“বেঁচেই যদি থাকি, চেংলি পাহাড় দেখতে কেন বাকি!”
কথা ছিল গরমের ছুটিতে বাবা-মা আসবে আমার কাছে। তারপর একসাথে বেড়াতে যাবো। কিন্তু ঠাকুমা অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে প্ল্যান বাতিল হল। ততদিনে এদিকের সব টিকিট কাটা হয়ে গেছে। ভাবলাম ধুত্তেরি বলে সবকিছু ক্যানসেল করে দিই। কিন্তু একটার পর একটা ‘ভাল্লাগে না’ জমা হতে হতে এমন আকাশঢাকা দেওয়াল তুললো যে শেষ পারানীর কড়ি ‘তার’ দিকে চোখ ফেরানো ছাড়া আর উপায় কি। এমন বন্ধু আর কে আছে তোমার মত সিস্টার! তাই চলেছি তার কাছেই। ‘তালুক তুলুক মালুক মুলুক যত, চেংলি পাহাড়, গুম্ফি আরো কত’ – সব তো দেখতে হবে, নাকি? কে জানে কবে মানুষ নিভে যায়। হয়তো গিয়ে পৌঁছবো লুব্ধক নক্ষত্রের আশে পাশে। যদি আর ফেরা না হয়!!
দিনের শুরুটা ছিল মেঘলা। শেষ রাতে ঘুম ভেঙে উঠে একটি তারাকেও দেখতে পেলাম না। এমন দিনে অকারনেই মেজাজ থাকে বাসী ডোনাটের মত। মন নাহি মোর কিছুতেই, নাহি কিছুতেই! ভোর ছ’টায় ফ্লাইট। চেক-ইন করতে গিয়েও বিপত্তি। কানেক্টিং ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস বার করতে পারলাম না। সিট পছন্দ করতে পারলাম না। প্যাঁচা মুখ নিয়ে এয়ারপোর্টে বসে আছি। ঠিক এমন সময় সূর্য উঠলো। কালো মেয়ের কপালে লাল টিপের মত জ্বলজ্বলে নিখুঁত নিটোল সূর্য। সেটা দেখেই এমন খুশী হয়ে গেলাম যে জানলার ধারে সিট পেয়েও সহযাত্রীকে সেটা ছেড়ে দিতে একটুও দোনামোনা করলাম না।
পরের ফ্লাইটে অবশ্য বসেছিলাম জানলার ধারেই। কতবার আকাশে উড়েছি। তবু জানলার ধারে বসতে পেলে এখনো অদ্ভুত চাঞ্চল্য লাগে। বিশেষ করে চলেছি যখন আমার প্রিয়তম ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে। পায়ের তলায় ভুবনজোড়া ক্যালভাসে লাল, কালো আর হলুদের বন্যা। কে জানে কোন পাগলে এঁকেছে এ ছবি! দূর থেকে ক্যানিয়নগুলোকে মনে হচ্ছে থাক থাক কোঁকড়া চুলের ঢেউএর মত। তাদের মাঝখানে সরু নীল ফিতের মত কলোরাডো নদী। প্লেন যখন গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমে বাঁক নেয় মেঘলা আকাশের নীচে কমলা পাথরের সেই ভাস্কর্যকে দেখে চোখ ফেরাতে পারি না। নয় নয় করে খুব কমও তো দেখিনি এই পৃথিবীর। কিন্তু সূর্যের আঁচে লাল এই রূক্ষ পাথরের থেকেও সম্মোহক কিছু চোখে পড়েনি আজ পর্যন্ত। যেন জীবনের মতই সাধারন ও নাটকীয়তাহীন, আবার জীবনের মতই নির্মম, জীবনের মতই অপ্রত্যাশিত সুন্দর। লেক মিডের ওপর দিয়ে যেতে যেতে বেশ ক’টা এয়ার পকেট পড়লো। প্রতিটা পকেট এক একটা লাফে নিয়ে যাচ্ছিল রকির আরো কাছাকাছি। অনেক উঁচু থেকে যা শুধুই ঢেউ খেলানো পেশীর বিস্তার মনে হচ্ছিল, কাছে গেলে চোখে পড়ে তার মধ্যেও কত ভাঙাগড়া। মাটি আর জলের লড়াইয়ে কখনো জিতেছে মাটি, কখনো পথ করে দিতে হয়েছে জলকে। আর এই খেলা চলছে আজও। এভাবেই একটা রবারের বলের মত ড্রপ খেতে খেতে আমরা লাস ভেগাসের মাটি ছুঁলাম।
“হোরি খেলত নন্দলাল”
লাস ভেগাস আমার বিচ্ছিরি লাগে। এখানে সবকিছুই বড্ড চকচকে, বড্ড চড়া। আর সত্যি বলতে কি ক্যাসিনোগুলোকে একটু ভয়ই পাই। ভেতরের মেঠো ক্যাবলাকার্তিকটি বেরিয়ে আসে। কিন্তু বাবা-মার ইচ্ছে ছিল লাস ভেগাস দেখবে। তাই লাস ভেগাসকে ইটিনিরারিতে রাখতেই হয়েছিল। যদিও আমি জানতাম ওদেরও ভালো লাগবে না। আমারই তো বাপ-মা! সেজন্যই স্টেট পার্কস নিয়ার লাস ভেগাস লিখে গুগুলে সার্চ দিয়েছিলাম। ক্যাসিনোর প্রাথমিক চমকটা কেটে গেলে যাতে ওদের সেখানে ঘুরিয়ে আনতে পারি। ইমেজ সার্চে যে ছবিটি সবচেয়ে নজর কেড়েছিল তা ছিল একটি সর্পিল রাস্তা – সেই রাস্তা চলেছে রামধনু রঙের পাথরের মধ্যে দিয়ে। কথার কথা নয়। সত্যিকারের রামধনু রঙ। লাল-হলুদ-কমলা-ম্যাজেন্টা-গোলাপী পাথর। তাদের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ বুনো ঘাসের ঝোপ। আর মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। সে জায়গার নাম ভ্যালি অফ ফায়ার। লাস ভেগাস থেকে মোটে পঞ্চাশ মাইল। এটি নাকি নেভাডার প্রথম স্টেট পার্ক। ছবি দেখেই বড্ড ভালো লেগেছিল। আজ নিজের চোখে যা দেখলাম তার তো তুলনাই নেই। খালি আফসোস এই – যাদের দেখাবো ভেবেছিলাম তাদের দেখানো হল না। আর তাদের জন্যই আমাকে আরো দু’রাত লাস ভেগাসের উপদ্রব সহ্য করতে হবে :(
পার্কটা মূলত লাল স্যান্ডস্টোনে ভর্তি। সেই নরম স্যান্ডস্টোনের ওপর কোটি কোটি বছর ধরে বৃষ্টির জল যে ভাস্কর্য তৈরী করেছে তারই নাম ভ্যালি অফ ফায়ার। মৌচাকের মত রাশি রাশি গর্ত তৈরী হয়েছে পাথরের গায়ে। কোন কোন গর্ত রীতিমত গভীর – গুহাই বলা চলে। তাদের মধ্যে নাকি মাউন্টেন লায়ন থাকে। কোন গুহার মধ্যে নাকি জল জমে স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাকমাইটও তৈরী হয়েছে। আমি যদিও দেখিনি। লাল পাথরের বুকে এই পূর্ণ বা অর্ধসমাপ্ত গুহাগুলো দেখে ইজিপ্টের ভ্যালি অফ কিংসে রাজ পরিবারের সমাধিস্থলের কথা মনে আসছিল। সেগুলি অবশ্য মানুষের তৈরী।
একটি পাথর আছে এখানে যেটি খুব বিখ্যাত। ভ্যালি অফ ফায়ার দিয়ে সার্চ করলেই ছবি দেখা যায়। তার নাম এলিফ্যান্ট রক। পাথরটিকে দেখতে সত্যিই সেই প্রাচীন যুগের খুব লম্বা শুঁড়ওয়ালা ম্যামথের মত। আরেকটি পাথরও ছিল খুব বিখ্যাত – তার নাম আর্চ রক – প্রকৃতির তৈরী একটি নিখুঁত আর্চ। ‘ছিল’ বললাম কারন দিন তিনেক আগে সেটি ভেঙে গেছে। কোন মানুষ ভাঙেনি। প্রকৃতিই নিজের খেয়ালে ভেঙে দিয়েছে। হয়তো আরেকটা গড়বে বলে!
