About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Monday, August 30, 2010

উরশিমা নামের জেলেটি

[একটি জাপানী রূপকথার ছায়ানুসারে। দিয়ালা ২০১০ পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত।
http://diyala.kochisamsad.com/godyo/urshima-namer-jeleti.html]

অনেক অনেক দিন আগে জাপান দেশে উরশিমা নামে এক জেলে থাকত। সারাদিন ধরে সে সমুদ্রে মাছ ধরে বেড়ায়। ঢেউয়ের পিঠে চেপে মাছের পিছু পিছু সে চলে যায় বহু বহু দূর। একবার হয়েছে কি, দিনের পর দিন যায়, মাছের বড় আকাল। উরশিমা সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল ডুবে রাত – সারাবেলা জাল বিছিয়ে বসে থাকে, কিচ্ছুটি পায় না। এইভাবে অনেক দিনের পর উরশিমা দেখে এক পাঁচরঙা কাছিম গুটি গুটি উঠে এসেছে তার জালে। মাছের বদলে কাছিম, তো তাই সই! পাঁচরঙা কাছিমটিকে নৌ্কোর খোলে রেখে, অনেক রাত পর উরশিমা খুব ঘুমোল।

ঘুম থেকে উঠে উরশিমা তো তাজ্জব। কোথায় কাছিম! এতো এক পরমাসুন্দরী কন্যে বসে আছে তার শিয়রের কাছে! কন্যে মিষ্টি হেসে বলল,


- “আকাশ থেকে দেখতে পেলাম অথৈ সাগর জলে
ডিঙি চেপে বেড়ায় ঘুরে একলাটি এক ছেলে
তোমার সাথে কইতে কথা ইচ্ছে হল ভারী
মেঘে চড়ে, হাওয়ায় উড়ে এলাম তাড়াতাড়ি”

- “দাঁড়াও দাঁড়াও। মেঘে চড়ে? হাওয়ায় উড়ে? সে আবার হয় নাকি? সত্যি করে বল দেখি, কন্যে তুমি কে?”

- “আমি হলাম আকাশলীনা, মেঘের দেশে বাস
অজর অমর সবাই সেথায়, ফাগুন বারোমাস
আমার সাথে যাবে ছেলে, দেখবে নাকি ভেবে?
থাকব সাথে যদ্দিন না চন্দ্র-সূর্য নেভে।”

এমন সুন্দরী কন্যে! সে থাকে আকাশপারে! প্রস্তাব শুনে উরশিমার তো চোখে পলক পড়ে না। সে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবিশ্যি অবিশ্যি। নিশ্চয়ই যাব তোমার সাথে”। এই বলে সে আকাশলীনার হাতটি ধরে দুই চোখের পাতা বন্ধ করল। আর নিমেষের মধ্যেই তারা দুজনে পৌঁছে গেল মেঘের দেশে।

এমন দেশ উরশিমা কখনও দেখে নি। সে দেশের মাটি জেড পাথরের মত হাল্কা সবুজ আভায় উজ্জ্বল। সে দেশের আকাশ বর্ণনাতীত। তারা পৌঁছনো মাত্র পরীর মত সুন্দর ছ’টি মেয়ে ছুটে এল তাদের দিকে। “আকাশলীনার বর এসেছে। শুনছ সবাই, আকাশলীনার বর এসেছে” – বলতে বলতে তারা কলকল করে ছুটে গেল জেড পাথরের শোভায় স্নিগ্ধ, সবুজ এক প্রাসাদের দিকে।

- “এরা কারা?” উরশিমা জানতে চাইল।

- “বুঝলে না? কৃত্তিকারা ছ’বোন। একই সাথে সারাটি দিন এবং রাতের স্বপন।”

উরশিমা ভাবে বাহ রে! আকাশের ছ’টি তারা – কৃত্তিকা – তারাও কিনা আকাশলীনার বন্ধু! বলতে বলতেই এক ভারী সুন্দর সৌম্য দর্শন পুরুষ আর তেমনই সুন্দর এক মহিলা বেরিয়ে এলেন প্রাসাদ থেকে। তাঁরা আকাশলীনার মা-বাবা। আকাশপারের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীর মানুষের মিলন – এ ভারী বিরল ঘটনা। আকাশলীনার মা-বাবা বার বার বলতে লাগলেন কত খুশী হয়েছেন তাঁরা উরশিমাকে নিজেদের মধ্যে পেয়ে। দেখতে দেখতে আরো লোক জড়ো হল। সকলেরই দিব্যকান্তি। এদেশে বার্ধক্য নেই। সকলেই ভারী হাসিখুশি। আকাশলীনা আর উরশিমার বিয়ে উপলক্ষ্যে সক্কলে মিলে খুব আনন্দ করল। নাচে-গানে, অপূর্ব সব খাদ্য-পানীয়ে মেঘের দেশে উরশিমার প্রথম দিনটি ঝলমল করতে লাগল।

* * * * * * * * * * *

দেখতে দেখতে তিনটি বছর কেটে গেছে। উরশিমা আর আকাশলীনা মনের সুখে সংসার করছে। জেড পাথরের দেশটি তার সবুজ দীপ্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে উরশিমার সবুজ মনে, মেঘে মেঘে, আকাশলীনার চোখের তারায়। তিনটি বছর পরে উরশিমার হঠাৎ একদিন ফেলে আসার গ্রামের কথা, পৃথিবীর কথা মনে পড়ল। আহা, সেখানে বিকালগুলি কেমন হলুদ! সাগরের ঢেউয়ে নাচতে নাচতে মাছ ধরতে যাওয়ার সেই দিনগুলি! রাতের আঁধারে সাগরের ফেনা কেমন আলেয়ার মত জ্বলে! সেইসব পুরোনো কথা ভারী মনে পড়ে উরশিমার। তার গভীর দুই চোখে কুয়াশা ঘিরে আসে।

উরশিমার মনের ভাব আকাশলীনার নজর এড়াল না। সে জানতে চাইল কি হয়েছে। উরশিমা বলল, “গ্রামের কথা, আমার সেই ফেলে আসা পৃথিবীর কথা বড্ড মনে পড়ছে। সে দেশ এমন ঝলমলে নয়। এমন সবুজ আভা ছড়ায় না সেখানে। মানুষেরাও নয় এমন দেবতার মত সুন্দর। তবু তার কথা বড় মনে পড়ছে। খুব ইচ্ছে করছে নিজের বুড়ো বাপ-মাকে একটিবার দেখি।”

আকাশলীনা বুঝল উরশিমাকে বাধা দিয়ে কোনও লাভ হবে না। দুটিতে মিলে হাত ধরে অনেকক্ষণ হাটঁল চুপচাপ। মেঘের দেশে তখন দিন শেষের ঝিকিমিকি বেলা। অস্ত সূর্যের গোলাপী আলো যখন সন্ধ্যাতারার নীলে মুখ লুকালো তখন আকাশলীনা তার প্রিয়তম উরশিমার হাতে হীরে-মানিক গাঁথা একটি ছোট্ট কৌটো তুলে দিয়ে বলল,

- “উরশিমা, সবুজ ছেলে, নিজের ঘরে যাও
সাগরজলে ভাসাও গিয়ে ফেলে আসা নাও!
আকাশপারের দেশের কথা পড়েই যদি মনে
ফিরতে যদি ইচ্ছে করে জেড পাথরের বনে,
কৌটো ছুঁয়ে আমার কথা একটুখানি ভেবো
মেঘে চড়ে, হাওয়ায় উড়ে ঠিক পৌঁছে যাব।
কিন্তু বলি একটি কথা, দোহাই তোমার শুনো,
কোনমতেই এই কৌটো খুলবে না কক্ষনো ”

আকাশলীনার বাবা-মা ভারী দুঃখ পেলেন উরশিমার চলে যাওয়ার সংবাদে। কৃত্তিকারা ছ’বোন সেদিনের মেঘে ঢাকা আকাশে ম্লান আলোর ইশারা হয়ে জেগে রইল। আকাশলীনা হাসি মুখে উরশিমাকে তুলে দিল তার পুরোনো নৌকায়। বুজিয়ে দিল তার চোখের পাতা। নিমেষের মধ্যে আকাশের দেশ ফিকে হয়ে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগল সবুজ পৃথিবী। উরশিমার ফেলে আসা গ্রাম। নীল সাগরের ঢেউ তার কিনারে আছড়ে পড়ছে।

কিন্তু সব কেমন নতুন লাগে। যে পাথরটিতে বসে উরশিমা তার চাঁদের আলোর মত চিকণ জালের পরিচর্যা করতো সেটা সমুদ্রের কত কাছে চলে এসেছে! রাস্তাগুলোও কেমন বদলে গেছে। এই বাড়িগুলোই বা এখানে এল কোথা থেকে! উরশিমা ভাবে ভুল জায়গায় এসে পড়েছে নাকি! কিন্তু সমুদ্রের গন্ধ যে নির্ভুল বলে দিচ্ছে এ তারই গ্রাম।

- “আচ্ছা, উরশিমাদের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারো আমায়? ওর বুড়ো বাপ, ওর মা – কেমন আছে তারা? আমায় সন্ধান দিতে পারো তাদের?”

