আজ সকালে আমি ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম। দূরপাল্লার ট্রেন। নীল রঙের। ফ্যাকাসে হলুদ গমক্ষেতের মধ্যে দিয়ে, রুখু রুখু কালো মাটির মধ্যে দিয়ে, লাল কাঁকরে ভরা ঝুরঝুরে পথের মধ্যে দিয়ে – ট্রেনটা ছুটছে ছুটছে ছুটছে। খোলা জানলা দিয়ে গরম হাওয়া আর পাটকিলে ধুলো আমার মুখে এসে লাগছে। আমার রোমকূপগুলো গোগ্রাসে ধুলো খাচ্ছে। আমার চুল উড়ছে। আমি ক্রমশই ধূসর হয়ে যাচ্ছি। আর ট্রেনটা ছুটে চলেছে। শুকিয়ে আসা নদীর খাত পার হয়ে, রেলের ব্রিজে ঝমঝম শব্দ তুলে, পাকা খরমুজার গন্ধে বিভোর হয়ে টেনটা শুধুই ছুটছে।
তারপর ওরা বললো এখানেই নামতে হবে। আমি জায়গাটা চিনি না। কেমন পুরোনো পুরোনো লালচে স্টেশন। চকচকে মেরুনরঙের জরিওলা শাড়ী পরা এক বুড়ী চুবড়ী ভরে লিচু বিক্রী করছিল। তার কালো রোগা হাতে রুপোর বালা। কোঁচকানো চামড়ায় উল্কিতে কালীয়দমনের কৃষ্ণ বাঁশী বাজাচ্ছে। আমি স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা বুড়ো মত টাঙ্গাওয়ালা – নীল-সবুজ চৌখুপ্পি লুঙ্গী পরা – আমায় বললো কোথায় যাবে? আমার তো মনে নেই কোথায় যেতে হবে। স্টেশনের ধারে একটা লাড্ডু-জিলিপির দোকান। কমলা রঙের জিলিপির ঝুড়ির ওপর একটা বিশাল কালো মাছি বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। একটা বটগাছ – তার গায়ে অনেক সিঁদুর লেপা। আমি ওদিকেই চললাম।
রাস্তাগুলো সরু সরু। দুই দিকে উঁচু উঁচু বাড়ি। মাঝে কোন ফাঁক নেই। আলো ঢোকে না একটুও। তবু গলিপথ কেমন আলো আলো। চৌকো পাথর সাজানো পথ। ফ্যাকাসে হলুদ পাথর। তার খাঁজে খাঁজে অনেক ধুলো। সেই ধুলোর সাথে জল মিশে শিরা-উপশিরা ছড়িয়েছে। আমি ওই শিরাওলা পথ ধরে এগিয়ে চলি – যেদিকে জল বয়েছে। আমার দুপাশে ভেজা ভেজা বাড়িগুলোর জাফরির ফাঁকে সময় বাঁধা আছে। গলির শেষে যেখানে সিঁড়ি নেমেছে ধাপে ধাপে সেখানে একটা পাথরের কুয়ো। কুয়োর ধারে একটা মেয়ে। লালহলুদ ঘাগরা পরা। তার তেলহীন চুল বাদামী রঙের। সরু হাতে লাল প্লাস্টিকের চুড়ি সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। মেয়েটাকে আমি চিনি না। তবু মনে হয় দেখেছি কোথাও। থমথমে দুপুরে তখন ‘কুব’ ‘কুব’ করে একটা পাখী ডাকছিল। কেউ কোত্থাও নেই। এই হলুদ ধুলো ধুলো শহরে খালি আমি আর ওই মেয়েটা। যার চোখদুটো আয়নার মত। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরি। তারপর হাঁটতে থাকি ওর সাথে এই অচেনা শহরের গলিপথ ধরে – যেখানে রোদ ঢোকে না, অথচ কেমন আলো আলো।
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago
No comments:
Post a Comment