১৯৩৫ সালে ভ্যালি অফ ফায়ার যখন প্রথম স্টেট পার্কের মর্যাদা পায় তার ক’বছর পরেই এখানে পার্কের ভিতর থাকার জন্য কয়েকটা কেবিন বানানো হয়েছিল যেগুলি এখন পরিত্যক্ত। কেবিনগুলো দেখতে বেশ। প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে লাল পাথরের কেবিন। ভেতরে একটুকরো ফায়ার প্লেস যেটা এখন সাপের আড্ডা। কেবিনের পেছনে সামান্য একটু হাইক করলেই দেখা যাবে এই এলাকার প্রাচীনতম বাসিন্দাদের আঁকা ছবি। আমি দেখতে পেলাম একটা স্প্রিং-এর মত গোল্লা, কিছু নাচিয়ে মানুষ, একটা হরিণ। দু’হাজার বছর আগে কে জানে কোন মানুষ কিসের খেয়ালে এই ছবি এঁকেছিল! শিকার করে ভারী আনন্দ হয়েছিল বুঝি তার! আগুন জ্বালিয়ে সেদিন রাতে খুব নাচ নেচেছিল বুঝি!!
কিন্তু যে ছবি দেখবো বলে আসা সে তো এই দু’হাজার বছরের আঁকিবুকির থেকেও অনেক অনেক প্রাচীন। একটা গোটা রাস্তা – যার দুদিকে শুধু রঙ। সেই স্বপ্নের মত রাস্তাও এল অবশেষে। পথটির নাম রেইনবো ভিস্তা। প্রকৃতি নামের ছিটিয়াল মেয়েমানুষটি যে রঙ পেয়েছে উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে এখানে। স্যান্ডস্টোনের সাথে নানা মিনারেলের ভেজাল মিশে তৈরী হয়েছে এই পাগলাটে কালার প্যালেট। পাগলাটে ছাড়া আর কিই বা বলি এই মাত্রাছাড়া রঙকে! এর ছবি কাউকে দেখালে সে নির্ঘাত বলবে আমি ফটোশপে রঙ করেছি। অথচ এই রঙ নিখাদ সত্যি। এই ম্যাজেন্টা, কমলা আর গোলাপী – আর সবের ওপর এলোপাথাড়ী ইয়েলো অকার – ভিনসেণ্টের মত পাগল হলুদ!
হোরীখেলার শেষে লাস ভেগাসে ফেরা। আমি আছি ইমপিরিয়াল প্যালেসে। এদের কোরিয়ান রেস্তোরাঁ জিনসেং-এ সিফুড স্ট্যু দিয়ে ডিনার সেরে এখন ঘরে। ব্লুমিংটনের ভ্যাপসা গরম আর আমার বিকল এসির সৌজন্যে গলাটা বসাই ছিল। আজকের পঁচানব্বই ডিগ্রী উষ্ণতা তাতে আরেকটু ইন্ধন জুগিয়েছে। তবে আমি কিনা ভারী সাবধানী মেয়ে। তাই জ্বরের ওষুধ সাথেই এনেছি। আপাতত দুখানা নাইকুইল মেরে শুয়ে পড়ছি। কাল ডেথ ভ্যালি।
"হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনখানে”
ডেথ ভ্যালির সাথে আমার সখ্যতা বেশ কিছুদিনের। গত শীতে যখন বাড়ীতে সারপ্রাইজ ভিজিট দিলাম তখন ওদের বলেছিলাম ডেথ ভ্যালি যাচ্ছি। একদম বিনাকারনে মিথ্যা বলেছি ভাববেন না। কারনটি আমার মা-জননী। একদিন ফোন না পেলেই মিলু আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অথচ বাড়ী যেতে স্টপ ওভার মিলিয়ে মিনিমাম সাতাশ ঘন্টা তো সময় লাগবেই। এর মধ্যে ফোন করবো কি করে! তাই মিলুকে বলেছিলাম ডেথ ভ্যালি যাচ্ছি দু’দিনের জন্য। আর ওখানে যেহেতু ফোনের সিগনাল থাকে না তাই ফোন করার তো প্রশ্নই নেই। তারপর যখন ডেথ ভ্যালির ভ্রমণকাহিনীর বদলে এই মূর্তিমান বাড়ী গিয়ে পৌঁছোলো তখন ওদের কি অবস্থা হয়েছিল সে তো অন্য গল্প, কিন্তু সমস্যা হল এইবারে ডেথ ভ্যালিতে ট্যুর বুক করাতে মিলু খামোখা সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়লো। রাখালের পালে বাঘ পড়লে যা হয় আর কি! তবে কি আর করা যাবে! রাখালেরা কবেই বা বাঘের ভয়ে গোপাল হয়েছে! অতএব মিলুর অদৃষ্টকে দুষে আমি চললাম ডেথ ভ্যালি দর্শনে।
ডেথ ভ্যালি নামটা শুনে যতটা রোম্যান্টিক লাগে আদতে জায়গাটা মোটেই তেমন নীলাঞ্জনঘন শ্যামসুন্দর নয়। ডেথ ভ্যালি গত বছরেও দুটি প্রান নিয়েছে। এক মহিলা ডেথ ভ্যালি গেছিলেন ছেলেকে নিয়ে, সাথে ছিল পোষা কুকুরটিও। পার্কের মধ্যে একবার টায়ার খারাপ হয়। মহিলার কাছে বাড়তি টায়ার ছিল না। তবে আরেকটি গাড়ী কিছুক্ষণ পরেই সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তারা তাদের বাড়তি টায়ারটি মহিলাকে দেয়। নতুন টায়ার লাগিয়ে মহিলা এবার চলে যান ডেথ ভ্যালির একটি অল্প পরিচিত ট্রেলে। সেই রাস্তার মাঝপথে আবার টায়ার খারাপ হয়। এবারে আর কোন গাড়ী আসে না। ঘটনার দু’দিন পরে পার্কের রেঞ্জার এদের খোঁজ পান। ততক্ষণে ছোটো ছেলেটি ও কুকুরটির মৃত্যু হয়েছে। গ্রীষ্মকালে ডেথভ্যালির তাপমাত্রা ১০০ থেকে ১২০ ডিগ্রীর মধ্যে ঘোরাফেরা করে। আর্দ্রতা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি। রেকর্ড তাপমাত্রা উঠেছিল উনিশশো তিরিশের দশকে – ১৩৪ ডিগ্রী। সাধে কি আর এটা পৃথিবীর দ্বিতীয় উষ্ণতম অঞ্চল! যদি যেতেই হয় অবশ্যই দল বেঁধে যান। অন্তত দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যেন সাথে থাকে। অচেনা ট্রেলে না যাওয়াই ভালো। একান্তই অ্যাডভেঞ্চার করে মরার শখ হয়ে থাকলে হিমালয়ে যেতে পারেন। ডেথ ভ্যালির সৌন্দর্য মরার জন্য যথেষ্ট নয়।