সাগরপারে জটলা করা কিছু ছেলে উরশিমার প্রশ্নে অবাক হয়ে তাকায়। দূরে এক শ্যাওলা ধরা পাথরের ওপর বসে ছিল এক বুড়োমত লোক। গোলমাল শুনে সে তার জীর্ণ হাতখানি তুলে উরশিমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।

- “তুমি কে হে বাপু? কোত্থেকে আসছ? এসব পুরোনো দিনের কথা জানলেই বা কেমন করে? শুনেছি বটে আমার বাপ-ঠাকুর্দার কাছে উরশিমা নামের এক জেলের কথা। সে নাকি সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে হারিয়ে গেছিল। তাকে আর কেউ কোনদিন দেখেনি। কিন্তু সে তো প্রায় তিনশো বছর আগের কথা। এতদিন পর উরশিমার খোঁজ করছো, কে হে তুমি?”

তিনশো বছর! তিনশো বছর কেটে গেছে! উরশিমা ঘাড় নেড়ে বুড়োর কাছ থেকে চলে আসে। ঘুরে বেড়ায় তার পুরোনো গ্রামের পথে পথে। কিচ্ছুটি আর আগের মত নেই। একটা চেনা মানুষ নেই। চেনা বাড়ি নেই। তার ফেলে যাওয়া দেশটি সম্পূর্ন বদলে গেছে। শুধু সমুদ্রটা সেই আগের মতই সশব্দে আছড়ে পড়ছে পাথরের বুকে। দেখতে দেখতে দশটা দিন, দশটা রাত কেটে গেল। উরশিমা বসে আছে সাগরতীরে। হঠাৎ তার মনে পড়ল আকাশলীনার দেওয়া কৌটোটার কথা। আকাশলীনা কথা দিয়েছিল ওই কৌটো ছুঁয়ে তার কথা ভাবলেই সে চলে আসবে উরশিমার কাছে। আর তাহলেই তো আকাশলীনার সাথে উরশিমা আবার চলে যেতে পারবে মেঘের পারে। এই আত্মীয়-স্বজনহীন নির্বান্ধব দেশে আর থাকতে হবে না তাকে। আনন্দের চোটে উরশিমা ভুলেই গেল আকাশলীনা তাকে কৌটোটা খুলতে বারন করেছিল। সে তড়িঘড়ি হীরে-মানিক জড়ানো সেই মহামূল্যবান কৌটো খুলে বসলো। আর খোলা মাত্রই আকাশলীনার আবছায়া অবয়ব ধূপের ধোঁয়ার মত পাক খেতে খেতে মিশে গেল হাওয়ায় হাওয়ায়, মেঘে মেঘে।


উরশিমা বুঝল নিজের দোষেই সে চিরকালের মত হারালো আকাশলীনাকে। আর কোনদিন সে আকাশলীনার হাত ধরে মেঘের রাজ্যে হাঁটতে পারবে না, জেড পাথরের আভা মাখা সেই আকাশপারের দেশ তার কাছে আর নেমে আসবে না।

* * * * * * * * * * * * * * *

অনেক দিন কেটে গেছে। সাগরপারের ছেলে উরশিমা তার প্রিয় পাথরটিতে বসে তিনশো বছরের পুরোনো গ্রামটির কথা ভাবে। ছেলেবেলার কথা ভাবে। ঘোর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার কথা ভাবে। একবার কেমন মাছের আকাল হয়েছিল আর তার জালে ধরা পড়েছিল এক পাঁচরঙা কাছিম – সেই কথা ভাবে। মাঝে মাঝে এক অদ্ভুত মায়াবী আলোয় আকাশ ভরে যায়। নীলচে ধূসর মেঘের ফাঁক দিয়ে এক ফালি আলো এসে উরশিমার কপাল ছোঁয়। ঝোড়ো সমুদ্রও সেই আলো পেয়ে জেড পাথরের মত সবজে আভায় মসৃণ হয়ে ওঠে। উরশিমা বুঝতে পারে মেঘের ওপার থেকে আকাশলীনার তাকে মনে পড়েছে। সে গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠে। সবজেটে সমুদ্র শোঁ শোঁ শব্দে সঙ্গত করতে থাকে তার সাথে।

Sunday, August 29, 2010

নিষাদ

আমার এই একটি মাত্র গলি
সপাট ওষ্ঠাঘাতে
বাঁশিওলা, তুমি ডেকে যাও
আমি সেই পথে চলি।

আমার এই একটি মাত্র সুর
অলীক নিষাদ রাতে
উদাসীন, করো ছেলেখেলা
জেগে থাকি, ক্ষণভঙ্গুর।

আমার এই একটি মাত্র ঘর
শিথিল বিস্মৃতিতে
আকিঞ্চন, আমি কড়া নাড়ি
পাশ ফেরো, বিলাসী ঈশ্বর!

Sunday, August 22, 2010

অবান্তর কথামালা - ৩

আমার খুব ইচ্ছে করছে কিছু লিখতে। কিন্তু আমার মনে কোন ভাবনা নেই – ব্লটিং পেপারের মত নিদাগ। কবিতা লিখব ভাবি। শব্দেরা দেখা দিয়েই পালিয়ে যায়। তাদের গাঁথা যায় না। ধরা যায় না। ইচ্ছে হয় চাবুকের মত গদ্য লিখি। আমার তূণে কোন অস্ত্র নেই। আমার খিড়কি দোরে দিন শেষের আলো তেরছা ভাবে বিছিয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি অসহায়। চাকা বসে যাওয়া সৈনিকের মত। দিন বয়ে যায়। দিন বয়ে যায়। আমার লেখা হয় না। কতিপয় শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করি শুধু। সামনে আনি, পিছনে আনি। সাজাই গোছাই। পণ্ডশ্রম খালি। একটি লাইনও তার পূর্ণ রূপ নিয়ে আমার সামনে মুখোস খোলে না।

চাকা বসে যাওয়া সৈনিকের মহাভারতীয় উপমা হঠাৎ কেন মনে এল কে জানে! আমার ছোট থেকেই বীরপূজায় মন। মহাভারতেও আমি অর্জুনকেই ভালোবেসেছি। কর্ণের পরিণতি নিয়ে ভাবি নি কখনও। কর্ণকে প্রথম ভালো লেগেছিল পিটার ব্রুকের মহাভারত দেখে। কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতার ঘন কালো চোখ – এক বুক শূন্যতা নিয়ে সেই চোখ তাকিয়েছিল – কিসের দিকে – শূন্যতার দিকেই বোধহয়। দেখার মত আর কিই বা ছিল! সেই চোখ দেখে প্রথম কর্ণের কথা ভাবলাম। পিটার ব্রুকের মহাভারতে আবহসঙ্গীত ভারী সুন্দর। শর্মিলা রায় পোমোর গাওয়া – “অন্তর মম বিকশিত কর, অন্তরতর হে”। আজ মনে হচ্ছে এই গান বোধহয় কর্ণের কথা, দ্রৌপদীর কথা, যুধিষ্ঠিরেরও কথা। কিন্তু অর্জুনের কথা কি? তার কি অন্তর নিয়ে বিশেষ মাথাব্যাথা ছিল? সে তো সারাজীবন ধরে নিয়মনিষ্ঠ সৈনিক, নিয়মনিষ্ঠ সন্তান, নিয়মনিষ্ঠ ভাই; এমন কি তার প্রেমও নিক্তিমাপা। বস্তুত তার চেয়ে দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ মহাভারতে দ্বিতীয়টি নেই। পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, ভাইদের রক্ষা করা – এই তার জীবনের স্থির উদ্দেশ্য। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ – কিচ্ছুটি তাকে স্পর্শ করে না। এমনকি অনুশোচনাও নয়। সে যেন মানুষ নয়, যেন প্রোগ্রাম করা একটি অ্যান্ড্রয়েড।

