদ্যবাটী খালের সবুজ জলে ছায়া ঘনাল, চারুশীলা বসু বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে উদাসীন প্রেমিকদের সাইকেল বিলাস। দেখতে পাই সন্ধ্যা নামছে আমার মুখচোরা মফস্বলে। শেওড়াফুলি হাটের কাছে তেলেভাজা আর ঘাম মেশানো ঝাঁঝালো গন্ধ। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে কাঁসরের আওয়াজ। স্টেশনের কাছে নিষিদ্ধ পল্লিতে কূপী হাতে দাঁড়ানো কিছু কালো মেয়ে। এদের সকলকে নিয়ে আমার প্রথম পনেরোটা বছর। গরমের সন্ধ্যায় গা ধোয়ার পর প্রতিটি বাড়ি থেকে কেমন একটা ঠান্ডা আমেজ ছড়ায়, বেলফুলের গন্ধ ভেসে আসে, রিকশাওয়ালা জোরে হর্ণ বাজায় অফিস-ফেরত সওয়ারী নিয়ে, আর তারই মধ্যে ঝপাং করে লোডশেডিং হয়। আকাশের লুকিয়ে থাকা তারাগুলি জেগে ওঠে। সাতটি বুড়ো, মনে যাদের অনন্ত জিজ্ঞাসা, যাদের প্রথম দুজনকে অনুসরণ করলেই ধ্রুবতারাটির খোঁজ পাওয়া যায়, সেই পনেরো বছর থেকেই তাঁরা আছেন আমার সাথে। তাই দেশকে ছাড়লেও দেশ আমায় কখনও ছাড়ে না।

লেডি ব্রাবোর্নের হোস্টেলে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমি আমার একটেরে ঘরটির জানলা দিয়ে সাত বুড়োকে দেখতে পাই। ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপে ভারত একটার পর একটা উইকেট খোয়ায়, ডাইনিং রুমের টিভি বন্ধ করে আমরা মেয়ের দল হোস্টেলের মাঠে খোলা আকাশের নিচে বিষন্ন পায়চারী করি। তখন কত অল্পেতেই কত দুঃখ! তারপর টুয়েলভের ফেয়ারওয়েলের দিন গভীর রাতে অমৃতাদি গাইলো – ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু, পালাতে চাই, তবু সে আসে আমার পিছু পিছু’ – আমি শিউরে উঠে বুঝলাম অজান্তেই কখন কলকাতা ‘আমার শহর’ হয়ে উঠেছে। আমি আর শুধু বৈদ্যবাটির মেয়ে নই। কলকাতা মিশেছে আমার মধ্যে। হাজরা মোড়ে বাসের অপেক্ষা, কলেজ স্ট্রীটে পুরোনো বই ঘাঁটা, রবীন্দ্রসদনের আড্ডা, বৃষ্টিভেজা রেড রোড – সব যেন আমার সিগারেট ঠোঁটে চাপা নিরুত্তাপ প্রেমিক, নির্নিমেষ চেয়ে আছে আমার দিকে, ভাবটা এই – যাবি কোথায় আমায় ছেড়ে!

কিন্তু তার অখণ্ড অধিকারকে উপেক্ষা করেই একদিন চলে গেলাম মুম্বই। সেই প্রথম বাংলার বাইরে। জায়গাটা ভারতের ম্যাপের মধ্যে থাকলে কি হবে, এ আমার দেশ নয় – এমনটাই মনে হয়েছিল প্রথমে। অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি, অন্য খাদ্যাভ্যাস – এ তো কিছুতেই আমার হতে পারে না! রোজ নিয়ম করে ফোন যেত বাংলা দেশে, রাত এগারোটার পর যখন এস টি ডির চার্জ এক তৃতীয়াংশ হত। পড়াশোনা শেষ হলেই বাড়ি ফেরা – এমনটাই জানতাম। এর মধ্যে একদিন গেলাম মাথেরনে। আহ! সে কি বৃষ্টি! পশ্চিমঘাট সবুজে সবুজ। পায়ের তলায় মাটি গলে যাচ্ছে। ওরই মধ্যে চুপ্পুর ভিজে আমরা পাহাড়ের মাথায় চড়ার চেষ্টা করছি। জোরে জোরে আবৃত্তি করছি – ‘শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো? আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ, টক টক থাকে নাকো হ’লে পরে বিষ্টি, তখন দেখেছি চেখে একেবারে মিষ্টি’ – মনে ভাসেন সুকুমার রায় আর সেই তুমুল বৃষ্টিতে আপ্রাণ বোঝার চেষ্টা আকাশটা সত্যিই তাল-মিছরির পানা হয়ে ঝরছে কি না! এবং আবারও বড় বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার, পৃথিবীর শ্রেষ্ট বৃষ্টি বাংলা দেশে নয়, এই পশ্চিমঘাটেই হয়। তখনও কি একে নিজের দেশ নয় ভেবে দূরে রাখতে পারি! বিশেষ করে সেই সাত বুড়ো যখন সেখানেও সঙ্গী আছেন, শেষ রাতে পাওয়াই লেকের ধারে একাকী পদচারনায়!

তাঁরা আমার সাথেই দিল্লী এলেন। রাজধানী শহর। অন্ধকারেরও শহর। সে আমার মনের অন্ধকার, না শহরটির অন্ধকার – তা জানি না। সেই শহরেই প্রথম অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আবার সেই শহরেই জীবনযাপনের অনিবার্য পরাধীনতাগুলোর সাথে প্রথম পরিচয়। নিজেকে বদলানো, সভ্যতার খাতিরে, কর্পোরেট জীবনের খাতিরে। এককাপ কফির জন্য পঞ্চাশটাকা দাম দিয়েও মুখের পেশী একফোঁটাও বিকৃত না করার আভিজাত্যের শিক্ষা এই শহরেই প্রথম হল। এই শহরেই প্রথম দেখলাম মানুষ কি ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করছে তার প্রেক্ষিতেই কেমন সহজ হিসেবে তার সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা যায়। অনেকরাত হত বাড়ি ফিরতে। একদিন দেড়টা ছাড়িয়ে গেল। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখি আমার রক্ষণশীল পাঞ্জাবী বাড়িওয়ালী উদ্বিগ্ন মুখে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আঙ্কেল ঘর-বার করছেন। আমাকে দেখে তাঁদের যে স্বস্তির নিশ্বাসটা পড়ল, সেই একটা নিমেষে এই শহরটাও কেমন নিজের হয়ে গেল। তারপরেও কমলানগর মার্কেটে সুযোগসন্ধানীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়েছে, তারপরেও অটোওয়ালা ঠকিয়েছে, তারপরেও এই শহর তার স্থূলতা প্রকট করেছে বারবার, কিন্তু সেই সাত বুড়োকে আবার আমি দেখতে পাচ্ছিলাম নিয়মিত, আমার চিলেকোঠার বারান্দা থেকে।

তারপরেতে সাত-সমুদ্দুর, তেরো নদীর পার, খুকু এবার সত্যি করেই দেশের হল বার! আবারও যথারীতি ভেবেছি, এই তো, বছর দুয়েক থাকবো মোটে, তারপরেতেই পড়া হবে শেষ, ফিরবো নিজের দেশ। যেমনটা ভেবেছিলাম মুম্বইতে, যেমনটা দিল্লীতে, ঠিক তেমনটাই অবিকল। শুধু এবারে দেশের ধারনাটা অন্যরকম। কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় বাড়ি বলতে বুঝতাম বৈদ্যবাটি। মুম্বই-দিল্লীতে থাকাকালীন দেশ মানে কলকাতা, তখন আর বৈদ্যবাটি ফেরার কথা ভাবি না। আর পৃথিবীর অপর পিঠে বসে দেশকে ভাবলে গোটা ভারতকেই দেখতে পাই। ভারত যেন একটা ট্রেন। সেকেন্ড ক্লাস স্লীপারের কামরা। বেশ নোংরা, চিনে বাদামের খোলা ছড়িয়ে আছে মেঝেতে, এক বিকলাঙ্গ নুলো ছেলে ঝাঁট দিচ্ছে। পয়সা চাইছে জনে জনে। কেউ আধুলী ছুঁড়ে দেয়, কেউ উদাসীন – না দেখার ভান করে তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। বাইরে প্রচন্ড গরম, লু আসছে জানলা দিয়ে। মানুষের কিন্তু তাপ-উত্তাপ নেই। ওরই মধ্যে পুরী-সবজী চলছে, তাস চলছে, জমি-বাড়ি-প্রপার্টি চলছে, ভিখিরির ইনিয়ে-বিনিয়ে গান চলছে, এফ-এমে বলিউডি লাস্য চলছে। আর মাঝে মাঝে এসবের থেকে চোখ সরানোর অবকাশ মিললে দেখা যাচ্ছে চলার দুই পাশে সঙ্গী আছে হলুদ-সবুজ ধানক্ষেত, তিরতিরে রূপোলী নদী, ইউক্যালিপটাসের বন, গোধূলীর অস্তবেলায় জন্ম নেওয়া একফালি শীর্ণ চাঁদ। এবং আবারও সেই সাত বুড়ো। যারা এই ভিনদেশে এসেও আমার সঙ্গ ছাড়ে নি। প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে ওঠার পর দেখেছি এদেশের মানুষও গ্রহন করছেন দেশীয় সহজতায়। গত শীতে ভারতে হপ্তাতিনেক কাটিয়ে এদেশে ফিরছি। শিকাগোতে যখন নামলাম তখন তাপমাত্রা মাইনাস তিরিশ। শাটল বাসে করে ব্লুমিংটনের পথে। দেখি সাদা বালির মত মিহি তুষারকণায় শেষ সূর্যের লাল আভা গলে পড়ছে। আহ! শীত তো এমনই হওয়া উচিত। এমন সাদা, এমন প্রশান্ত, এমন আত্মভোলা। হঠাৎ খেয়াল হল বাড়ির জন্য মন কেমন একেবারেই নেই। মরমে মরে গেলাম। আমি কি দ্বিচারিনী! সন্ধ্যা নামে। টালমাটাল মন নিয়ে বাইরে তাকাই। তারাভরা আকাশে সাত জিজ্ঞাসু সেই একই রকম অনন্ত প্রশ্নের খোঁজে বিভোর। ‘যে নাহং নামৃতাস্যাং, কি মহং তেন কুর্যাং’? যে অমৃতের সন্ধান শুরু হয়েছিল পশ্চিম বাংলার একটি মফস্বলে তাকে এখানেও অব্যাহত দেখতে পাই। ভিনদেশের আকাশও এই ভাবেই নিজের আকাশ হয়ে ওঠে। বৈদ্যবাটির সূর্যাস্ত আর ব্লুমিংটনের সূর্যাস্তে বিশেষ তফাৎ খুঁজে পাই না। খুব সাধ হয় একবার দক্ষিণ গোলার্ধে যাই। শুনেছি সেখানে আকাশ অন্যরকম। একবার যদি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারি, যদি একবার সেই আকাশকেও নিজের মনে গেঁথে নিতে পারি, যদি পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত হতে উপরের দিকে চাইলেই সবকটি তারা আমার দিকে চেয়ে হাসে, সেদিন কি পরিক্রমা শেষ হয়? সেদিন কি আসে স্বাধীনতা?

Friday, August 13, 2010

আবার বৃষ্টি...

আচ্ছা বলো, আছেটা কি বৃষ্টি ছাড়া?
গুমোট ছিল অভিমানী মেঘলা দুপুর
সারা বিকেল গান শুনেছি মনখারাপী
ঘুম ভাঙালো পাল্লা ভাঙা দমকা হাওয়া

তুমিই বলো, ঠেকাই তাকে সাধ্যটা কি?
তারপরেতেই ধুলোয় ভরে সমস্ত ঘর
উঠোন জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় পাগল ছেলে
বর্শা ফলায় গাঁথছে আমায় শিকার-পটু
বলো আমায়, কিই বা থাকে বৃষ্টি ছাড়া?

Thursday, August 12, 2010

অবান্তর কথামালা - ২

পথে শব্দ গড়ায়
আমি ছন্দে গাঁথি
ঝরে বিষাদ কণা
আমি আঁজলা পাতি

যত জমাট বিষাদ
চাপা রক্তক্ষরণ
আমি লাগাই পালিশ
করি স্ট্রীট-স্মার্টায়ন

কিছু পালিশ চটক
আর আলগা বাহার
আমি সন্ধ্যা গানে
সঁপি কথার পাহাড়

জানি গানের পারে
তুমি দাঁড়িয়ে আছো
ওহে আলোর পোকা
তুমি সুরেই বাঁচো

আমি সুর অচেতন
করি শব্দ জড়ো
ভিতু গায়ন-বিমুখ
শুধু অঙ্কে দড়


[মারাত্মক শ্রীজাত প্রভাব]

Wednesday, August 11, 2010

অবান্তর কথামালা - ১

পাকিস্তানে বন্যায় দেড় কোটি লোক ঘর ছাড়া। চীনে প্রবল বৃষ্টিতে ল্যান্ড স্লাইড। কম করে হাজার মানুষ মারা গেছে। তিন দিন আগে লেহ-তে ক্লাউড বার্স্ট হয়ে চারখানা গ্রাম ভেসে গেল। আর আমি কাল বৃষ্টি নিয়ে পদ্য লিখেছি। আজকাল কিছুতেই কিছু এসে যায় না। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলেও বোধহয় একবার উঁকি দিয়ে কৌতুহল নিভিয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখতে পারি। আজকাল কোন খবরেই বিচলিত হই না। কাকার স্ট্রোক। বেশ। দিদা মরে গেল। বেশ। ছোটবেলার খেলার সাথী উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়াচ্ছে। বেশ। প্রেমে লাথি খেয়ে পাড়ার মেয়েটার নার্ভাস ব্রেকডাউন। বেশ। ক্লাস এইটের ছেলেকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। বেশ। সবই বেশ। কফি খেতে খেতে, প্রসাধনী মাখতে মাখতে মুচমুচে খবর। পদ্মপাতায় জল। দু’মিনিটের জন্য টলমল করে। তারপরেই কোথায় গড়িয়ে যায় – খোঁজ রাখি না। কিচ্ছুটি ছাপ ফেলে না। কিচ্ছুটি না। এসব নিয়ে লিখতেও আমার ঘেন্না করে। নিজেকে চুড়ান্ত অসৎ মনে হয়। এর চেয়ে ‘আমি-তুমি-তুমি-আমি’ প্রেমের পদ্য লেখা ভালো। সেখানেও অসৎ। তবু এতখানি লজ্জায় ফেলে না সেটা। আর মনটাও ভারী ফুরফুরে হয়। দিব্যি ফানুস হয়ে ভেসে বেড়ায়। মাটির টান থাকে না। কোন দায় থাকে না। এক ফোঁটাও আওয়াজ পৌঁছয় না। বেশ মনোরম এই আকাশ-বিহার।

Tuesday, August 10, 2010

বৃষ্টি, সুমন, কাঙাল, প্রথমশহর ও কিছু গেঁজে যাওয়া নস্টালজিয়া

বৃষ্টি আমার পুরোনো রোগ, নতুন কথা কি আর লিখি?
তাই বা কেন, এ পাতাও তো রোমন্থনের প্রাত্যহিকি!
আজকে কেমন সকাল থেকেই মেঘ করেছে আকাশজুড়ে
আঁকড়ে বালিশ, পদ্য লিখি, পি-পু-ফি-শু হদ্দ কুঁড়ে।
এমন দিনে সুমন গানে আসছে মনে প্রথম শহর –
প্রথম সাঁতার, প্রথম চেনার, প্রথম ডোবার তীক্ষ্ণ প্রহর!
প্রথম রাগের, পরাজয়ের, বিপন্নতার প্রথম রেখা,
নিরুদ্দেশে প্রথম সফর, প্রথম বারের আয়না দেখা!
আরো অনেক প্রথম আমার দাঁড়িয়ে আছে পথের বাঁকে –
অপেক্ষাতে জমছে আষাঢ়, নিকোটিনে, ক্লাসের ফাঁকে।
সুমন শেখান নিমেষ ছোঁয়ার বাউন্ডুলে কাঙালপনা
অকাল মেঘে ভাসুক শহর, শিরায় নাচুক বৃষ্টিকণা!

