About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Monday, October 12, 2015

উৎসব

 যে মেয়েটি তার ভালোবাসার ছেলেটির সাথে উৎসব দেখার জন্য মিথ্যে বলে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে, আজ তার কথা খুব মনে পড়ছে। প্রথম শহরে আসা পুজোর দিনে। রেল স্টেশনের ভিড় পেরিয়ে, বাস স্ট্যান্ডে শেষ মুহুর্তের বিকিকিনির ব্যস্ততা ঠেলে সে যখন নির্ধারিত জায়গাটিতে এসে পৌঁছয় ছেলেটি তখন ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া মাত্র তার চোখ জ্বলে ওঠে। শহরে যাওয়ার বাসের লাইনে এতক্ষণ সবাইকে ছেড়ে দিচ্ছিল সে। এবার সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে সঙ্গিনীকে নিয়ে জানলার ধারের একটা সীটে উঠে পড়ে। ব্রিজ পেরোতেই সময় লাগে ঘন্টাখানেক। তা হোক, এখন তো কোন তাড়া নেই। যদিও ফিরতে হবে সন্ধ্যে নামার আগে, তবু ঘড়ির কাঁটা তো সবে মধ্যাহ্ন পেরিয়েছে। পাশাপাশি বসেছে তারা অনেকদিন পরে। এখন লাগাক ওরা সময় যত খুশি, সময় তো আসলেই স্থির।

উৎসব দেখেনি সে কোনদিন। শহর যখন রঙিন কাপড়ে, জড়োয়া চুমকিতে, মুখ ঢাকা প্রতিমায় সবে সেজে উঠেছে তার ট্রেনের হুইসিল বেজে উঠত। ব্যস্ত, কোলাহল মুখর শহর থেকে হাঁফ ছাড়ার জন্য তারা চলে যেত বহুদূর। ছেলেটি তাকে বহুবার অনুনয় করেছে একটি দিন থেকে যাওয়ার জন্য। ক্ষমতাহীনের কাছে অনুনয় যে বিড়ম্বনার তা জেনেও। এবার সে নিজেই থাকে দূরের দেশে। এবার সে ফিরছে বলে কোলাহল থেকে বিশ্রাম চায়নি কেউ। তাকে চেয়েছে সবাই। তার পুরো স্বত্ত্ব চারদিনের জন্য। সেখান থেকে সময় চুরি করে পালিয়ে এল সে।

বড় আশ্চর্য পুজোমন্ডপ বানিয়েছে নাকি এক ক্লাব। মাটির খুরি - ছোট, বড়, মাঝারি, কিছু আস্ত, কিছু নিপুণ ভাবে কাটা - সেই দিয়ে বানিয়েছে মন্ডপ। মন্ডপের ভিতরে প্রতিমা - সেও নাকি আশ্চর্য সুন্দর। আড়াইটে পার করে তারা সেই অবাক মন্ডপের কাছে এসে পোঁছয়। মন্ডপ থেকে বিশাল লম্বা লাইন বেরিয়েছে এঁকেবেঁকে। তারাও এসে যোগ দেয় সেই ভিড়ে। গল্প করে। এতদিন পরে পাশাপাশি দাঁড়ানোর প্রতিটা মুহূর্ত শুষে নেয়। ঘন্টাখানেক পরে খেয়াল হয় তারা এগিয়েছে বড়জোর ফুট খানেক। তাদের সামনে যত মানুষ পিছনেও তার চেয়ে কম নয়। বৃদ্ধ সরীসৃপের মত স্থবির সে লাইন মেয়েটাকে অশান্ত করে তোলে। ফিরতে হবে সন্ধ্যা নামার আগেই।

তাদের কথাগুলো আর আগের মত থাকে না। অস্থিরতার শয়তান তাদের মাথায় ভর করে। দোষারোপ শুরু হয়। অবিশ্বাস কাঁটা ফোটাতে থাকে। সময় ছুটতে থাকে তেজী ঘোড়ার মত। সাড়ে চারটে পার করে মেয়েটি যখন দেখে সামনের জনসমুদ্র তখনও নিশ্চল, লাইন ছেড়ে বেরিয়ে আসে তারা। ঝলমলানো ভীড়ের মাঝে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায় দুটি প্রাণী। ম্লান। ফেরার সময় আর একসাথে ফেরে না। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গুঁজে দিয়ে ফাঁকা স্লেটের মত দাঁড়িয়ে থাকে সে। স্টেশনে এসে দৌড়য় খুব। তবুও ট্রেন ছেড়ে দেয় প্ল্যাটফর্ম থেকে। ধীরেসুস্থে, যেন সময় আবার ফিরে এসেছে অফুরান, পরের ট্রেনে ওঠে সে। দুটাকার বাদাম কিনে খায়। বাড়ি যখন ফেরে সন্ধ্যা তখন গভীর। তার সাথে কথা বলে না কেউ। চারটে দিন কোনভাবে কাটিয়ে নিজের দেশে ফিরে যায় সে। আর কখনও উৎসবের দিনে বাড়ি ফেরা হয়নি তার।

