দীপুদির কথা মনে পড়ছে। এক মুখ পান, পূর্ণিমার চাঁদের মত বড় একখানা টিপ। হাঁটুতে ব্যাথা ছিল। শেষের দিকে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে খুব কষ্ট পেতেন। দীপুদির পুরো নাম কি ছিল কেউ জানি না। খুব আদর দিতেন। কাছের মানুষ ছিলেন সবার। কাছের মানুষকে কি কেউ আর ভালো নাম ধরে ডাকে! দীপুদি কোন সাবজেক্ট পড়াতেন আমার জানা নেই। ফাইভ থেকে টেন – যেকোন ক্লাসে সাবজেক্ট টিচার অ্যাবসেন্ট হলে দীপুদিকে ডেকে আনা ছিল দস্তুর। দিদি, আমাদের ক্লাসে চলুন, গল্প বলতে হবে। দিদিও আরেকটি পান মুখে দিয়ে ক্লাসে আসতেন। তারপর চল্লিশ মিনিট কোথা দিয়ে কেটে যেত কেউ জানে না। গ্রীম ভাইদের রূপকথা দীপুদির মুখে শুনতে শুনতে মনে হত সিনেমা দেখছি। সাবজেক্ট টিচাররা কেন বেশি করে অসুস্থ হন না এই নিয়ে ক্ষোভ জন্মাত মনে।
ফাইভ থেকে টেনের প্রত্যেকটা মেয়ে যাকে যমের মত ভয় করত তিনি হলেন সেলাইয়ের টিচার গীতাদি। সেই যে ক্লাস সিক্স থেকে গীতাদির বকুনি খাওয়া শুরু হল তা থামল মাধ্যমিক পাশ করার পর। গীতাদির ক্লাস শুরু হলেই লাস্ট বেঞ্চে দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে বসতাম। কিন্তু শ্যেন দৃষ্টিকে এড়ায় কার সাধ্য। কথিত আছে, নাইন এ-র একটি মেয়ের সেলাই পছন্দ না হওয়ায় তিনি সেটি জানলা গলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আরো অনেক গল্প ঘুরত গীতাদির নামে। সোয়েটারের বোনা সমান না হওয়ায় পুরো সোয়েটার খুলে দেওয়া, লাস্ট বেঞ্চে বসে গল্প করার অপরাধে চক ছুঁড়ে মারা – সব গল্প সম্ভবত সত্যি নয়। স্কুলে থাকাকালীন শেষ যে ম্যাগাজিনটা বেরিয়েছিল তাতে গীতাদি একটা লেখা দিয়েছিলেন। ওনার রিটায়ার করতে তখন বোধহয় বছরখানেক বাকি ছিল। উনি লিখেছিলেন – আমি তোমাদের খুব বকি বলে তোমরা আমায় ভয় পাও জানি, কিন্তু আমি তোমাদের ভালোওবাসি। আমি মারা গেলে সেই খবর স্কুলে আসলে তোমরা কিন্তু সেদিন ছুটি নেবে না। বরং খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করবে সেদিন। কথাগুলো হুবহু মনে নেই আর ম্যাগাজিনটাও হাতের কাছে নেই। তাই উদ্ধৃতি চিহ্ন দিলাম না। কিন্তু এই রকমই ছিল বিদায় নেওয়ার আগে মেয়েদের প্রতি দোর্দন্ডপ্রতাপ গীতাদির সম্ভাসন। পুরোনো দিনের মানুষগুলো এমনই ছিলেন। স্নেহ দেখাতে ভয় পেতেন পাছে ছেলে-মেয়ে বখে যায়। তাঁদের ছেড়ে এলে টের পাওয়া যেত উত্তাপ।
সেভেনে উঠে লাইফ সায়েন্স, ফিজিকাল সায়েন্স ভাগ হয়ে গেল। ফিজিকাল সায়েন্স পড়াতে এলেন কলিকাদি। অপূর্ব সুন্দরী। ইরানিয়ান মেয়েদের মত গায়ের রং ছিল কলিকাদির। ওনার তখনও বিয়ে হয়নি। ঠিক মনে পড়ে না কোন ক্লাসে কলিকাদির বিয়ে হয়। শিখাদিরও কাছাকাছি সময়ে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর প্রথম যেদিন দিদিরা ক্লাসে আসতেন সেই দিনগুলো ছিল বলার মত। যারা স্মার্ট তারা তো সামনে গিয়েই দেখে নিচ্ছে। কেউ কেউ তো বলেই ফেলছে – দিদি আপনাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে। সবার তো সেটা সাহসে কুলোচ্ছে না। তাদের ঘন ঘন বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে। যদি কোন ফাঁকে দিদিকে দেখা যায় – কোন করিডরে বা ক্লাসরুমে।
No comments:
Post a Comment