যুধিষ্ঠির নিজেকে নিয়ে বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে। সে রাজা হতে চায় নি, তবু রাজা হওয়ার দায় তার। আচারে সে ক্ষত্রিয়, যদিও তার মনটি ব্রাহ্মণের, পড়ুয়ার। আবারও ঋণ পিটার ব্রুকের কাছে। ধর্মের সাথে কথোপকথনের দৃশ্যটি না দেখলে হয়ত যুধিষ্ঠিরের স্বরূপ এভাবে বুঝতাম না। সারাজীবন তাকে নিজের বুদ্ধি আর ভবিতব্যের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হল। এদিক দিয়ে সে কর্ণের সাথে তুলনীয়। “দেখিয়াছি শান্তিময় শূন্য পরিণাম” – দুজনেই দেখেছিল। আর দেখার পরেও তার কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। তাই আড়াই হাজার (কি জানি মহাভারতের সঠিক বয়েস কত! এ নিয়ে তো অনেক দ্বিমত আছে) বছর পরের পাঠকের চিন্তায় তারা বারবার ফিরে আসে। “অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় – আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতর খেলা করে। আমাদের ক্লান্ত, ক্লান্ত করে”- যতবার উচ্চারণ করি এই দুটি লাইন, যুধিষ্ঠিরকে মনে পড়ে, মনে পড়ে কর্ণের শূন্য দৃষ্টি। কিন্তু অর্জুন? সে জন্ম থেকেই একটি বলিপ্রদত্ত পবিত্র পশু। মাংস, শুধু মাংসের জন্য বড় করা। ভরণ-পোষন, যত্ন-আত্তি, সোহাগ-আহ্লাদ – সব কিছুই শেষের দিনটির কথা মনে রেখে। আর সেও উৎসর্গ হওয়াতেই জীবনের চরম সিদ্ধি জেনে এসেছে। শুধুমাত্র অভিমন্যু বধের সন্ধ্যাটুকু ছাড়া আমরা অর্জুনকে কখনও উত্তেজিত হতে দেখি না। একমাত্র ঐ খণ্ডমূহুর্তে তাকে মানুষ মনে হয়। বাকি জীবন ধরে সে ধর্মাচরণের মত যুদ্ধবৃত্তি করে গেছে। যদি বা কিছু সংশয় ক্কচিৎ কদাচিৎ ছায়া ফেলেছে মনে, তার প্রবল কর্তব্যবোধের সামনে তা খড়কুটোর মত ভেসে গেছে। মহাভারতের সব চেয়ে বড় বীর – সব চেয়ে তুচ্ছ বোড়ের মত জীবন তার। কর্ণ নয়, যুধিষ্ঠির নয়, দ্রৌপদী নয় – মহাভারতকার সব চেয়ে বড় ফাঁকিবাজিটা তার সাথেই খেলেছেন। অন্তরের মাঝে যে অন্তরতর – যার সন্ধান কর্ণ পেয়েছে তার হতাশা দিয়ে, যুধিষ্ঠির পেয়েছে বিপন্নতা দিয়ে, দ্রৌপদী পেয়েছে ক্রোধ দিয়ে, এমনকি ভীম, যে ভীমকে তামসিক মানুষ বলেই জানি, সেও তাঁকে ছুঁয়েছে তার প্রেম দিয়ে – সেই অন্তরতর-র আভাসটুকুও অর্জুনকে দিলেন না মহাভারতকার। মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় বঞ্চনা আর কি হতে পারে!


পিটার ব্রুকের মহাভারতঃ
যুধিষ্ঠির ও ধর্মঃ http://www.youtube.com/watch?v=uiMpjoL5Yws&feature=related
অন্তর মম বিকশিত করঃ http://www.youtube.com/watch?v=JpaT14XddKk&feature=related
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রঃ http://www.youtube.com/watch?v=IGvpq6vV3lI&feature=related

Saturday, August 21, 2010

সত্যি-মিথ্যের গপ্পো

[অনুবাদ। গুগল বুকসে বই সার্চ করতে গিয়ে এই লোককথাটি পেলাম। ইংরিজি নাম "The Old Lady in the Cave" , তবে লোককথাটি কোন দেশের তার উল্লেখ ছিল না। ঈষৎ মেল-শভিনিজম আছে। কি আর করা যাবে। লোককথা এমনই হয়]

এক যে ছিল ছেলে। আর ছিল এক মেয়ে। গোলা ভরা ধান, দীঘি ভরা মাছ, অতিথ-স্বজন, ভজন-পূজন, সাত-মহলা বাড়ি – তাদের কিচ্ছুটি নেই অভাব। তবুও ছেলের বাউন্ডুলে স্বভাব। একলা বসে দীঘির পাড়ে আকাশ-পাতাল ভাবে। মনেতে নাই সুখ। দেখে মেয়ের ভয়েই কাঁপে বুক।

“আচ্ছা শুনি, ব্যাপারটা কি তোমার?”, শুধোয় মেয়ে, “সারাটা দিন আপন মনে অতই বা কি ভাবো? এমন বাড়ি, জমিদারী, লোকে মান্যি করে কত! কোথায় তোমার মন? মুখের কাছে খাবার ধরি – মাছের মুড়ো, মন্ডা-মেঠাই, গব্য ঘৃতে তপ্ত ভাজা লুচি। কিচ্ছুতে নেই রুচি! মেজাজ যেন লাট সাহেবের নাতি! গা জ্বলে যায় দেখলে এমন উলটপানা বাতিক!”

“একটি কথাই ঘুরে ফিরে আসে আমার মনে।”, বললে ছেলে, “‘সত্য’ কোথায় থাকে? তার মুখের কেমন আদল? কোন দেশেতে বসত বারোমাস? কেমন ধরন, কেমন চলন, কেমন বেশবাস? জানতে বড় সাধ হয় রে মেয়ে! কে জানে কোথায় লুকিয়ে আছে পথের বাঁকে! অথবা কোন দীঘির মায়ায়, স্তব্ধ নিবিড় হিজল ছায়ায় পাতার ফাঁকে! ছুঁতে গেলেই হারিয়ে যায় শিশিরফোঁটা! তার খোঁজেতেই আমার ছোটা।”

“মরনরোগে ধরছে তোমায় ছোঁড়া! খণ্ডাবে কে লিখন তোমার পথে পথেই ঘোরা! তবে যাওয়ার আগে হিসেব-নিকেশ চোকাও ষোলোআনা। টাকা-কড়ি, গয়না-গাঁটি, জমির মালিকানা – প্রাপ্য বুঝে নেবো। তারপরেতে যাও যেখানে খুশী। খোঁজ নেবো না মোটে। কপাল আমার! এমন মানুষ আমার ঘরেই জোটে!”

যেমন কথা, সেইমত কাজ। তালুক-তুলুক, মালুক-মুলুক – যা কিছু তার ছিল, লিখে দিয়ে মেয়ের নামে, ছেলে বেরোয় পথের টানে। কুয়াশালীন পাহাড়ি পথ, তরুণ উপত্যকা, আলো-ছায়ার মায়াবী দিন, রামধনুতে ঢাকা – পেরিয়ে গেল। তারপরেতে মস্ত শহর, ব্যাস্ত সবাই ভারী, ঝলমলানো আলোর মালা, আকাশ-ছোঁয়া বাড়ি – দেখলো তাও। তবুও ছেলে সত্য পায় না খুঁজে। পথ দেখাল সাঁঝের পিদিম, সবুজ মোড়া মখমলী গ্রাম, ছোট্ট নদী খামখেয়ালী, বেগুনী ফুল অচেনা নাম – যেইখানে যায় – সবজেটে-নীল বনের ধারে, ঝিনুক-ছেঁচা সাগরপারে, জোছনাহীন অন্ধকারে ঢেউ আছড়ায় খরস্রোতা – কোত্থাও নেই, যার খোঁজেতে এতটা পথ, সেই মেয়েটা কোত্থাও নেই!