এত কথা জানতে পারলাম আমার ট্যুর গাইডের থেকে। আটজনের ছোটখাটো দল। লাস ভেগাস থেকে বেরিয়েছি সাড়ে সাতটা নাগাদ। প্রথমে যাওয়া হল রিওলাইট নামে একটা ঘোস্ট টাউনে। বিশ শতকের প্রথম দিকে হঠাত শোনা যায় নেভাডার এই অঞ্চলে সোনা পাওয়া যাচ্ছে। তখনো লাস ভেগাসের জন্ম হয়নি। আমেরিকার এই অংশ প্রায় পরিত্যক্ত বলা চলে। কঠিন ভূপ্রকৃতি আর অতিরিক্ত গরমের জন্য। কিন্তু সোনার খোঁজে মাছি জুটতে দেরী হল না। মাত্র বছরখানেকে রিওলাইট হয়ে উঠলো আমেরিকার মোস্ট হ্যাপেনিং সিটি। দলে দলে লোক এসে কাজ খুঁজে নিল সোনার খনিতে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল এ মেঘ যতটা গর্জেছে ততটা বর্ষনোপযোগী নয়। নেভাডার এই প্রচন্ড গরমে খনি মজুরদের নাভিশ্বাস উঠলো। আর সোনাও যতখানি পাওয়া যাবে ভাবা গিয়েছিল ততটা মিললো না। ইতিমধ্যে ১৯০৬ এ সান ফ্রানসিসকোর ভূমিকম্পের পর টাকা পয়সার যোগানও কমে গেল। ১৯০৭ এ এলো রিসেশান। শেয়ারের দাম হু হু করে পড়তে লাগলো। সব বিনিয়োগ বন্ধ। কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল একটি অগ্নিকাণ্ড। গণিকাপল্লীর একটি মেয়ের অসাবধানতায় স্টোভ থেকে আগুন লাগলো তার ঘরে। সেখান থেকে আশে পাশের বাড়িগুলোতে। ১৯০৮ এ রিওলাইট ঘোস্ট টাউন হয়ে গেল। পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়ীগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কয়েকটা ছবি তুললাম। তারপর গাড়ী চললো ডেথ ভ্যালির দিকে। গাইডের কাছে একটি বই ছিল রিওলাইটের ওপর। সেখানেই পড়লাম এসব গল্প।
ডেথ ভ্যালিতে ঢুকলেই যেন মৃত্যুর নিস্তব্ধতা ছোঁয়া যায়। এখানে গাছগুলো কেমন অদ্ভুত। গাইড একটি গাছের কাছে নিয়ে গিয়ে বললো ‘গন্ধ শুঁকে দেখো’। আমি তো নাকে কোন গন্ধই পাচ্ছি না ক’দিন ধরে। কি আর করবো! ক্যাবলা ক্যাবলা হাসি মুখ করে রইলাম – যার অর্থ ‘বাহ কি সুন্দর গন্ধ’ও হতে পারে, আবার ‘কি বিকট’ও হতে পারে। তারপর গাইড বললো ‘এবার হাতে ক’টা পাতা নিয়ে জোরে দু’বার ফুঁ দাও। তারপর গন্ধ শোঁকো’। তাই করলাম। ফুঁ দেওয়ার সাথে সাথে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এলো। বাতাসে আর্দ্রতা অত্যন্ত কম বলে এখানে গাছেরা তাদের পাতার ছিদ্রগুলো বুজিয়ে রাখে। যে মুহুর্তে ফুঁ দিয়েছি গাছটি জলীয় বাষ্পের খোঁজ পেয়েছে আর মুখ খুলে দিয়েছে সেই বাষ্পটুকু টেনে নেওয়ার জন্য। গাছটির নাম Creosote। আরেক রকম গাছ জন্মেছে যত্রতত্র – তার নাম ডেজার্ট হলি – ফিকে সবুজ বা কখনো বা নীলচে ধূসর রঙের পাতা – তাতে রূপোলী আভাস। সবই অন্য রকম। এক সময় বোরাক্সের বড় খনি ছিল এখানে – একখানা গাড়ী এখনো রাখা আছে পার্কে, যাতে করে মালপত্র আদানপ্রদান হত। সব কিছুই সাদা আর ফ্যাকাশে। কোন চেনা গাছপালা নেই। রুক্ষ এবং পাথুরে।
ডেথ ভ্যালির বয়েস খুব বেশী নয়। মাত্র দশ মিলিয়ন বছর। তার আগে এখানে অনেক গুলো লেক ছিল। ফল্ট বরাবর মাটি বসে গিয়ে কিছু অংশ সমুদ্র তলের থেকেও নীচে নেমে গেছে। ব্যাড ওয়াটার বেসিনের খুব নাম শুনেছিলাম। সমুদ্রতল থেকে ৮০ মিটার গভীর সেই বেসিন। ব্যাড ওয়াটার কারন জলে নুনের পরিমান এতো বেশী যে মুখে দেওয়া যায় না। আরেকটা মজার জিনিস হল এই বেসিন যেহেতু তৈরী হয়েছে মাটি বসে গিয়ে তাই বেসিনের মধ্যে যে মাটির ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার বয়েস সব চেয়ে কম। আর যে পাথরের দেওয়াল আমাদের ঘিরে আছে তাদের বয়েস ভূপৃষ্ঠের চেয়ে বেশি। বেশীর ভাগ পাহাড়ী জায়গায় এর উল্টোটা হয়। কারণ পাহাড় সাধারনত তৈরী হয় দুইপাশ থেকে চাপের ফলে মাঝের অংশ উপরে উঠে গিয়ে – যার ফলে সবচেয়ে শেষে তৈরী হওয়া নতুন পাথরের স্তর চলে যায় ওপরে। আর যতো নিচে নামবে পাথর তত পুরোনো হতে থাকে। ব্যাড ওয়াটার বেসিনে এই উলটপুরাণ দেখে আমার বেশ লাগলো।
সমুদ্রতল থেকেও ৮০ মিটার নেমে আসার ফলে গরম ছিল মারাত্মক। গাড়ীর বাইরে বেরোলেই গরম হলকা। যেন কুম্ভীপাক নরকে ঝলসানো হচ্ছে! আমার পাশের সিটের মেরি জ্যেঠিমা তো গাড়ীর মধ্যেই অন্তর্বাস সম্বল হয়ে পোষাক পরিবর্তন করে ফেললেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এমনই চমকে গেলাম যে ‘আ ছি ছি’ করার অবকাশটুকুও পেলাম না!এরই মধ্যে গাইডকাকু গাড়ী ভিড়িয়েছেন ডেভিলস গলফ কোর্সে।দশ মিলিয়ন বছর আগের সেই লেক এখানে শুকিয়ে কাদা হয়ে আছে। আর সেই কাদার গায়ে মাছের আঁশের মত সাদা আস্তরন। একটু ঘসতেই সাদা গুঁড়ো উঠে এল হাতে। মুখে দিয়ে দেখলাম ভীষন নোনতা। লোকে বলে ডেথ ভ্যালির এই অঞ্চলে নাকি সমুদ্রের গন্ধ পাওয়া যায়। আমার তো নাক বন্ধ। গন্ধবিচার দূরঅস্ত। চারিদিকের এই সাদা বর্ণহীনতা আর রুক্ষ কঠিন জমি দেখতে দেখতে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল। গাইডকে জিগ্যেস করলাম – ‘আর্টিস্ট প্যালেট যাবেন না?’ গাইড জানালো সেটাই আমাদের পরের স্টপ।
আর্টিস্ট প্যালেট আবার সেই গ্রেট আর্টিস্টের ফেলে যাওয়া ক্যানভাস। এখানে যাওয়ার রাস্তাটা ভারী সুন্দর। উপত্যকার মধ্যে এঁকে বেঁকে উঠে গিয়েছে পথ। একটু ওপরে বলেই বোধহয় সামান্য কিছু সবুজ দেখা যায়। পাথরের চরিত্র যদিও একই রকম। তবু তারই ফাঁকফোকরে ফুটে রয়েছে হলুদ রঙের ডেজার্ট গোল্ড। যতই এগোনো হয় বাদামী পাহাড়ের গায়ে রঙের প্রলেপ লাগে। পথ এসে শেষ হয় একটি পাথুরে ক্যানভাসের সামনে। বেগুনী-গোলাপী-সবুজ-নীলে উজ্জ্বল সেই ক্যানভাস। আমরা আটজন মানুষ সেই রঙের বন্যার সামনে এসে স্তব্ধবাক হয়ে দাঁড়াই। বিশ্বাস করাই কঠিন এই মৃত্যু উপত্যকার মধ্যেও লুকিয়ে আছে এত রঙ!
