আজ পনেরোই অগাস্ট। যদিও আমার কোন দায় নেই স্বাধীনতা দিবসের দিন ডায়েরী লিখতে বসার, তবু আজ রবিবার, হাতে কিছু উদ্বৃত্ত সময়, তাই কাটলাম নাহয় কিছু আঁকিবুকি। নাহ, আজ সারাদিনে একবারও ‘জনগনমন’ বা ‘বন্দেমাতরম’ শুনি নি। বরং দিন কেটেছে ষাট দশকের স্বাধীনতায় উন্নয়নের অগ্রগতির কিছু পরিসংখ্যান দেখে। তাতে মন বিক্ষিপ্তই হয়েছে বেশী। তবু দিনের শেষে আমার খিড়কি দোরের সিঁড়িটিতে বসতেই নাকে ভেসে এল বাপুজী কেকের গন্ধ। প্রভাতফেরী, পতাকা উত্তোলন, ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ আর ফেরার পথে একটি কাগজের বাক্সে গোটা দুই দানাদার, একখানি বাপুজী কেক – এই তো আমার স্বাধীনতা দিবস! যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, পনেরোই অগাস্টের দুপুর বেলায় ডিডি টু-তে দিল তামিল ছবি ‘রোজা’। ‘রোজা’র হিন্দী ভার্সান তখন রমরম করে চলছে। কিন্তু আমাদের ঘোরতর রাবীন্দ্রিক বাড়িতে হিন্দী মানেই অপসংস্কৃতি। দেশপ্রেমের ছুতোয় সেবারের পনেরোই অগাস্টে আমার অপসংস্কৃতিতে হাতেখড়ি হয়ে গেল। খোলা আকাশের নিচে মধু গাইছে – ‘ইয়ে হাসিন ওয়াদিয়া, ইয়ে খুলা আসমান’ – আহ, সে কি মুক্তি! রাবীন্দ্রিক রক্ষণশীলতা থেকে মুক্তি, নব্বই দশকের হিন্দী সিনেমার স্থবিরতা থেকে মুক্তি, সুরের মুক্তি! এরই কি নাম স্বাধীনতা?
স্বাধীন অবশ্য হলাম তার পরের বছরেই। সেই যে পনেরো বছর বয়েসে বাড়ি ছেড়ে বেরোলাম, আর তো ফেরা হল না। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লী, অ্যামেরিকা – যে বয়সে বাড়ি ছেড়েছি আরো ততগুলি বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আর দেশ বলতে কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক বৈচিত্র, কিছু বিশেষ মুখের সারি মনে ভাসে না। পাসপোর্টে যে দেশের ছাপ আছে, সেই ভূখন্ড তো দেশ বটেই; কিন্তু ঠিক ততটুকুতেই সে সীমাবদ্ধ নয়। যেখানে জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে, আমার সেই মফস্বল, সেই রেললাইন, কচুরীপানায় ঢাকা সেই সবুজ পুকুর – মনের ভেতরে ছবিটা এখনও অক্ষুণ্ণই আছে। আমার এই সিঁড়িতে বসেই দিব্যি দেখতে পাই পঞ্চাননতলার শিব-মন্দিরে ফাটল ধরেছে, বৈদ্যবাটী খালের সবুজ জলে ছায়া ঘনাল, চারুশীলা বসু বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে উদাসীন প্রেমিকদের সাইকেল বিলাস। দেখতে পাই সন্ধ্যা নামছে আমার মুখচোরা মফস্বলে। শেওড়াফুলি হাটের কাছে তেলেভাজা আর ঘাম মেশানো ঝাঁঝালো গন্ধ। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে কাঁসরের আওয়াজ। স্টেশনের কাছে নিষিদ্ধ পল্লিতে কূপী হাতে দাঁড়ানো কিছু কালো মেয়ে। এদের সকলকে নিয়ে আমার প্রথম পনেরোটা বছর। গরমের সন্ধ্যায় গা ধোয়ার পর প্রতিটি বাড়ি থেকে কেমন একটা ঠান্ডা আমেজ ছড়ায়, বেলফুলের গন্ধ ভেসে আসে, রিকশাওয়ালা জোরে হর্ণ বাজায় অফিস-ফেরত সওয়ারী নিয়ে, আর তারই মধ্যে ঝপাং করে লোডশেডিং হয়। আকাশের লুকিয়ে থাকা তারাগুলি জেগে ওঠে। সাতটি বুড়ো, মনে যাদের অনন্ত জিজ্ঞাসা, যাদের প্রথম দুজনকে অনুসরণ করলেই ধ্রুবতারাটির খোঁজ পাওয়া যায়, সেই পনেরো বছর থেকেই তাঁরা আছেন আমার সাথে। তাই দেশকে ছাড়লেও দেশ আমায় কখনও ছাড়ে না।