সেদিনের কোলাহলবিমুখ মানুষেরা আজ ষষ্ঠীপুজোর দিন কলাবউ চান করিয়ে আনে। জীবন তো বদলাবেই। সময় তো আসলেই স্থবির নয়। এমনই অনায়াস সপ্রতিভ তার চলন, তাকে দেখে যতখানি ঘৃণা জাগে, ততখানিই প্রেম। অজগরের মত শ্বাসরোধী প্রেমে কয়েকটি মুহূর্ত জেগে থাকে যার রহস্য ভেদ না করা পর্যন্ত অস্থিরতা ঘোচে না। কি ছিল সেই আশ্চর্য মন্ডপের ভেতরে? কেমন সে মুখ? এত লক্ষ মানুষ দাঁড়িয়েছিল সেদিন তাকে দেখবে বলে। কি দেখেছিল তারা? কোলাহল, দোষারোপ, অবিশ্বাসের শেষে কোন স্থির শান্তির দ্বীপ জেগে ছিল কি? থাকে কি কোথাও?

Friday, February 27, 2015

অস্থির সময়ের জার্নাল - ৩

 কাল রাতে রবীন্দ্রনাথের ১৯১৭ সালে লেখা ন্যাশনালিজম প্রবন্ধগুচ্ছ পড়ছিলাম। ১৯১৭ থেকে ২০১৬ - নিরানব্বই বছর হয়ে গেছে। দেখে গা শিরশির করে ন্যাশনালিজম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেদিন যে আশঙ্কার কথা লিখেছিলেন সেগুলো আজও ভীষনভাবে প্রযোজ্য। আজ এমন দিন এসেছে যখন এইটুকু পড়েই এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। সেই সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই এই লেখা শুরু করছি। আমাদের সমস্যা হল রবীন্দ্রনাথকে আমরা ঠাকুর বানিয়ে দেরাজে তুলে রেখেছি। তাঁর বই পড়িনি, চিন্তার সাথে পরিচিত হইনি। যে মানুষেরা এই বইগুলো পড়েছেন এবং যাঁদের চিন্তায় এই উপলব্ধির ছাপ আছে তাঁদের তাই সিউডো সেকুলার, কমিউনিস্ট, দেশদ্রোহী ইত্যাদি বলে ব্রাত্য করে দেওয়া খুব সহজ হচ্ছে। দেশ জুড়ে অসংখ্য স্কলার অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে মুখ খুলেছিলেন। মানুষ পাত্তা দেয়নি এবং তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে। এই স্কলাররাই বিদেশ থেকে দামী পুরস্কার নিয়ে এলে তাঁদের পুজো করা হবে। অথচ তাঁদের চিন্তাকে সম্মান দেওয়া হবে না।

মানুষ স্বভাবগত ভাবে আবেগপ্রবণ, পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী। এমনকি যাঁরা অব্রাহামিক ধর্মগুলোর অনুসারী তাঁরাও। অ্যাব্স্ট্রাক্ট চিন্তার ভার বহন করা খুব স্বস্তিদায়ক নয়। মানুষ তাই কোনও মূর্তিতে দেবত্ব আরোপ করে, অথবা কোনও কাঠের টুকরোয়, অথবা কোনও বইতে। এই পৃথিবীতে যতটুকু যা পাওয়া যায় আমরা কিন্তু ততটুকুই দেখি। তবে তাতে মন ওঠে না। তাই পৃথিবীর উপদানকে অপার্থিব বানানোর চেষ্টা চলে। আবারও ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ ও ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রসঙ্গে আসবো। ঈশ্বর যদি সত্যিই মনের মধ্যে থাকেন তাহলে তাঁর সাথে কথা বলার জন্য মূর্তির সামনেও হাত জোড় করতে হয় না, প্রার্থনাঘরেও যেতে হয় না। যিনি সর্বভূতে আছেন এবং পরমকল্যাণময় তিনি দেশ-কাল-জাতির বিচার করে তাঁর পক্ষপাত প্রদর্শন করবেন এমন ভাবলেই বরং তাঁর অসম্মান হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদও সেই খন্ডিত ঈশ্বরকে নিয়ে লোফালুফি খেলার একটা প্রচেষ্টা।
"ন্যাশনালিজম" প্রবন্ধ থেকে কয়েকটা লাইন তুলে দিই।