বেলা ফুরিয়ে আসছিল। দিনের শেষ গন্তব্য ছিল জ্যাব্রাস্কি পয়েন্ট। আবারো সেই ঢেউ খেলানো রাস্তা। এবারে আমরা চলেছি সমুদ্রতলের উপরে। যেখানে এসে ভ্যান থামে সেটা পাহাড়ে ঘেরা একটি ছোট উপত্যকার মত। একটি রাস্তা উঠে গেছে উপরের দিকে। মেরি আমাকে বললেন ‘আমি আর উঠবো না, তুমি আমার ক্যামেরাটা নিয়ে যাও। কয়েকটা ফটো তুলে এনো।’ আমি নিজের আর মেরির ক্যামেরা নিয়ে উঠতে লাগলাম। প্রথম বাঁকটা ঘুরেই যা দেখলাম সেটাই বোধহয় ডেথ ভ্যালির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছবি। এই ছবিটা দেখেই আমি প্রথম ডেথ ভ্যালি যাওয়ার কথা ভাবি। এটা আসলে একটা পাহাড়। সোনালী রঙের পাহাড়। আমি ছবি দেখে ভেবেছিলাম স্যান্ড ডিউনস। ওই সোনালী পাহাড়কে পাশে রেখে যতই এগোতে থাকি ততই যেন একটা ফ্যান্টাসীল্যান্ড আমার সামনে তার পেখম মেলতে থাকে। সোনালী-বাদামী-চকোলেট-সাদা – নিখুঁত কালার কম্বিনেশন। যে কোন ফটোগ্রাফারের স্বপ্ন। আমি আমার আর মেরির ক্যামেরা নিয়ে হ্যাংলার মত গাদা গাদা ফটো তুললাম।
তারপর ফেরার পালা। বেশ ভালোই কাটলো দিনটা। তবে ডেথ ভ্যালিই বোধহয় আমেরিকার এই অঞ্চলে একমাত্র জায়গা যেখানে আমি আবার ফিরে আসতে চাই না। ডেথ ভ্যালি আক্ষরিক ভাবেই মৃত্যু উপত্যকা। আমি রঙ ভালোবাসি। ডেথ ভ্যালি বড় বেশী বর্ণহীন। কাল যাচ্ছি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। সেখানেই সফরের শেষ।
“ঘাটে বসে আছি আনমনা, যেতেছে বহিয়া সুসময়”
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এই নিয়ে তিনবার হল। প্রথমবার এসেছিলাম ২০০২ এ – প্রথম চাকরী, প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। ভূগোলের বইয়ে পড়া দূরের দেশ প্রথমবারের জন্য জ্যান্ত হয়ে ওঠা। সেবারে দুপুর নাগাদ এসে সানসেট দেখে ফিরে যাওয়া হয়েছিল। তিনবছর পরে আবার আসা। সেবারে সানরাইজ। দিনের শেষে ফেরার পথে অ্যা্রিজোনার নির্মেঘ আকাশে সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটা। তাই এবারে যখন বাবা-মাকে নিয়ে আবার আসবো ঠিক করলাম তখন ওদের কোনোটা থেকেই বঞ্চিত করতে মন চাইলো না। ঠিক করলাম পার্কের ভেতরে থাকবো। সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত তো বটেই, নিশুত রাতের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখারও বড় শখ আমার। পার্কের ভিতরে না থাকলে সে আশা পূর্ণ হবে কেমন করে! সেই হিসেব মত ইয়াভাপাই লজ়ে বুকিং সারা। অতঃপর তিনজনের টিম থেকে দুজন খসে গেল। একা কুম্ভ চলেছি ক্যানিয়ন সফরে।
প্রতিবার পুরী গেলেই প্রথমবার সমুদ্র দেখার অনুভূতিটা বড় উপভোগ করি। [যদিও শেষবার গেছি মাধ্যমিক দিয়ে, এখন গেলে কেমন লাগবে জানি না।] স্টেশন থেকে রিকশা নিয়ে স্বর্গদ্বারে যাওয়ার পথে প্রথমে একটা জায়গায় এসে সমুদ্রের গন্ধ পাওয়া যায়, তারপর আরেকটু গেলে শোনা যায় ঢেউ-এর আওয়াজ। আর তারপরেই রাস্তাটা স্বর্গদ্বারে ঢোকে। মুহূর্তের মধ্যে সমুদ্রে আছড়ে পড়ে চোখের ওপর। এখানেও অনেকটা অমন হল। ম্যাথার পয়েন্টের ইনফরমেশন সেন্টার থেকে রিম ট্রেলের দিকে হাঁটছি। আশেপাশে হাজারটা গাড়ী পার্ক করা, কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে – নেহাতই ভেতো জীবন। তারপর একটা বাঁক ঘুরতেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যানিয়ন তার সমস্ত রঙ নিয়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো। যতই চেনা হোক – অনেকদিনের পর প্রথম দেখা সবসময় একই অনুভূতি নিয়ে আসে।
পরের কাজ হল ইয়াভাপাই লজ়ে চেকইন করে মনের সুখে বেরিয়ে পড়া। ছোটোবেলায় একবার বেতলা রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতরে থাকার সুযোগ হয়েছিল। ইয়াভাপাই লজ অনেকটা সেইরকম। গতবছর ইয়েলোস্টোনেও পার্কের ভেতরে কেবিনে ছিলাম। ইয়েলোস্টোনের কেবিনগুলো সব রকমের বাহুল্য বর্জিত – বনের মধ্যে যেভাবে থাকা উচিত ঠিক সেই রকম। ইয়াভাপাই লজ সে হিসেবে বেশ সুখী আদুরে প্রকৃতির। ঘরে ঢুকে জানলার পর্দা সরাতেই দেখি একটি লম্বা সিং-ওয়ালা হরিণ আমার ঘরের সামনেই ঘাস খাচ্ছে। প্রথম বলেই ছক্কা ওঠায় আমি তো দারুন খুশি!