Saturday, August 7, 2010

আমার আসলে কোন ফেরা নেই


আমার আসলে কোন ফেরা নেই।
জানি এ শীতের রাতে
জ়েগে আছে আমার শহর -
চাঁদে পাওয়া ঘুসঘুসে বুড়ি,
একলাটি রেলপথ,
মথুরা নগর ছাড়া বহুদিন,
জড়ো করে কানা ভাঙা চকমকি নুড়ি।

আমার যদিও কোন ফেরা নেই।
আমার মায়াবী বাড়ি -
আহা, সে শীতের রাত!
বসেছিল আগুনের বড় কাছাকাছি,
গোল গোল ধোঁয়া ওঠা,
মোলায়েম রুশ দেশী রুটি -
বুড়ো মেঘ, আমিও তো দিন আনি দিন খাই বাঁচি!

আমার অবশ্য কোন ফেরা নেই।
আমার রূপসী সিঁড়ি,
খুঁটে বাঁধা চেকনাই ঘোড়া,
ছাইচাপা জোছনাতে এবারেও চাঁদ ডাকে, আয় –
আমি তো বাধ্য মেয়ে,
কথা মত ছায়াপথ হাঁটি -
আমার সমস্ত পথ, যথারীতি, তোমার কাছেই যায়!

The Crows

আমি খুব লেট লার্নার। বাঙালী হবু আঁতেলরা যা সতেরো থেকে একুশের মধ্যে করে ফেলে আমি তা তিরিশে করি। আমি এখন কুরোসাওয়ার ‘ড্রিমস’ ছবিটি দেখছি। এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আমাকে এখনই লিখতে হল। কারন পাঁচ নম্বর ছবিটা – ‘দ্য ক্রো’স’ নিয়ে আমি ব্লগ লিখেছিলাম এপ্রিল মাসে। তখন অবশ্য জানতাম না ভ্যান ঘঘের এই ছবিটা – ‘Wheatfield with Crows’ নিয়ে কুরোসাওয়াও ছবি করেছেন। আগেই বলেছি – আমি নেহাতই মূর্খ। আমি ছবিটা প্রথম দেখি ইন্টারনেটে। আসলটা আছে অ্যামস্টারডামে। লোকে ভাবতে ভালোবাসে এই ছবিটা আঁকার পরই ভ্যান ঘঘ আত্মহত্যা করেন, যদিও সেটা সত্যি নয়।

ছবিটা এমন ভাবে ডাকত... শেষ পর্যন্ত একটা প্রিন্ট কিনে এনে নিজের ঘরের দেওয়ালেই লাগিয়ে দিলাম। কতবার এই ছবির দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থেকেছি! আজ জানলাম কুরোসাওয়ার স্বপ্নেও আসত এই ছবি। একটি লোক গ্যালারীতে বসে ছিল। তারপর সে ছবির মধ্যে ঢুকে গেল। যে ছবিটা দিয়ে ঢুকল সেটা আমার চেনা নয় – একটি ব্রিজের নিচে কিছু মেয়ে কাপড় কাচছে – পরে নাম খুঁজে পেলে লিখে দেব। ছবির রাস্তায় লোকটা ভ্যান ঘঘকে দেখতে পায়। কিন্তু সেই পাগলের সাথে পাল্লা দিয়ে পথ চলা কি সাধারণ মানুষের কাজ! যথারীতি হারিয়ে ফেলে তাকে। তারপর এ ছবি, ও ছবি – অনেক ছবি ঘুরে সে আসে এই পাগলাটে হলুদ গমক্ষেতে। ভিনসেন্ট সেখানে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন দিগন্তের দিকে। তারপরই চারদিক থেকে অসংখ্য কাক এসে সব কিছু ঢেকে দিতে থাকে। আমি কখনও বুঝতে পারি না কাকগুলো কোন দিকে আসছে – আমার দিকে, নাকি ভিনসেন্ট যেদিকে গেলেন সেই দিকে! এবারেও বুঝতে পারলাম না। বারবার দেখলাম। ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে, স্ক্রিন ফ্রিজ করে। কিন্তু কাকগুলো কেন এসেছে, কি চায়, কোনদিকে উড়ছে তা এবারেও বুঝতে পারলাম না! অথচ জানি, আমি আবারও তাকিয়ে থাকব ছবিটার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কাকেরা কোথায় যেতে চায় না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।

Wednesday, August 4, 2010

নেই মানুষ

আচ্ছা ধরা যাক, আমি নেই। ‘নেই’ মানে ‘নেই’ নয়। দিব্যি আছি। ভূত-টুত কিছু হই নি। খালি একটু বদলে গেছি। বলা যেতে পারে ‘নেই মানুষ’ হয়ে গেছি। হেই মানুষের জায়গায় নেই মানুষ। কালো-কোলো আধমনি চেহারার জায়গায় একটা মিষ্টি মত সবজ়ে ছায়া হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি যে দিকে মন চায়। এই ইচ্ছে হল, রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া পপি’স চিকেনের ফ্লায়ারটার সাথে এক পাক নেচে নিলাম। পরের মূহুর্তেই চড়ে বসেছি সিলভার ম্যাপেলের মগডালে। শ্রীমান কাকেশ্বরের পাশটিতে বসে গম্ভীর গলায় বলছি – ক্কঃ! আর সে ব্যাটা চমকে চিৎপাত। একরাশ হাওয়া দিল। ফুরফুরে চেরি ব্লসমের সাথে জড়িয়ে-মরিয়ে আমি সটান মাটিতে। ঘাসের বুকে শুয়ে মজাসে দেয়ালা করছি। একটা মভ রঙের ফ্রক পরা ঘোঁতন মত মেয়ে উদোল-বুদোল পায়ে আঁকাবাঁকা হাঁটতে হাঁটতে থুপুস করে পড়ল আমার ওপর। আর অমনি আমি ওর প্রজাপতি ক্লিপে আটকে গেলাম। তারপর আর কিছুতেই বেরোতে পারি না। আমাকে তো বসিয়ে দিয়েছে গাড়ীর পিছনে কার সিটে। আমিও চলেছি ওর সাথে সাথে আকাশ দেখতে দেখতে, বাতাস দেখতে দেখতে, সবুজ দেখতে দেখতে – রোদ্দুরের সাথে ছুটতে ছুটতে। একটিবারের জন্য রেস্ট এরিয়ায় দাঁড়িয়েছে গাড়ি। আর আমিও সেই সুযোগে ধাঁ! এক লাফে আকাশে উঠে গিয়ে এক টুকরো ছায়া হয়ে রোদ্দুরের বুকে লেগে রইলাম।

ওমা! শুনি লোকজনে বলাবলি করছে – কি আপদ! মেঘটাকে এখনই আসতে হল! কার্নিভালটা মাটি না হলে বাঁচি! কার্নিভাল? কোথায় কার্নিভাল? আমি কার্নিভাল দেখব! তরতর করে নেমে আসি আবার। নাগরদোলায় একটি পাক খেয়ে মাটি ছুঁই। দেখি একশো লোকের ভীড় জমেছে। মুখোস এসেছে আফ্রিকা থেকে। ইটালী থেকে ঘন বুনোটের ট্যাপেস্ট্রি। মরক্কোর চামড়ার ব্যাগ। জাপানী জলরং। অ্যাজটেক পুঁতির গয়না। সরগরম ব্যাপার একেবারে! আমি তক্কে তক্কে লেগে রইলাম এক ছবিওলার গায়ে আঠার মত। ভারী ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে সে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা ঘুরে বেড়ায় আর ছবি তোলে। কখনও সে চলে যায় জর্ডনে – শেষ সূর্যের আলো যখন পেট্রাকে গোলাপী আভায় মুড়ে দেয় তার চোখে পলক পড়ে না। চাঁদনী রাতে রাওয়ান্ডার জঙ্গলে বসে সে নীলনদের জন্মকথা শোনে। ইস্টার দ্বীপে পাহাড় সমান মানুষের মুখগুলোর নীচে দাঁড়িয়ে একমুঠি ধুলো ভরে নেয় তার চামড়ার পাউচে। রঙ-বেরঙের পাথর ছড়ানো কাসিদের বেলাভূমিতে আনমনা হাঁটে। ভারী কাজের মানুষ। এবারে যাবে দক্ষিণ আমেরিকায়। আমিও ওর সাথে ভেসে ভেসে চলি লিমা, লিমা থেকে কুজকো, কুজকো থেকে ইনকা ট্রেল ধরে হাঁটতে থাকি মাচুপিচুর দিকে। সারাদিন হাঁটি। সন্ধ্যে হলে তাঁবু খাটিয়ে জিরিয়ে নিই। অল্প অল্প চাঁদের আলো আর কুয়াশা মাখা আন্দিজ একরাশ রূপকথা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন আমরা আকাশে পৌঁছোই। মাচুপিচুর সবুজ শিখর ধূসর নীল মেঘে ডুবে আছে। ওই ম্লান মেঘ আমায় ডাকে। আমি আমার ছবিওলার ঝোলা থেকে বেরিয়ে সেই বিষাদে মিশে যাই।

বাংলা দেশে তখনও আলো ফোটে নি। গুমোট রাতের শেষে আমি আকাশ ভরা কেদার হয়ে বাজতে থাকি। পায়ের তলায় পুরোনো শহর। আমার ফেলে আসা সব কিছু। কিছুটা চেনা, কিছুটা অচেনা। আমি অবিশ্রাম বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকি আমার আধোচেনা অতীতে। মা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে বেরোতে গিয়ে দেখে থই থই করছে জল। সাবধানে শাড়ী বাঁচিয়ে রেললাইনের ধার দিয়ে হাঁটে মা। আমি মায়ের শাড়ীর আঁচলে লেগে থাকি। মায়ের পিঠে ছিটে ছিটে জলের কণা হয়ে জড়িয়ে থাকি মা-কে। ভিজে মাটির গন্ধ হয়ে মায়ের নাকে ভাসি। জলে ভিজে মায়ের অল্প অল্প সর্দি হয়। আমি এক টুকরো ব্যাথা হয়ে সারাদিন ঝুলতে থাকি আমার মায়ের গলা ধরে।

Monday, August 2, 2010

ভ্যান-তারা

কাল অয়দিপাউসকে নিয়ে আঁতলামী করে ডায়েরী লিখলাম। সেটা পড়ে রাজাদাদা আমাকে এই গানটা দিল।
"এই যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি
অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি
এই তো পরম দান, সফল করিল প্রান,
সত্যের আনন্দরূপ, এই তো জাগিছে
ক্ষত যত, ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে,
নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে পিছে"

এই গানটা ভাবতে ভাবতে আমার ষোলো বছর আগের একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি প্রথম বড়দের বই পড়ছি। বাড়িতে লুকিয়ে, অন্য বই-এর ভাঁজে – বুদ্ধদেব গুহ-র ‘সবিনয় নিবেদন’। মানুষের স্মৃতি কি অদ্ভুত! নিষিদ্ধ জগতে প্রথম পা রাখার সেই গোপন উত্তেজনা এখন আর কিচ্ছু মনে নেই। কেমন ছিল গল্প, কি হয়েছিল – সেসব কিচ্ছু না। শুধু কি করে জানি মনে থেকে গেছে – কোন একটা সময়ে মেয়েটা খুব বিভ্রান্ত ছিল, তখন লোকটা ওকে চিঠিতে লিখেছিল – মনে মনে এই দুটো লাইন বার বার গাইবে, গাইতেই থাকবে যতক্ষণ না বাকি সব ভুলে যাও –
“হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই
সংসারে যা দিবে মানিব তাই
হৃদয়ে তোমায় যেন পাই”

ষোলো বছর আগে এই গানের মানে নিশ্চয়ই বুঝি নি। তখন যাবতীয় ‘মেনে নেওয়া’র প্রতি তীব্র বিদ্রোহ। আর দয়া! সে অনুভূতির সাথে পরিচয় সাদা-কালো টিভির পর্দায় বিদ্যাসাগর-রূপী পাহাড়ী সান্যালেই সীমাবদ্ধ। নিষিদ্ধ ফল চাখতে ব্যস্ত কৌতূহলী মন সেদিন গানটাকে মুখস্থ করে নিয়েছিল। আজ কেমন একবার মনে করতেই ধোয়া-মোছা ন্যাপথলিনে মোড়া স্মৃতিটাকে আমায় ফিরিয়ে দিল!

আমরা ভারী ভাগ্যবান – আমাদের দেশে একটা মানুষ জন্মেছিলেন যিনি দেড়শো বছর ধরে একটা জাতের ইমোশনাল ক্রাইসিস একা হাতে সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে, age-এ cage-এ rage-এ ও মঙ্গলে – এমন বন্ধু আর কে আছে, তোমার মত মিস্টার!

ন’বছর আগের কথা মনে পড়ে। তখন আমি বম্বে আই আই টি তে। জীবনে প্রথম একটা টেপ রেকর্ডার পেয়েছি। তাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোটা চারেক ক্যাসেট শুনি। মাঝে মাঝেই মাঝ রাত্তিরে ল্যাব থেকে ফিরে লো ভলিউমে চালাতাম
“আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব”

কি বলব মশাই! অদ্ভুত বল পেতাম। অদ্ভুত! আমার একটু তারা দেখা বাতিক আছে তা তো জানেনই। সেই সব রাত্তিরে মনে হত, আমার জানলার ফাঁক দিয়ে ধরা দেওয়া এক চিলতে আকাশটায় বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। যেন সব কটা আলোর কণা পাগলের মত পাক খাচ্ছে। সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত আর শান্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপর সেই শান্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে একে সবকটি তারা আবার জ্বলে উঠত। সক্কলে মিলে বলত – এই তো আমরা! ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছি, জীবন নব নব!

আরও ছ’বছর পর জেনেছিলাম, সেই ছবিটার নাম Starry Night. আর তার আকাশে সব চেয়ে উজ্জ্বল যে তারাটা – তিনিই আমার রবি ঠাকুর।



গান শোনা যাবে এখানে
হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাইঃ http://www.in.com/music/search.php?type=song&search_data=Hridaye+Tomar+Daya+Jeno+Paai+Ashok
আমারে তুমি অশেষ করেছঃ http://www.in.com/music/search.php?type=song&search_data=Amare+Tumi+Asesh+Korechho

Sunday, August 1, 2010

Some things are better left unsaid

আমার মাঝে মাঝেই আঁতেল হওয়ার শখ জাগে। তখন আমি বিদেশী সিনেমা দেখি, ইংরিজিতে উপনিষদ পড়ি, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ভুল ভাল জায়গায় মাথা নাড়াই – এই সব আর কি! তা আজ রবিবার। ইংলিশ মাফিন আর কালো কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে মনটা ভারী সাহেব সাহেব হয়ে গেল। ভাবলাম আজ সারাদিন ধরে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখি। যা তা মুভি হলে চলবে না। আঁতেল হতে হবে। কাল রাতের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শ্রবণের কন্টিনিউয়েশন আর কি! দেখে শুনে বেছে নিলাম ১৯৬৭ সালের একটি ইটালিয়ান মুভি – পাওলো পাসোলিনির অয়দিপাউস। অর্থাৎ শুধু আঁতেলই নয়, অ্যান্টিকও বটে!