"India has never had a real sense of nationalism. Even though from childhood I had been taught that the idolatry of Nation is almost better than reverence for God and humanity, I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will gain truly their India by fighting against that education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity."


এই জায়গাটা পড়ে বেশ স্বস্তি লাগে কারন আমিও ছোট থেকে দেশপ্রেমকে খুব উঁচু জায়গায় বসিয়েছি। দেশকে ভালোবাসি এই কথা স্বীকার করতে আজও আমার কোন কুণ্ঠা নেই। কিন্তু দেশ নামের মূর্তিটার পুজো করতে গিয়ে আমি কোথাও দেশের হৃদয়ের অবমাননা করে ফেলছি না তো? সেটা দেখা খুব জরুরী। ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখলাম কাল। ভিডিওর নাম "Kaun Afzal Guru? The Best Reply from Indian Soldier to the Anti Nationalists of #JNU"। ভিডিওতে দুটি সৈন্যকে দেখা যায় যারা সীমান্তে পাহারা দিচ্ছে। এমন সময় কিছু গোলযোগ কানে আসে। একটি সৈন্য তার বন্দুকের নল ঘোরায় সেই গোলযোগের দিকে। অন্যজন বলে - ওদিকে বন্দুক ঘোরাচ্ছিস কেন? ঐদিকে তো আমাদেরই দেশ। যাদের দিকে বন্দুক তাক করছিস তারা তো আমাদেরই ভাই। অন্য সৈন্যটি উত্তর দেয় - "জিসনে হামারে মা কো দিল সে নিকাল দিয়া, উসকে সাথ সারে রিশতে খতম"। এই কথাগুলোর সাথে একজন ধর্মীয় মৌলবাদীর কোনও তফাৎ নেই। "দেশ-মা"য়ের জায়্গায় স্থানীয় ঈশ্বরদের বসিয়ে দিতে হবে শুধু। আরো একবার রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো দেখি ... "it is my conviction that my countrymen will gain truly their India by fighting against that education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity." খুবই দুঃখের কথা এই যে মানবতাকে আমরা এখনও দেশপ্রতিমার ওপরে বসাতে পারলাম না।


যাঁরা দেশপ্রেমের জোয়ারে ভেসে JNUতে অ্যান্টিন্যাশনাল শিকার উৎসবে মেতেছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন "রোজা", "মিশন কাশ্মীর", "বর্ডার", "হায়দার" - এই সিনেমাগুলোর বাইরে কাশ্মীর নিয়ে একটুও পড়াশোনা করেছেন? বই কিন্তু আছে। এই দেশে এখনও কিছু কিছু স্কলার আছেন যাঁরা দেশটার ইতিহাসের চর্চা করেন। খুঁত ধরার জন্য নয়। ভালোবেসে। আপনি যেমন আপনার ভালোবাসার মানুষটাকে বুঝতে চান, তার ভালো-মন্দ সব জানতে চান - কতকটা সেইরকম আগ্রহে ও ভালোবাসায়। এই মানুষগুলোকে দেশদ্রোহী বলে কাঠগড়ায় তুললে যে গুটিকয় মানুষ দেশটাকে বোঝার চেষ্টা করেছিল তাদেরও আপনি হারাবেন।