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে পার্কের ভেতরে সবসময় শাটল চলে। বিশেষ করে পশ্চিমপ্রান্তটি মে থেকে সেপ্টেম্বর প্রাইভেট গাড়ীর জন্য বন্ধ রাখা হয়। শাটলই একমাত্র ভরসা। সূর্যাস্ত দেখতে গেলে যেতে হবে ঐ দিকেই আর তার জন্য সেরা জায়গা হল হোপি পয়েন্ট। কিন্তু সেটা যেমন আমি জানি তেমন সারা পৃথিবীর প্রতিটা মানুষই জানে – যারাই গ্রান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে একবার গুগল করেছে। অতএব যত হাজার লোক আজ গ্রান্ড ক্যানিয়নে হাজির হয়েছে তারা সবাই গিয়ে ভিড় জমাবে সেখানে। আমি তাই ঠিক করলাম পশ্চিমপ্রান্ত অর্থাৎ হারমিট রেস্টের শাটল নিয়ে সবকটা পয়েন্টই ঘুরে দেখবো। তারপর যেটা আমার নিজের পচ্ছন্দ হবে এবং ভিড় কম থাকবে সেখানে বসে পড়বো ক্যামেরা নিয়ে। এইভাবে একে একে হারমিট রেস্ট, মোহাভি, পিমা এবং পাওয়েল পয়েন্ট দেখে আমার পছন্দ হল পাওয়েলকে। আসলে পাওয়েলে এসে রিম ট্রেল থেকে বেরিয়ে একটা নিজস্ব পাথর পেয়ে গেলাম যেখানে বসে পূর্ব আর পশ্চিম – দুই দিকেই অবিশ্রাম ক্যানিয়ন দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমে সূর্য ডুববে আর সেই ঝিমিয়ে আসা সূর্যের আলোয় লাল হবে পুবের পাথর – তবে না ম্যাজিক!
জায়গা খোঁজার উত্তেজনায় খেয়াল হয় নি দুপুরের ঝকঝকে আকাশ মেঘে ছেয়েছে। বজ্রগম্ভীর বৃষ্টির মেঘ নয়, হালকা-পাতলা দুঃখবিলাসী মেঘ। সেই মেঘ এসে আমার সাধের সূর্যাস্ত মাটি করে দিল। এমন নিবিড় হল না যা নিয়ে কাব্যি করতে পারি। আবার এমন হালকাও সে নয় যাকে উপেক্ষা করে আলোছায়ার লুকোচুরি চলতে পারে ক্যানিয়নের বুকে। আমি আমার পাথরটির ওপর বসে এই নিস্ফলা মেঘের কুম্ভিরাশ্রু দেখে গেলাম। ক্যানিয়নের আনাচে কানাচে ছায়া ঘনিয়ে এলো। সূর্যটি ঘামে ভেজা কপালে গলা সিঁদুরের টিপের মত পাহাড়ের ওদিকে ডুবে গেল। ঘরে ফেরার বাস ধরলাম।
“আমি আদতে আনাড়ী”
এরপরে যেটা হল সেটা বোধহয় লেখা উচিত ছিল আগের অধ্যায়ে। যাই হোক এখানেই লিখি। সানসেট দেখে হোটেলে ফেরার শাটলে উঠেছি হঠাত শুনি কে আমাকে ডাকছে। এখানে সেটা একান্তই অসম্ভব ভেবে ইগনোর করতে গিয়ে দেখতে পেলাম জেসি-কে। জেসি হল একটি পুয়ের্টোরিকান মেয়ে যে কাল আমার সাথে ডেথ ভ্যালি ট্যুর নিয়েছিল। সে মেয়ে যে আজই গ্রান্ড ক্যানিয়নে আসবে তা কে ভেবেছিল! তাও আবার দেখা হবে একই বাসে! ও সানসেট দেখে ফিরছে হোপি পয়েন্ট থেকে। আমরা দুজনেই দুজনকে দেখে দারুন অবাক। তবে অবাক হওয়ার আরো বাকি ছিল। বললে কি কেউ বিশ্বাস করবে জেসিও ইয়াভাপাই লজে উঠেছে; আমার রুম নাম্বার ৭২৫৭ আর জেসির ৭২৫৮! ঘটনাটা হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু আমার যাকে বলে বিস্ময়ে প্রাণ জেগে উঠলো আমরা ঠিক করে নিলাম পরের দিন একসাথে সানরাইজ দেখতে যাবো। আমি আমার সন্ধ্যার তারা দেখার প্রোগ্রামেও জেসিকে নেমন্তন্ন করলাম। কিন্তু ও তাতে খুব একটা আগ্রহী হল না। অতএব ঠিক করলাম ডিনার সেরে আমি একাই রাতের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এক্সপ্লোর করতে বেরোবো।
আমার দ্বিতীয়বার গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন আসা ২০০৫ এ। সে বারে ছিলাম আমি, শুভ আর শুভ’র বন্ধু সান্যাল। ফ্ল্যাগস্টাফ থেকে শেষরাতে বেরোনো হয়েছিল সানরাইজ দেখা হবে বলে। আমাদের সেবারের ট্রিপে আমাদের সাথে শুধু দু’টি সিডি ছিল। চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’ আর ‘গাধা’। সারা রাস্তা আমরা ওই দু’টো সিডিই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুনেছিলাম। আর লজ্জার কথা কি বলবো তার আগে আমি কখনো চন্দ্রবিন্দু শুনিনি। মনে পড়ে ফ্ল্যাগস্টাফ থেকে গ্রান্ড ক্যানিয়নের পথে গাড়ী ছুটছে – আমি পেছনের সিটে – সামনে ওরা কি কথা বলছে কিচ্ছু শুনিনি, তখন তো অনিন্দ্য গাইছে “আমি পাই না ছুঁতে তোমায়, আমার একলা লাগে ভারী”। অ্যা্রিজোনার নিষ্পাপ আকাশ, পেছনের সিটে আধশোয়া আমি সপ্তর্ষিমন্ডলের শেষ দুটি তারা দেখতে পাচ্ছি। অনিন্দ্যকে কেউ মস্ত গায়ক বলবে না কোনদিন। কিন্তু কি জানি কি ছিল সেদিন ঐ ঝলমলে দুটি তারায় – পৃথিবীর সব মানুষের সব ছুঁতে না পারার অভিমান সেখানে গিয়ে মিশছিল। “ভিনদেশী তারা” যেখানেই শুনি না কেন, দুনিয়ার যে প্রান্তেই – আমার চোখে ভাসে অ্যা্রিজোনার আকাশ। গ্রাণ্ড ক্যানিয়নে রাতে থাকার পেছনে এটা একটা বড় কারন।
