মেয়েদের জীবনের অত্যন্ত স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা নিয়ে আমাদের লুকোচুরির অন্ত ছিলনা। পিরিয়ড বা মেন্সট্রুয়েশন জাতীয় শব্দগুলো তখনও ছিল অপ্রচলিত। শরীর খারাপ বললেই সবাই বুঝে যেত। আমরা সবাই নারী হয়ে উঠছিলাম কোন ট্রেনিং ছাড়াই। যাদের বড় দিদি ছিল তারা হয়তো কিছু জানতো। কিন্তু অনেকের কাছেই জীবনের প্রথম রক্তপাত আসতো খুব আকস্মিক ভাবে। আমি যখন সিক্সে উঠি তখন দেখতাম রীনা আর আরেকটা কেউ (কিছুতেই মনে পড়ে না সে কে ছিল) মাঝে মাঝে একটা রহস্যময় হাসি হাসে। কিছুতেই বুঝতে পারি না হাসির কারন। তারপর খুব চেপে ধরতে রীনা বলল – প্রতি মাসে মেয়েদের শরীর থেকে দুষিত রক্ত বেরিয়ে যায়। তোর হলে তুইও বুঝবি। আমি সত্যিই বুঝিনি রক্তে দূষন আসছে কোথা থেকে। মেয়েদেরই বেছে বেছে এটা হচ্ছে কেন। তবে এটুকু বোঝা গেল এটা নিয়ে বেশি কথা বলতে নেই বা বললেও ফিসফিস করে বলতে হয়।
যে সময়ের কথা বলছি সেটা সম্ভবত টিভিতে “চুপচাপ রয়েছে বল না কি হয়েছে” বা “অনুভব করেছি তাই বলছি” অ্যাডগুলোর আগে। সম্ভবত লিখলাম কারন আমার বাড়িতে টিভি দেখায় বাধা ছিল। খুব বেশি টিভি আমি দেখিনি। এই অ্যাডগুলো যখন আমার চোখে পড়ে তখন এইট-নাইনে পড়ি মনে হয়। কাজেই ঐ যুগে আমরা হঠাৎ করেই একদিন একটা গোপন জগতে প্রবেশ করতাম। আর সেই জগত ছিল সিক্রেট সোসাইটির মত। সেখানে কি হয় সে কথা বাইরের কাউকে বলা যাবে না।
আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান যা ছিল তাতে “অনুভব করেছি তাই বলছি”-র কাস্টোমার আমরা অবশ্যই ছিলাম না। দু-একটি ব্যাতিক্রম বাদে সকলেই কাপড় ব্যবহার করত। আজকে এটাকে আনহাইজিনিক বলেই জানি। কিন্তু সেদিন আমাদের এগুলো কেউ শেখায় নি। চিরাচরিত কাল ধরে যা চলে আসছে তাকে মেনে নেওয়াই ছিল আমাদের এবং আমাদের মায়েদের অভ্যাস। স্কুলেও পুরোনো কাপড় পরিস্কার করে রাখা থাকত। কারোর যদি স্কুলের মধ্যে প্রয়োজন হয় তাহলে মীনাদির কাছে চাইলে পাওয়া যেত। এমনিতে খুব দরকার না পড়লে স্কুলের বাথরুম আমরা ব্যবহার করতাম না। তিনতলায় তিনটে বাথরুম থাকলেও সেগুলোর অবস্থা খুব পরিস্কার থাকত না।
এইভাবেই আমরা আস্তে আস্তে বড় হওয়ার গোপনীয়তাগুলো শিখে নিচ্ছিলাম। শরীর খারাপের দিনগুলোতে বসার আগে জামা সরিয়ে বেঞ্চের ওপর নিজেকে ন্যাস্ত করার কৌশল রপ্ত করছিলাম। তা সত্বেও যদি কখনও জামায় দাগ লাগে তাহলে সব ক্লাসেই দু-একজন এক্সপার্ট পাওয়া যেত যারা সেফটিপিন দিয়ে জামা বা শাড়ি প্লিট করে দেবে যাতে দাগ দেখা না যায়। কারন বাড়ি ফিরতে হবে হেঁটে অথবা ভিড় বাসে। আর আমরা সবাই জানতাম যতই আমরা সিক্রেট সোসাইটির সদস্য হই না কেন, আসলে আমাদের সিক্রেটটা উটপাখীর বালিতে মুখ গোঁজার মত। যে গোপনীয়তার দূর্গ আমরা নির্মান করেছিলাম তাতে দরকার পড়লে কোন ছেলের কাছে সাহায্য চাওয়া অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু জামার দাগ বাইরের কেউ দেখতে পেলে হাসাহাসি আর লাঞ্ছনা থেকে নিষ্কৃতির কোন উপায় ছিল না।