প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো সিনেমাটি আমার পছন্দ হয় নি। আমি ভেবেছিলাম সফোক্লিসের নাটকটির একটি আধুনিক চিত্রায়ন দেখবো। গল্পের শুরুও তেমনই ছিল – ষাটের দশকের ইতালী – একটি শিশু, শিশুর মা, তার কামুক স্বামী – যে শিশুর প্রতি তার নারীর মনোযোগ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে শিশুটিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আর ঠিক তখনই পটভূমি বদলে যায়। গল্প চলে যায় আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসে – থিবস নগরীতে। তারপর ঠিক তেমনটিই হয়, যেমনটি গল্পে আছে। ভয়, দয়া, বাৎসল্য, ভাগ্যানুসন্ধান, হত্যা, কাম, বিপন্নতা, গ্লানি ও সবশেষে অন্ধত্ব। অন্ধত্বের পর গল্প আবার ফিরে আসে ইতালীতে। একটি অন্ধ মানুষ রাস্তায় রাস্তায় বাঁশী বাজিয়ে ফেরে। মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। তাকে ফ্রেমে ধরেই শেষ হয় এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সিনেমাটি। খুবই নাটকীয় সিনেমা। অভিনয় দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল স্টেজ অ্যাক্টিং দেখছি। সেটা ভালো না লাগার একটা কারন। সংলাপ অত্যন্ত কম। ছবির প্রথম সংলাপটি আসে ছবি শুরুর ছ’মিনিট সতেরো সেকেণ্ড পরে। সেটাও কোন চরিত্রের মুখের সাধারণ সংলাপ নয়। শিশুটিকে দেখে পুরুষটির ঈর্ষা – যেন যাত্রাদলের বিবেক! নাটকে দেখতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সিনেমাতে অন্যরকম হতেই পারতো। আর শেষ কথা হল – ছবির প্রথম ও শেষ দশ মিনিটে কেন ষাট দশকের ইটালীর অবতারনা হল তা আমি বুঝলাম না। পরিচালক কি এটাই বোঝাতে চাইলেন যে অয়দিপাউসের গল্প আড়াই হাজার বছর আগেই শেষ হয়ে যায় নি, এখনও চলছে! ষাট দশকের ইতালী না দেখালেও সেটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

Some things are better left unsaid
Some strings are better left undone
Some hearts are better left unbroken
Some lives are better left untouched
Some lies are better off believed
Some words are better left unspoken

কি আসে যায় অয়দিপাউস আর জোকাস্টার, যদি তারা না জানে তারা কে! কি অসুবিধা তাদের স্বাভাবিক নারী-পুরুষের মত জীবন কাটাতে! কেউ তো বাধা দেয় নি তাদের! কেউ তো অনাহূত এসে ধাক্কা দিয়ে তাদের ঘুম ভাঙায় নি। ভবিষ্যত-দ্রষ্টা নীরব থাকতে চেয়েছে। মেষপালক স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেছে। রাজ্য ছিল, অনুরক্ত নারী ছিল, শিশু ছিল। তবু তার বিপন্নতা ঘুচলো না। আর কাউকে তো লাগে না – মাথার মধ্যে কিলবিল করে যে বোধটা – সে ভেংচি কাটে। বিরক্ত করে, অনুনয় করে, পায়ে মাথা খুঁড়ে মরে – বলো, বলো, আমাকে বলো! সে জেনে এসেছে ছোট থেকে – ফলটিতে কামড় বসালেই টুপ করে ঝরে যেতে হয় স্বর্গ থেকে। তবু তার মারাত্মক লোভ। জানতে তাকে হবেই। তারপর সত্যের ঝাঁঝ সামলাতে না পেরে নিজেকে সরিয়ে নিই জীবন থেকে কিংবা অন্ধ হই – সেও ভালো। যেন জীবনের জন্য সত্য নয়, সত্যের জন্য জীবন! কথাটা যতটা নায়কোচিত শোনায় আদতে তা’ও নয়। কোন মহৎ সত্যনিষ্ঠা থেকে এই প্রশ্নের উৎপত্তি নয়। এ নিজের সাথে নিজের খেলা। পোকা যেমন আগুনের দিকে ছোটে। ডানা পোড়ে আর সে তাকে জীবনের উষ্ণতা ভেবে চোখ ঠারে। তারপর তীব্র ঝলক, অন্ধত্ব। সবশেষে ছেঁড়া জামা পরে বাঁশী বাজানো রাস্তায় রাস্তায় এবং অস্থির আক্রোশে উন্মাদের মত চিৎকার। আমি হাফ আঁতেল এসব নিয়ে ব্লগ লিখি আর ভাবি বিপন্নতা কোন ওষুধে সারে!

Friday, July 30, 2010

আরশীনগর

আরশীতে মুখ খুঁজেছি অন্যমনা
চেনাদাগ বদলে গেছে কার আদলে
বেখেয়াল একলষেঁড়ে সে ভ্রাম্যমাণ
ভয়ানক অবাধ্যতায় তুলছে ফণা
খড়কুটো বাস্তুভিটে যাচ্ছে ভেসে
উড়োমেঘ সেই ঠিকানা বক্ষে নিলো
বালিঝড় ছদ্মপ্রেমিক ধূর্ত রাখাল
রুনুঝুন নাচছে পায়ে ইচ্ছেদানা
কোনোদিন কলজ়ে ছিঁড়ে জ্বালবে আগুন
ঝলকাবে লাস্যমুখর বৃষ্টিমাতাল
রোজকার তর্কপ্রিয় বিপন্নতায়
অনাবিল উড়বে তারই দগ্ধডানা

Sunday, July 25, 2010

তাওবাদের তত্ত্ব-তলাশ

একটা কাজে নর্থ ক্যারোলাইনা গেছিলাম। ফেরার পথে র‌্যালে এয়ারপোর্টে একটা পুরোনো বই-এর দোকান আবিষ্কার করলাম। বেশ অনেক বই। চার-পাঁচ ডলার করে দাম। অ্যান আরবরে সেন্ট্রাল ক্যাম্পাসের রাস্তায় এক বুড়ো লোক যেমন পুরোনো বই নিয়ে টেবিল সাজিয়ে বসতেন তারই একটা বড়সড় সংস্করণ। তো সেই দোকানে এটা সেটা বই-এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা বই হাতে উঠে এল – “দ্য তাও অফ পুহ”। লেখক বেঞ্জামিন হফ। পেঙ্গুইনের পাবলিকেশন। নেড়ে চেড়ে বুঝলাম সেটা তাওইজমের একটা বিশ্লেষণ। আর সেই বিশ্লেষণের কাজে উইনি দ্য পুহ-কে ব্যবহার করা হয়েছে একটা মডেল চরিত্র হিসেবে। আমার নানা রকমের ধর্মমত সম্পর্কে জানতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু ধর্মগ্রন্থগুলো এত গুরুপাক হয় যে কখনো শেষ পর্যন্ত পড়ে উঠতে পারি না। এই বইটার প্রচ্ছদে ঘুড়ি ওড়ানো উইনি দ্য পুহ-র ছবি দেখে মনে হল একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

“তাও” কথার মানে “দ্য ওয়ে” – পথ। কিসের পথ? বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে – যেখান দিয়ে রোজ ঘুম চোখে আপিস যাই, নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরি – আমার পথ চেনা বলতে সেটুকুই – আর শুনতে পাই হাজার হাজার মানুষ হাজার রকম ভাবে তারই কোটিখানেক ব্যাখ্যা ফেঁদেছেন! এই বইটাই যেমন শুরু হচ্ছে কনফুসিয়াস, বুদ্ধ আর লাও সুহ-র (তাওবাদী দার্শনিক) তুলনামূলক আলোচনা দিয়ে। তিন প্রৌঢ়কে এক চামচ করে ভিনিগার খেতে দেওয়া হয়েছে। ভিনিগার খেয়ে কনফুসিয়াসের মুখ সদ্য বউল ধরা আমের মত যখ্যি টক। জীবনের টকভাব সরাতে কনফুসিয়াস দাওয়াই দিলেন – “চল নিয়ম মতে, চল সমান পথে”। পুহ-র বয়েই গেছে অত নিয়মকানুন মেনে চলতে! সে বুদ্ধের মুখের দিকে তাকালো। তাঁর মুখ তেঁতো বিষ – জীবন ভারী দুঃখময়, মায়ার প্রলোভনে ভরা – নির্বাণেই মিলবে মুক্তি, বুঝলে ছোকরা! এসব কঠিন কথা পুহ-র এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেলো। লাও সুহ-র দিকে তাকিয়ে দেখলো, তিনি হাসছেন আর আপনমনে গুনগুন করছেন - “এই তো ভালো লেগেছিল, আলোর নাচন পাতায় পাতায়, শালের বনের খ্যাপা হাওয়া এই তো আমার মনকে মাতায়... ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো, আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই না হতে আরো বড়”। পুহ নেচে উঠলো। বাহ! এতক্ষণে কেউ একজন নাচ-গানের কথা বলেছে। পুহ-র তো সেটাই কাজ। সকালে উঠে ফুরফুরে মেজাজে সে তার বন্ধু পিগলেট-কে বলে – ‘আহা অলম্বুশ! আজকে আমার মেজাজ বড়ই খুশ!’ চলো একটু ঘুরে আসা যাক! তারপর পুহ আর পিগলেট দুজনে মিলে নেচে-কুঁদে মধু খুঁজতে বেরোয়। পুহ-র বাকি বন্ধুরা অবিশ্যি ঠিক এইরকম নয়। খরগোশ যেমন ভারী চালাক-চতুর। সারা দুনিয়ার খবর তার নখদর্পণে। অন্য কেউ তার চেয়েও বেশী বুদ্ধিমান হয়ে যাবে এই তার বড় ভয়। আবার প্যাঁচাকে দেখো। সারাদিন ধরে সে প্রচুর পড়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের পাহাড়। পৃথিবীতে কিছু আছে, আর প্যাঁচা সেটা জানে না – সে ভারী লজ্জা! ইয়র, মানে ওই ভুরু কোঁচকানো, সব সময় গুম হয়ে থাকা গাধাটা আবার আরেক রকম। সেও বিস্তর পড়াশোনা করে রেখেছে – আর সব কিছুতেই খুঁত ধরে যাচ্ছে। কিছুই ঠিক মনের মত হয় না তার।

বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে
– কি হে পুহ? কাজকর্ম নেই?
- নাহ! কাজ কি! দিনটা ভারী খাসা!
- তো?
- এমন খাসা দিনকে নষ্ট করার মানে হয়?
- সে কি হে! কোন জরুরী কাজে তো লাগাতে পারতে এমন পরিস্কার দিনটাকে!
- জরুরী কাজই তো করছি!
- কি রকম?
- শুনছি।
- কি শুনছো?
- পাখীদের গান শুনছি। তারপর দেখো, ঐখানে একটা কাঠবেড়ালী কেমন কিচিরমিচির করছে! ওর কথাও শুনছি।
- কি বলছে ওরা?
- ওরা বলছে – শোনো ভাই, তাক ধিনা ধিন তা! খাসা বটে আজকের দিনটা!
- এ আর নতুন কথা কি! এতো তুমি জানতেই!
- হুঁ, জানতাম। কিন্তু অন্য কেউও আমার মতই ভাবছে জানলে মনটা খুশী লাগে, ঠিক কিনা?
- তা হবে! তবে তুমি কিন্তু ভাই দিনটাকে অন্যভাবেও কাটাতে পারতে। এই ধরো রেডিওতে খবর শুনলে একটু! কত কিছু জানা যায় বলতো!
- রেডিও?
- হ্যাঁ, রেডিও। না’হলে জানবে কি করে বাইরে কি হচ্ছে?
- কেন? বাইরে বেরোলেই তো জানা যায়। এই যেমন আমি বেরিয়েছি এখন। পাখীরা বলছে – শোনো ভাই, তাক ধিনা ধিন তা! খাসা বটে আজকের দিনটা!


পুহ-র দিনগুলো এমনি ভাবেই কাটে। তাওবাদী দার্শনিকরা যার গালভরা নাম দেন – “the state of Uncarved Block” – আঁচড় কাটা হয় নি এমন পাথর। মন যখন এমন অবস্থায় থাকে তখন সত্য আসে সহজ ভাবে, শান্ত পায়ে, অনায়াসে – “জীবনপ্রান্তে হে নীরবনাথ, শান্ত চরণে এসো”। পুহ অবশ্য এত ভাবনাচিন্তার ধার ধারে না। পিগলেট-টা প্যাংলা আর কুচোমত হলে কি হবে, ভারী সুন্দর কথা বলেছে একখানা – “পুহ-টার বুদ্ধি-সুদ্ধি বিশেষ নেই, কিন্তু ও কারোর ক্ষতি করবে না কখনো। মাঝে মাঝেই বোকা বোকা কাজ করে ফেলে বটে, কিন্ত কি করে যেন সেই কাজগুলোই ঠিক-ঠাক সময়ে ঠিক-ঠাক কাজে এসে যায়।”