দিনের পর দিন কাটে। মাসের পর মাস। পথের পর পথ বয়ে যায়। ছেলের মলিন বেশবাস। এইভাবেতে অনেক দিনের, অনেক পথের শেষে, সন্ধ্যা যখন তারার আলোয় মেশে, ক্লান্ত ছেলে থামল এসে পাহাড়চুড়োয়। একলা সে দেশ নিথর কালো আকাশ ছোঁয়া। পাথর ঘেরা অপরিসর ছোট্ট গুহা। সেই গুহাতে বাস করে এক বুড়ি। ফোকলা বুড়ি, একখানি দাঁত মোটে। শনের নুড়ি চুলের গুছি পিঠ ছাপানো, জোলো হাওয়ায় উড়ছে এলোমেলো। হাড় ক’খানি চামড়া দিয়ে ঢাকা, তীক্ষ্ণ সে মুখ – ছেলে দেখতে পেল। কে এই বুড়ি! কুদর্শনা, দৃষ্টি কেমনতর! ভাবছে ছেলে। এমন সময় বাড়িয়ে হাত, শীর্ণ আঙুল, হলদেটে নখ দীর্ঘ অতি – বুড়ি তাকে ডাকছে ইশারাতে। ছেলেও তখন বেভুল কেমন, চলছে বুড়ির পিছু পিছু, গুহার পথে। আনমুনি গান গাইছে বুড়ি, অবাক সে সুর, শোনেনি কেউ কোথাও। বলছে কথা ছেলের সাথে, গলার আওয়াজ নদীর স্বরের মত, নিখাদ নিটোল, জগতে যা কিছু খাঁটি, বুড়ির গলায় পড়ছে ঝরে, অটুট পরিপাটি। একেই খুঁজতে আসা – বুঝল ছেলে। পাহাড়-নদী-অরন্যপথ, অথই সাগর, নীল জনপদ – অনেক ঘোরার পরে, এবার পেলাম দেখা। ‘সত্য’ বলেই চিনছি তাকে। নিখুঁত স্বরলেখা।

ছেলে ক’দিন সেইখানেতেই থাকে। প্রশ্ন যত জমাট ছিল মনে, চলা-ফেরায় আনা-গোনায় একলা ঘরের কোণে, শুধোয় তাকে। সত্য-বুড়ি যত্ন করে বোঝায়। ছেলের মনে পোষ মেনেছে ঝড়, শুনে কাঁচের মত স্বচ্ছতোয়া, অপূর্ব সে স্বর। দিন কেটে যায়, মাস কেটে যায়। বছর ঘোরার পরে, ভাবছে ছেলে, এবার বাড়ি টানে, ফিরব দেশে। বিদায় নিতে বুড়ির কাছে আসে।

“অনেক কিছু শিখেছি তোমার কাছে”, বলছে ছেলে, “এবার ঘরে ফেরা। ফেরার আগে আমায় বল বুড়ি, যদি কোন ইচ্ছে থাকে তোমার, যদি কোন কাজে লাগতে পারি?”

ফোকলা বুড়ি ঘাড় বেঁকিয়ে ভাবে। প্রাচীন নখের ইশারাতে আবার তাকে ডাকে। “শোনো হে ছেলে, ফিরবে যবে ঘরে, বলবে যখন আমার কথা বন্ধু-স্বজনেরে, সেসব কথা কেমন হবে বুঝতে ভালোই পারি। আমার কেমন মুখের গড়ন, চামড়া কোমল কিনা, হাসলে পরে মুক্তো ঝরে নাকি, এসব নিয়ে চলবে বাড়াবাড়ি। দোহাই ছেলে, এই কথাটি রেখো”, সত্য-বুড়ি কাতর হেসে বলে, তীক্ষ্ণ চোখে আবেশ জড়ায় ভারী, জানায় মনের ইচ্ছে গভীর গোপন, “বোলো তাদের, সত্য হল চিকন, সুদর্শনা লাবণ্যময় যুবতী এক নারী।”

Sunday, August 15, 2010

সাত বুড়োর দেশ

আজ পনেরোই অগাস্ট। যদিও আমার কোন দায় নেই স্বাধীনতা দিবসের দিন ডায়েরী লিখতে বসার, তবু আজ রবিবার, হাতে কিছু উদ্বৃত্ত সময়, তাই কাটলাম নাহয় কিছু আঁকিবুকি। নাহ, আজ সারাদিনে একবারও ‘জনগনমন’ বা ‘বন্দেমাতরম’ শুনি নি। বরং দিন কেটেছে ষাট দশকের স্বাধীনতায় উন্নয়নের অগ্রগতির কিছু পরিসংখ্যান দেখে। তাতে মন বিক্ষিপ্তই হয়েছে বেশী। তবু দিনের শেষে আমার খিড়কি দোরের সিঁড়িটিতে বসতেই নাকে ভেসে এল বাপুজী কেকের গন্ধ। প্রভাতফেরী, পতাকা উত্তোলন, ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’ আর ফেরার পথে একটি কাগজের বাক্সে গোটা দুই দানাদার, একখানি বাপুজী কেক – এই তো আমার স্বাধীনতা দিবস! যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, পনেরোই অগাস্টের দুপুর বেলায় ডিডি টু-তে দিল তামিল ছবি ‘রোজা’। ‘রোজা’র হিন্দী ভার্সান তখন রমরম করে চলছে। কিন্তু আমাদের ঘোরতর রাবীন্দ্রিক বাড়িতে হিন্দী মানেই অপসংস্কৃতি। দেশপ্রেমের ছুতোয় সেবারের পনেরোই অগাস্টে আমার অপসংস্কৃতিতে হাতেখড়ি হয়ে গেল। খোলা আকাশের নিচে মধু গাইছে – ‘ইয়ে হাসিন ওয়াদিয়া, ইয়ে খুলা আসমান’ – আহ, সে কি মুক্তি! রাবীন্দ্রিক রক্ষণশীলতা থেকে মুক্তি, নব্বই দশকের হিন্দী সিনেমার স্থবিরতা থেকে মুক্তি, সুরের মুক্তি! এরই কি নাম স্বাধীনতা?

স্বাধীন অবশ্য হলাম তার পরের বছরেই। সেই যে পনেরো বছর বয়েসে বাড়ি ছেড়ে বেরোলাম, আর তো ফেরা হল না। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লী, অ্যামেরিকা – যে বয়সে বাড়ি ছেড়েছি আরো ততগুলি বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আর দেশ বলতে কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক বৈচিত্র, কিছু বিশেষ মুখের সারি মনে ভাসে না। পাসপোর্টে যে দেশের ছাপ আছে, সেই ভূখন্ড তো দেশ বটেই; কিন্তু ঠিক ততটুকুতেই সে সীমাবদ্ধ নয়। যেখানে জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে, আমার সেই মফস্বল, সেই রেললাইন, কচুরীপানায় ঢাকা সেই সবুজ পুকুর – মনের ভেতরে ছবিটা এখনও অক্ষুণ্ণই আছে। আমার এই সিঁড়িতে বসেই দিব্যি দেখতে পাই পঞ্চাননতলার শিব-মন্দিরে ফাটল ধরেছে, বৈদ্যবাটী খালের সবুজ জলে ছায়া ঘনাল, চারুশীলা বসু বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে উদাসীন প্রেমিকদের সাইকেল বিলাস। দেখতে পাই সন্ধ্যা নামছে আমার মুখচোরা মফস্বলে। শেওড়াফুলি হাটের কাছে তেলেভাজা আর ঘাম মেশানো ঝাঁঝালো গন্ধ। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে কাঁসরের আওয়াজ। স্টেশনের কাছে নিষিদ্ধ পল্লিতে কূপী হাতে দাঁড়ানো কিছু কালো মেয়ে। এদের সকলকে নিয়ে আমার প্রথম পনেরোটা বছর। গরমের সন্ধ্যায় গা ধোয়ার পর প্রতিটি বাড়ি থেকে কেমন একটা ঠান্ডা আমেজ ছড়ায়, বেলফুলের গন্ধ ভেসে আসে, রিকশাওয়ালা জোরে হর্ণ বাজায় অফিস-ফেরত সওয়ারী নিয়ে, আর তারই মধ্যে ঝপাং করে লোডশেডিং হয়। আকাশের লুকিয়ে থাকা তারাগুলি জেগে ওঠে। সাতটি বুড়ো, মনে যাদের অনন্ত জিজ্ঞাসা, যাদের প্রথম দুজনকে অনুসরণ করলেই ধ্রুবতারাটির খোঁজ পাওয়া যায়, সেই পনেরো বছর থেকেই তাঁরা আছেন আমার সাথে। তাই দেশকে ছাড়লেও দেশ আমায় কখনও ছাড়ে না।

লেডি ব্রাবোর্নের হোস্টেলে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। আমি আমার একটেরে ঘরটির জানলা দিয়ে সাত বুড়োকে দেখতে পাই। ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপে ভারত একটার পর একটা উইকেট খোয়ায়, ডাইনিং রুমের টিভি বন্ধ করে আমরা মেয়ের দল হোস্টেলের মাঠে খোলা আকাশের নিচে বিষন্ন পায়চারী করি। তখন কত অল্পেতেই কত দুঃখ! তারপর টুয়েলভের ফেয়ারওয়েলের দিন গভীর রাতে অমৃতাদি গাইলো – ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু, পালাতে চাই, তবু সে আসে আমার পিছু পিছু’ – আমি শিউরে উঠে বুঝলাম অজান্তেই কখন কলকাতা ‘আমার শহর’ হয়ে উঠেছে। আমি আর শুধু বৈদ্যবাটির মেয়ে নই। কলকাতা মিশেছে আমার মধ্যে। হাজরা মোড়ে বাসের অপেক্ষা, কলেজ স্ট্রীটে পুরোনো বই ঘাঁটা, রবীন্দ্রসদনের আড্ডা, বৃষ্টিভেজা রেড রোড – সব যেন আমার সিগারেট ঠোঁটে চাপা নিরুত্তাপ প্রেমিক, নির্নিমেষ চেয়ে আছে আমার দিকে, ভাবটা এই – যাবি কোথায় আমায় ছেড়ে!

