কোন এক অজ্ঞাত কারনে গার্গী আমাকে “তুমি” বলত। আমিও গার্গীকে “তুমি” বলতাম। আমরা দুজনে কখনও এক সেকশনে পড়িনি। গার্গীর সাথে আমার বন্ধুত্ব গাঢ় হয় স্কুল ছাড়ার পরে।প্রথম আলাপের ছয় বছর পর আমরা “তুমি” থেকে “তুই”তে নামি। স্কুলের দিনগুলোতে একটা গোপন রেষারেষি চলত আমাদের দুজনের। অন্য সব সাবজেক্টে ভালো নম্বর পেলেও ইংরিজিতে আমি কখনও গার্গীকে হারাতে পারি নি। এই নিয়ে আমার চেয়ে বেশি দুঃখ ছিল আমার মায়ের। গার্গীকে হারানোর জন্য নয়। ইংরিজি দিদিমনির মেয়ে হয়ে ইংরিজিতে কাঁচা বলে। এইট পর্যন্ত তাও কোনমতে চলছিল। নাইন-টেনে আমরা যেসব নম্বর নিয়ে ঘরে ঢুকতাম তা প্রকাশ পেলে ভদ্র সমাজে আর স্থান হবে না। নাইন এবং টেনে দুই বছরে চারটি পরীক্ষায় আমাদের ইংরিজির হায়েস্ট উঠেছিল একান্ন। সেই নম্বরটি অবশ্যই পেয়েছিল গার্গী। আমি একবারও পঞ্চাশ ছুঁতে পারি নি।
আমাদের এ হেন দুর্দশার কারন ছিলেন ছোট দীপ্তিদি আর রীতাদি। ছোট দীপ্তিদি তাও একটু ভদ্রস্থ নম্বর দিতেন। রীতাদির হাতে হামেশাই দশে একের চার বা একের আট জুটত। দুই কি তিন পেয়ে যাওয়া তো প্রায় নোবেল পাওয়ার সমান। এই অভিনব নম্বর দেওয়া ছাড়াও ছোট দীপ্তিদি আর রীতাদির বৈশিষ্ট্য ছিল ওনা ইংরিজির ক্লাসে ইংরিজিতে পড়াতেন। এই জায়গাটায় এসে আমার ইংরিজি মিডিয়ামে পড়া পাঠকরা হোঁচট খাবে। কাজেই খুলে বলা যাক। সেই সময়ে ক্লাস সিক্স থেকে ইংরিজি পড়ানো শুরু হত। লার্ণিং ইংলিশ নামে একটা বই ছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রথাগত ভাবে ব্যাকরণ মুখস্থ না করিয়ে ব্যাবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে ইংরিজি ভাষা শেখানো। উদ্দেশ্য খুব মহৎ। কিন্ত সমস্যা হল এই নতুন পদ্ধতিতে পড়ানোর মত টিচার যথেষ্ট সংখ্যায় ছিলনা। লার্ণিং ইংলিশ যখন প্রথম চালু হয় তখন কয়েকটা ওয়ার্কশপ করানো হলেও সরকারের বেশীর ভাগ প্রকল্পের মত এই প্রকল্পটিও অচিরেই ঝিমিয়ে পড়ে এবং বছরের পর বছর অশ্বডিম্ব প্রসব করে যেতে থাকে। ছোট দীপ্তিদি আর রীতাদি দুজনেই উঁচু ক্লাসে পড়াতেন। সিক্স থেকে এইট – নিচের ক্লাসগুলোতে যারা ইংরিজি পড়াতেন তাঁদের লার্ণিং ইংলিশের ট্রেনিং ছিল না। এনারা টিচার হিসেবে খারাপ ছিলেন না। আমরা টুকটাক ইংরিজি লিখতে শিখছিলাম।সহজ ইংরিজিতে লেখা একটা প্যারাগ্রাফ পড়ে মানেও বুঝতে পারতাম। কিন্তু লার্ণিং ইংলিশে ছোট ছোট বাক্য গঠন করে কথাবার্তা বলার যে এক্সসারসাইজগুলো ছিল সেগুলো আমরা একেবারেই করিনি। দিদিরা ইংরিজি প্যাসেজ পড়ে বাংলাতে মানে বুঝিয়ে দিতেন। কিছু লিখতে হলে আমরা বাংলাতে আগে ভেবে নিতাম, তারপর ইংরিজিতে অনুবাদের চেষ্টা করতাম। অর্থাৎ শিখছিলাম পুরনো পদ্ধতিতেই, কিন্তু ব্যবহার করছিলাম নতুন বই। ফলে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছিল ব্যাপারটা। শুধু চারুশীলা নয়, আরো অনেক বাংলা মিডিয়াম স্কুলেই এভাবে পড়াশোনা হত। ইংরিজি বলা তো দূরের কথা ইংরিজি শুনতেও আমরা অভ্যস্ত ছিলাম না।