কাশ্মীর সমস্যা এমন কোন সমস্যা নয় যাতে যে কোন একপক্ষের মানুষকে আপনি কাঠগড়ায় তুলতে পারেন। পার্টিশানেরও অনেক আগে থেকে এই উপত্যকায় হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের ইতিহাস রয়েছে। কখনও মুসলিম শাসক এসেছে, কখনও হিন্দু। এবং যখনই যে এসেছে অন্য সম্প্রদায়কে ছেড়ে কথা বলেনি। পার্টিশানের অব্যবহিত পরে গণভোট হওয়ার কথা ছিল। সেই ভোট বারবার ভেস্তে গেছে। কাশ্মীর সমস্যায় অবশ্যই বিদেশী মদত আছে। কিন্তু ভারত সরকার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবিমৃশ্যকারীতা সেই সমস্যা জিইয়ে রাখতে অক্লান্তভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। আশীর দশকের শেষ থেকে এই উপত্যকায় মিলিটারী শাসন চলে। এখানে বেড়ে ওঠা একটা শিশুর ছেলেবেলা আর ভারতের মূল ভূখন্ডে বেড়ে ওঠা আরেকটি শিশুর ছেলেবেলায় আকাশপাতাল তফাৎ। সেই তফাৎকে না জেনে, না বুঝে তাকে দমিয়ে রাখলে যে দানবের সৃষ্টি হয় তার পরিচয় আমরা পেয়েছি। শুধু আমাদের দেশে কেন, সারা পৃথিবীতেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধ দিয়ে, অন্যায় ভোট দিয়ে, স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক লাভের আশায় তড়িঘড়ি কায়েম করা কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে কোন সমস্যার সমাধান হয়না। দেশের বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুললেই তার গলা টিপে মারা দেশপ্রেম নয়। আওয়াজ কেন উঠল সেটা খতিয়ে দেখা, তার সমাধানের চেষ্টা করা একজন সত্যিকারের প্রেমিকের কাজ। আপনার নিজের জীবনেই ভেবে দেখুন না। বাড়িতে আপনার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললেই কি আপনি তাকে খুন করতে যান? নাকি তার সাথে আলোচনায় বসেন?

Saturday, February 21, 2015

আবার বছর কুড়ি পরে – ৯

 পঁচানব্বই সালে আমার চারুশীলার স্কুল জীবনে দাঁড়ি পড়ল। চুরানব্বই-এর ডিসেম্বরেই প্রিটেস্ট হয়ে গেল। তারপর আর খুব একটা স্কুলে যাইনি। মাধ্যমিকের রেজিস্ট্রেশনে নামের বানান ভুল এসেছিল। ইলাদি আমায় নিয়ে গেলেন কলকাতায় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিসে। স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে আবার বাড়ি এসে ফেরত দিয়ে গেলেন। চারুশীলার দিদিদের থেকে যা আদর পেয়েছি তা পরে আর কক্ষনো কোথাও পাইনি। ফিজিক্যাল এডুকেশনে খুব খারাপ করতাম। দীপিকাদি জোর করে আসন করাতেন। মায়ের সাথে একবার দেখা হয়েছিল। বলেছিলেন, ওকে স্কিপিং কিনে দেবেন আর দেখবেন রোজ যেন প্র্যাকটিস করে। সে এক প্রাণান্তকর অবস্থা। বিকেল হলেই মা ছাদে পাঠিয়ে দিত স্কিপিং করার জন্য। গল্পের বই পড়ার সময় নিয়ে টানাটানি। গীতাদির খুব চিন্তা ছিল সেলাই-এর পরীক্ষায় কিছুই পারবো না। আমার মা ছিল খুব নির্মম। কোনদিন একটা সেলাই নিজে করে দিত না, কারোর থেকে করাতেও দিত না। অনেকে প্রমাণ সাইজের সোয়েটার বানিয়েছিল। কি করে বানিয়েছিল ভেবে অবাক হই। আমি তো বাচ্চাদের সোয়েটারই শেষ করতে পারছিলাম না। অথচ মানিকে বললে একদিনে বুনে দিত। কিন্ত মা’কে এড়িয়ে সেই প্রস্তাব রাখার সাহস আমার হয়নি। এর ওপর ছিল ব্লাউজ, সায়া আর জাঙিয়া বানানো। সব হাতে সেলাই করতে হত। টেবিলক্লথের একটা কোনা বানিয়ে বাকিটা মুড়ে জমা দিয়েছিলাম। দিদি আপত্তি করেন নি। এর পরেও সব জিনিসের একটা করে ছোট স্যাম্পেল বানিয়ে খাতায় সাঁটতে হয়েছিল। ফাইনাল পরীক্ষায় এক্সটার্নাল এক্সামিনার ব্লাউজ বানাতে দিয়েছিলেন। আর কোন একটা এমব্র্য়ডারী ছিল, মনে পড়ছে না। কোন রকম কেলেঙ্কারী ছাড়াই উৎরে গেছিলাম।