সব আলো নিভিয়ে দিলে, এমন কি চাঁদও না থাকলে রাতের আকাশ কেমন দেখায় তা আমি প্রথম জানি শিমুলতলাতে গিয়ে। ছোটোবেলাতে তো প্রতি বছরই প্রায় পুজোর সময় শিমুলতলা যাওয়া হত। আমরা দুই ভাইবোন যদিও একটুও যেতে চাইতাম না। কেনই বা চাইবো! পুজোর সময় নতুন জামা, ঠাকুর দেখা, ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে যেতে হবে শিমুলতলায়! যেখানে ইলেক্ট্রিসিটিও নেই! যেতে হবে অষ্টমীর দিন, ফেরা সেই কালীপুজো পার করে। আমরা দু’জনে তীব্র প্রতিবাদ করতাম। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তখনো ছোটোদের ইচ্ছেকে পাত্তা দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়নি। মিলু মুখে গজগজ করতো বটে, কিন্তু আজ বুঝতে পারি তারও দিব্যি লাগতো ওই একমাস ইলেকট্রিকের বদলে চাঁদের আলোতে ঘরকন্না করতে :) সন্ধ্যেবেলা অনিলের দোকান থেকে শালপাতার ঠোঙায় গরম রসগোল্লা খেয়ে ফেরার পথে আমার ভাই গুলুরাম পায়ে ব্যাথার অভিনয় করে তীব্র কান্না জুড়ে রাস্তার ওপর বসে পড়তো। কিন্তু শিমূলতলায় রিকশা কোথায়! আর আট বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে বাড়ী ফিরবে – প্রদীপবাবুর এতখানি স্নেহপ্রাবল্য কোনোকালেই ছিল না। অগত্যা গুলুরামকে রাগে গনগন করতে করতে হেঁটেই ফিরতে হত। আর ওরই মাঝে আমি কোন কোন দিন লক্ষ করে ফেলতাম জ্যোতস্নায় ভেসে যাচ্ছে ছোটনাগপুরের মালভূমি। কৃষ্ণপক্ষ তখন। আকাশে চাঁদ নেই। কোটি কোটি অগুন্তি তারাদের থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে অপূর্ব এক আলো। সেই প্রথম বুঝেছিলাম জ্যোতস্নার মানে। আর আজও দেখা-অদেখায় আমার পিছু ছাড়ে না সেই তারাভরা আকাশ। শিমূলতলা অনিবার্য ভাবে ফিরে আসে আমার প্রতিটি লেখায়। প্রদীপ-বাবু এ লেখা পড়ে নির্ঘাত মনে মনে হাসবেন আর ভাববেন – “তোমাকে ভাবাবোই ভাবাবো, সে তুমি মুখ যাই বলো না/ তোমাকে পথে আমি নামাবো, যতই ঘরে বসে থাকো না” :)
এই ভিনদেশী আকাশে সেই চেনা তারাগুলোকে খুঁজে বার করতে আমি ডিনার সেরে পৌঁছে গেলাম ইয়াভাপাই অবজারভেশন পয়েন্টে – আমার হোটেল থেকে খুব দূরে নয়। রাস্তায় সামান্য যা আলো তা অন্ধকার দূর করার জন্য যথেষ্ট নয়। যেখান থেকে রিম ট্রেল শুরু হয়েছে সেখানে সেটুকুও বন্ধ। টর্চের আলোতে পথ হাঁটলাম কিছুটা। আমি ভেবেছিলাম আরো অনেকেই হয়তো আকাশ দেখতে বেরোবে। কিন্তু ট্রেলে জনপ্রানী নেই। সামনে যেটাকে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বলে জানি সেখানে নিরেট নিকষ অন্ধকার। অপর পারে নর্থ রিমে হাল্কা একটা আলোর আভাষ। আর অনেক নিচে – সম্ভবত কলোরাডো নদীর পাশে যে ক্যাম্পগ্রাউন্ডগুলো আছে সেখানে একটা আবছা আলো। মাথার ওপরে আকাশে সেই ন্যাকা মেঘ তখনো মায়া কান্না কাঁদছে। আর মেঘের পাতলা পর্দার ওপারে দেখা যাচ্ছে কোটি কোটি তারা। তাদের দেখাচ্ছে বহু ব্যবহৃত চিমনির ভেতরে লুকিয়ে থাকা টিমটিমে শিখার মত। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। এই জুন মাসের গরমে ফ্লিস জ্যাকেটের তলাতেও কেঁপে উঠছি। ক্যানিয়নের মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে উঠে আসা সেই হাওয়ার দাপটে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। অথচ দিনের বেলা এ আওয়াজ শুনতেই পাই নি।
প্রথম পাঁচ মিনিট বেশ কাটলো। আমার চেনা আকাশকে যদিও খুঁজে পেলাম না এ’রাতের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে! যেন কেমন অপার্থিব বহু দূরের জিনিস এসব। দূরের জিনিস তো বটেই। কিন্তু সেভাবে তো কখনো ভাবি নি! তারপর একটার পর একটা মুহুর্ত যায় – ওই সীসের মত অন্ধকার, ঘসা কাঁচের মত তারার দল আর সর্বোপরি কলোরাডো নদীর বুক থেকে উঠে আসা সেই উত্তাল হাওয়া আমার ওপর চেপে বসতে থাকে। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই, তবে ভয় আছে সাড়ে ষোলোআনা ;) আর শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আমি একটু ইয়ে টাইপের কল্পনাপ্রবণ। তাই জনপ্রানীহীন বিদ্যুতহীন ইয়াভাপাই ট্রেলে আমার যদি মনে হয় এই বুড়ো ক্যানিয়ন তার ছয় মিলিয়ন বছরের সুখ-দুঃখের গপ্পো আমার সাথে ফাঁদতে চাইছে আর সেই চিন্তায় আমি যদি কিঞ্চিত বিব্রত হয়ে পড়ি তাহলে খুব বেশী দোষ দেওয়া যায় কি? “কেটে পড়ি, ভেগে পড়ি চুপি চুপি রে” গাইতে গাইতে রাস্তার দিকে সরে এলাম। এসে দাঁড়ালাম ল্যাম্পপোস্টের নিচে। কি মনে হতে সেলফোনটা বার করে দেখি জ্বলজ্বল করছে সিগন্যাল। ব্যাস! ধড়ে প্রাণ এলো। ৯১১ থাকতে ডরাই কাকে! সেই মুহুর্তে শাটল বাসও দেখা দিল একটা। আমার তারাবাজির এখানেই ইতি।
“বিশ্ব হৃদয় হতে ধাওয়া আলোয় পাগল প্রভাত হাওয়া”
রাতের বীরত্ব প্রদর্শনের পর জেসি যদি না থাকতো আমার কিছুতেই সাহস হত না পরের দিন ভোর চারটেয় সানরাইজ দেখতে যাওয়ার। তবে আমি কিনা ভারী লক্ষ্মী মেয়ে। তাই আমার রাস্তায় বেরোলেই একজন মধুসূদন-দাদা জুটে যায়। জেসিকে যে পাওয়া যাবে সে তো আগেই জানতাম!