প্রথম ইংরিজি শুনলাম নাইনে উঠে ছোট দীপ্তিদির ক্লাসে এসে। দিদি থেমে থেমেই বলতেন। কিন্তু শোনার অভ্যাস যেহেতু একেবারেই ছিল না, কানের জড়তা কাটতেই অনেক সময় লাগতো।তার ওপর দিদি নিয়ম করে দিয়েছিলেন ক্লাসে কথা বলতে হবে ইংরিজিতে। এর ফলে নিজেদের মধ্যে গল্প করা তো বন্ধ হলই (সেটা না হয় ভালোর জন্যই হল), উপরন্তু কারোর যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে সেটা পেশ করার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল। ইংরিজিতে প্রশ্ন করতে হবে ভাবলেই মনে হত থাক আর জেনে কাজ নেই। তোরা বোধহয় জানিস, আমার মা সুরেন্দ্রনাথে পড়াতেন। মা’ও ছোট দীপ্তিদি, রীতাদিদের মত ইংরিজিতে পড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কারন অভিযোগ আসে মেয়েরা বুঝতে পারছে না, প্রশ্ন করতে পারছে না। তার চেয়ে মেয়েরা বুঝবে এমন ভাষায় পড়িয়ে মাধ্যমিকের জন্য তৈরী করে দেওয়ার দাবী আসে।
আমার মনে হয় আমাদের ইংরিজি শিখতে যে সমস্যাগুলো হয়েছে তার কারন ছিল – এক)আমাদের স্কুলে ইংরিজির টিচার ছিলেন সাকুল্যে তিনজন – ছোট দীপ্তিদি, রীতাদি আর হৈমন্তীদি।ওনাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না নিচু ক্লাস থেকে আমাদের তৈরী করা। ক্লাস নাইনে যখন ঘাড়ের ওপর মাধ্যমিক নিঃশ্বাস ফেলছে সেই সময়ে আমরা ছোট দীপ্তিদির নতুন পড়ানোর স্টাইল নিতে পারি নি। দুই) আমাদের এক একটা সেকশনে কম করে চল্লিশটা মেয়ে থাকতো। একজন দিদির পক্ষে সম্ভব হত না এই চল্লিশজনের তত্বাবধান করা। আর সর্বোপরি, আমাদের মনের মধ্যে কেমন একটা গেঁথে গেছিল যে ইংরিজি শক্ত সাবজেক্ট। ওটা আমরা পারব না। যে জিনিসটা শুরু করার আগেই মন হাল ছেড়ে দিতে চায় তাতে বেশি দূর এগোনো যায় কি?
আগের প্যারাগ্রাফেই এই পর্ব শেষ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু তার আগে আমাদের স্কুলের আরেকজন অসাধারণ মহিলার কথা মনে পড়ে গেল। ভূগোলের টিচার কল্পনাদি। আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি। কোন একটা ক্লাস ফাঁকা যাচ্ছে। সেই সময় ক্লাস ফাঁকা গেলে আমরা নিজেদের মধ্যেই গুজগুজ ফুসফুস করি। দীপুদিকে ছোটদের জন্য ছেড়ে দিই। কল্পনাদি এলেন। তারপর এমনিই আমাদের সাথে গল্প করতে শুরু করলেন। কথায় কথায় ইংরিজির প্রসঙ্গ উঠল। ইংরিজি বুঝতে পারি না, বলতে পারি না এসব। উনি সঙ্গে সঙ্গে ভাষা পরিবর্তন করে ইংরিজিতে গল্প করতে শুরু করে দিলেন। “গল্প করছিলেন” বলাটা ঠিক হল না। কারন গল্প করতে দুই পক্ষ লাগে। কল্পনাদি ইংরিজি ধরা মাত্র আমরা বোবা হয়ে গেছি। দিদি আমাদের জোর করলেন না।উনি নিজেই অনেক কথা বলে গেলেন। ওনার বাড়ির কথা, মেয়েদের কথা। যেহেতু এই গল্পগুলোর সাথে পড়াশোনার কোন সম্পর্ক নেই, আমাদের শুনতেও খুব ভালো লাগছিল। আর আশ্চর্যের বিষয়, যদিও বোঝার কোন বাধ্যবাধকতাছিল না, কিন্তু আমরা দিদির বেশির ভাগ কথাই বুঝতে পারছিলাম। আসলে দিদির ঘরের খবর জানার ইন্টারেস্ট ছিল। তাই কান খাড়া করেছিলাম। খানিকক্ষণ এসব গল্প করে উনি বললেন, তোমরা ভয় পাও কেন? যা ইচ্ছে হয় বলবে। ঠিক হল কি ভুল হল ভাববে না। পরে যখন বেঁচে থাকার জন্যই ইংরিজি বলার দরকার পড়ল তখন কল্পনাদির কথা মনে করার চেষ্টা করেছি। কাজটা খুব সহজ নয়।কারন সব সময়েই মনে হতে থাকে এক্ষুনি একটা ভুল করব আর বিশ্ব সংসার আমার দিকে আঙুল তুলে হাসবে। আজকাল এই ভাবটা একটু কমেছে। এখন বুঝতে পারি আমি অত বড় কেউকেটাও নই যে সারা পৃথিবী আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমিই বা তাহলে এত কিছু ভেবে মরি কেন!
No comments:
Post a Comment