আমার খুব ইচ্ছে করছে কিছু লিখতে। কিন্তু আমার মনে কোন ভাবনা নেই – ব্লটিং পেপারের মত নিদাগ। কবিতা লিখব ভাবি। শব্দেরা দেখা দিয়েই পালিয়ে যায়। তাদের গাঁথা যায় না। ধরা যায় না। ইচ্ছে হয় চাবুকের মত গদ্য লিখি। আমার তূণে কোন অস্ত্র নেই। আমার খিড়কি দোরে দিন শেষের আলো তেরছা ভাবে বিছিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি অসহায়। চাকা বসে যাওয়া সৈনিকের মত। দিন বয়ে যায়। দিন বয়ে যায়। আমার লেখা হয় না। কতিপয় শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করি শুধু। সামনে আনি, পিছনে আনি। সাজাই গোছাই। পণ্ডশ্রম খালি। একটি লাইনও তার পূর্ণ রূপ নিয়ে আমার সামনে মুখোস খোলে না।
চাকা বসে যাওয়া সৈনিকের মহাভারতীয় উপমা হঠাৎ কেন মনে এল কে জানে! আমার ছোট থেকেই বীরপূজায় মন। মহাভারতেও আমি অর্জুনকেই ভালোবেসেছি। কর্ণের পরিণতি নিয়ে ভাবি নি কখনও। কর্ণকে প্রথম ভালো লেগেছিল পিটার ব্রুকের মহাভারত দেখে। কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতার ঘন কালো চোখ – এক বুক শূন্যতা নিয়ে সেই চোখ তাকিয়েছিল – কিসের দিকে – শূন্যতার দিকেই বোধহয়। দেখার মত আর কিই বা ছিল! সেই চোখ দেখে প্রথম কর্ণের কথা ভাবলাম। পিটার ব্রুকের মহাভারতে আবহসঙ্গীত ভারী সুন্দর। শর্মিলা রায় পোমোর গাওয়া – “অন্তর মম বিকশিত কর, অন্তরতর হে”। আজ মনে হচ্ছে এই গান বোধহয় কর্ণের কথা, দ্রৌপদীর কথা, যুধিষ্ঠিরেরও কথা। কিন্তু অর্জুনের কথা কি? তার কি অন্তর নিয়ে বিশেষ মাথাব্যাথা ছিল? সে তো সারাজীবন ধরে নিয়মনিষ্ঠ সৈনিক, নিয়মনিষ্ঠ সন্তান, নিয়মনিষ্ঠ ভাই; এমন কি তার প্রেমও নিক্তিমাপা। বস্তুত তার চেয়ে দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মহাভারতে দ্বিতীয়টি নেই। পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, ভাইদের রক্ষা করা – এই তার জীবনের স্থির উদ্দেশ্য। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ – কিচ্ছুটি তাকে স্পর্শ করে না। এমনকি অনুশোচনাও নয়। সে যেন মানুষ নয়, যেন প্রোগ্রাম করা একটি অ্যান্ড্রয়েড।
যুধিষ্ঠির নিজেকে নিয়ে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। সে রাজা হতে চায় নি, তবু রাজা হওয়ার দায় তার। আচারে সে ক্ষত্রিয়, যদিও তার মনটি ব্রাহ্মণের, পড়ুয়ার। আবারও ঋণ পিটার ব্রুকের কাছে। ধর্মের সাথে কথোপকথনের দৃশ্যটি না দেখলে হয়ত যুধিষ্ঠিরের স্বরূপ এভাবে বুঝতাম না। সারাজীবন তাকে নিজের বুদ্ধি আর ভবিতব্যের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হল। এদিক দিয়ে সে কর্ণের সাথে তুলনীয়। “দেখিয়াছি শান্তিময় শূন্য পরিণাম” – দুজনেই দেখেছিল। আর দেখার পরেও তার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। তাই আড়াই হাজার (কি জানি মহাভারতের সঠিক বয়েস কত! এ নিয়ে তো অনেক দ্বিমত আছে) বছর পরের পাঠকের চিন্তায় তারা বারবার ফিরে আসে। “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় – আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত, ক্লান্ত করে”- যতবার উচ্চারণ করি এই দুটি লাইন, যুধিষ্ঠিরকে মনে পড়ে, মনে পড়ে কর্ণের শূন্য দৃষ্টি। কিন্তু অর্জুন? সে জন্ম থেকেই একটি বলিপ্রদত্ত পবিত্র পশু। মাংস, শুধু মাংসের জন্য বড় করা। ভরণ-পোষন, যত্ন-আত্তি, সোহাগ-আহ্লাদ – সব কিছুই শেষের দিনটির কথা মনে রেখে। আর সেও উৎসর্গ হওয়াতেই জীবনের চরম সিদ্ধি জেনে এসেছে। শুধুমাত্র অভিমন্যু বধের সন্ধ্যাটুকু ছাড়া আমরা অর্জুনকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখি না। একমাত্র ঐ খণ্ডমূহুর্তে তাকে মানুষ মনে হয়। বাকি জীবন ধরে সে ধর্মাচরণের মত যুদ্ধবৃত্তি করে গেছে। যদি বা কিছু সংশয় ক্কচিৎ কদাচিৎ ছায়া ফেলেছে মনে, তার প্রবল কর্তব্যবোধের সামনে তা খড়কুটোর মত ভেসে গেছে। মহাভারতের সব চেয়ে বড় বীর – সব চেয়ে তুচ্ছ বোড়ের মত জীবন তার। কর্ণ নয়, যুধিষ্ঠির নয়, দ্রৌপদী নয় – মহাভারতকার সব চেয়ে বড় ফাঁকিবাজিটা তার সাথেই খেলেছেন। অন্তরের মাঝে যে অন্তরতর – যার সন্ধান কর্ণ পেয়েছে তার হতাশা দিয়ে, যুধিষ্ঠির পেয়েছে বিপন্নতা দিয়ে, দ্রৌপদী পেয়েছে ক্রোধ দিয়ে, এমনকি ভীম, যে ভীমকে তামসিক মানুষ বলেই জানি, সেও তাঁকে ছুঁয়েছে তার প্রেম দিয়ে – সেই অন্তরতর-র আভাসটুকুও অর্জুনকে দিলেন না মহাভারতকার। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় বঞ্চনা আর কি হতে পারে!
পিটার ব্রুকের মহাভারতঃ
যুধিষ্ঠির ও ধর্মঃ http://www.youtube.com/watch?v=uiMpjoL5Yws&feature=related
অন্তর মম বিকশিত করঃ http://www.youtube.com/watch?v=JpaT14XddKk&feature=related
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রঃ http://www.youtube.com/watch?v=IGvpq6vV3lI&feature=related
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago
bah, sundor post. ebhabe bhabini kokhono. bhabale didimoni
ReplyDelete