কিন্তু তার অখণ্ড অধিকারকে উপেক্ষা করেই একদিন চলে গেলাম মুম্বই। সেই প্রথম বাংলার বাইরে। জায়গাটা ভারতের ম্যাপের মধ্যে থাকলে কি হবে, এ আমার দেশ নয় – এমনটাই মনে হয়েছিল প্রথমে। অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতি, অন্য খাদ্যাভ্যাস – এ তো কিছুতেই আমার হতে পারে না! রোজ নিয়ম করে ফোন যেত বাংলা দেশে, রাত এগারোটার পর যখন এস টি ডির চার্জ এক তৃতীয়াংশ হত। পড়াশোনা শেষ হলেই বাড়ি ফেরা – এমনটাই জানতাম। এর মধ্যে একদিন গেলাম মাথেরনে। আহ! সে কি বৃষ্টি! পশ্চিমঘাট সবুজে সবুজ। পায়ের তলায় মাটি গলে যাচ্ছে। ওরই মধ্যে চুপ্পুর ভিজে আমরা পাহাড়ের মাথায় চড়ার চেষ্টা করছি। জোরে জোরে আবৃত্তি করছি – ‘শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো? আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ, টক টক থাকে নাকো হ’লে পরে বিষ্টি, তখন দেখেছি চেখে একেবারে মিষ্টি’ – মনে ভাসেন সুকুমার রায় আর সেই তুমুল বৃষ্টিতে আপ্রাণ বোঝার চেষ্টা আকাশটা সত্যিই তাল-মিছরির পানা হয়ে ঝরছে কি না! এবং আবারও বড় বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার, পৃথিবীর শ্রেষ্ট বৃষ্টি বাংলা দেশে নয়, এই পশ্চিমঘাটেই হয়। তখনও কি একে নিজের দেশ নয় ভেবে দূরে রাখতে পারি! বিশেষ করে সেই সাত বুড়ো যখন সেখানেও সঙ্গী আছেন, শেষ রাতে পাওয়াই লেকের ধারে একাকী পদচারনায়!

তাঁরা আমার সাথেই দিল্লী এলেন। রাজধানী শহর। অন্ধকারেরও শহর। সে আমার মনের অন্ধকার, না শহরটির অন্ধকার – তা জানি না। সেই শহরেই প্রথম অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আবার সেই শহরেই জীবনযাপনের অনিবার্য পরাধীনতাগুলোর সাথে প্রথম পরিচয়। নিজেকে বদলানো, সভ্যতার খাতিরে, কর্পোরেট জীবনের খাতিরে। এককাপ কফির জন্য পঞ্চাশটাকা দাম দিয়েও মুখের পেশী একফোঁটাও বিকৃত না করার আভিজাত্যের শিক্ষা এই শহরেই প্রথম হল। এই শহরেই প্রথম দেখলাম মানুষ কি ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা ব্যবহার করছে তার প্রেক্ষিতেই কেমন সহজ হিসেবে তার সামাজিক অবস্থান নির্ণয় করা যায়। অনেকরাত হত বাড়ি ফিরতে। একদিন দেড়টা ছাড়িয়ে গেল। বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেখি আমার রক্ষণশীল পাঞ্জাবী বাড়িওয়ালী উদ্বিগ্ন মুখে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আঙ্কেল ঘর-বার করছেন। আমাকে দেখে তাঁদের যে স্বস্তির নিশ্বাসটা পড়ল, সেই একটা নিমেষে এই শহরটাও কেমন নিজের হয়ে গেল। তারপরেও কমলানগর মার্কেটে সুযোগসন্ধানীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়েছে, তারপরেও অটোওয়ালা ঠকিয়েছে, তারপরেও এই শহর তার স্থূলতা প্রকট করেছে বারবার, কিন্তু সেই সাত বুড়োকে আবার আমি দেখতে পাচ্ছিলাম নিয়মিত, আমার চিলেকোঠার বারান্দা থেকে।

তারপরেতে সাত-সমুদ্দুর, তেরো নদীর পার, খুকু এবার সত্যি করেই দেশের হল বার! আবারও যথারীতি ভেবেছি, এই তো, বছর দুয়েক থাকবো মোটে, তারপরেতেই পড়া হবে শেষ, ফিরবো নিজের দেশ। যেমনটা ভেবেছিলাম মুম্বইতে, যেমনটা দিল্লীতে, ঠিক তেমনটাই অবিকল। শুধু এবারে দেশের ধারনাটা অন্যরকম। কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় বাড়ি বলতে বুঝতাম বৈদ্যবাটি। মুম্বই-দিল্লীতে থাকাকালীন দেশ মানে কলকাতা, তখন আর বৈদ্যবাটি ফেরার কথা ভাবি না। আর পৃথিবীর অপর পিঠে বসে দেশকে ভাবলে গোটা ভারতকেই দেখতে পাই। ভারত যেন একটা ট্রেন। সেকেন্ড ক্লাস স্লীপারের কামরা। বেশ নোংরা, চিনে বাদামের খোলা ছড়িয়ে আছে মেঝেতে, এক বিকলাঙ্গ নুলো ছেলে ঝাঁট দিচ্ছে। পয়সা চাইছে জনে জনে। কেউ আধুলী ছুঁড়ে দেয়, কেউ উদাসীন – না দেখার ভান করে তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। বাইরে প্রচন্ড গরম, লু আসছে জানলা দিয়ে। মানুষের কিন্তু তাপ-উত্তাপ নেই। ওরই মধ্যে পুরী-সবজী চলছে, তাস চলছে, জমি-বাড়ি-প্রপার্টি চলছে, ভিখিরির ইনিয়ে-বিনিয়ে গান চলছে, এফ-এমে বলিউডি লাস্য চলছে। আর মাঝে মাঝে এসবের থেকে চোখ সরানোর অবকাশ মিললে দেখা যাচ্ছে চলার দুই পাশে সঙ্গী আছে হলুদ-সবুজ ধানক্ষেত, তিরতিরে রূপোলী নদী, ইউক্যালিপটাসের বন, গোধূলীর অস্তবেলায় জন্ম নেওয়া একফালি শীর্ণ চাঁদ। এবং আবারও সেই সাত বুড়ো। যারা এই ভিনদেশে এসেও আমার সঙ্গ ছাড়ে নি। প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে ওঠার পর দেখেছি এদেশের মানুষও গ্রহন করছেন দেশীয় সহজতায়। গত শীতে ভারতে হপ্তাতিনেক কাটিয়ে এদেশে ফিরছি। শিকাগোতে যখন নামলাম তখন তাপমাত্রা মাইনাস তিরিশ। শাটল বাসে করে ব্লুমিংটনের পথে। দেখি সাদা বালির মত মিহি তুষারকণায় শেষ সূর্যের লাল আভা গলে পড়ছে। আহ! শীত তো এমনই হওয়া উচিত। এমন সাদা, এমন প্রশান্ত, এমন আত্মভোলা। হঠাৎ খেয়াল হল বাড়ির জন্য মন কেমন একেবারেই নেই। মরমে মরে গেলাম। আমি কি দ্বিচারিনী! সন্ধ্যা নামে। টালমাটাল মন নিয়ে বাইরে তাকাই। তারাভরা আকাশে সাত জিজ্ঞাসু সেই একই রকম অনন্ত প্রশ্নের খোঁজে বিভোর। ‘যে নাহং নামৃতাস্যাং, কি মহং তেন কুর্যাং’? যে অমৃতের সন্ধান শুরু হয়েছিল পশ্চিম বাংলার একটি মফস্বলে তাকে এখানেও অব্যাহত দেখতে পাই। ভিনদেশের আকাশও এই ভাবেই নিজের আকাশ হয়ে ওঠে। বৈদ্যবাটির সূর্যাস্ত আর ব্লুমিংটনের সূর্যাস্তে বিশেষ তফাৎ খুঁজে পাই না। খুব সাধ হয় একবার দক্ষিণ গোলার্ধে যাই। শুনেছি সেখানে আকাশ অন্যরকম। একবার যদি সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে পারি, যদি একবার সেই আকাশকেও নিজের মনে গেঁথে নিতে পারি, যদি পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত হতে উপরের দিকে চাইলেই সবকটি তারা আমার দিকে চেয়ে হাসে, সেদিন কি পরিক্রমা শেষ হয়? সেদিন কি আসে স্বাধীনতা?

Friday, August 13, 2010

আবার বৃষ্টি...

আচ্ছা বলো, আছেটা কি বৃষ্টি ছাড়া?
গুমোট ছিল অভিমানী মেঘলা দুপুর
সারা বিকেল গান শুনেছি মনখারাপী
ঘুম ভাঙালো পাল্লা ভাঙা দমকা হাওয়া

তুমিই বলো, ঠেকাই তাকে সাধ্যটা কি?
তারপরেতেই ধুলোয় ভরে সমস্ত ঘর
উঠোন জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় পাগল ছেলে
বর্শা ফলায় গাঁথছে আমায় শিকার-পটু
বলো আমায়, কিই বা থাকে বৃষ্টি ছাড়া?

Thursday, August 12, 2010

অবান্তর কথামালা - ২

পথে শব্দ গড়ায়
আমি ছন্দে গাঁথি
ঝরে বিষাদ কণা
আমি আঁজলা পাতি

যত জমাট বিষাদ
চাপা রক্তক্ষরণ
আমি লাগাই পালিশ
করি স্ট্রীট-স্মার্টায়ন

কিছু পালিশ চটক
আর আলগা বাহার
আমি সন্ধ্যা গানে
সঁপি কথার পাহাড়

জানি গানের পারে
তুমি দাঁড়িয়ে আছো
ওহে আলোর পোকা
তুমি সুরেই বাঁচো

আমি সুর অচেতন
করি শব্দ জড়ো
ভিতু গায়ন-বিমুখ
শুধু অঙ্কে দড়


[মারাত্মক শ্রীজাত প্রভাব]

Wednesday, August 11, 2010

অবান্তর কথামালা - ১

পাকিস্তানে বন্যায় দেড় কোটি লোক ঘর ছাড়া। চীনে প্রবল বৃষ্টিতে ল্যান্ড স্লাইড। কম করে হাজার মানুষ মারা গেছে। তিন দিন আগে লেহ-তে ক্লাউড বার্স্ট হয়ে চারখানা গ্রাম ভেসে গেল। আর আমি কাল বৃষ্টি নিয়ে পদ্য লিখেছি। আজকাল কিছুতেই কিছু এসে যায় না। পাশের বাড়িতে আগুন লাগলেও বোধহয় একবার উঁকি দিয়ে কৌতুহল নিভিয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখতে পারি। আজকাল কোন খবরেই বিচলিত হই না। কাকার স্ট্রোক। বেশ। দিদা মরে গেল। বেশ। ছোটবেলার খেলার সাথী উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়াচ্ছে। বেশ। প্রেমে লাথি খেয়ে পাড়ার মেয়েটার নার্ভাস ব্রেকডাউন। বেশ। ক্লাস এইটের ছেলেকে ট্রেন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। বেশ। সবই বেশ। কফি খেতে খেতে, প্রসাধনী মাখতে মাখতে মুচমুচে খবর। পদ্মপাতায় জল। দু’মিনিটের জন্য টলমল করে। তারপরেই কোথায় গড়িয়ে যায় – খোঁজ রাখি না। কিচ্ছুটি ছাপ ফেলে না। কিচ্ছুটি না। এসব নিয়ে লিখতেও আমার ঘেন্না করে। নিজেকে চুড়ান্ত অসৎ মনে হয়। এর চেয়ে ‘আমি-তুমি-তুমি-আমি’ প্রেমের পদ্য লেখা ভালো। সেখানেও অসৎ। তবু এতখানি লজ্জায় ফেলে না সেটা। আর মনটাও ভারী ফুরফুরে হয়। দিব্যি ফানুস হয়ে ভেসে বেড়ায়। মাটির টান থাকে না। কোন দায় থাকে না। এক ফোঁটাও আওয়াজ পৌঁছয় না। বেশ মনোরম এই আকাশ-বিহার।

Tuesday, August 10, 2010

বৃষ্টি, সুমন, কাঙাল, প্রথমশহর ও কিছু গেঁজে যাওয়া নস্টালজিয়া

বৃষ্টি আমার পুরোনো রোগ, নতুন কথা কি আর লিখি?
তাই বা কেন, এ পাতাও তো রোমন্থনের প্রাত্যহিকি!
আজকে কেমন সকাল থেকেই মেঘ করেছে আকাশজুড়ে
আঁকড়ে বালিশ, পদ্য লিখি, পি-পু-ফি-শু হদ্দ কুঁড়ে।
এমন দিনে সুমন গানে আসছে মনে প্রথম শহর –
প্রথম সাঁতার, প্রথম চেনার, প্রথম ডোবার তীক্ষ্ণ প্রহর!
প্রথম রাগের, পরাজয়ের, বিপন্নতার প্রথম রেখা,
নিরুদ্দেশে প্রথম সফর, প্রথম বারের আয়না দেখা!
আরো অনেক প্রথম আমার দাঁড়িয়ে আছে পথের বাঁকে –
অপেক্ষাতে জমছে আষাঢ়, নিকোটিনে, ক্লাসের ফাঁকে।
সুমন শেখান নিমেষ ছোঁয়ার বাউন্ডুলে কাঙালপনা
অকাল মেঘে ভাসুক শহর, শিরায় নাচুক বৃষ্টিকণা!

Saturday, August 7, 2010

আমার আসলে কোন ফেরা নেই


আমার আসলে কোন ফেরা নেই।
জানি এ শীতের রাতে
জ়েগে আছে আমার শহর -
চাঁদে পাওয়া ঘুসঘুসে বুড়ি,
একলাটি রেলপথ,
মথুরা নগর ছাড়া বহুদিন,
জড়ো করে কানা ভাঙা চকমকি নুড়ি।

আমার যদিও কোন ফেরা নেই।
আমার মায়াবী বাড়ি -
আহা, সে শীতের রাত!
বসেছিল আগুনের বড় কাছাকাছি,
গোল গোল ধোঁয়া ওঠা,
মোলায়েম রুশ দেশী রুটি -
বুড়ো মেঘ, আমিও তো দিন আনি দিন খাই বাঁচি!

আমার অবশ্য কোন ফেরা নেই।
আমার রূপসী সিঁড়ি,
খুঁটে বাঁধা চেকনাই ঘোড়া,
ছাইচাপা জোছনাতে এবারেও চাঁদ ডাকে, আয় –
আমি তো বাধ্য মেয়ে,
কথা মত ছায়াপথ হাঁটি -
আমার সমস্ত পথ, যথারীতি, তোমার কাছেই যায়!

The Crows

আমি খুব লেট লার্নার। বাঙালী হবু আঁতেলরা যা সতেরো থেকে একুশের মধ্যে করে ফেলে আমি তা তিরিশে করি। আমি এখন কুরোসাওয়ার ‘ড্রিমস’ ছবিটি দেখছি। এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আমাকে এখনই লিখতে হল। কারন পাঁচ নম্বর ছবিটা – ‘দ্য ক্রো’স’ নিয়ে আমি ব্লগ লিখেছিলাম এপ্রিল মাসে। তখন অবশ্য জানতাম না ভ্যান ঘঘের এই ছবিটা – ‘Wheatfield with Crows’ নিয়ে কুরোসাওয়াও ছবি করেছেন। আগেই বলেছি – আমি নেহাতই মূর্খ। আমি ছবিটা প্রথম দেখি ইন্টারনেটে। আসলটা আছে অ্যামস্টারডামে। লোকে ভাবতে ভালোবাসে এই ছবিটা আঁকার পরই ভ্যান ঘঘ আত্মহত্যা করেন, যদিও সেটা সত্যি নয়।