ইয়রের জন্মদিনের কথাই ধরা যাক। ইয়রের জন্মদিনের দিন পুহ আর পিগলেট ভাবলো ইয়র-কে কিছু দেওয়া যাক। পুহ-র মনে পড়লো এক শিশি মধু রাখা আছে ঘরে – সেটাই তো দেওয়া যেতে পারে ইয়র-কে। সে মধু আনতে গেলো। আর পিগলেট ভেবেচিন্তে বার করলো – জন্মদিনে ইয়রকে যদি একখানা বেলুন দেওয়া যায় ইয়র কি খুশীই না হবে! পিগলেট গেলো বেলুন নিয়ে আসতে। পুহ মধু নিয়ে ফিরছে আর শুনছে পাখীরা গাইছে – শোনো ভাই, তাক ধিনা ধিন তা! খাসা বটে আজকের দিনটা! ফুর্তির চোটে সে ভুলেই গেলো কোথায় যাচ্ছিল। হাতে মধুর শিশি, এমন খাসা দিন, একটু একটু খিদেও পাচ্ছে – সে মধুর শিশি খালি করে ফেললো। তারপরেই মাথায় বজ্রাঘাত – যাহ! মধু তো নেই! ইয়রের জন্মদিনের কি হবে এখন! যাই হোক, মধু নেই তো কি, মধুর শিশিটা তো আছে! সে শিশিটা নিয়ে প্যাঁচার কাছে গিয়ে বললো – এটাতে সুন্দর করে হ্যাপি বার্থ ডে লিখে দাও দিকি! প্যাঁচা অবিশ্যি লিখে দিলো খুশী মনেই। পুহ তখন খালি শিশি নিয়েই চললো ইয়রের বাড়ি। ওদিকে পিগলেট বেলুন নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছিল – আহা, যদি কোনক্রমে পুহ-র আগে পৌঁছে যেতে পারি তাহলে আমিই প্রথম ইয়রকে হ্যাপি বার্থ ডে বলতে পারবো – ফার্স্ট হওয়ার মজাই আলাদা! ভাবতে ভাবতেই ধপাস। পথে গর্ত ছিলো খেয়াল করে নি। বেচারা পিগলেট তো আছাড় খেলোই, বেলুনটাও ফুস করে ফুটো হয়ে গেলো। গুটলি পাকিয়ে যাওয়া রবারের টুকরোটা নিয়েই ও পৌঁছালো ইয়রের বাড়ি।
- ইয়র, তোমার জন্য একটা বেলুন এনেছিলাম হে!
- বেলুন? মানে ঐ বিশাল ফোলা ফোলা রঙীন বলগুলো? ট্রা লা লা লা! ট্রা লা লা লা! কই? কই? কই?
- ইয়ে মানে... বেলুনটা ফেটে গেছে। আমি রাস্তায় পড়ে গেলাম ইয়র। আর তখনই বেলুনটা ফেটে গেলো।
- ফেটে গেলো? আমার বেলুনটা ফেটে গেলো? আমার জন্মদিনের বেলুনটা??
- হ্যাঁ, ইয়র।
এই বলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পিগলেট চুপসে যাওয়া রবারের টুকরোটা ইয়রের হাতে তুলে দিয়ে বলে – হ্যাপি বার্থ ডে ইয়র! ঠিক তখনই পুহ এসে ঢোকে।
- এই দেখো ইয়র, আমি তোমার জন্য কি এনেছি। কি সুন্দর শিশি দেখো! আবার তার ওপর হ্যাপি বার্থ ডেও লিখিয়ে এনেছি। পছন্দ নয়?
ইয়রের একহাতে খালি মধুর শিশি, অন্য হাতে চুপসে যাওয়া বেলুন। দুই বন্ধুর দেওয়া বার্থ ডে প্রেজেন্ট।
- আরে, দেখো দেখো! বেলুনের টুকরোটা শিশির মধ্যে ঢোকানো যাচ্ছে!
- বাহ রে! তাই তো! দেখেছো ইয়র, আমি কেমন তোমাকে একটা শিশি এনে দিলাম, যাতে তুমি পছন্দ মত জিনিস এনে রাখবে।
- আর আমার জিনিসটাও দেখো ইয়র, আমিও কেমন তোমাকে একটা প্রেজেন্ট দিলাম যেটা তুমি পুহ-র শিশিটার মধ্যে ভরে রাখতে পারবে।
ঠিকই তো! বেলুনটা যদি না ফাটতো, তাহলে কি সেটা শিশির মধ্যে ঢোকানো যেত! ভারী খুশী হয় ইয়র তার জন্মদিনের উপহারে। সে বারবার বেলুনটা শিশির মধ্যে ঢোকাতে আর বার করতে থাকে। কেমন কাজের শিশি যাতে ইচ্ছেমত জিনিস রাখা যায়! আর কেমন কাজের বেলুন যেটা ইচ্ছেমত শিশির মধ্যে ঢোকানো যায়!

এটাই তাওবাদ। জীবনকে তারই মত স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে মেনে নেওয়া। আগলি ডাকলিং-এর গল্পটা মনে আছে? আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা রাজহাঁস থাকে। সেটাকে শুধু খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা। প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু দুর্বলতা আছে, কিছু ত্রুটি আছে, কিছু না পাওয়া আছে। আবার একটা রাজহাঁসও তো আছে – যেটা আমাদের “Inner Nature”। তাতে বিশ্বাস রাখা। মরীয়া হয়ে কিছু বদলানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতেই পরিবর্তন আসবে – হঠাৎ করে একদিন পুকুরের জলে নিজের ছায়া দেখে চমকে উঠতে হবে – আরে! ‘এইটুকুনি মানুষগুলো এততো বড় কেমন করে হয়?’ তাও জানো না – বলবে পুহ – ‘তালুক-তুলুক-মালুক-মুলুক যত, চেংলি পাহাড়, গুম্ফি আরো কত, সব দেখেছি,’ গান গেয়েছি জোরে, জীবন জুড়ে সুর নিয়েছি ভরে। এবার জিরোই খানিক। যেইদিকে চাই, শুধুই দেখি মানিক। ভুল যা কিছু ছিলো, চৈতি রাতের মাদল নাচে কোথায় উড়ে গেলো! এইভাবেতেই থাকি। খড়-কুটো সব ধুলো-বালি বয়াম ভরে রাখি!

Saturday, July 24, 2010

S আর K

আচ্ছা তা’লে খুলেই বলা যাক। একদিন – যখন কিনা S-এর বেশ রাত আর K-এর বেশ সকাল তখন তাঁরা দুজনে গপ্পো করছিলেন। K কিনা ভারী ছেলেমানুষ – বিস্ময়ের মত খাঁটি অনুভূতি তাঁকেই মানায়। S যাই বলেন, অবাক বিস্ময়ে K প্রশ্ন করেন – হ্যাঁ, তাই নাকি? সে কি রকম? S-ও এই সুযোগে সাত বছরের বালিকাবেলায় ছোটো ভাই-বোনেদের নিজের বাসের টিকিটের সম্ভার বা খেলাঘরের ঐশ্বর্য দেখিয়ে যেমন আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেন, তেমনই সহজতায় K–এর কাছে নিজের গল্পের ঝুলি উজাড় করে দেন। এবং সেই ঝুলি থেকে বেরোয় একটি বিকেল ও তৎসংলগ্ন একটি সিঁড়ি। S-এর বাসার খিড়কি দোরের সেই সিঁড়িতে বসে S তাঁর বিকেলগুলি কাটান। আপনমনে ছবি আঁকেন, রং ভরান, মুছে দেন, আবার আঁকেন। এই সিঁড়ির ধাপেই জমা আছে S-এর যাবতীয় সূর্যোদয়, তাঁর বেলাশেষের অস্তরাগ, তাঁর উঠোনভাঙা বৃষ্টি, তাঁর দুকূলপ্লাবী বসন্ত। সর্বোপরি তাঁর রাত্রি – নিঝুম লোকালয়ে ফুটে ওঠা একটি-দুটি তারা – কদাচিৎ চৈত্রের নির্মেঘ আকাশে বশিষ্টের কাঁধের কাছে জেগে থাকা অরুন্ধতীর আশ্বাস। S-এর একাকী শহর – জ্যোৎস্নাবিলাসিনী!

S-এর সিঁড়ি আর বিকেলের গল্পে K খুব আপ্লুত হয়ে পড়েন। ছেলেমানুষ কিনা! সেদিন গল্প শেষে S-কে তিনি একখণ্ড কবিতা লিখে পাঠান। S আবেগপ্রবণ মানুষ। এমন হঠাৎ খুশীর ভার বইতে তিনি কোনদিনই বিশেষ পটু নন। যদিও K-এর সামনে তাঁর কাব্যপ্রতিভা সাঁঝবাতির পাশে হ্যালোজেনের মতই দৃষ্টিকটু ও উচ্চকিত, তবু আবেগের বশে তিনিও লিখে ফেলেন দু’লাইন। K কিনা জাত কবি। S-এর মনের কথা তাঁর নিজের থেকেও নিপুণ ভাবে প্রকাশ করার সহজাত ক্ষমতা K-এর। তাই আরো ক’লাইন যোগ করে তিনি কবিতাটি সম্পূর্ণ করেন। সেটি কেমন হলো? দেখে নেওয়া যাক –

K: বিকেল, তোকে এই সিঁড়িতে রাখি
এইখানে হোক গল্প গল্প খেলা
বাসায় যখন ফিরবে দোয়েল পাখি
ডানায় মেখে অল্প অল্প বেলা

S: বিকেল, আমার রূপকথা সন্ধান
বৃষ্টিশেষের হলুদ আলোয় ঘেরা
সিঁড়ির বাঁকে থমকে গেছে দিন
তোরই কাছে গল্প শেষে ফেরা

K: যখন আমায় খোলা আকাশ ডাকে
জানলা বেয়ে ডাকে গাছের সারি
রূপকথারা চুপটি করেই থাকে
তাদের সাড়া না দিয়ে কি পারি?

K: বিকেল, আমার নেই তো ওঠানামা
সিঁড়ির কাছে, অনেক কাজের ঝোঁকে
আমার শুধু একটুখানি থামা
একটুখানি জড়িয়ে নেওয়া তোকে

Friday, July 23, 2010

অস্থিরতা ভাত চেয়েছে

অস্থিরতা একটা পাগল
খুঁজছে আমায় সকাল-সাঁঝে
যেইখানে যাই, জটপড়া চুল
নোংরা জামা, সামনে আসে -
চাইছে খেতে, আমায় নিতে
ঘর চেনে না, ভাঙছে আগল!
ভাত দিই নি, তবুও দেখো
কপাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে!
জ্বরের মত আসছে কাছে
কপাল জুড়ে, শরীর জুড়ে
জরীপ করে আঠালো চোখ -
অতর্কিতে কামড় বসায়
ঘাড়ের কাছে, হ্যাঁচকা টানে
ফেলছে এনে শানের ওপর -
কাঁটা বেছে খায় তৃপ্ত বেড়াল!
অস্থিরতা ভাত চেয়েছে -
সাপটে ধরে বুকের মাঝে
তাকিয়ে আছে অষ্টপ্রহর -
দেয় না হতে চোখের আড়াল!

Tuesday, July 13, 2010

কাটুম-কুটুম

একটা থাই রেস্তোরাঁ থেকে বেরোচ্ছি – দেখি সদর দরজার পাশেই ক’টা বেলফুলের গাছ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাছের দিকে নিচু হলাম। একটুও বদলায় নি তো! একদম একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোটোবেলা! গ্রীষ্মকালের লোডশেডিং-এর সন্ধ্যে। আমি আর ভাই ল্যাম্পের আলোয় অঙ্ক কষছি। বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে তারা দেখছে। মা গুনগুন করছে – যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকাবনে... সুর লাগছে না। তবু যা গাইছে সেটাই যেন সুর হয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের দেড়তলার ছাদ থেকে ম ম করে ভেসে আসছে বেলফুলের গন্ধ!

টবের নিচে কিছু বেলফুল ঝরে ছিল। সেগুলো কুড়িয়ে নিলাম। বার বার ঘ্রাণ নিচ্ছি – আর ম্যাজিকের মত, আলিবাবার গুহার মত, প্রফেসর শঙ্কুর বোগদাদের বাক্সের মত আমার সামনে পর্দার পর পর্দা খুলে যাচ্ছে – একের পর এক প্রিয় মুখের সারি, প্রিয় দৃশ্যের অভিনয় – আমাদের গঙ্গাতীরের নরম হলুদ আলোর ফিল্টারে পরিশ্রুত! ব্লুমিংটনের বিকেলে তখন চাপ চাপ কালো মেঘের ফাঁকে কমলা সূর্যের ঝলক। হয়তো একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। পৃথিবীকে এতো সুন্দরও হতে হয়! শিউরে উঠি!

খেলাঘরের ছড়া

সেদিন তাদের খেলাঘরে সবই ছিল
কাটুম-কুটুম বুদ্ধু-ভুতুম ভালুকছানা
এমনকি এক নীলনয়না ঝাঁকড়া চুলও!

সেদিন তাদের খেলাঘরে দারুন ঘটা
পাতার লুচি, বেগুনভাজা পাথর কুচির
নিমন্ত্রণের নীলচে খামও তৈরী ছিল...


কিন্তু তাদের পুতুলখেলায় কেউ আসে নি।
কাগজফুলের শিকল গাঁথা সমস্তদিন...
অলক্ষুণে বৃষ্টিতে সব পণ্ড হল!

Sunday, July 11, 2010

স্বপ্নসম্ভব

আজ সকালে আমি ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম। দূরপাল্লার ট্রেন। নীল রঙের। ফ্যাকাসে হলুদ গমক্ষেতের মধ্যে দিয়ে, রুখু রুখু কালো মাটির মধ্যে দিয়ে, লাল কাঁকরে ভরা ঝুরঝুরে পথের মধ্যে দিয়ে – ট্রেনটা ছুটছে ছুটছে ছুটছে। খোলা জানলা দিয়ে গরম হাওয়া আর পাটকিলে ধুলো আমার মুখে এসে লাগছে। আমার রোমকূপগুলো গোগ্রাসে ধুলো খাচ্ছে। আমার চুল উড়ছে। আমি ক্রমশই ধূসর হয়ে যাচ্ছি। আর ট্রেনটা ছুটে চলেছে। শুকিয়ে আসা নদীর খাত পার হয়ে, রেলের ব্রিজে ঝমঝম শব্দ তুলে, পাকা খরমুজার গন্ধে বিভোর হয়ে টেনটা শুধুই ছুটছে।

তারপর ওরা বললো এখানেই নামতে হবে। আমি জায়গাটা চিনি না। কেমন পুরোনো পুরোনো লালচে স্টেশন। চকচকে মেরুনরঙের জরিওলা শাড়ী পরা এক বুড়ী চুবড়ী ভরে লিচু বিক্রী করছিল। তার কালো রোগা হাতে রুপোর বালা। কোঁচকানো চামড়ায় উল্কিতে কালীয়দমনের কৃষ্ণ বাঁশী বাজাচ্ছে। আমি স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা বুড়ো মত টাঙ্গাওয়ালা – নীল-সবুজ চৌখুপ্পি লুঙ্গী পরা – আমায় বললো কোথায় যাবে? আমার তো মনে নেই কোথায় যেতে হবে। স্টেশনের ধারে একটা লাড্ডু-জিলিপির দোকান। কমলা রঙের জিলিপির ঝুড়ির ওপর একটা বিশাল কালো মাছি বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। একটা বটগাছ – তার গায়ে অনেক সিঁদুর লেপা। আমি ওদিকেই চললাম।

রাস্তাগুলো সরু সরু। দুই দিকে উঁচু উঁচু বাড়ি। মাঝে কোন ফাঁক নেই। আলো ঢোকে না একটুও। তবু গলিপথ কেমন আলো আলো। চৌকো পাথর সাজানো পথ। ফ্যাকাসে হলুদ পাথর। তার খাঁজে খাঁজে অনেক ধুলো। সেই ধুলোর সাথে জল মিশে শিরা-উপশিরা ছড়িয়েছে। আমি ওই শিরাওলা পথ ধরে এগিয়ে চলি – যেদিকে জল বয়েছে। আমার দুপাশে ভেজা ভেজা বাড়িগুলোর জাফরির ফাঁকে সময় বাঁধা আছে। গলির শেষে যেখানে সিঁড়ি নেমেছে ধাপে ধাপে সেখানে একটা পাথরের কুয়ো। কুয়োর ধারে একটা মেয়ে। লালহলুদ ঘাগরা পরা। তার তেলহীন চুল বাদামী রঙের। সরু হাতে লাল প্লাস্টিকের চুড়ি সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। মেয়েটাকে আমি চিনি না। তবু মনে হয় দেখেছি কোথাও। থমথমে দুপুরে তখন ‘কুব’ ‘কুব’ করে একটা পাখী ডাকছিল। কেউ কোত্থাও নেই। এই হলুদ ধুলো ধুলো শহরে খালি আমি আর ওই মেয়েটা। যার চোখদুটো আয়নার মত। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরি। তারপর হাঁটতে থাকি ওর সাথে এই অচেনা শহরের গলিপথ ধরে – যেখানে রোদ ঢোকে না, অথচ কেমন আলো আলো।

এভাবেই

এভাবেই ঝরে যায় টুপটাপ
জলকণা, মেঘে আধোলীন।
এভাবেই তারাদের কিংখাব -
আঁধারেও ভীষন রঙীন।

এভাবেই গল্পেরা নিষ্পাপ -
শীতঘুম গেলো বালুচরে।
এভাবেই হৃদয়ের উত্তাপ
শোধে ঋণ, বিষাদে ও জ্বরে।

এভাবেই শুষে নিই জলছাপ
নিভৃতি এভাবেই এলো -
এভাবেই সোনা হয় চুপচাপ
যাবতীয় ভ্রমণের ধুলো।

Wednesday, July 7, 2010

আমি ও তিনি


- কেমন আছিস শুনি?
- কেমন আবার! রঙে-রসে জাল বুনি।
- রঙের গুমোর বড়!
- গুমোর তো নেই! যা আছে সব কাড়ো।
- কাড়লে কোথায় যাবি?
- দেখবো খুঁজে – হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নলোকের চাবি।
- অতই সহজ পাওয়া?
- নাই বা পেলাম। থাকবে ছুঁয়ে পাগল প্রভাত হাওয়া।
- পথ হারালে পরে?
- ভয় কি তাতে! হারাই বলেই পাই যে নতুন করে!
- হাত ধরবি কার?
- খুঁজবো তোকেই। পরাণসখা, বন্ধু রে আমার!