এমন এক সময়ে আমাদের লাইফ সায়েন্স পড়াতেন ইলাদি। কড়া টিচার ছিলেন। কিন্তু এতটাই ভালো পড়াতেন যে আমাদের সকলেরই ওনাকে পেতে ইচ্ছে করত। কল্পনাদির মতই উনিও কথা বলতেন জোরে। বই দেখতেন না কখনও। লাইফ সায়েন্স আমার পছন্দের বিষয় ছিল না। কিন্তু তা সত্বেও চল্লিশ মিনিট ধরে উনি যা যা বলতেন তা আমি ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিতাম। আমরা তখন বোধহয় ক্লাস নাইন। টেন ও হতে পারে। কোন এক সাহসী মেয়ে একদিন ক্লাসের শেষের দিকে ইলাদিকে বলল, দিদি আমাদের শরীর খারাপ কেন হয় বলবেন? দিদি মুচকি হেসে বলে গেলেন, পরের দিন বলব।
পরের লাইফ সায়েন্স ক্লাসের দিনে সম্ভবত একটি মেয়েও অনুপস্থিত ছিল না। ইলাদি বোর্ডে ছবি এঁকে নিঁখুত ভাবে ঋতুচক্র বোঝালেন। বুঝলাম মেয়েদের রক্ত দুষিত হয়না। বরং আরেকটা প্রাণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই রক্ত অপেক্ষা করে। একটা কথা মনে আছে, উনি রজঃ স্রাবকে বলেছিলেন ব্যর্থ জঠরের কান্না। বেশ কাব্যিক লেগেছিল উপমাটা। আমাদের অনেকেই মাধ্যমিকের পর সায়েন্স পড়ে নি। আমি হায়ার সেকেন্ডারীতে বায়োলজি নিয়েছিলাম। কিন্তু ফিজিওলজিতে রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেম যতদিনে এল ততক্ষণে প্রি-টেস্ট কাছে চলে এসেছে। সিলেবাস শেষের তাড়া। আর কলকাতার কলেজের টিচাররাও ঐ চ্যাপ্টার পড়াতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। টুয়েলভে আদৌ কিছু জেনেছিলাম কিনা তা মনে পড়ে না। আজ পর্যন্ত নিজের শরীরের এই অপরিহার্য ঘটনাটা নিয়ে আমার যা কিছু ধারনা তা ইলাদির দান।
এর কিছুদিন পরেই মেয়েরা আবার বায়না করে, দিদি বাচ্চা কি করে হয় বোঝান। আবার একটা চল্লিশ মিনিটের লেকচারে ইলাদি আমাদের প্রজনন বোঝান। অবশ্য এটা আজকে স্বীকার করে যাই, ওভারঅল সায়েন্সটা বুঝলেও শুক্রাণু কি করে ছেলেদের শরীর থেকে মেয়েদের শরীরে আসে সেটা আমি ইলাদির লেকচার থেকে বুঝতে পারিনি। সেটা আমাকে বন্ধুদের থেকেই বুঝতে হয়।
এগুলো চুরানব্বই-পঁচানব্বই সালের কথা। এর প্রায় বছর দশেক পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার জীবনশৈলী নামে একটি বিষয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু রিপোর্ট পাওয়া যায় শিক্ষকদের সেক্স এডুকেশন পড়ানোর অনীহার জন্য এই প্রকল্প খুব একটা সাকসেসফুল হয়নি। ইলাদি নিঃসন্দেহে সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এই ভেবে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় যে ওনার ছাত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
[পুনশ্চঃ আজ যে বিষয় নিয়ে লিখলাম, জানি না এই লেখা যারা পড়ছিস তারা সকলে খোলা পাতায় এই আলোচনায় স্বচ্ছন্দ বোধ করবি কিনা। অন্য দিনের মতই আমি তোদের ট্যাগ করছি। যদি তোরা তোদের টাইম লাইনে এই পর্বটা রাখতে না চাস আমাকে পার্সোনাল মেসেজ করে দিস। আমি ট্যাগ সরিয়ে দেব। আর আমি অবশ্যই কিছু মনে করব না। আমার নিজেরই অনেক সময় লেগেছে ঋতুচক্র নিয়ে অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে।]
No comments:
Post a Comment