ছবিটা এমন ভাবে ডাকত... শেষ পর্যন্ত একটা প্রিন্ট কিনে এনে নিজের ঘরের দেওয়ালেই লাগিয়ে দিলাম। কতবার এই ছবির দিকে সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থেকেছি! আজ জানলাম কুরোসাওয়ার স্বপ্নেও আসত এই ছবি। একটি লোক গ্যালারীতে বসে ছিল। তারপর সে ছবির মধ্যে ঢুকে গেল। যে ছবিটা দিয়ে ঢুকল সেটা আমার চেনা নয় – একটি ব্রিজের নিচে কিছু মেয়ে কাপড় কাচছে – পরে নাম খুঁজে পেলে লিখে দেব। ছবির রাস্তায় লোকটা ভ্যান ঘঘকে দেখতে পায়। কিন্তু সেই পাগলের সাথে পাল্লা দিয়ে পথ চলা কি সাধারণ মানুষের কাজ! যথারীতি হারিয়ে ফেলে তাকে। তারপর এ ছবি, ও ছবি – অনেক ছবি ঘুরে সে আসে এই পাগলাটে হলুদ গমক্ষেতে। ভিনসেন্ট সেখানে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন দিগন্তের দিকে। তারপরই চারদিক থেকে অসংখ্য কাক এসে সব কিছু ঢেকে দিতে থাকে। আমি কখনও বুঝতে পারি না কাকগুলো কোন দিকে আসছে – আমার দিকে, নাকি ভিনসেন্ট যেদিকে গেলেন সেই দিকে! এবারেও বুঝতে পারলাম না। বারবার দেখলাম। ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে, স্ক্রিন ফ্রিজ করে। কিন্তু কাকগুলো কেন এসেছে, কি চায়, কোনদিকে উড়ছে তা এবারেও বুঝতে পারলাম না! অথচ জানি, আমি আবারও তাকিয়ে থাকব ছবিটার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কাকেরা কোথায় যেতে চায় না জানা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।

Wednesday, August 4, 2010

নেই মানুষ

আচ্ছা ধরা যাক, আমি নেই। ‘নেই’ মানে ‘নেই’ নয়। দিব্যি আছি। ভূত-টুত কিছু হই নি। খালি একটু বদলে গেছি। বলা যেতে পারে ‘নেই মানুষ’ হয়ে গেছি। হেই মানুষের জায়গায় নেই মানুষ। কালো-কোলো আধমনি চেহারার জায়গায় একটা মিষ্টি মত সবজ়ে ছায়া হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি যে দিকে মন চায়। এই ইচ্ছে হল, রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়া পপি’স চিকেনের ফ্লায়ারটার সাথে এক পাক নেচে নিলাম। পরের মূহুর্তেই চড়ে বসেছি সিলভার ম্যাপেলের মগডালে। শ্রীমান কাকেশ্বরের পাশটিতে বসে গম্ভীর গলায় বলছি – ক্কঃ! আর সে ব্যাটা চমকে চিৎপাত। একরাশ হাওয়া দিল। ফুরফুরে চেরি ব্লসমের সাথে জড়িয়ে-মরিয়ে আমি সটান মাটিতে। ঘাসের বুকে শুয়ে মজাসে দেয়ালা করছি। একটা মভ রঙের ফ্রক পরা ঘোঁতন মত মেয়ে উদোল-বুদোল পায়ে আঁকাবাঁকা হাঁটতে হাঁটতে থুপুস করে পড়ল আমার ওপর। আর অমনি আমি ওর প্রজাপতি ক্লিপে আটকে গেলাম। তারপর আর কিছুতেই বেরোতে পারি না। আমাকে তো বসিয়ে দিয়েছে গাড়ীর পিছনে কার সিটে। আমিও চলেছি ওর সাথে সাথে আকাশ দেখতে দেখতে, বাতাস দেখতে দেখতে, সবুজ দেখতে দেখতে – রোদ্দুরের সাথে ছুটতে ছুটতে। একটিবারের জন্য রেস্ট এরিয়ায় দাঁড়িয়েছে গাড়ি। আর আমিও সেই সুযোগে ধাঁ! এক লাফে আকাশে উঠে গিয়ে এক টুকরো ছায়া হয়ে রোদ্দুরের বুকে লেগে রইলাম।

ওমা! শুনি লোকজনে বলাবলি করছে – কি আপদ! মেঘটাকে এখনই আসতে হল! কার্নিভালটা মাটি না হলে বাঁচি! কার্নিভাল? কোথায় কার্নিভাল? আমি কার্নিভাল দেখব! তরতর করে নেমে আসি আবার। নাগরদোলায় একটি পাক খেয়ে মাটি ছুঁই। দেখি একশো লোকের ভীড় জমেছে। মুখোস এসেছে আফ্রিকা থেকে। ইটালী থেকে ঘন বুনোটের ট্যাপেস্ট্রি। মরক্কোর চামড়ার ব্যাগ। জাপানী জলরং। অ্যাজটেক পুঁতির গয়না। সরগরম ব্যাপার একেবারে! আমি তক্কে তক্কে লেগে রইলাম এক ছবিওলার গায়ে আঠার মত। ভারী ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে সে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা ঘুরে বেড়ায় আর ছবি তোলে। কখনও সে চলে যায় জর্ডনে – শেষ সূর্যের আলো যখন পেট্রাকে গোলাপী আভায় মুড়ে দেয় তার চোখে পলক পড়ে না। চাঁদনী রাতে রাওয়ান্ডার জঙ্গলে বসে সে নীলনদের জন্মকথা শোনে। ইস্টার দ্বীপে পাহাড় সমান মানুষের মুখগুলোর নীচে দাঁড়িয়ে একমুঠি ধুলো ভরে নেয় তার চামড়ার পাউচে। রঙ-বেরঙের পাথর ছড়ানো কাসিদের বেলাভূমিতে আনমনা হাঁটে। ভারী কাজের মানুষ। এবারে যাবে দক্ষিণ আমেরিকায়। আমিও ওর সাথে ভেসে ভেসে চলি লিমা, লিমা থেকে কুজকো, কুজকো থেকে ইনকা ট্রেল ধরে হাঁটতে থাকি মাচুপিচুর দিকে। সারাদিন হাঁটি। সন্ধ্যে হলে তাঁবু খাটিয়ে জিরিয়ে নিই। অল্প অল্প চাঁদের আলো আর কুয়াশা মাখা আন্দিজ একরাশ রূপকথা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন আমরা আকাশে পৌঁছোই। মাচুপিচুর সবুজ শিখর ধূসর নীল মেঘে ডুবে আছে। ওই ম্লান মেঘ আমায় ডাকে। আমি আমার ছবিওলার ঝোলা থেকে বেরিয়ে সেই বিষাদে মিশে যাই।

বাংলা দেশে তখনও আলো ফোটে নি। গুমোট রাতের শেষে আমি আকাশ ভরা কেদার হয়ে বাজতে থাকি। পায়ের তলায় পুরোনো শহর। আমার ফেলে আসা সব কিছু। কিছুটা চেনা, কিছুটা অচেনা। আমি অবিশ্রাম বৃষ্টি হয়ে ঝরতে থাকি আমার আধোচেনা অতীতে। মা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে বেরোতে গিয়ে দেখে থই থই করছে জল। সাবধানে শাড়ী বাঁচিয়ে রেললাইনের ধার দিয়ে হাঁটে মা। আমি মায়ের শাড়ীর আঁচলে লেগে থাকি। মায়ের পিঠে ছিটে ছিটে জলের কণা হয়ে জড়িয়ে থাকি মা-কে। ভিজে মাটির গন্ধ হয়ে মায়ের নাকে ভাসি। জলে ভিজে মায়ের অল্প অল্প সর্দি হয়। আমি এক টুকরো ব্যাথা হয়ে সারাদিন ঝুলতে থাকি আমার মায়ের গলা ধরে।

Monday, August 2, 2010

ভ্যান-তারা

কাল অয়দিপাউসকে নিয়ে আঁতলামী করে ডায়েরী লিখলাম। সেটা পড়ে রাজাদাদা আমাকে এই গানটা দিল।
"এই যে হেরিলে চোখে অপরূপ ছবি
অরুণ গগনতলে প্রভাতের রবি
এই তো পরম দান, সফল করিল প্রান,
সত্যের আনন্দরূপ, এই তো জাগিছে
ক্ষত যত, ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে,
নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে পিছে"

এই গানটা ভাবতে ভাবতে আমার ষোলো বছর আগের একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি প্রথম বড়দের বই পড়ছি। বাড়িতে লুকিয়ে, অন্য বই-এর ভাঁজে – বুদ্ধদেব গুহ-র ‘সবিনয় নিবেদন’। মানুষের স্মৃতি কি অদ্ভুত! নিষিদ্ধ জগতে প্রথম পা রাখার সেই গোপন উত্তেজনা এখন আর কিচ্ছু মনে নেই। কেমন ছিল গল্প, কি হয়েছিল – সেসব কিচ্ছু না। শুধু কি করে জানি মনে থেকে গেছে – কোন একটা সময়ে মেয়েটা খুব বিভ্রান্ত ছিল, তখন লোকটা ওকে চিঠিতে লিখেছিল – মনে মনে এই দুটো লাইন বার বার গাইবে, গাইতেই থাকবে যতক্ষণ না বাকি সব ভুলে যাও –
“হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই
সংসারে যা দিবে মানিব তাই
হৃদয়ে তোমায় যেন পাই”

ষোলো বছর আগে এই গানের মানে নিশ্চয়ই বুঝি নি। তখন যাবতীয় ‘মেনে নেওয়া’র প্রতি তীব্র বিদ্রোহ। আর দয়া! সে অনুভূতির সাথে পরিচয় সাদা-কালো টিভির পর্দায় বিদ্যাসাগর-রূপী পাহাড়ী সান্যালেই সীমাবদ্ধ। নিষিদ্ধ ফল চাখতে ব্যস্ত কৌতূহলী মন সেদিন গানটাকে মুখস্থ করে নিয়েছিল। আজ কেমন একবার মনে করতেই ধোয়া-মোছা ন্যাপথলিনে মোড়া স্মৃতিটাকে আমায় ফিরিয়ে দিল!