************************************************
[জয়কে টুকলেই কি গোঁসাই হওয়া যায় মামনি?]

Friday, June 18, 2010

সরীসৃপ

অভ্যেস একটা রঙচঙে নাদুশনুদুশ গা-এলানো খোলস। তার মধ্যে শুয়ে থাকি গুটিসুটি। বাইরে বয়ে যায় শীতকাল।

পাতা ঝরেছিল বুঝি? জানি না তো! আমি তো দেখেছি শুধু উজ্জ্বল রূপোলী রোদ। সংক্রান্তির মেলা। ওলাবিবিতলায় মাটির পুতুল কেমন সারি সারি। বটের ঝুরির ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ে ফেলে যাওয়া কার্তিক ঠাকুরের মুখে। ঘাটের সিঁড়িতে অশথ পাতা ছড়িয়ে আছে জালিদার। চুড়িওয়ালা চুড়ি পরাচ্ছে কচি সবুজ হাতে। দেখেছি শীতের দুপুরে মাদুর পেতে কমলা-বিলাস। সেজ ঠাকুমা সাবধানে ফোঁড় তোলে নকশীকাঁথায়। ইঁটভাঁটির মরা আঁচে আলু পুড়িয়ে খেয়েছি দল বেঁধে। সেই সব ভরন্ত দিন। রোদ্দুরের হাট। এমনই তো বলতে তুমি? নিকোনো মাটির বুকে খড়ের ঘ্রাণমাখা বিকেলে।

খোলসকে ছাড়ি নাকি খোলসই ছেড়ে যায়! অঞ্জলী বেয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ে জলের মত। কাঁচা চামড়ায় বাতাসের দাগ – কেমন শিরশিরে! লালচে আকাশ। লাল চোখের মণি। গাঙুরের মজা স্রোত তবু সর্বনাশী। দুলেদের ঘরে চোরা খুনসুটি। টিনের চালের নিচে ধোঁয়াওঠা আমিষ দুপুর। গেরস্তর বৌ নিজের হাতে সাজিয়েছে দুধ-কলা। চেটেপুটে খাই পরিপাটি। ধুলো মাখি সারা গায়ে। মাটির খুব জোর। রোদের তাত এসে মেশে। জমে বৃষ্টির জল। পৃথিবীর সব স্বাদ মাটিতেই আছে। তারপর হেলেদুলে চলি আঁকেবাঁকে – যেমনটি ছোটনদী। কোন পাড়ায় নবান্নের ধান রুইছে – খুঁজতে যাই। নতুন চালের গন্ধ আজও শিশিরের মতই অপরূপ।

Thursday, June 17, 2010

বৃষ্টিমুখর

আজকাল ভারী বৃষ্টি পড়ে। এই ছিল শুকনো খটখটে রোদ, ঝলমলে উজ্জ্বল দিন। হঠাৎ করে তার ঠোঁট ফুলে ওঠে। তার টানাটানা দীর্ঘ চোখের পাতা নিবিড় হয়। তার গলার নীল শিরাটা কাঁপতে থাকে। হু হু করে হাওয়া দেয়। নিঃসাড় শরীরে হঠাৎ ব্যথা পাওয়ার মত একটা তীব্র জীবন্ত অনুভূতি তোলপাড় করতে থাকে সারা চরাচর। সেই সাথে উড়ে বেড়ায় ফেলে দেওয়া কোকের বোতল, উপচে পড়া ট্র্যাশক্যানের আবর্জনা, গ্রসারীর বিলের ছেঁড়া টুকরো। আর এদের মাঝেই সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে বৃষ্টি নামে। ধারালো নখের মত হিংস্র তুমুল বৃষ্টি। অবাধ্য মেয়ের মত সে আছড়ে পড়তে থাকে মাটির বুকে। যেন আরেকটু ধাক্কা দিলে মাটিটাও গলে যাবে।

আমি আমার জানলা দিয়ে দেখি বেরি গাছটা আকন্ঠ ভিজছে। লাল লাল ছোটো ছোটো বেরি – বৃষ্টিকণা তার উপর পড়ে এক একটা ম্যাজিক ক্রিস্টাল তৈরী হয়। কাঠের বেড়াটার গায়ে ফুটে ওঠে সবজ়েটে ছবি। ম্যাপল পাতাগুলো ভীষন বৃষ্টি খেয়ে গুটিসুটি চুপচাপ। কতবার ভাবি ক্যামেরাতে তুলে রাখবো এই মুহুর্তটুকু। জলের ছিটে লেগে লেন্সই ভেজে শুধু। সে আর ধরা দেয় না। ভারী রাগ হয় আমার। তাই তো... আসবি কেন আমার কাছে... আমি কি আর তেমন দেখনদার! খাটের ওপর ক্যামেরা ছুঁড়ে ফেলে সবকটা জানলা খুলে দিই। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যেতে থাকে আমার গেরস্থালী, আমার ছেঁড়া পাতার আঁকিবুঁকি। আমার ডায়েরীতে লেখা দিনগুলি বৃষ্টির আদর পেয়ে গলে যেতে থাকে। আকাশের মত নীলচে ধূসর হয়ে ওঠে তারা। আমি বাধা দিই না। ওরা ভিজতে ভিজতে একসময় মেঘেদের মাঝে মিশে যায়।

এমন সময় আকাশ ভরে আলো ফোটে। বৃষ্টিশেষের প্রথম আলো। অপূর্ব এক হলুদ আলো। একফালি মেঘ সরিয়ে দিয়ে ক্ষণিকের জন্য সে দেখা দেয়। লুকিয়ে পড়ে পর মুহুর্তেই। অবিরাম বর্ষণের মাঝে ভারী গোপন এক সুখের মত নরম সেই আলো ছড়িয়ে পড়ে সদ্যস্নাত ম্যাপল পাতায়, বৃষ্টিকাতর পথে পথে, নীলচে ধূসর আকাশের কোণে কোণে। সেই আলোটুকু ছোঁয়ার জন্য আমি বার বার ঘর-বাহির করি।

Friday, June 4, 2010

চেংলি পাহাড় দেখতে কেন বাকি!

“বেঁচেই যদি থাকি, চেংলি পাহাড় দেখতে কেন বাকি!”

কথা ছিল গরমের ছুটিতে বাবা-মা আসবে আমার কাছে। তারপর একসাথে বেড়াতে যাবো। কিন্তু ঠাকুমা অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে প্ল্যান বাতিল হল। ততদিনে এদিকের সব টিকিট কাটা হয়ে গেছে। ভাবলাম ধুত্তেরি বলে সবকিছু ক্যানসেল করে দিই। কিন্তু একটার পর একটা ‘ভাল্লাগে না’ জমা হতে হতে এমন আকাশঢাকা দেওয়াল তুললো যে শেষ পারানীর কড়ি ‘তার’ দিকে চোখ ফেরানো ছাড়া আর উপায় কি। এমন বন্ধু আর কে আছে তোমার মত সিস্টার! তাই চলেছি তার কাছেই। ‘তালুক তুলুক মালুক মুলুক যত, চেংলি পাহাড়, গুম্ফি আরো কত’ – সব তো দেখতে হবে, নাকি? কে জানে কবে মানুষ নিভে যায়। হয়তো গিয়ে পৌঁছবো লুব্ধক নক্ষত্রের আশে পাশে। যদি আর ফেরা না হয়!!

দিনের শুরুটা ছিল মেঘলা। শেষ রাতে ঘুম ভেঙে উঠে একটি তারাকেও দেখতে পেলাম না। এমন দিনে অকারনেই মেজাজ থাকে বাসী ডোনাটের মত। মন নাহি মোর কিছুতেই, নাহি কিছুতেই! ভোর ছ’টায় ফ্লাইট। চেক-ইন করতে গিয়েও বিপত্তি। কানেক্টিং ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস বার করতে পারলাম না। সিট পছন্দ করতে পারলাম না। প্যাঁচা মুখ নিয়ে এয়ারপোর্টে বসে আছি। ঠিক এমন সময় সূর্য উঠলো। কালো মেয়ের কপালে লাল টিপের মত জ্বলজ্বলে নিখুঁত নিটোল সূর্য। সেটা দেখেই এমন খুশী হয়ে গেলাম যে জানলার ধারে সিট পেয়েও সহযাত্রীকে সেটা ছেড়ে দিতে একটুও দোনামোনা করলাম না।

পরের ফ্লাইটে অবশ্য বসেছিলাম জানলার ধারেই। কতবার আকাশে উড়েছি। তবু জানলার ধারে বসতে পেলে এখনো অদ্ভুত চাঞ্চল্য লাগে। বিশেষ করে চলেছি যখন আমার প্রিয়তম ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে। পায়ের তলায় ভুবনজোড়া ক্যালভাসে লাল, কালো আর হলুদের বন্যা। কে জানে কোন পাগলে এঁকেছে এ ছবি! দূর থেকে ক্যানিয়নগুলোকে মনে হচ্ছে থাক থাক কোঁকড়া চুলের ঢেউএর মত। তাদের মাঝখানে সরু নীল ফিতের মত কলোরাডো নদী। প্লেন যখন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমে বাঁক নেয় মেঘলা আকাশের নীচে কমলা পাথরের সেই ভাস্কর্যকে দেখে চোখ ফেরাতে পারি না। নয় নয় করে খুব কমও তো দেখিনি এই পৃথিবীর। কিন্তু সূর্যের আঁচে লাল এই রূক্ষ পাথরের থেকেও সম্মোহক কিছু চোখে পড়েনি আজ পর্যন্ত। যেন জীবনের মতই সাধারন ও নাটকীয়তাহীন, আবার জীবনের মতই নির্মম, জীবনের মতই অপ্রত্যাশিত সুন্দর। লেক মিডের ওপর দিয়ে যেতে যেতে বেশ ক’টা এয়ার পকেট পড়লো। প্রতিটা পকেট এক একটা লাফে নিয়ে যাচ্ছিল রকির আরো কাছাকাছি। অনেক উঁচু থেকে যা শুধুই ঢেউ খেলানো পেশীর বিস্তার মনে হচ্ছিল, কাছে গেলে চোখে পড়ে তার মধ্যেও কত ভাঙাগড়া। মাটি আর জলের লড়াইয়ে কখনো জিতেছে মাটি, কখনো পথ করে দিতে হয়েছে জলকে। আর এই খেলা চলছে আজও। এভাবেই একটা রবারের বলের মত ড্রপ খেতে খেতে আমরা লাস ভেগাসের মাটি ছুঁলাম।



“হোরি খেলত নন্দলাল”

লাস ভেগাস আমার বিচ্ছিরি লাগে। এখানে সবকিছুই বড্ড চকচকে, বড্ড চড়া। আর সত্যি বলতে কি ক্যাসিনোগুলোকে একটু ভয়ই পাই। ভেতরের মেঠো ক্যাবলাকার্তিকটি বেরিয়ে আসে। কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছে ছিল লাস ভেগাস দেখবে। তাই লাস ভেগাসকে ইটিনিরারিতে রাখতেই হয়েছিল। যদিও আমি জানতাম ওদেরও ভালো লাগবে না। আমারই তো বাপ-মা! সেজন্যই স্টেট পার্কস নিয়ার লাস ভেগাস লিখে গুগুলে সার্চ দিয়েছিলাম। ক্যাসিনোর প্রাথমিক চমকটা কেটে গেলে যাতে ওদের সেখানে ঘুরিয়ে আনতে পারি। ইমেজ সার্চে যে ছবিটি সবচেয়ে নজর কেড়েছিল তা ছিল একটি সর্পিল রাস্তা – সেই রাস্তা চলেছে রামধনু রঙের পাথরের মধ্যে দিয়ে। কথার কথা নয়। সত্যিকারের রামধনু রঙ। লাল-হলুদ-কমলা-ম্যাজেন্টা-গোলাপী পাথর। তাদের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ বুনো ঘাসের ঝোপ। আর মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। সে জায়গার নাম ভ্যালি অফ ফায়ার। লাস ভেগাস থেকে মোটে পঞ্চাশ মাইল। এটি নাকি নেভাডার প্রথম স্টেট পার্ক। ছবি দেখেই বড্ড ভালো লেগেছিল। আজ নিজের চোখে যা দেখলাম তার তো তুলনাই নেই। খালি আফসোস এই – যাদের দেখাবো ভেবেছিলাম তাদের দেখানো হল না। আর তাদের জন্যই আমাকে আরো দু’রাত লাস ভেগাসের উপদ্রব সহ্য করতে হবে :(

পার্কটা মূলত লাল স্যান্ডস্টোনে ভর্তি। সেই নরম স্যান্ডস্টোনের ওপর কোটি কোটি বছর ধরে বৃষ্টির জল যে ভাস্কর্য তৈরী করেছে তারই নাম ভ্যালি অফ ফায়ার। মৌচাকের মত রাশি রাশি গর্ত তৈরী হয়েছে পাথরের গায়ে। কোন কোন গর্ত রীতিমত গভীর – গুহাই বলা চলে। তাদের মধ্যে নাকি মাউন্টেন লায়ন থাকে। কোন গুহার মধ্যে নাকি জল জমে স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাকমাইটও তৈরী হয়েছে। আমি যদিও দেখিনি। লাল পাথরের বুকে এই পূর্ণ বা অর্ধসমাপ্ত গুহাগুলো দেখে ইজিপ্টের ভ্যালি অফ কিংসে রাজ পরিবারের সমাধিস্থলের কথা মনে আসছিল। সেগুলি অবশ্য মানুষের তৈরী।


একটি পাথর আছে এখানে যেটি খুব বিখ্যাত। ভ্যালি অফ ফায়ার দিয়ে সার্চ করলেই ছবি দেখা যায়। তার নাম এলিফ্যান্ট রক। পাথরটিকে দেখতে সত্যিই সেই প্রাচীন যুগের খুব লম্বা শুঁড়ওয়ালা ম্যামথের মত। আরেকটি পাথরও ছিল খুব বিখ্যাত – তার নাম আর্চ রক – প্রকৃতির তৈরী একটি নিখুঁত আর্চ। ‘ছিল’ বললাম কারন দিন তিনেক আগে সেটি ভেঙে গেছে। কোন মানুষ ভাঙেনি। প্রকৃতিই নিজের খেয়ালে ভেঙে দিয়েছে। হয়তো আরেকটা গড়বে বলে!