তারপর হইহই করে মাধ্যমিক এসে গেল। শ্রীরামপুরের একটা স্কুলে সীট পড়েছিল। বাবার সাথে পরীক্ষা দিতে যেতাম। সেই প্রথম বাড়ি থেকে কেউ যাচ্ছিল পরীক্ষার সময়। পরীক্ষা মিটে গেলে সন্দেশ-টন্দেশ খেতে পেতাম। বন্ধুদের সাথে বেশ অনেকটা বাসে করে যাওয়াও সেই প্রথম। অ্যাডিশনাল পরীক্ষার আগে চারদিন ছুটি ছিল। বাবা আমার জন্য “অপরাজিত” কিনে এনেছিল মাধ্যমিকের পর পড়ব বলে।আমি অ্যাডিশনালকে অ্যাডিশনাল হিসেবেই ধরলাম এবং ঐ চারদিন বিভূতিভূষন পড়ে কাটিয়ে দিলাম। পরীক্ষাটা ছিল দুর্ভাগ্যক্রমে ফিজিক্সের। অপুর জীবন সম্পর্কে কোন প্রশ্ন এলনা। ফিজিক্স আমার যেটুকু মনে ছিল লিখে দিলাম। পরীক্ষা শেষ। নিশ্চিন্তি!



১২ই জুলাই, ১৯৯৫ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোয়। একাই রেজাল্ট দেখতে গেছিলাম স্কুলে। যখন বাড়ি ফিরছি দেখি আমার তুতাইয়া (মেজোপিসি) ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পাওয়া মাত্র চিৎকার দিল,বৌদি তিতুম এসে গেছে। মা-বাবা বাইরের ঘরে চুপ করে বসেছিল আর ঘড়ি দেখছিল। এর দুদিন পরেই ছিল আমার জন্মদিন। রেজাল্ট বেরোনো মাত্রই স্কুল-কলেজে ফর্ম দেওয়া শুরু হয়ে যেত। ১৪ তারিখে মা-বাবা দুজনে মিলে গেল কলকাতার কলেজে আমার জন্য ফর্ম তুলতে। সেই প্রথম একটা জন্মদিন এল যেদিন আমি একা একাই খাবার নিয়ে খেলাম। বড় হওয়ার প্রথম ধাপ ছিল সেটা।



বড় হওয়ার দ্বিতীয় ধাপে বিসর্জন দিলাম একটি ইচ্ছা। হয়তো কল্পনাদির পড়ানোর গুণেই আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয় ছিল প্রাকৃতিক ভূগোল। বাড়ির সকলেরই ইচ্ছা ছিল আমি সায়েন্স পড়ব। আমারও সায়েন্স অপছন্দ নয়। কিন্তুআমি চেয়েছিলাম ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথের সাথে ভূগোল নিতে। বায়োলজি ভালো লাগত না। চারুশীলাতে সেই কম্বিনেশন ছিল না। কিন্তু দিদিরা আমার জন্য সেই ব্যবস্থাও করেদিলেন। তা সত্বেও চারুশীলাতে পড়া হলনা। কলকাতায় বেথুন আর ব্রেবোর্নে ফর্ম তোলা হয়েছিল। দুই জায়গাতেই চান্স পেলাম। ব্রেবোর্নের হোস্টেলের ইনচার্জ ছিলেন আমার এক দিদার বন্ধু। তাই আমাকে ব্রেবোর্ণে দেওয়াই ঠিক হল। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথ এবং বায়োলজি। ভূগোল চিরকালের মত বাদ গেল কারিকুলাম থেকে। যোগাযোগ রইল শুধু ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পাতায়। চারুশীলার শাড়ি এসে গেছিল। রাখী আমার শাড়িটা কিনে নিল। কমলা স্কার্ট পাড়ের শাড়ি। বড় প্রিয় রং কমলা।




“তাহার বাবা বলিল – তুমি বড্ড হাঁ করা ছেলে, যা দ্যাখো তাতেই হাঁ ক‘রে থাকো কেন অমন? জোরে হাঁটো।” 