আমরা ভারী ভাগ্যবান – আমাদের দেশে একটা মানুষ জন্মেছিলেন যিনি দেড়শো বছর ধরে একটা জাতের ইমোশনাল ক্রাইসিস একা হাতে সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে, age-এ cage-এ rage-এ ও মঙ্গলে – এমন বন্ধু আর কে আছে, তোমার মত মিস্টার!

ন’বছর আগের কথা মনে পড়ে। তখন আমি বম্বে আই আই টি তে। জীবনে প্রথম একটা টেপ রেকর্ডার পেয়েছি। তাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোটা চারেক ক্যাসেট শুনি। মাঝে মাঝেই মাঝ রাত্তিরে ল্যাব থেকে ফিরে লো ভলিউমে চালাতাম
“আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব”

কি বলব মশাই! অদ্ভুত বল পেতাম। অদ্ভুত! আমার একটু তারা দেখা বাতিক আছে তা তো জানেনই। সেই সব রাত্তিরে মনে হত, আমার জানলার ফাঁক দিয়ে ধরা দেওয়া এক চিলতে আকাশটায় বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। যেন সব কটা আলোর কণা পাগলের মত পাক খাচ্ছে। সব কিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত আর শান্ত হয়ে যাচ্ছে। তারপর সেই শান্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে একে সবকটি তারা আবার জ্বলে উঠত। সক্কলে মিলে বলত – এই তো আমরা! ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছি, জীবন নব নব!

আরও ছ’বছর পর জেনেছিলাম, সেই ছবিটার নাম Starry Night. আর তার আকাশে সব চেয়ে উজ্জ্বল যে তারাটা – তিনিই আমার রবি ঠাকুর।



গান শোনা যাবে এখানে
হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাইঃ http://www.in.com/music/search.php?type=song&search_data=Hridaye+Tomar+Daya+Jeno+Paai+Ashok
আমারে তুমি অশেষ করেছঃ http://www.in.com/music/search.php?type=song&search_data=Amare+Tumi+Asesh+Korechho

Sunday, August 1, 2010

Some things are better left unsaid

আমার মাঝে মাঝেই আঁতেল হওয়ার শখ জাগে। তখন আমি বিদেশী সিনেমা দেখি, ইংরিজিতে উপনিষদ পড়ি, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ভুল ভাল জায়গায় মাথা নাড়াই – এই সব আর কি! তা আজ রবিবার। ইংলিশ মাফিন আর কালো কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে মনটা ভারী সাহেব সাহেব হয়ে গেল। ভাবলাম আজ সারাদিন ধরে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখি। যা তা মুভি হলে চলবে না। আঁতেল হতে হবে। কাল রাতের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শ্রবণের কন্টিনিউয়েশন আর কি! দেখে শুনে বেছে নিলাম ১৯৬৭ সালের একটি ইটালিয়ান মুভি – পাওলো পাসোলিনির অয়দিপাউস। অর্থাৎ শুধু আঁতেলই নয়, অ্যান্টিকও বটে!

প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো সিনেমাটি আমার পছন্দ হয় নি। আমি ভেবেছিলাম সফোক্লিসের নাটকটির একটি আধুনিক চিত্রায়ন দেখবো। গল্পের শুরুও তেমনই ছিল – ষাটের দশকের ইতালী – একটি শিশু, শিশুর মা, তার কামুক স্বামী – যে শিশুর প্রতি তার নারীর মনোযোগ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে শিশুটিকে হত্যার পরিকল্পনা করে। আর ঠিক তখনই পটভূমি বদলে যায়। গল্প চলে যায় আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসে – থিবস নগরীতে। তারপর ঠিক তেমনটিই হয়, যেমনটি গল্পে আছে। ভয়, দয়া, বাৎসল্য, ভাগ্যানুসন্ধান, হত্যা, কাম, বিপন্নতা, গ্লানি ও সবশেষে অন্ধত্ব। অন্ধত্বের পর গল্প আবার ফিরে আসে ইতালীতে। একটি অন্ধ মানুষ রাস্তায় রাস্তায় বাঁশী বাজিয়ে ফেরে। মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। তাকে ফ্রেমে ধরেই শেষ হয় এক ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের সিনেমাটি। খুবই নাটকীয় সিনেমা। অভিনয় দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল স্টেজ অ্যাক্টিং দেখছি। সেটা ভালো না লাগার একটা কারন। সংলাপ অত্যন্ত কম। ছবির প্রথম সংলাপটি আসে ছবি শুরুর ছ’মিনিট সতেরো সেকেণ্ড পরে। সেটাও কোন চরিত্রের মুখের সাধারণ সংলাপ নয়। শিশুটিকে দেখে পুরুষটির ঈর্ষা – যেন যাত্রাদলের বিবেক! নাটকে দেখতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সিনেমাতে অন্যরকম হতেই পারতো। আর শেষ কথা হল – ছবির প্রথম ও শেষ দশ মিনিটে কেন ষাট দশকের ইটালীর অবতারনা হল তা আমি বুঝলাম না। পরিচালক কি এটাই বোঝাতে চাইলেন যে অয়দিপাউসের গল্প আড়াই হাজার বছর আগেই শেষ হয়ে যায় নি, এখনও চলছে! ষাট দশকের ইতালী না দেখালেও সেটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

Some things are better left unsaid
Some strings are better left undone
Some hearts are better left unbroken
Some lives are better left untouched
Some lies are better off believed
Some words are better left unspoken

কি আসে যায় অয়দিপাউস আর জোকাস্টার, যদি তারা না জানে তারা কে! কি অসুবিধা তাদের স্বাভাবিক নারী-পুরুষের মত জীবন কাটাতে! কেউ তো বাধা দেয় নি তাদের! কেউ তো অনাহূত এসে ধাক্কা দিয়ে তাদের ঘুম ভাঙায় নি। ভবিষ্যত-দ্রষ্টা নীরব থাকতে চেয়েছে। মেষপালক স্বেচ্ছা নির্বাসনে গেছে। রাজ্য ছিল, অনুরক্ত নারী ছিল, শিশু ছিল। তবু তার বিপন্নতা ঘুচলো না। আর কাউকে তো লাগে না – মাথার মধ্যে কিলবিল করে যে বোধটা – সে ভেংচি কাটে। বিরক্ত করে, অনুনয় করে, পায়ে মাথা খুঁড়ে মরে – বলো, বলো, আমাকে বলো! সে জেনে এসেছে ছোট থেকে – ফলটিতে কামড় বসালেই টুপ করে ঝরে যেতে হয় স্বর্গ থেকে। তবু তার মারাত্মক লোভ। জানতে তাকে হবেই। তারপর সত্যের ঝাঁঝ সামলাতে না পেরে নিজেকে সরিয়ে নিই জীবন থেকে কিংবা অন্ধ হই – সেও ভালো। যেন জীবনের জন্য সত্য নয়, সত্যের জন্য জীবন! কথাটা যতটা নায়কোচিত শোনায় আদতে তা’ও নয়। কোন মহৎ সত্যনিষ্ঠা থেকে এই প্রশ্নের উৎপত্তি নয়। এ নিজের সাথে নিজের খেলা। পোকা যেমন আগুনের দিকে ছোটে। ডানা পোড়ে আর সে তাকে জীবনের উষ্ণতা ভেবে চোখ ঠারে। তারপর তীব্র ঝলক, অন্ধত্ব। সবশেষে ছেঁড়া জামা পরে বাঁশী বাজানো রাস্তায় রাস্তায় এবং অস্থির আক্রোশে উন্মাদের মত চিৎকার। আমি হাফ আঁতেল এসব নিয়ে ব্লগ লিখি আর ভাবি বিপন্নতা কোন ওষুধে সারে!