লেডি ব্রাবোর্নের হোস্টেলে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমি আমার একটেরে ঘরটির জানলা দিয়ে সাত বুড়োকে দেখতে পাই। ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপে ভারত একটার পর একটা উইকেট খোয়ায়, ডাইনিং রুমের টিভি বন্ধ করে আমরা মেয়ের দল হোস্টেলের মাঠে খোলা আকাশের নিচে বিষন্ন পায়চারী করি। তখন কত অল্পেতেই কত দুঃখ! তারপর টুয়েলভের ফেয়ারওয়েলের দিন গভীর রাতে অমৃতাদি গাইলো – ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু, পালাতে চাই, তবু সে আসে আমার পিছু পিছু’ – আমি শিউরে উঠে বুঝলাম অজান্তেই কখন কলকাতা ‘আমার শহর’ হয়ে উঠেছে। আমি আর শুধু বৈদ্যবাটির মেয়ে নই। কলকাতা মিশেছে আমার মধ্যে। হাজরা মোড়ে বাসের অপেক্ষা, কলেজ স্ট্রীটে পুরোনো বই ঘাঁটা, রবীন্দ্রসদনের আড্ডা, বৃষ্টিভেজা রেড রোড – সব যেন আমার সিগারেট ঠোঁটে চাপা নিরুত্তাপ প্রেমিক, নির্নিমেষ চেয়ে আছে আমার দিকে, ভাবটা এই – যাবি কোথায় আমায় ছেড়ে!
কিন্তু তার অখণ্ড অধিকারকে উপেক্ষা করেই একদিন চলে গেলাম মুম্বই। সেই প্রথম বাংলার বাইরে। জায়গাটা ভারতের ম্যাপের মধ্যে থাকলে কি হবে, এ আমার দেশ নয় – এমনটাই মনে হয়েছিল প্রথমে। অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি, অন্য খাদ্যাভ্যাস – এ তো কিছুতেই আমার হতে পারে না! রোজ নিয়ম করে ফোন যেত বাংলা দেশে, রাত এগারোটার পর যখন এস টি ডির চার্জ এক তৃতীয়াংশ হত। পড়াশোনা শেষ হলেই বাড়ি ফেরা – এমনটাই জানতাম। এর মধ্যে একদিন গেলাম মাথেরনে। আহ! সে কি বৃষ্টি! পশ্চিমঘাট সবুজে সবুজ। পায়ের তলায় মাটি গলে যাচ্ছে। ওরই মধ্যে চুপ্পুর ভিজে আমরা পাহাড়ের মাথায় চড়ার চেষ্টা করছি। জোরে জোরে আবৃত্তি করছি – ‘শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো? আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ, টক টক থাকে নাকো হ’লে পরে বিষ্টি, তখন দেখেছি চেখে একেবারে মিষ্টি’ – মনে ভাসেন সুকুমার রায় আর সেই তুমুল বৃষ্টিতে আপ্রাণ বোঝার চেষ্টা আকাশটা সত্যিই তাল-মিছরির পানা হয়ে ঝরছে কি না! এবং আবারও বড় বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার, পৃথিবীর শ্রেষ্ট বৃষ্টি বাংলা দেশে নয়, এই পশ্চিমঘাটেই হয়। তখনও কি একে নিজের দেশ নয় ভেবে দূরে রাখতে পারি! বিশেষ করে সেই সাত বুড়ো যখন সেখানেও সঙ্গী আছেন, শেষ রাতে পাওয়াই লেকের ধারে একাকী পদচারনায়!