বড় হওয়ার তৃতীয় ধাপে এসে পৌঁছলাম এমন এক জায়গায়, এমন এক পরিবেশে যেটা ছিল সম্পূর্ণ অচেনা। তিরিশ জনের ক্লাসে পাঁচটি বাংলা মিডিয়াম। বাকিদের পড়াশোনার ভাষাই তো শুধু আলাদা ছিল না। চলাফেরা, জামা-কাপড়, কথা বলার ভঙ্গি সবেতেই বিস্তর ফারাক। সেসব ডিঙিয়ে তাদের কাছে পৌঁছনো, ইংরিজি ভাষায় লেকচার শোনা ও নোট নেওয়া, উচ্চমাধ্যমিকের পাহাড়প্রমাণ সিলেবাস – যতখানি জোরে হাঁটার দরকার ছিল ততটা তো পারিনি। হাঁ করেই বেলা গেল। দ্বিপ্রহরে এসে খেয়াল হল পা চালাতে হবে। গন্তব্য তখনও বহুদূর। পথ ফুরোনোর আগেই যে সন্ধ্যা নামতে পারে এটাই বুঝলাম বড় হওয়ার তৃতীয় ধাপে। তবে সেই সাথে এটাও বোঝা গেল সব সময় পৌঁছনোটাই শেষ কথা নয়। হয়তো গন্তব্য বলে আসলেই কিছু নেই। কারন পথের যতটুকু চোখে দেখা যায় তা তো একটা খন্ডাংশমাত্র। সেই অবাঙমনসগোচর কখন কোথায় বাঁক নেবে তা কি কেউ বলতে পারে?

আবার বছর কুড়ি পরে – ৮

 লিপিকা, তুই আর আমি কৃষ্ণদার রিক্সায় স্কুলে যেতাম মনে আছে? বেশির ভাগ বন্ধুই হেঁটে বা সাইকেলে যেত। আমাদের বাবা-মায়েরা বোধহয় ভয় পেল মেয়েকে একা রাস্তায় ছেড়ে দিলেই প্রেম করতে শুরু করবে! অবশ্য ভয় নেহাৎ অমূলক নয়। স্কুলে যাওয়ার রাস্তার ওপরেই আমার ছ’বছরের স্কুল জীবনের একমাত্র হার্টথ্রব থাকতো। ঐ ছ’বছরে তার সাথে একটিবারও কথা বলিনি। কিন্তু তার বাড়িটা এলেই আমার অবাধ্য ঘাড় বার বার ডান দিকে বেঁকে যেতে চাইতো। আমি জোর করে ঘাড় সামলিয়ে তোর সাথে গল্প করতাম। চোখটাকে কিছুতেই শাসন করতে পারতাম না। রিকশার ঘোমটার ফাঁক দিয়ে সে ঠিক চঞ্চল হয়ে উঠতে চাইতো। বৈদ্যবাটি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর যতবার বাড়ি গেছি, মাঝে মাঝেই দেখতাম পঞ্চানন তলার মোড়ে রিকশা স্ট্যান্ডটায় কৃষ্ণদা রেলের পাঁচিলের ওপর বসে আছে। আমাকে দেখলেই রিকশায় তুলে নিত। আমায় হয়তো দরকার নেই, হয়তো হাঁটতেই ভালো লাগছে। কিন্তু সে কিছুতেই শুনবে না। পয়সা নিতে চাইতো না। তারপর যখন বলতাম, না নিলে মা বকবে তোমায়, তখন নিতো। বছর দুয়েক আগে বাড়ি গিয়ে শুনলাম কৃষ্ণদা মারা গেছে।



পঞ্চানন তলা পার করে বাঁদিকের গলিটায় ঢুকলেই কেমন শীতশীত করতো না? সরু গলি, উঁচুউঁচু বাড়ি ছিল অনেকগুলো। রোদ ঢুকতো না। তার ওপর একটা পুকুরও ছিল। ঐ গলিতে ঢোকার মুখে ডানদিকের বাগানে একটা বিশাল বড় মৌচাক ঝুলতো মনে পড়ে? স্কুলজীবনের শেষের দিকে, তখন আমরা শাড়ি পরি, ঐ মৌচাকে আগুন দেওয়া হয়। যেদিন যেদিন কৃষ্ণদা আসতো না, আমরা হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। দুপুর শেষ হয়ে তখন বিকেল হচ্ছে, রাস্তাঘাটে লোক থাকতো না একটাও। পঞ্চানন তলার ভাঙা মন্দির, তার ফাটল ধরা চাতাল এখনও মনে পড়ে। কোন কোন বাড়িতে তখনই স্টোভে আঁচ পড়ে যেত। কেরোসিনের স্টোভে চা হওয়ার গন্ধ আমাদের বাড়ি ফেরার দুপুরগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে।