জেসি আমার দরজায় নক করলো যখন তখন বাজে পৌনে চারটে। আমি অবশ্য দুটো সতেরো থেকেই জেগে বসে আছি আর “যখন সবাই মগন ঘুমের ঘোরে, আমার ঘুম নিয়ো গো হরন করে” জাতীয় আঙুর ফল টক গান সহযোগে প্রকৃতির শোভা নিরীক্ষণ করছি। জেসি আসতেই বেরিয়ে পড়া গেল। সাথে আমার থেকেও বীরাঙ্গনা আমার নিভু নিভু টর্চ।
সানরাইজ দেখতে যাওয়া হবে ম্যাথার পয়েন্টে। কিন্তু ম্যাথার পয়েন্টে কনস্ট্রাকশনের কমলা দড়ির পাকে যাবতীয় ডিরেকশন গেল ঘেঁটে। আমরা ম্যাথারের আশা ছেড়ে রিম ট্রেল ধরে হাঁটতে থাকলাম। দিগন্তে তখন হাল্কা নীলচে আভা। সেই নাছোড় মেঘ পাত্তা না পেয়ে অনেকটাই পিছু হটেছে। আকাশে আধখানা বেগুন ভাজার মত চাঁদ আর তাকে ঘিরে থাকা তারারা সবে বুঝতে শুরু করেছে তাদের নিভে যাওয়ার সময় হয়ে এল। আমি রিম ট্রেলের ওপর একটা পাথর খুঁজে পেলাম যেটা ক্যানিয়নের ওপর আধা বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছে এবং তার ফলে পূর্ব-পশ্চিম দুই দিকই নাগালের মধ্যে। জেসিকে সে পাথর দেখাতে সে বলে “না ভাই, আমার আজ জন্মদিন। আর আমার মা আমাকে দিয়ে প্রমিস করিয়ে নিয়েছে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে এসে আমি বিপজ্জনক কিছু করবো না”। আমি ভেবে দেখলাম মিলু স্পেসিফিকালি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে আমাকে কোন নির্দেশ দেয় নি। আর তাছাড়া আমার আজ জন্মদিনও নয়। তাই আমি ওই পাথরের দিকে পা বাড়ালাম এবং যুগপত হর্ষ ও বিষাদে লক্ষ করলাম আমি যেখানে যেতে চাইছি সেই পাথরটিতে যাওয়ার জন্য আরো কিছু ছোটো পাথরের টুকরো দিয়ে সিঁড়ির মত সাজানো আছে। তারমানে আমিই পাথরের আবিষ্কর্তা নই। আর পাথরটা তেমন বিপজ্জনকও নয়। জেসিকে এই সংবাদ দিতে সেও তরতর করে নেমে এলো।
মেঘ অনেকটাই সরেছিল, তবে আকাশ সম্পূর্ণ পরিস্কার ছিল না। তাই পাঁচ বছর আগে দেখা সেই অবর্ণনীয় বর্ণচ্ছটা এবারে দেখা হল না। তবে যা দেখলাম তাও ভারী সুন্দর। পাথরের ওপর বসে আছি পুব দিকে মুখ করে। ঠান্ডা তাজা বাতাসে সব ক্লান্তি, সব বিষাদ ধুয়ে যায়। তারপর সূর্যের প্রথম আলোটি এসে ক্যানিয়নের দেওয়ালে পড়ে, আমার কপাল ছোঁয়। “কি আনন্দ, কি আনন্দ, কি আনন্দ!” – এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু কি হয় পৃথিবীতে! ধীরে ধীরে গোটা ক্যানিয়ন আলোতে ভরে যায়। হাল্কা মেঘ তখনো ছিল, কুয়াশা ছিল পাথরের দেওয়ালের কোণায় কোণায়। লাল-কমলা-সোনালী-হলুদের বিবর্তন তাই ধরা পড়লো না। তবে আলো পেলো সকলেই। ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো দিন। ভোরের এই প্রথম আলোটুকু বড় ভালো লাগে – যখন যেভাবেই দেখি না কেন। “জনম অবধি হাম এ রূপ নেহারিলুঁ, নয়ন না তিরপিত ভেল”।
আমার মুখে কাল রাতের ঘটনা শুনে জেসির ইচ্ছে হল সেও ইয়াভাপাই পয়েন্ট দেখবে। সানরাইজ দেখে আমরা তাই চললাম সেইদিকে। দিনের আলোতে কাল রাতের সেই রহস্যময়তা একবারে উধাও। এখান থেকে ক্যানিয়নের প্যানারোমিক ভিউ ভারী সুন্দর। এখানেও আসা যেতো আজ সকালে। আমরা যখন গেলাম তখন বিশেষ কেউ ছিল না। একটা নীল পাখি চিড়িক চিড়িক করে ভোরের নিস্তব্ধতায় আঁচড় বসাচ্ছিল। ক্যামেরা তাক করার আগেই সে উড়ে পালালো। জেসি গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন ছাড়বে সাড়ে সাতটা নাগাদ। আমরা তাই ব্রেকফাস্টের আশায় হোটেলমুখো হলাম। আমার হাতে অবশ্য রয়েছে সারাটা দিন। ব্রেকফাস্ট সেরে আমি ফিরবো এখানেই – একটা রেঞ্জার প্রোগ্রাম শুনতে।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে সারা বছর প্রতিটা দিনই কিছু বিশেষ সময়ে পার্কের রেঞ্জাররা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন সম্পর্কে আলোচনা করেন। এর জন্যে আলাদা টিকিট কাটতে হয় না। যে কেউ শুনতে পারে। কাল সন্ধ্যাতেও নাইট স্কাই নিয়ে একটা প্রোগ্রাম ছিল। কিন্তু স্লাইড শো তো যে কোন জায়গাতেই দেখা যায়, তার চেয়ে নিজের চোখে দেখি – এই ভেবে আমি সেখানে যাইনি। আজ সকালে ইয়াভাপাই পয়েন্টে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন কি ভাবে তৈরী হল তা নিয়ে একটা ৩০ মিনিটের ক্লাস হবে। যদিও সে গল্পও গুগল করলেই পাওয়া যায় তাও আমি চললাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বুকে বসে তার জন্মকথা শুনবো বলে। সে কথা অবশ্য আমি এখানে লিখবো না, কারন যা শুনলাম সে তো গুগলেই পাওয়া যায়। তবে রেঞ্জার মেয়েটি পৃথিবীকে peanut m&m এর সাথে তুলনা করলো। ওপরে চকোলেটের আস্তরন, মধ্যিখানে পিনাট। এই উপমাটা বেশ মনে ধরেছে।
বিকেল বেলা ভিড়ের ভয়ে হোপি পয়েন্ট যাইনি। সকালে ফাঁকায় ফাঁকায় সেখানে ঘুরে আসার শখ হল। হোপির সৌন্দর্য শুধু হোপিতেই আছে। ক্যানিয়নের এমন প্রশস্ত রূপ আর কোন জায়গা থেকেই দেখা যায় না। গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন যে কতো বিশাল তা অনুভব করতে হোপিতে আসতেই হবে। অনেক নিচে দেখায় যায় নীল রঙের কলোরাডো নদী। হুভার ড্যাম তৈরী হওয়ার আগে কলোরাডো নাকি এমন নীল ছিল না। লোকে নাকি কলোরাডোর লালচে কর্দমাক্ত জলকে বলতো – too thin to plow, too thick to drink. প্রাক উনিশো তিরিশ যুগের সেই লাল কলোরাডোর ছবি ইয়াভাপাই জিওলজিকাল মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যায়। হুভার ড্যাম তৈরী হওয়ার পর সেটা ছাঁকনীর কাজ করে লাল কলোরাডোকে নীল করে দিয়েছে। এইটুকু সরু একটা নদী কিভাবে এই বিশাল ক্যানিয়ন তৈরী করলো তা ভেবে অবাক হতে হয়। সময় লেগেছে যদিও ছয় মিলিয়ন বছর, তবে জিওলজিকাল ক্লকে সে তো তুচ্ছ। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরতা প্রায় এক মাইল। তবে আসল ক্যানিয়নের উচ্চতা নাকি এর দ্বিগুন ছিল। ওপরের অংশ ক্ষয়ে গিয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছে এই বাকি অর্ধেক। কি করে জানা গেল? ভারী সোজা। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে কোন ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া যায় নি। অথচ এই ক্যানিয়ন তো তৈরী হয়েছে মোটে ছয় মিলিয়ন বছর আগে। জুরাসিক যুগের বয়স সেখানে ষাট মিলিয়নেরও বেশী। সেই সময়ে আমেরিকার এই অঞ্চলে দাপিয়ে রাজত্ব করেছে ডাইনোসরের দল। তার কিছু নিদর্শন আমি নিজেও দেখেছি গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন থেকে সামান্য দূরে পেট্রিফায়েড ফরেস্টে। তাহলে তাদের জীবাশ্মসহ গ্রান্ড ক্যানিয়নের নতুন পাথরের স্তর গেলো কোথায় আর কিভাবেই বা গেলো? কলোরাডো নদীই বা এমন গভীর খাত বানালো কি করে? এর উত্তর নিয়ে জিওলজিস্টরা এখনো একমত নন।
গ্রান্ড ক্যানিয়নের পূর্বপ্রান্তে এর আগে কখনো যাইনি। খুব বেশী লোকে এদিকে আসেও না। হাতে ঘন্টাখানেক সময় ছিল। ভাবলাম ইয়াকি পয়েন্ট দেখেই আসি। এদিকে সবুজের ভাগ একটু বেশী মনে হল। শীতের শুরুতে এখানে নাকি অনেক পাখী দেখা যায়। কাইবাব ট্রেইলহুডের যে চওড়া পাথরের দেওয়ালটা ক্যানিয়নের পুবদিকের কিছুটা আড়াল করে রাখে, ইয়াকি পয়েন্ট তাকেও পেছনে ফেলে আরো খানিকটা পূর্বে। ইয়াকি পয়েন্টে এসে দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না। শুধুই লাল পাথরের ভাঙাগড়া আর জেদী কলোরাডোর মহিমা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছিল। আমি ফেরার পথ ধরলাম। চেক আউট করাই ছিল। লকার থেকে লাগেজ তোলাটাই যা বাকি।
“আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে”
উপসংহার লেখা ভারী কঠিন কাজ। গুলুরাম বাংলা রচনা শেষ করতে হলেই ‘তাই তো কবি বলেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি’ বলে টেক্সটের পদ্য সংকলন থেকে একটা যে কোন কবিতার লাইন গুঁজে দিত। কিন্ত আমি পড়েছি মহা সমস্যায়। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নিয়ে কোন বাঙালী কবি পদ্য রচনা করে যান নি। এমন কি মহাকবি বৈকুণ্ঠ মল্লিকও নয়। তাহলে উপায়?
কবি কহিপ্তাশা অবশ্য লিখেছিলেন – “এবম্বিধ দুকুলপ্লাবী দিনে খেলার শেষে ঘরে ফেরার পালা / অনেকে ছিল ঝলমলানো খুশী, অনেকে ছিল অন্ধকারে চুপ”। কিন্তু আমার যাত্রা যে শেষ হল এক আশ্চর্য গোধূলীতে এসে। শুধু আলো বা শুধুই অন্ধকারের দায় তো আমি নিতে পারি না! তাহলে সেই গোধূলীর গল্পেই শেষ হোক এই কাহিনী।
গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন থেকে ফিরছি লাস ভেগাসে। পরের দিন বাড়ি ফেরা। ফেরার পথে সেই বহুকাঙ্খিত সূর্যাস্ত নামলো। তীব্র হলুদ সূর্য গড়াতে গড়াতে এসে থামলো রকির ঢেউ খেলানো কাঁধে। খাপছাড়া সবুজ উপত্যকা হলুদ আলো মেখে যেন ভিনসেন্টের ছবি। হুভার ড্যাম পেরিয়ে গেলো। আকাশ ভরা কমলা আর নীলের চালচিত্রে ব্ল্যাক ক্যানিয়নের শিল্যুয়েট নিথর রাত্রির মত দাঁড়িয়ে আছে। একে একে তারা ফুটছে। তাদের একটি আমার বড় চেনা। আমার সন্ধ্যাতারা। বাকি পথটুকু সে আমার আমার সাথেই হাঁটলো। আর এভাবেই চলতে থাকলো আমার যাত্রা শুরু অথবা যাত্রা শেষের গল্প।
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago
osadharon laglo.. ek niswase porlam.. grand canyon ke eto kachh theke dekha hoito sambhob hobena tobe buri chhue ashi.. dekhi katota dekhte pai.. tor kalomke roilo ashirbaad..
ReplyDeleteঅনেক দিনের পরে
ReplyDeleteযখন তারা ফিরল এসে ঘরে
সবাই তাদের দেখতে এসে কয়,
এইটুকুনি মানুশগুলো এত্ত বড় কেমন করে হয়?
তাও জান না, বললে তারা;
কম ঘুরেছি? সেই কবে দেশ ছাড়া.....
বেশ ভাল........
এক নিশ্বাসেই প্রায় পড়ে ফেললাম তোমার গ্রান্ড ক্যানিওন ভ্রমণের পুরো কাহিনী - আমি বাকরুদ্ধ !
ReplyDeleteদুটো ব্যাপার যেনে খুব খারাপ লাগলো... মিলু কে ছেড়ে একা একাই তোমাকে গোটা বেড়ানো টা উপভোগ করতে হলো, আর সুর্যদয় বা সুর্যাস্তের কোনটাই ক্যাপচার করার সৌভাগ্য হলো না :(
লেখা টা পড়তে পড়তে দু-এক জায়গায় কেমন যেন মনে হলো "ইয়ে টাইপের কল্পনা" টা এসে মিশেছে, কিন্তু তাতে বরং আমার উত্তেজনা আর পড়ার স্পীড বাড়িয়েই দিয়েছে !
একটা অভিমান থেকে গেলো খালি - বর্ণনার সাথে সাথে সমান তালে ছবি দেখতে পেলাম না । "হ্যাংলার মতো" যে অত ছবি তুললে, সেসব গেলো কই ?
amio pore fellam namesake tomar osadharon bhromon kahini ek nissase. thik porbo bole asini. kothao ekta tomar blog er link ta dekhe blog ghurte asar lobh ta samlate parlam na. ar blog ta khulei ektar por ekta osadharon upoma sohojoge odvut sundor ek bornonar chobi tomar chokh diye amar moner vetor pouche gelo. oprubo lekha namesake kono tulonai nei. tobe amaro boktobbo lekha gulor songe jodi aro kichu chobi thakto omon jaiga gulo tahole bhromon kahini pore moner sadh metanor songe songe chokh dutokeo sarthok kore tulte partam..:)
ReplyDeletemon kharaper dine hothat tomar blog ta khullam. mon bhalo korar rosod peyeo gelam... tumi aro anek anek lekha likhte thako, majhe majhe moner khorak khuje nite chole asbo amio..:)
ReplyDeleteখুব সুন্দর লেখা, পড়লেই মন ভালো হয়ে যায় !!
ReplyDelete