১৯৩৫ সালে ভ্যালি অফ ফায়ার যখন প্রথম স্টেট পার্কের মর্যাদা পায় তার ক’বছর পরেই এখানে পার্কের ভিতর থাকার জন্য কয়েকটা কেবিন বানানো হয়েছিল যেগুলি এখন পরিত্যক্ত। কেবিনগুলো দেখতে বেশ। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে লাল পাথরের কেবিন। ভেতরে একটুকরো ফায়ার প্লেস যেটা এখন সাপের আড্ডা। কেবিনের পেছনে সামান্য একটু হাইক করলেই দেখা যাবে এই এলাকার প্রাচীনতম বাসিন্দাদের আঁকা ছবি। আমি দেখতে পেলাম একটা স্প্রিং-এর মত গোল্লা, কিছু নাচিয়ে মানুষ, একটা হরিণ। দু’হাজার বছর আগে কে জানে কোন মানুষ কিসের খেয়ালে এই ছবি এঁকেছিল! শিকার করে ভারী আনন্দ হয়েছিল বুঝি তার! আগুন জ্বালিয়ে সেদিন রাতে খুব নাচ নেচেছিল বুঝি!!

কিন্তু যে ছবি দেখবো বলে আসা সে তো এই দু’হাজার বছরের আঁকিবুকির থেকেও অনেক অনেক প্রাচীন। একটা গোটা রাস্তা – যার দুদিকে শুধু রঙ। সেই স্বপ্নের মত রাস্তাও এল অবশেষে। পথটির নাম রেইনবো ভিস্তা। প্রকৃতি নামের ছিটিয়াল মেয়েমানুষটি যে রঙ পেয়েছে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে এখানে। স্যান্ডস্টোনের সাথে নানা মিনারেলের ভেজাল মিশে তৈরী হয়েছে এই পাগলাটে কালার প্যালেট। পাগলাটে ছাড়া আর কিই বা বলি এই মাত্রাছাড়া রঙকে! এর ছবি কাউকে দেখালে সে নির্ঘাত বলবে আমি ফটোশপে রঙ করেছি। অথচ এই রঙ নিখাদ সত্যি। এই ম্যাজেন্টা, কমলা আর গোলাপী – আর সবের ওপর এলোপাথাড়ী ইয়েলো অকার – ভিনসেণ্টের মত পাগল হলুদ!

হোরীখেলার শেষে লাস ভেগাসে ফেরা। আমি আছি ইমপিরিয়াল প্যালেসে। এদের কোরিয়ান রেস্তোরাঁ জিনসেং-এ সিফুড স্ট্যু দিয়ে ডিনার সেরে এখন ঘরে। ব্লুমিংটনের ভ্যাপসা গরম আর আমার বিকল এসির সৌজন্যে গলাটা বসাই ছিল। আজকের পঁচানব্বই ডিগ্রী উষ্ণতা তাতে আরেকটু ইন্ধন জুগিয়েছে। তবে আমি কিনা ভারী সাবধানী মেয়ে। তাই জ্বরের ওষুধ সাথেই এনেছি। আপাতত দুখানা নাইকুইল মেরে শুয়ে পড়ছি। কাল ডেথ ভ্যালি।



"হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনখানে”

ডেথ ভ্যালির সাথে আমার সখ্যতা বেশ কিছুদিনের। গত শীতে যখন বাড়ীতে সারপ্রাইজ ভিজিট দিলাম তখন ওদের বলেছিলাম ডেথ ভ্যালি যাচ্ছি। একদম বিনাকারনে মিথ্যা বলেছি ভাববেন না। কারনটি আমার মা-জননী। একদিন ফোন না পেলেই মিলু আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অথচ বাড়ী যেতে স্টপ ওভার মিলিয়ে মিনিমাম সাতাশ ঘন্টা তো সময় লাগবেই। এর মধ্যে ফোন করবো কি করে! তাই মিলুকে বলেছিলাম ডেথ ভ্যালি যাচ্ছি দু’দিনের জন্য। আর ওখানে যেহেতু ফোনের সিগনাল থাকে না তাই ফোন করার তো প্রশ্নই নেই। তারপর যখন ডেথ ভ্যালির ভ্রমণকাহিনীর বদলে এই মূর্তিমান বাড়ী গিয়ে পৌঁছোলো তখন ওদের কি অবস্থা হয়েছিল সে তো অন্য গল্প, কিন্তু সমস্যা হল এইবারে ডেথ ভ্যালিতে ট্যুর বুক করাতে মিলু খামোখা সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়লো। রাখালের পালে বাঘ পড়লে যা হয় আর কি! তবে কি আর করা যাবে! রাখালেরা কবেই বা বাঘের ভয়ে গোপাল হয়েছে! অতএব মিলুর অদৃষ্টকে দুষে আমি চললাম ডেথ ভ্যালি দর্শনে।

ডেথ ভ্যালি নামটা শুনে যতটা রোম্যান্টিক লাগে আদতে জায়গাটা মোটেই তেমন নীলাঞ্জনঘন শ্যামসুন্দর নয়। ডেথ ভ্যালি গত বছরেও দুটি প্রান নিয়েছে। এক মহিলা ডেথ ভ্যালি গেছিলেন ছেলেকে নিয়ে, সাথে ছিল পোষা কুকুরটিও। পার্কের মধ্যে একবার টায়ার খারাপ হয়। মহিলার কাছে বাড়তি টায়ার ছিল না। তবে আরেকটি গাড়ী কিছুক্ষণ পরেই সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তারা তাদের বাড়তি টায়ারটি মহিলাকে দেয়। নতুন টায়ার লাগিয়ে মহিলা এবার চলে যান ডেথ ভ্যালির একটি অল্প পরিচিত ট্রেলে। সেই রাস্তার মাঝপথে আবার টায়ার খারাপ হয়। এবারে আর কোন গাড়ী আসে না। ঘটনার দু’দিন পরে পার্কের রেঞ্জার এদের খোঁজ পান। ততক্ষণে ছোটো ছেলেটি ও কুকুরটির মৃত্যু হয়েছে। গ্রীষ্মকালে ডেথভ্যালির তাপমাত্রা ১০০ থেকে ১২০ ডিগ্রীর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আর্দ্রতা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। রেকর্ড তাপমাত্রা উঠেছিল উনিশশো তিরিশের দশকে – ১৩৪ ডিগ্রী। সাধে কি আর এটা পৃথিবীর দ্বিতীয় উষ্ণতম অঞ্চল! যদি যেতেই হয় অবশ্যই দল বেঁধে যান। অন্তত দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যেন সাথে থাকে। অচেনা ট্রেলে না যাওয়াই ভালো। একান্তই অ্যাডভেঞ্চার করে মরার শখ হয়ে থাকলে হিমালয়ে যেতে পারেন। ডেথ ভ্যালির সৌন্দর্য মরার জন্য যথেষ্ট নয়।

এত কথা জানতে পারলাম আমার ট্যুর গাইডের থেকে। আটজনের ছোটখাটো দল। লাস ভেগাস থেকে বেরিয়েছি সাড়ে সাতটা নাগাদ। প্রথমে যাওয়া হল রিওলাইট নামে একটা ঘোস্ট টাউনে। বিশ শতকের প্রথম দিকে হঠাত শোনা যায় নেভাডার এই অঞ্চলে সোনা পাওয়া যাচ্ছে। তখনো লাস ভেগাসের জন্ম হয়নি। আমেরিকার এই অংশ প্রায় পরিত্যক্ত বলা চলে। কঠিন ভূপ্রকৃতি আর অতিরিক্ত গরমের জন্য। কিন্তু সোনার খোঁজে মাছি জুটতে দেরী হল না। মাত্র বছরখানেকে রিওলাইট হয়ে উঠলো আমেরিকার মোস্ট হ্যাপেনিং সিটি। দলে দলে লোক এসে কাজ খুঁজে নিল সোনার খনিতে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল এ মেঘ যতটা গর্জেছে ততটা বর্ষনোপযোগী নয়। নেভাডার এই প্রচন্ড গরমে খনি মজুরদের নাভিশ্বাস উঠলো। আর সোনাও যতখানি পাওয়া যাবে ভাবা গিয়েছিল ততটা মিললো না। ইতিমধ্যে ১৯০৬ এ সান ফ্রানসিসকোর ভূমিকম্পের পর টাকা পয়সার যোগানও কমে গেল। ১৯০৭ এ এলো রিসেশান। শেয়ারের দাম হু হু করে পড়তে লাগলো। সব বিনিয়োগ বন্ধ। কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল একটি অগ্নিকাণ্ড। গণিকাপল্লীর একটি মেয়ের অসাবধানতায় স্টোভ থেকে আগুন লাগলো তার ঘরে। সেখান থেকে আশে পাশের বাড়িগুলোতে। ১৯০৮ এ রিওলাইট ঘোস্ট টাউন হয়ে গেল। পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়ীগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কয়েকটা ছবি তুললাম। তারপর গাড়ী চললো ডেথ ভ্যালির দিকে। গাইডের কাছে একটি বই ছিল রিওলাইটের ওপর। সেখানেই পড়লাম এসব গল্প।


ডেথ ভ্যালিতে ঢুকলেই যেন মৃত্যুর নিস্তব্ধতা ছোঁয়া যায়। এখানে গাছগুলো কেমন অদ্ভুত। গাইড একটি গাছের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো ‘গন্ধ শুঁকে দেখো’। আমি তো নাকে কোন গন্ধই পাচ্ছি না ক’দিন ধরে। কি আর করবো! ক্যাবলা ক্যাবলা হাসি মুখ করে রইলাম – যার অর্থ ‘বাহ কি সুন্দর গন্ধ’ও হতে পারে, আবার ‘কি বিকট’ও হতে পারে। তারপর গাইড বললো ‘এবার হাতে ক’টা পাতা নিয়ে জোরে দু’বার ফুঁ দাও। তারপর গন্ধ শোঁকো’। তাই করলাম। ফুঁ দেওয়ার সাথে সাথে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এলো। বাতাসে আর্দ্রতা অত্যন্ত কম বলে এখানে গাছেরা তাদের পাতার ছিদ্রগুলো বুজিয়ে রাখে। যে মুহুর্তে ফুঁ দিয়েছি গাছটি জলীয় বাষ্পের খোঁজ পেয়েছে আর মুখ খুলে দিয়েছে সেই বাষ্পটুকু টেনে নেওয়ার জন্য। গাছটির নাম Creosote। আরেক রকম গাছ জন্মেছে যত্রতত্র – তার নাম ডেজার্ট হলি – ফিকে সবুজ বা কখনো বা নীলচে ধূসর রঙের পাতা – তাতে রূপোলী আভাস। সবই অন্য রকম। এক সময় বোরাক্সের বড় খনি ছিল এখানে – একখানা গাড়ী এখনো রাখা আছে পার্কে, যাতে করে মালপত্র আদানপ্রদান হত। সব কিছুই সাদা আর ফ্যাকাশে। কোন চেনা গাছপালা নেই। রুক্ষ এবং পাথুরে।

ডেথ ভ্যালির বয়েস খুব বেশী নয়। মাত্র দশ মিলিয়ন বছর। তার আগে এখানে অনেক গুলো লেক ছিল। ফল্ট বরাবর মাটি বসে গিয়ে কিছু অংশ সমুদ্র তলের থেকেও নীচে নেমে গেছে। ব্যাড ওয়াটার বেসিনের খুব নাম শুনেছিলাম। সমুদ্রতল থেকে ৮০ মিটার গভীর সেই বেসিন। ব্যাড ওয়াটার কারন জলে নুনের পরিমান এতো বেশী যে মুখে দেওয়া যায় না। আরেকটা মজার জিনিস হল এই বেসিন যেহেতু তৈরী হয়েছে মাটি বসে গিয়ে তাই বেসিনের মধ্যে যে মাটির ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার বয়েস সব চেয়ে কম। আর যে পাথরের দেওয়াল আমাদের ঘিরে আছে তাদের বয়েস ভূপৃষ্ঠের চেয়ে বেশি। বেশীর ভাগ পাহাড়ী জায়গায় এর উল্টোটা হয়। কারণ পাহাড় সাধারনত তৈরী হয় দুইপাশ থেকে চাপের ফলে মাঝের অংশ উপরে উঠে গিয়ে – যার ফলে সবচেয়ে শেষে তৈরী হওয়া নতুন পাথরের স্তর চলে যায় ওপরে। আর যতো নিচে নামবে পাথর তত পুরোনো হতে থাকে। ব্যাড ওয়াটার বেসিনে এই উলটপুরাণ দেখে আমার বেশ লাগলো।

সমুদ্রতল থেকেও ৮০ মিটার নেমে আসার ফলে গরম ছিল মারাত্মক। গাড়ীর বাইরে বেরোলেই গরম হলকা। যেন কুম্ভীপাক নরকে ঝলসানো হচ্ছে! আমার পাশের সিটের মেরি জ্যেঠিমা তো গাড়ীর মধ্যেই অন্তর্বাস সম্বল হয়ে পোষাক পরিবর্তন করে ফেললেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এমনই চমকে গেলাম যে ‘আ ছি ছি’ করার অবকাশটুকুও পেলাম না!এরই মধ্যে গাইডকাকু গাড়ী ভিড়িয়েছেন ডেভিলস গলফ কোর্সে।দশ মিলিয়ন বছর আগের সেই লেক এখানে শুকিয়ে কাদা হয়ে আছে। আর সেই কাদার গায়ে মাছের আঁশের মত সাদা আস্তরন। একটু ঘসতেই সাদা গুঁড়ো উঠে এল হাতে। মুখে দিয়ে দেখলাম ভীষন নোনতা। লোকে বলে ডেথ ভ্যালির এই অঞ্চলে নাকি সমুদ্রের গন্ধ পাওয়া যায়। আমার তো নাক বন্ধ। গন্ধবিচার দূরঅস্ত। চারিদিকের এই সাদা বর্ণহীনতা আর রুক্ষ কঠিন জমি দেখতে দেখতে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। গাইডকে জিগ্যেস করলাম – ‘আর্টিস্ট প্যালেট যাবেন না?’ গাইড জানালো সেটাই আমাদের পরের স্টপ।

আর্টিস্ট প্যালেট আবার সেই গ্রেট আর্টিস্টের ফেলে যাওয়া ক্যানভাস। এখানে যাওয়ার রাস্তাটা ভারী সুন্দর। উপত্যকার মধ্যে এঁকে বেঁকে উঠে গিয়েছে পথ। একটু ওপরে বলেই বোধহয় সামান্য কিছু সবুজ দেখা যায়। পাথরের চরিত্র যদিও একই রকম। তবু তারই ফাঁকফোকরে ফুটে রয়েছে হলুদ রঙের ডেজার্ট গোল্ড। যতই এগোনো হয় বাদামী পাহাড়ের গায়ে রঙের প্রলেপ লাগে। পথ এসে শেষ হয় একটি পাথুরে ক্যানভাসের সামনে। বেগুনী-গোলাপী-সবুজ-নীলে উজ্জ্বল সেই ক্যানভাস। আমরা আটজন মানুষ সেই রঙের বন্যার সামনে এসে স্তব্ধবাক হয়ে দাঁড়াই। বিশ্বাস করাই কঠিন এই মৃত্যু উপত্যকার মধ্যেও লুকিয়ে আছে এত রঙ!

