[একটি জাপানী রূপকথার ছায়ানুসারে। দিয়ালা ২০১০ পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত।
http://diyala.kochisamsad.com/godyo/urshima-namer-jeleti.html]
অনেক অনেক দিন আগে জাপান দেশে উরশিমা নামে এক জেলে থাকত। সারাদিন ধরে সে সমুদ্রে মাছ ধরে বেড়ায়। ঢেউয়ের পিঠে চেপে মাছের পিছু পিছু সে চলে যায় বহু বহু দূর। একবার হয়েছে কি, দিনের পর দিন যায়, মাছের বড় আকাল। উরশিমা সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল ডুবে রাত – সারাবেলা জাল বিছিয়ে বসে থাকে, কিচ্ছুটি পায় না। এইভাবে অনেক দিনের পর উরশিমা দেখে এক পাঁচরঙা কাছিম গুটি গুটি উঠে এসেছে তার জালে। মাছের বদলে কাছিম, তো তাই সই! পাঁচরঙা কাছিমটিকে নৌ্কোর খোলে রেখে, অনেক রাত পর উরশিমা খুব ঘুমোল।
ঘুম থেকে উঠে উরশিমা তো তাজ্জব। কোথায় কাছিম! এতো এক পরমাসুন্দরী কন্যে বসে আছে তার শিয়রের কাছে! কন্যে মিষ্টি হেসে বলল,
- “আকাশ থেকে দেখতে পেলাম অথৈ সাগর জলে
ডিঙি চেপে বেড়ায় ঘুরে একলাটি এক ছেলে
তোমার সাথে কইতে কথা ইচ্ছে হল ভারী
মেঘে চড়ে, হাওয়ায় উড়ে এলাম তাড়াতাড়ি”
- “দাঁড়াও দাঁড়াও। মেঘে চড়ে? হাওয়ায় উড়ে? সে আবার হয় নাকি? সত্যি করে বল দেখি, কন্যে তুমি কে?”
- “আমি হলাম আকাশলীনা, মেঘের দেশে বাস
অজর অমর সবাই সেথায়, ফাগুন বারোমাস
আমার সাথে যাবে ছেলে, দেখবে নাকি ভেবে?
থাকব সাথে যদ্দিন না চন্দ্র-সূর্য নেভে।”
এমন সুন্দরী কন্যে! সে থাকে আকাশপারে! প্রস্তাব শুনে উরশিমার তো চোখে পলক পড়ে না। সে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবিশ্যি অবিশ্যি। নিশ্চয়ই যাব তোমার সাথে”। এই বলে সে আকাশলীনার হাতটি ধরে দুই চোখের পাতা বন্ধ করল। আর নিমেষের মধ্যেই তারা দুজনে পৌঁছে গেল মেঘের দেশে।
এমন দেশ উরশিমা কখনও দেখে নি। সে দেশের মাটি জেড পাথরের মত হাল্কা সবুজ আভায় উজ্জ্বল। সে দেশের আকাশ বর্ণনাতীত। তারা পৌঁছনো মাত্র পরীর মত সুন্দর ছ’টি মেয়ে ছুটে এল তাদের দিকে। “আকাশলীনার বর এসেছে। শুনছ সবাই, আকাশলীনার বর এসেছে” – বলতে বলতে তারা কলকল করে ছুটে গেল জেড পাথরের শোভায় স্নিগ্ধ, সবুজ এক প্রাসাদের দিকে।
- “এরা কারা?” উরশিমা জানতে চাইল।
- “বুঝলে না? কৃত্তিকারা ছ’বোন। একই সাথে সারাটি দিন এবং রাতের স্বপন।”
উরশিমা ভাবে বাহ রে! আকাশের ছ’টি তারা – কৃত্তিকা – তারাও কিনা আকাশলীনার বন্ধু! বলতে বলতেই এক ভারী সুন্দর সৌম্য দর্শন পুরুষ আর তেমনই সুন্দর এক মহিলা বেরিয়ে এলেন প্রাসাদ থেকে। তাঁরা আকাশলীনার মা-বাবা। আকাশপারের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীর মানুষের মিলন – এ ভারী বিরল ঘটনা। আকাশলীনার মা-বাবা বার বার বলতে লাগলেন কত খুশী হয়েছেন তাঁরা উরশিমাকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে। দেখতে দেখতে আরো লোক জড়ো হল। সকলেরই দিব্যকান্তি। এদেশে বার্ধক্য নেই। সকলেই ভারী হাসিখুশি। আকাশলীনা আর উরশিমার বিয়ে উপলক্ষ্যে সক্কলে মিলে খুব আনন্দ করল। নাচে-গানে, অপূর্ব সব খাদ্য-পানীয়ে মেঘের দেশে উরশিমার প্রথম দিনটি ঝলমল করতে লাগল।