তাঁরা আমার সাথেই দিল্লী এলেন। রাজধানী শহর। অন্ধকারেরও শহর। সে আমার মনের অন্ধকার, না শহরটির অন্ধকার – তা জানি না। সেই শহরেই প্রথম অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আবার সেই শহরেই জীবনযাপনের অনিবার্য পরাধীনতাগুলোর সাথে প্রথম পরিচয়। নিজেকে বদলানো, সভ্যতার খাতিরে, কর্পোরেট জীবনের খাতিরে। এককাপ কফির জন্য পঞ্চাশটাকা দাম দিয়েও মুখের পেশী একফোঁটাও বিকৃত না করার আভিজাত্যের শিক্ষা এই শহরেই প্রথম হল। এই শহরেই প্রথম দেখলাম মানুষ কি ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করছে তার প্রেক্ষিতেই কেমন সহজ হিসেবে তার সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা যায়। অনেকরাত হত বাড়ি ফিরতে। একদিন দেড়টা ছাড়িয়ে গেল। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখি আমার রক্ষণশীল পাঞ্জাবী বাড়িওয়ালী উদ্বিগ্ন মুখে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আঙ্কেল ঘর-বার করছেন। আমাকে দেখে তাঁদের যে স্বস্তির নিশ্বাসটা পড়ল, সেই একটা নিমেষে এই শহরটাও কেমন নিজের হয়ে গেল। তারপরেও কমলানগর মার্কেটে সুযোগসন্ধানীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়েছে, তারপরেও অটোওয়ালা ঠকিয়েছে, তারপরেও এই শহর তার স্থূলতা প্রকট করেছে বারবার, কিন্তু সেই সাত বুড়োকে আবার আমি দেখতে পাচ্ছিলাম নিয়মিত, আমার চিলেকোঠার বারান্দা থেকে।
তারপরেতে সাত-সমুদ্দুর, তেরো নদীর পার, খুকু এবার সত্যি করেই দেশের হল বার! আবারও যথারীতি ভেবেছি, এই তো, বছর দুয়েক থাকবো মোটে, তারপরেতেই পড়া হবে শেষ, ফিরবো নিজের দেশ। যেমনটা ভেবেছিলাম মুম্বইতে, যেমনটা দিল্লীতে, ঠিক তেমনটাই অবিকল। শুধু এবারে দেশের ধারনাটা অন্যরকম। কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় বাড়ি বলতে বুঝতাম বৈদ্যবাটি। মুম্বই-দিল্লীতে থাকাকালীন দেশ মানে কলকাতা, তখন আর বৈদ্যবাটি ফেরার কথা ভাবি না। আর পৃথিবীর অপর পিঠে বসে দেশকে ভাবলে গোটা ভারতকেই দেখতে পাই। ভারত যেন একটা ট্রেন। সেকেন্ড ক্লাস স্লীপারের কামরা। বেশ নোংরা, চিনে বাদামের খোলা ছড়িয়ে আছে মেঝেতে, এক বিকলাঙ্গ নুলো ছেলে ঝাঁট দিচ্ছে। পয়সা চাইছে জনে জনে। কেউ আধুলী ছুঁড়ে দেয়, কেউ উদাসীন – না দেখার ভান করে তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। বাইরে প্রচন্ড গরম, লু আসছে জানলা দিয়ে। মানুষের কিন্তু তাপ-উত্তাপ নেই। ওরই মধ্যে পুরী-সবজী চলছে, তাস চলছে, জমি-বাড়ি-প্রপার্টি চলছে, ভিখিরির ইনিয়ে-বিনিয়ে গান চলছে, এফ-এমে বলিউডি লাস্য চলছে। আর মাঝে মাঝে এসবের থেকে চোখ সরানোর অবকাশ মিললে দেখা যাচ্ছে চলার দুই পাশে সঙ্গী আছে হলুদ-সবুজ ধানক্ষেত, তিরতিরে রূপোলী নদী, ইউক্যালিপটাসের বন, গোধূলীর অস্তবেলায় জন্ম নেওয়া একফালি শীর্ণ চাঁদ। এবং আবারও সেই সাত বুড়ো। যারা এই ভিনদেশে এসেও আমার সঙ্গ ছাড়ে নি। প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে ওঠার পর দেখেছি এদেশের মানুষও গ্রহন করছেন দেশীয় সহজতায়। গত শীতে ভারতে হপ্তাতিনেক কাটিয়ে এদেশে ফিরছি। শিকাগোতে যখন নামলাম তখন তাপমাত্রা মাইনাস তিরিশ। শাটল বাসে করে ব্লুমিংটনের পথে। দেখি সাদা বালির মত মিহি তুষারকণায় শেষ সূর্যের লাল আভা গলে পড়ছে। আহ! শীত তো এমনই হওয়া উচিত। এমন সাদা, এমন প্রশান্ত, এমন আত্মভোলা। হঠাৎ খেয়াল হল বাড়ির জন্য মন কেমন একেবারেই নেই। মরমে মরে গেলাম। আমি কি দ্বিচারিনী! সন্ধ্যা নামে। টালমাটাল মন নিয়ে বাইরে তাকাই। তারাভরা আকাশে সাত জিজ্ঞাসু সেই একই রকম অনন্ত প্রশ্নের খোঁজে বিভোর। ‘যে নাহং নামৃতাস্যাং, কি মহং তেন কুর্যাং’? যে অমৃতের সন্ধান শুরু হয়েছিল পশ্চিম বাংলার একটি মফস্বলে তাকে এখানেও অব্যাহত দেখতে পাই। ভিনদেশের আকাশও এই ভাবেই নিজের আকাশ হয়ে ওঠে। বৈদ্যবাটির সূর্যাস্ত আর ব্লুমিংটনের সূর্যাস্তে বিশেষ তফাৎ খুঁজে পাই না। খুব সাধ হয় একবার দক্ষিণ গোলার্ধে যাই। শুনেছি সেখানে আকাশ অন্যরকম। একবার যদি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারি, যদি একবার সেই আকাশকেও নিজের মনে গেঁথে নিতে পারি, যদি পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত হতে উপরের দিকে চাইলেই সবকটি তারা আমার দিকে চেয়ে হাসে, সেদিন কি পরিক্রমা শেষ হয়? সেদিন কি আসে স্বাধীনতা?
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteeta ki likhechho diaryr patay?? kobitar moto sundor godyo hoyeche, nikhaad - chitto jetha bhoyshunyo, uchcho jetha sheer mone poRchilo khub. ki kore lekho emon?
ReplyDeleteBhishon bhalo laglo.
ছোট্ট মফস্বলে বড় হওয়া মেয়েরা যখন ডানা মেলে উড়ে যায় এদিক ওদিক, তহ্কন তাদের অনুভুতিগুলো অনেকটাই একরকম হয় বোধহয়৷
ReplyDeleteki sundor lekho tumi... mone hoi jeno chobi aankcho!
ReplyDeletekobitar moton godya.. ar jugopojogi bhabna chinta monke chhnue galo.. aro lekhar opekhai roilam
ReplyDeleteচোখের সামনে দিয়ে বৈদ্যবাটি, শেওড়াফুলি আর কলকাতার চেনা জায়গা গুলি আর একবার ভেসে চলে গেল। আপনার চোখ দিয়ে আবার নতুন ভাবে দেখলাম।
ReplyDeleteএকটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হঠাৎ মনে হল। আজ আপনি যেখানে থাকেন, সেখানে না থেকে যদি অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা বা অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে হত - আর তো আপনার সাত বুড়োকে দেখতে পেতেন না । তখন কাদের কথা বলতেন এই লেখাতে?
ReplyDeletetokhon kaader katha boltam taar ingit sesh pargraph e achhe to! :)
ReplyDelete