বেলা ফুরিয়ে আসছিল। দিনের শেষ গন্তব্য ছিল জ্যাব্রাস্কি পয়েন্ট। আবারো সেই ঢেউ খেলানো রাস্তা। এবারে আমরা চলেছি সমুদ্রতলের উপরে। যেখানে এসে ভ্যান থামে সেটা পাহাড়ে ঘেরা একটি ছোট উপত্যকার মত। একটি রাস্তা উঠে গেছে উপরের দিকে। মেরি আমাকে বললেন ‘আমি আর উঠবো না, তুমি আমার ক্যামেরাটা নিয়ে যাও। কয়েকটা ফটো তুলে এনো।’ আমি নিজের আর মেরির ক্যামেরা নিয়ে উঠতে লাগলাম। প্রথম বাঁকটা ঘুরেই যা দেখলাম সেটাই বোধহয় ডেথ ভ্যালির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছবি। এই ছবিটা দেখেই আমি প্রথম ডেথ ভ্যালি যাওয়ার কথা ভাবি। এটা আসলে একটা পাহাড়। সোনালী রঙের পাহাড়। আমি ছবি দেখে ভেবেছিলাম স্যান্ড ডিউনস। ওই সোনালী পাহাড়কে পাশে রেখে যতই এগোতে থাকি ততই যেন একটা ফ্যান্টাসীল্যান্ড আমার সামনে তার পেখম মেলতে থাকে। সোনালী-বাদামী-চকোলেট-সাদা – নিখুঁত কালার কম্বিনেশন। যে কোন ফটোগ্রাফারের স্বপ্ন। আমি আমার আর মেরির ক্যামেরা নিয়ে হ্যাংলার মত গাদা গাদা ফটো তুললাম।

তারপর ফেরার পালা। বেশ ভালোই কাটলো দিনটা। তবে ডেথ ভ্যালিই বোধহয় আমেরিকার এই অঞ্চলে একমাত্র জায়গা যেখানে আমি আবার ফিরে আসতে চাই না। ডেথ ভ্যালি আক্ষরিক ভাবেই মৃত্যু উপত্যকা। আমি রঙ ভালোবাসি। ডেথ ভ্যালি বড় বেশী বর্ণহীন। কাল যাচ্ছি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। সেখানেই সফরের শেষ।

“ঘাটে বসে আছি আনমনা, যেতেছে বহিয়া সুসময়”

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এই নিয়ে তিনবার হল। প্রথমবার এসেছিলাম ২০০২ এ – প্রথম চাকরী, প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। ভূগোলের বইয়ে পড়া দূরের দেশ প্রথমবারের জন্য জ্যান্ত হয়ে ওঠা। সেবারে দুপুর নাগাদ এসে সানসেট দেখে ফিরে যাওয়া হয়েছিল। তিনবছর পরে আবার আসা। সেবারে সানরাইজ। দিনের শেষে ফেরার পথে অ্যা্রিজোনার নির্মেঘ আকাশে সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা। তাই এবারে যখন বাবা-মাকে নিয়ে আবার আসবো ঠিক করলাম তখন ওদের কোনোটা থেকেই বঞ্চিত করতে মন চাইলো না। ঠিক করলাম পার্কের ভেতরে থাকবো। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত তো বটেই, নিশুত রাতের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখারও বড় শখ আমার। পার্কের ভিতরে না থাকলে সে আশা পূর্ণ হবে কেমন করে! সেই হিসেব মত ইয়াভাপাই লজ়ে বুকিং সারা। অতঃপর তিনজনের টিম থেকে দুজন খসে গেল। একা কুম্ভ চলেছি ক্যানিয়ন সফরে।


প্রতিবার পুরী গেলেই প্রথমবার সমুদ্র দেখার অনুভূতিটা বড় উপভোগ করি। [যদিও শেষবার গেছি মাধ্যমিক দিয়ে, এখন গেলে কেমন লাগবে জানি না।] স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে স্বর্গদ্বারে যাওয়ার পথে প্রথমে একটা জায়গায় এসে সমুদ্রের গন্ধ পাওয়া যায়, তারপর আরেকটু গেলে শোনা যায় ঢেউ-এর আওয়াজ। আর তারপরেই রাস্তাটা স্বর্গদ্বারে ঢোকে। মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রে আছড়ে পড়ে চোখের ওপর। এখানেও অনেকটা অমন হল। ম্যাথার পয়েন্টের ইনফরমেশন সেন্টার থেকে রিম ট্রেলের দিকে হাঁটছি। আশেপাশে হাজারটা গাড়ী পার্ক করা, কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে – নেহাতই ভেতো জীবন। তারপর একটা বাঁক ঘুরতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যানিয়ন তার সমস্ত রঙ নিয়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো। যতই চেনা হোক – অনেকদিনের পর প্রথম দেখা সবসময় একই অনুভূতি নিয়ে আসে।

পরের কাজ হল ইয়াভাপাই লজ়ে চেকইন করে মনের সুখে বেরিয়ে পড়া। ছোটোবেলায় একবার বেতলা রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতরে থাকার সুযোগ হয়েছিল। ইয়াভাপাই লজ অনেকটা সেইরকম। গতবছর ইয়েলোস্টোনেও পার্কের ভেতরে কেবিনে ছিলাম। ইয়েলোস্টোনের কেবিনগুলো সব রকমের বাহুল্য বর্জিত – বনের মধ্যে যেভাবে থাকা উচিত ঠিক সেই রকম। ইয়াভাপাই লজ সে হিসেবে বেশ সুখী আদুরে প্রকৃতির। ঘরে ঢুকে জানলার পর্দা সরাতেই দেখি একটি লম্বা সিং-ওয়ালা হরিণ আমার ঘরের সামনেই ঘাস খাচ্ছে। প্রথম বলেই ছক্কা ওঠায় আমি তো দারুন খুশি!

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে পার্কের ভেতরে সবসময় শাটল চলে। বিশেষ করে পশ্চিমপ্রান্তটি মে থেকে সেপ্টেম্বর প্রাইভেট গাড়ীর জন্য বন্ধ রাখা হয়। শাটলই একমাত্র ভরসা। সূর্যাস্ত দেখতে গেলে যেতে হবে ঐ দিকেই আর তার জন্য সেরা জায়গা হল হোপি পয়েন্ট। কিন্তু সেটা যেমন আমি জানি তেমন সারা পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই জানে – যারাই গ্রান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে একবার গুগল করেছে। অতএব যত হাজার লোক আজ গ্রান্ড ক্যানিয়নে হাজির হয়েছে তারা সবাই গিয়ে ভিড় জমাবে সেখানে। আমি তাই ঠিক করলাম পশ্চিমপ্রান্ত অর্থাৎ হারমিট রেস্টের শাটল নিয়ে সবকটা পয়েন্টই ঘুরে দেখবো। তারপর যেটা আমার নিজের পচ্ছন্দ হবে এবং ভিড় কম থাকবে সেখানে বসে পড়বো ক্যামেরা নিয়ে। এইভাবে একে একে হারমিট রেস্ট, মোহাভি, পিমা এবং পাওয়েল পয়েন্ট দেখে আমার পছন্দ হল পাওয়েলকে। আসলে পাওয়েলে এসে রিম ট্রেল থেকে বেরিয়ে একটা নিজস্ব পাথর পেয়ে গেলাম যেখানে বসে পূর্ব আর পশ্চিম – দুই দিকেই অবিশ্রাম ক্যানিয়ন দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমে সূর্য ডুববে আর সেই ঝিমিয়ে আসা সূর্যের আলোয় লাল হবে পুবের পাথর – তবে না ম্যাজিক!

জায়গা খোঁজার উত্তেজনায় খেয়াল হয় নি দুপুরের ঝকঝকে আকাশ মেঘে ছেয়েছে। বজ্রগম্ভীর বৃষ্টির মেঘ নয়, হালকা-পাতলা দুঃখবিলাসী মেঘ। সেই মেঘ এসে আমার সাধের সূর্যাস্ত মাটি করে দিল। এমন নিবিড় হল না যা নিয়ে কাব্যি করতে পারি। আবার এমন হালকাও সে নয় যাকে উপেক্ষা করে আলোছায়ার লুকোচুরি চলতে পারে ক্যানিয়নের বুকে। আমি আমার পাথরটির ওপর বসে এই নিস্ফলা মেঘের কুম্ভিরাশ্রু দেখে গেলাম। ক্যানিয়নের আনাচে কানাচে ছায়া ঘনিয়ে এলো। সূর্যটি ঘামে ভেজা কপালে গলা সিঁদুরের টিপের মত পাহাড়ের ওদিকে ডুবে গেল। ঘরে ফেরার বাস ধরলাম।


“আমি আদতে আনাড়ী”

এরপরে যেটা হল সেটা বোধহয় লেখা উচিত ছিল আগের অধ্যায়ে। যাই হোক এখানেই লিখি। সানসেট দেখে হোটেলে ফেরার শাটলে উঠেছি হঠাত শুনি কে আমাকে ডাকছে। এখানে সেটা একান্তই অসম্ভব ভেবে ইগনোর করতে গিয়ে দেখতে পেলাম জেসি-কে। জেসি হল একটি পুয়ের্টোরিকান মেয়ে যে কাল আমার সাথে ডেথ ভ্যালি ট্যুর নিয়েছিল। সে মেয়ে যে আজই গ্রান্ড ক্যানিয়নে আসবে তা কে ভেবেছিল! তাও আবার দেখা হবে একই বাসে! ও সানসেট দেখে ফিরছে হোপি পয়েন্ট থেকে। আমরা দুজনেই দুজনকে দেখে দারুন অবাক। তবে অবাক হওয়ার আরো বাকি ছিল। বললে কি কেউ বিশ্বাস করবে জেসিও ইয়াভাপাই লজে উঠেছে; আমার রুম নাম্বার ৭২৫৭ আর জেসির ৭২৫৮! ঘটনাটা হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু আমার যাকে বলে বিস্ময়ে প্রাণ জেগে উঠলো  আমরা ঠিক করে নিলাম পরের দিন একসাথে সানরাইজ দেখতে যাবো। আমি আমার সন্ধ্যার তারা দেখার প্রোগ্রামেও জেসিকে নেমন্তন্ন করলাম। কিন্তু ও তাতে খুব একটা আগ্রহী হল না। অতএব ঠিক করলাম ডিনার সেরে আমি একাই রাতের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এক্সপ্লোর করতে বেরোবো।

আমার দ্বিতীয়বার গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন আসা ২০০৫ এ। সে বারে ছিলাম আমি, শুভ আর শুভ’র বন্ধু সান্যাল। ফ্ল্যাগস্টাফ থেকে শেষরাতে বেরোনো হয়েছিল সানরাইজ দেখা হবে বলে। আমাদের সেবারের ট্রিপে আমাদের সাথে শুধু দু’টি সিডি ছিল। চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’ আর ‘গাধা’। সারা রাস্তা আমরা ওই দু’টো সিডিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুনেছিলাম। আর লজ্জার কথা কি বলবো তার আগে আমি কখনো চন্দ্রবিন্দু শুনিনি। মনে পড়ে ফ্ল্যাগস্টাফ থেকে গ্রান্ড ক্যানিয়নের পথে গাড়ী ছুটছে – আমি পেছনের সিটে – সামনে ওরা কি কথা বলছে কিচ্ছু শুনিনি, তখন তো অনিন্দ্য গাইছে “আমি পাই না ছুঁতে তোমায়, আমার একলা লাগে ভারী”। অ্যা্রিজোনার নিষ্পাপ আকাশ, পেছনের সিটে আধশোয়া আমি সপ্তর্ষিমন্ডলের শেষ দুটি তারা দেখতে পাচ্ছি। অনিন্দ্যকে কেউ মস্ত গায়ক বলবে না কোনদিন। কিন্তু কি জানি কি ছিল সেদিন ঐ ঝলমলে দুটি তারায় – পৃথিবীর সব মানুষের সব ছুঁতে না পারার অভিমান সেখানে গিয়ে মিশছিল। “ভিনদেশী তারা” যেখানেই শুনি না কেন, দুনিয়ার যে প্রান্তেই – আমার চোখে ভাসে অ্যা্রিজোনার আকাশ। গ্রাণ্ড ক্যানিয়নে রাতে থাকার পেছনে এটা একটা বড় কারন।

সব আলো নিভিয়ে দিলে, এমন কি চাঁদও না থাকলে রাতের আকাশ কেমন দেখায় তা আমি প্রথম জানি শিমুলতলাতে গিয়ে। ছোটোবেলাতে তো প্রতি বছরই প্রায় পুজোর সময় শিমুলতলা যাওয়া হত। আমরা দুই ভাইবোন যদিও একটুও যেতে চাইতাম না। কেনই বা চাইবো! পুজোর সময় নতুন জামা, ঠাকুর দেখা, ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে যেতে হবে শিমুলতলায়! যেখানে ইলেক্ট্রিসিটিও নেই! যেতে হবে অষ্টমীর দিন, ফেরা সেই কালীপুজো পার করে। আমরা দু’জনে তীব্র প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তখনো ছোটোদের ইচ্ছেকে পাত্তা দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়নি। মিলু মুখে গজগজ করতো বটে, কিন্তু আজ বুঝতে পারি তারও দিব্যি লাগতো ওই একমাস ইলেকট্রিকের বদলে চাঁদের আলোতে ঘরকন্না করতে :) সন্ধ্যেবেলা অনিলের দোকান থেকে শালপাতার ঠোঙায় গরম রসগোল্লা খেয়ে ফেরার পথে আমার ভাই গুলুরাম পায়ে ব্যাথার অভিনয় করে তীব্র কান্না জুড়ে রাস্তার ওপর বসে পড়তো। কিন্তু শিমূলতলায় রিকশা কোথায়! আর আট বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ী ফিরবে – প্রদীপবাবুর এতখানি স্নেহপ্রাবল্য কোনোকালেই ছিল না। অগত্যা গুলুরামকে রাগে গনগন করতে করতে হেঁটেই ফিরতে হত। আর ওরই মাঝে আমি কোন কোন দিন লক্ষ করে ফেলতাম জ্যোতস্নায় ভেসে যাচ্ছে ছোটনাগপুরের মালভূমি। কৃষ্ণপক্ষ তখন। আকাশে চাঁদ নেই। কোটি কোটি অগুন্তি তারাদের থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে অপূর্ব এক আলো। সেই প্রথম বুঝেছিলাম জ্যোতস্নার মানে। আর আজও দেখা-অদেখায় আমার পিছু ছাড়ে না সেই তারাভরা আকাশ। শিমূলতলা অনিবার্য ভাবে ফিরে আসে আমার প্রতিটি লেখায়। প্রদীপ-বাবু এ লেখা পড়ে নির্ঘাত মনে মনে হাসবেন আর ভাববেন – “তোমাকে ভাবাবোই ভাবাবো, সে তুমি মুখ যাই বলো না/ তোমাকে পথে আমি নামাবো, যতই ঘরে বসে থাকো না” :)

এই ভিনদেশী আকাশে সেই চেনা তারাগুলোকে খুঁজে বার করতে আমি ডিনার সেরে পৌঁছে গেলাম ইয়াভাপাই অবজারভেশন পয়েন্টে – আমার হোটেল থেকে খুব দূরে নয়। রাস্তায় সামান্য যা আলো তা অন্ধকার দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। যেখান থেকে রিম ট্রেল শুরু হয়েছে সেখানে সেটুকুও বন্ধ। টর্চের আলোতে পথ হাঁটলাম কিছুটা। আমি ভেবেছিলাম আরো অনেকেই হয়তো আকাশ দেখতে বেরোবে। কিন্তু ট্রেলে জনপ্রানী নেই। সামনে যেটাকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলে জানি সেখানে নিরেট নিকষ অন্ধকার। অপর পারে নর্থ রিমে হাল্কা একটা আলোর আভাষ। আর অনেক নিচে – সম্ভবত কলোরাডো নদীর পাশে যে ক্যাম্পগ্রাউন্ডগুলো আছে সেখানে একটা আবছা আলো। মাথার ওপরে আকাশে সেই ন্যাকা মেঘ তখনো মায়া কান্না কাঁদছে। আর মেঘের পাতলা পর্দার ওপারে দেখা যাচ্ছে কোটি কোটি তারা। তাদের দেখাচ্ছে বহু ব্যবহৃত চিমনির ভেতরে লুকিয়ে থাকা টিমটিমে শিখার মত। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। এই জুন মাসের গরমে ফ্লিস জ্যাকেটের তলাতেও কেঁপে উঠছি। ক্যানিয়নের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে উঠে আসা সেই হাওয়ার দাপটে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। অথচ দিনের বেলা এ আওয়াজ শুনতেই পাই নি।