* * * * * * * * * * *
দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেছে। উরশিমা আর আকাশলীনা মনের সুখে সংসার করছে। জেড পাথরের দেশটি তার সবুজ দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে উরশিমার সবুজ মনে, মেঘে মেঘে, আকাশলীনার চোখের তারায়। তিনটি বছর পরে উরশিমার হঠাৎ একদিন ফেলে আসার গ্রামের কথা, পৃথিবীর কথা মনে পড়ল। আহা, সেখানে বিকালগুলি কেমন হলুদ! সাগরের ঢেউয়ে নাচতে নাচতে মাছ ধরতে যাওয়ার সেই দিনগুলি! রাতের আঁধারে সাগরের ফেনা কেমন আলেয়ার মত জ্বলে! সেইসব পুরোনো কথা ভারী মনে পড়ে উরশিমার। তার গভীর দুই চোখে কুয়াশা ঘিরে আসে।
উরশিমার মনের ভাব আকাশলীনার নজর এড়াল না। সে জানতে চাইল কি হয়েছে। উরশিমা বলল, “গ্রামের কথা, আমার সেই ফেলে আসা পৃথিবীর কথা বড্ড মনে পড়ছে। সে দেশ এমন ঝলমলে নয়। এমন সবুজ আভা ছড়ায় না সেখানে। মানুষেরাও নয় এমন দেবতার মত সুন্দর। তবু তার কথা বড় মনে পড়ছে। খুব ইচ্ছে করছে নিজের বুড়ো বাপ-মাকে একটিবার দেখি।”
আকাশলীনা বুঝল উরশিমাকে বাধা দিয়ে কোনও লাভ হবে না। দুটিতে মিলে হাত ধরে অনেকক্ষণ হাটঁল চুপচাপ। মেঘের দেশে তখন দিন শেষের ঝিকিমিকি বেলা। অস্ত সূর্যের গোলাপী আলো যখন সন্ধ্যাতারার নীলে মুখ লুকালো তখন আকাশলীনা তার প্রিয়তম উরশিমার হাতে হীরে-মানিক গাঁথা একটি ছোট্ট কৌটো তুলে দিয়ে বলল,
- “উরশিমা, সবুজ ছেলে, নিজের ঘরে যাও
সাগরজলে ভাসাও গিয়ে ফেলে আসা নাও!
আকাশপারের দেশের কথা পড়েই যদি মনে
ফিরতে যদি ইচ্ছে করে জেড পাথরের বনে,
কৌটো ছুঁয়ে আমার কথা একটুখানি ভেবো
মেঘে চড়ে, হাওয়ায় উড়ে ঠিক পৌঁছে যাব।
কিন্তু বলি একটি কথা, দোহাই তোমার শুনো,
কোনমতেই এই কৌটো খুলবে না কক্ষনো ”
আকাশলীনার বাবা-মা ভারী দুঃখ পেলেন উরশিমার চলে যাওয়ার সংবাদে। কৃত্তিকারা ছ’বোন সেদিনের মেঘে ঢাকা আকাশে ম্লান আলোর ইশারা হয়ে জেগে রইল। আকাশলীনা হাসি মুখে উরশিমাকে তুলে দিল তার পুরোনো নৌকায়। বুজিয়ে দিল তার চোখের পাতা। নিমেষের মধ্যে আকাশের দেশ ফিকে হয়ে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগল সবুজ পৃথিবী। উরশিমার ফেলে আসা গ্রাম। নীল সাগরের ঢেউ তার কিনারে আছড়ে পড়ছে।
কিন্তু সব কেমন নতুন লাগে। যে পাথরটিতে বসে উরশিমা তার চাঁদের আলোর মত চিকণ জালের পরিচর্যা করতো সেটা সমুদ্রের কত কাছে চলে এসেছে! রাস্তাগুলোও কেমন বদলে গেছে। এই বাড়িগুলোই বা এখানে এল কোথা থেকে! উরশিমা ভাবে ভুল জায়গায় এসে পড়েছে নাকি! কিন্তু সমুদ্রের গন্ধ যে নির্ভুল বলে দিচ্ছে এ তারই গ্রাম।
- “আচ্ছা, উরশিমাদের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো আমায়? ওর বুড়ো বাপ, ওর মা – কেমন আছে তারা? আমায় সন্ধান দিতে পারো তাদের?”