প্রথম পাঁচ মিনিট বেশ কাটলো। আমার চেনা আকাশকে যদিও খুঁজে পেলাম না এ’রাতের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে! যেন কেমন অপার্থিব বহু দূরের জিনিস এসব। দূরের জিনিস তো বটেই। কিন্তু সেভাবে তো কখনো ভাবি নি! তারপর একটার পর একটা মুহুর্ত যায় – ওই সীসের মত অন্ধকার, ঘসা কাঁচের মত তারার দল আর সর্বোপরি কলোরাডো নদীর বুক থেকে উঠে আসা সেই উত্তাল হাওয়া আমার ওপর চেপে বসতে থাকে। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই, তবে ভয় আছে সাড়ে ষোলোআনা ;) আর শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আমি একটু ইয়ে টাইপের কল্পনাপ্রবণ। তাই জনপ্রানীহীন বিদ্যুতহীন ইয়াভাপাই ট্রেলে আমার যদি মনে হয় এই বুড়ো ক্যানিয়ন তার ছয় মিলিয়ন বছরের সুখ-দুঃখের গপ্পো আমার সাথে ফাঁদতে চাইছে আর সেই চিন্তায় আমি যদি কিঞ্চিত বিব্রত হয়ে পড়ি তাহলে খুব বেশী দোষ দেওয়া যায় কি? “কেটে পড়ি, ভেগে পড়ি চুপি চুপি রে” গাইতে গাইতে রাস্তার দিকে সরে এলাম। এসে দাঁড়ালাম ল্যাম্পপোস্টের নিচে। কি মনে হতে সেলফোনটা বার করে দেখি জ্বলজ্বল করছে সিগন্যাল। ব্যাস! ধড়ে প্রাণ এলো। ৯১১ থাকতে ডরাই কাকে! সেই মুহুর্তে শাটল বাসও দেখা দিল একটা। আমার তারাবাজির এখানেই ইতি।


“বিশ্ব হৃদয় হতে ধাওয়া আলোয় পাগল প্রভাত হাওয়া”


রাতের বীরত্ব প্রদর্শনের পর জেসি যদি না থাকতো আমার কিছুতেই সাহস হত না পরের দিন ভোর চারটেয় সানরাইজ দেখতে যাওয়ার। তবে আমি কিনা ভারী লক্ষ্মী মেয়ে। তাই আমার রাস্তায় বেরোলেই একজন মধুসূদন-দাদা জুটে যায়। জেসিকে যে পাওয়া যাবে সে তো আগেই জানতাম!

জেসি আমার দরজায় নক করলো যখন তখন বাজে পৌনে চারটে। আমি অবশ্য দুটো সতেরো থেকেই জেগে বসে আছি আর “যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে, আমার ঘুম নিয়ো গো হরন করে” জাতীয় আঙুর ফল টক গান সহযোগে প্রকৃতির শোভা নিরীক্ষণ করছি। জেসি আসতেই বেরিয়ে পড়া গেল। সাথে আমার থেকেও বীরাঙ্গনা আমার নিভু নিভু টর্চ।

সানরাইজ দেখতে যাওয়া হবে ম্যাথার পয়েন্টে। কিন্তু ম্যাথার পয়েন্টে কনস্ট্রাকশনের কমলা দড়ির পাকে যাবতীয় ডিরেকশন গেল ঘেঁটে। আমরা ম্যাথারের আশা ছেড়ে রিম ট্রেল ধরে হাঁটতে থাকলাম। দিগন্তে তখন হাল্কা নীলচে আভা। সেই নাছোড় মেঘ পাত্তা না পেয়ে অনেকটাই পিছু হটেছে। আকাশে আধখানা বেগুন ভাজার মত চাঁদ আর তাকে ঘিরে থাকা তারারা সবে বুঝতে শুরু করেছে তাদের নিভে যাওয়ার সময় হয়ে এল। আমি রিম ট্রেলের ওপর একটা পাথর খুঁজে পেলাম যেটা ক্যানিয়নের ওপর আধা বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে এবং তার ফলে পূর্ব-পশ্চিম দুই দিকই নাগালের মধ্যে। জেসিকে সে পাথর দেখাতে সে বলে “না ভাই, আমার আজ জন্মদিন। আর আমার মা আমাকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে এসে আমি বিপজ্জনক কিছু করবো না”। আমি ভেবে দেখলাম মিলু স্পেসিফিকালি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে আমাকে কোন নির্দেশ দেয় নি। আর তাছাড়া আমার আজ জন্মদিনও নয়। তাই আমি ওই পাথরের দিকে পা বাড়ালাম এবং যুগপত হর্ষ ও বিষাদে লক্ষ করলাম আমি যেখানে যেতে চাইছি সেই পাথরটিতে যাওয়ার জন্য আরো কিছু ছোটো পাথরের টুকরো দিয়ে সিঁড়ির মত সাজানো আছে। তারমানে আমিই পাথরের আবিষ্কর্তা নই। আর পাথরটা তেমন বিপজ্জনকও নয়। জেসিকে এই সংবাদ দিতে সেও তরতর করে নেমে এলো।

মেঘ অনেকটাই সরেছিল, তবে আকাশ সম্পূর্ণ পরিস্কার ছিল না। তাই পাঁচ বছর আগে দেখা সেই অবর্ণনীয় বর্ণচ্ছটা এবারে দেখা হল না। তবে যা দেখলাম তাও ভারী সুন্দর। পাথরের ওপর বসে আছি পুব দিকে মুখ করে। ঠান্ডা তাজা বাতাসে সব ক্লান্তি, সব বিষাদ ধুয়ে যায়। তারপর সূর্যের প্রথম আলোটি এসে ক্যানিয়নের দেওয়ালে পড়ে, আমার কপাল ছোঁয়। “কি আনন্দ, কি আনন্দ, কি আনন্দ!” – এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু কি হয় পৃথিবীতে! ধীরে ধীরে গোটা ক্যানিয়ন আলোতে ভরে যায়। হাল্কা মেঘ তখনো ছিল, কুয়াশা ছিল পাথরের দেওয়ালের কোণায় কোণায়। লাল-কমলা-সোনালী-হলুদের বিবর্তন তাই ধরা পড়লো না। তবে আলো পেলো সকলেই। ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো দিন। ভোরের এই প্রথম আলোটুকু বড় ভালো লাগে – যখন যেভাবেই দেখি না কেন। “জনম অবধি হাম এ রূপ নেহারিলুঁ, নয়ন না তিরপিত ভেল”।

আমার মুখে কাল রাতের ঘটনা শুনে জেসির ইচ্ছে হল সেও ইয়াভাপাই পয়েন্ট দেখবে। সানরাইজ দেখে আমরা তাই চললাম সেইদিকে। দিনের আলোতে কাল রাতের সেই রহস্যময়তা একবারে উধাও। এখান থেকে ক্যানিয়নের প্যানারোমিক ভিউ ভারী সুন্দর। এখানেও আসা যেতো আজ সকালে। আমরা যখন গেলাম তখন বিশেষ কেউ ছিল না। একটা নীল পাখি চিড়িক চিড়িক করে ভোরের নিস্তব্ধতায় আঁচড় বসাচ্ছিল। ক্যামেরা তাক করার আগেই সে উড়ে পালালো। জেসি গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন ছাড়বে সাড়ে সাতটা নাগাদ। আমরা তাই ব্রেকফাস্টের আশায় হোটেলমুখো হলাম। আমার হাতে অবশ্য রয়েছে সারাটা দিন। ব্রেকফাস্ট সেরে আমি ফিরবো এখানেই – একটা রেঞ্জার প্রোগ্রাম শুনতে।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে সারা বছর প্রতিটা দিনই কিছু বিশেষ সময়ে পার্কের রেঞ্জাররা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সম্পর্কে আলোচনা করেন। এর জন্যে আলাদা টিকিট কাটতে হয় না। যে কেউ শুনতে পারে। কাল সন্ধ্যাতেও নাইট স্কাই নিয়ে একটা প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু স্লাইড শো তো যে কোন জায়গাতেই দেখা যায়, তার চেয়ে নিজের চোখে দেখি – এই ভেবে আমি সেখানে যাইনি। আজ সকালে ইয়াভাপাই পয়েন্টে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন কি ভাবে তৈরী হল তা নিয়ে একটা ৩০ মিনিটের ক্লাস হবে। যদিও সে গল্পও গুগল করলেই পাওয়া যায় তাও আমি চললাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বুকে বসে তার জন্মকথা শুনবো বলে। সে কথা অবশ্য আমি এখানে লিখবো না, কারন যা শুনলাম সে তো গুগলেই পাওয়া যায়। তবে রেঞ্জার মেয়েটি পৃথিবীকে peanut m&m এর সাথে তুলনা করলো। ওপরে চকোলেটের আস্তরন, মধ্যিখানে পিনাট। এই উপমাটা বেশ মনে ধরেছে।


বিকেল বেলা ভিড়ের ভয়ে হোপি পয়েন্ট যাইনি। সকালে ফাঁকায় ফাঁকায় সেখানে ঘুরে আসার শখ হল। হোপির সৌন্দর্য শুধু হোপিতেই আছে। ক্যানিয়নের এমন প্রশস্ত রূপ আর কোন জায়গা থেকেই দেখা যায় না। গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন যে কতো বিশাল তা অনুভব করতে হোপিতে আসতেই হবে। অনেক নিচে দেখায় যায় নীল রঙের কলোরাডো নদী। হুভার ড্যাম তৈরী হওয়ার আগে কলোরাডো নাকি এমন নীল ছিল না। লোকে নাকি কলোরাডোর লালচে কর্দমাক্ত জলকে বলতো – too thin to plow, too thick to drink. প্রাক উনিশো তিরিশ যুগের সেই লাল কলোরাডোর ছবি ইয়াভাপাই জিওলজিকাল মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যায়। হুভার ড্যাম তৈরী হওয়ার পর সেটা ছাঁকনীর কাজ করে লাল কলোরাডোকে নীল করে দিয়েছে। এইটুকু সরু একটা নদী কিভাবে এই বিশাল ক্যানিয়ন তৈরী করলো তা ভেবে অবাক হতে হয়। সময় লেগেছে যদিও ছয় মিলিয়ন বছর, তবে জিওলজিকাল ক্লকে সে তো তুচ্ছ। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরতা প্রায় এক মাইল। তবে আসল ক্যানিয়নের উচ্চতা নাকি এর দ্বিগুন ছিল। ওপরের অংশ ক্ষয়ে গিয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে এই বাকি অর্ধেক। কি করে জানা গেল? ভারী সোজা। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে কোন ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যায় নি। অথচ এই ক্যানিয়ন তো তৈরী হয়েছে মোটে ছয় মিলিয়ন বছর আগে। জুরাসিক যুগের বয়স সেখানে ষাট মিলিয়নেরও বেশী। সেই সময়ে আমেরিকার এই অঞ্চলে দাপিয়ে রাজত্ব করেছে ডাইনোসরের দল। তার কিছু নিদর্শন আমি নিজেও দেখেছি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে সামান্য দূরে পেট্রিফায়েড ফরেস্টে। তাহলে তাদের জীবাশ্মসহ গ্রান্ড ক্যানিয়নের নতুন পাথরের স্তর গেলো কোথায় আর কিভাবেই বা গেলো? কলোরাডো নদীই বা এমন গভীর খাত বানালো কি করে? এর উত্তর নিয়ে জিওলজিস্টরা এখনো একমত নন।

গ্রান্ড ক্যানিয়নের পূর্বপ্রান্তে এর আগে কখনো যাইনি। খুব বেশী লোকে এদিকে আসেও না। হাতে ঘন্টাখানেক সময় ছিল। ভাবলাম ইয়াকি পয়েন্ট দেখেই আসি। এদিকে সবুজের ভাগ একটু বেশী মনে হল। শীতের শুরুতে এখানে নাকি অনেক পাখী দেখা যায়। কাইবাব ট্রেইলহুডের যে চওড়া পাথরের দেওয়ালটা ক্যানিয়নের পুবদিকের কিছুটা আড়াল করে রাখে, ইয়াকি পয়েন্ট তাকেও পেছনে ফেলে আরো খানিকটা পূর্বে। ইয়াকি পয়েন্টে এসে দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না। শুধুই লাল পাথরের ভাঙাগড়া আর জেদী কলোরাডোর মহিমা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছিল। আমি ফেরার পথ ধরলাম। চেক আউট করাই ছিল। লকার থেকে লাগেজ তোলাটাই যা বাকি।


“আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে”

উপসংহার লেখা ভারী কঠিন কাজ। গুলুরাম বাংলা রচনা শেষ করতে হলেই ‘তাই তো কবি বলেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি’ বলে টেক্সটের পদ্য সংকলন থেকে একটা যে কোন কবিতার লাইন গুঁজে দিত। কিন্ত আমি পড়েছি মহা সমস্যায়। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে কোন বাঙালী কবি পদ্য রচনা করে যান নি। এমন কি মহাকবি বৈকুণ্ঠ মল্লিকও নয়। তাহলে উপায়?

কবি কহিপ্তাশা অবশ্য লিখেছিলেন – “এবম্বিধ দুকুলপ্লাবী দিনে খেলার শেষে ঘরে ফেরার পালা / অনেকে ছিল ঝলমলানো খুশী, অনেকে ছিল অন্ধকারে চুপ”। কিন্তু আমার যাত্রা যে শেষ হল এক আশ্চর্য গোধূলীতে এসে। শুধু আলো বা শুধুই অন্ধকারের দায় তো আমি নিতে পারি না! তাহলে সেই গোধূলীর গল্পেই শেষ হোক এই কাহিনী।

গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন থেকে ফিরছি লাস ভেগাসে। পরের দিন বাড়ি ফেরা। ফেরার পথে সেই বহুকাঙ্খিত সূর্যাস্ত নামলো। তীব্র হলুদ সূর্য গড়াতে গড়াতে এসে থামলো রকির ঢেউ খেলানো কাঁধে। খাপছাড়া সবুজ উপত্যকা হলুদ আলো মেখে যেন ভিনসেন্টের ছবি। হুভার ড্যাম পেরিয়ে গেলো। আকাশ ভরা কমলা আর নীলের চালচিত্রে ব্ল্যাক ক্যানিয়নের শিল্যুয়েট নিথর রাত্রির মত দাঁড়িয়ে আছে। একে একে তারা ফুটছে। তাদের একটি আমার বড় চেনা। আমার সন্ধ্যাতারা। বাকি পথটুকু সে আমার আমার সাথেই হাঁটলো। আর এভাবেই চলতে থাকলো আমার যাত্রা শুরু অথবা যাত্রা শেষের গল্প।