সাগরপারে জটলা করা কিছু ছেলে উরশিমার প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকায়। দূরে এক শ্যাওলা ধরা পাথরের ওপর বসে ছিল এক বুড়োমত লোক। গোলমাল শুনে সে তার জীর্ণ হাতখানি তুলে উরশিমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।
- “তুমি কে হে বাপু? কোত্থেকে আসছ? এসব পুরোনো দিনের কথা জানলেই বা কেমন করে? শুনেছি বটে আমার বাপ-ঠাকুর্দার কাছে উরশিমা নামের এক জেলের কথা। সে নাকি সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে হারিয়ে গেছিল। তাকে আর কেউ কোনদিন দেখেনি। কিন্তু সে তো প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। এতদিন পর উরশিমার খোঁজ করছো, কে হে তুমি?”
তিনশো বছর! তিনশো বছর কেটে গেছে! উরশিমা ঘাড় নেড়ে বুড়োর কাছ থেকে চলে আসে। ঘুরে বেড়ায় তার পুরোনো গ্রামের পথে পথে। কিচ্ছুটি আর আগের মত নেই। একটা চেনা মানুষ নেই। চেনা বাড়ি নেই। তার ফেলে যাওয়া দেশটি সম্পূর্ন বদলে গেছে। শুধু সমুদ্রটা সেই আগের মতই সশব্দে আছড়ে পড়ছে পাথরের বুকে। দেখতে দেখতে দশটা দিন, দশটা রাত কেটে গেল। উরশিমা বসে আছে সাগরতীরে। হঠাৎ তার মনে পড়ল আকাশলীনার দেওয়া কৌটোটার কথা। আকাশলীনা কথা দিয়েছিল ওই কৌটো ছুঁয়ে তার কথা ভাবলেই সে চলে আসবে উরশিমার কাছে। আর তাহলেই তো আকাশলীনার সাথে উরশিমা আবার চলে যেতে পারবে মেঘের পারে। এই আত্মীয়-স্বজনহীন নির্বান্ধব দেশে আর থাকতে হবে না তাকে। আনন্দের চোটে উরশিমা ভুলেই গেল আকাশলীনা তাকে কৌটোটা খুলতে বারন করেছিল। সে তড়িঘড়ি হীরে-মানিক জড়ানো সেই মহামূল্যবান কৌটো খুলে বসলো। আর খোলা মাত্রই আকাশলীনার আবছায়া অবয়ব ধূপের ধোঁয়ার মত পাক খেতে খেতে মিশে গেল হাওয়ায় হাওয়ায়, মেঘে মেঘে।
উরশিমা বুঝল নিজের দোষেই সে চিরকালের মত হারালো আকাশলীনাকে। আর কোনদিন সে আকাশলীনার হাত ধরে মেঘের রাজ্যে হাঁটতে পারবে না, জেড পাথরের আভা মাখা সেই আকাশপারের দেশ তার কাছে আর নেমে আসবে না।
* * * * * * * * * * * * * * *
অনেক দিন কেটে গেছে। সাগরপারের ছেলে উরশিমা তার প্রিয় পাথরটিতে বসে তিনশো বছরের পুরোনো গ্রামটির কথা ভাবে। ছেলেবেলার কথা ভাবে। ঘোর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা ভাবে। একবার কেমন মাছের আকাল হয়েছিল আর তার জালে ধরা পড়েছিল এক পাঁচরঙা কাছিম – সেই কথা ভাবে। মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত মায়াবী আলোয় আকাশ ভরে যায়। নীলচে ধূসর মেঘের ফাঁক দিয়ে এক ফালি আলো এসে উরশিমার কপাল ছোঁয়। ঝোড়ো সমুদ্রও সেই আলো পেয়ে জেড পাথরের মত সবজে আভায় মসৃণ হয়ে ওঠে। উরশিমা বুঝতে পারে মেঘের ওপার থেকে আকাশলীনার তাকে মনে পড়েছে। সে গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠে। সবজেটে সমুদ্র শোঁ শোঁ শব্দে সঙ্গত করতে থাকে তার সাথে।
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago
অসাধারন !!
ReplyDeletedarun laglo :-) . budun o khub mon die shunlo.
ReplyDeletesatyi..Uroshimar jonye mon kharap hoye gelo...
ReplyDeletelekhata jathariti darun legechhe...
ভীষণ ছিমছাম, মায়াময়, মানে যেমনটা তুমি লেখ আর কী। অদ্ভুত ভালো লাগল। সঙ্গে দু-একটা পর্যবেক্ষন -
ReplyDelete“দেখ একবার ভেবে”র জায়গায় “দেখবে নাকি ভেবে” হলে কেমন হত? “কোন লাভ” নয়, “কোনও লাভ” লেখ।
শুভেচ্ছা...
bristir dine emon ekti anubad golpo mon ke akristo korey...sathe raktim bedonaye bhore othey mon...tao tumi sundar, resh rekhe jao.
ReplyDelete