পারমিতাকে মনে পড়ে? বোধহয় কুড়ি-বাইশটা বেড়াল ছিল ওর। স্কুলের খুব কাছে আমাদের যাওয়া আসার রাস্তার ওপরেই থাকতো ও। কিন্তু বেড়াল প্রীতির জন্য কিছুতেই ওর বাড়ি যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারিনি। লিপিকার বাবা আর আমার বাবা বন্ধু। তাই লিপিকার বাড়ি যেতাম ছোটবেলা থেকেই। একবার লিপিকার বাড়ি গেছি। ব্রেণভিটা খেলা হয়ে গেছে। কাকীমার দেওয়া ম্যাগিটাও শেষ হয়েগেছে। কিছুই করার পাচ্ছি না। কর্ণকাকু বলল, লিপিকা তুই একটা গল্প বল। লিপিকা বলতে শুরু করল, এক গ্রামে একটা বড়লোক আর ছোটলোক ছিল...। মানে বলতে চেয়েছিল গরীব, কিন্তু উপযুক্ত শব্দটা হাতের কাছে খুঁজে পায়নি। ব্যাস, কর্ণকাকুই এমন প্যাক দিতে শুরু করল যে ওর আর গল্প বলা হল না।



মাঝে মাঝে বেঙ্গল বুক হাউস থেকে কিছু কেনার দরকার হত।গীতাদির পছন্দ মাফিক রুমালের কাপড়, এমব্রয়ডারীর সুতো, ভূগোলের ম্যাপ পয়েন্টিং এর পেন একমাত্র ওখানেই পাওয়া যেত। যারা বাসে ফিরত বেঙ্গল তাদের রাস্তার ওপরেই পড়ত। আমাদের যেতে গেলে উলটো দিকে আসতে হত কিছুটা। রোজকার এক ঘেয়ে পথে একটু বৈচিত্র মন্দ লাগতো না। এখানেই আমি প্রথম বেবি পিঙ্ক কথাটা শুনি। ক্লাস নাইনে টেবিল ক্লথ বানাতে হত। বটল গ্রীণ টেবিল ক্লথের সাথে কি রঙের সুতো মানানসই হবে খুঁজতে গিয়ে বেঙ্গলের কাকু বলল, বেবি পিঙ্ক নিয়ে যাও – খুব ভালো লাগবে। আমার তখন বেশি মতামত ছিলনা। তাই নিয়ে এলাম। এখন ভাবতে গিয়ে মনে পড়ছে সেই সময় সবুজের সাথে গোলাপী, বেগুনীর সাথে কমলা কন্ট্রাস্ট করার খুব রেওয়াজ উঠেছিল। এটা কি হিন্দী সিনেমা থেকে এসেছিল?



আমার প্রধান সমস্যা ছিল আমি হিন্দী সিনেমা দেখতাম না। বাড়ি থেকে তো বারন করতোই। আমি নিজেও লুকিয়ে চুরিয়ে দু-একটা যা দেখেছিলাম ভালো লাগেনি। তখন অচেনা কোন সমবয়েসীর প্রথম আলাপেই সে জিজ্ঞেস করতো, তোমার কাকে ভালো লাগে? আমীর না সলমন? (শাহরুখ কি তখন অত পপুলার হয়েছিল?) ভালো লাগা তো দূরের কথা, আমি তো এদের চিনতামই না। হাম আপকে হ্যায় কৌন যখন এল রাখীর থেকে গল্পটা শুনে নিলাম। কুকুর এসে বিয়ের মীমাংসা করছে শুনে এমন ব্যোমকে গেলাম যে পরের কুড়ি বছরেও ঐ সিনেমা দেখার সাহস করে উঠতে পারলাম না। তখন নচিকেতা চক্রবর্তী আস্তে আস্তে পপুলার হচ্ছিল। মৌমিতা প্রথম ক্যাসেটের সব কটা গান মুখস্থ করে ফেলেছিল। আমি ওর থেকেই শিখেছিলাম। ঐ সময়েই রিলিজ করল রোজা। “দিল হ্যায় ছোটাসা”, “ইয়ে খুলা আসমান”, “রোজা জানেমন” তখন সর্বত্র বাজছে। আর ডি বর্মনের শেষ কাজ “১৯৪২ লাভ স্টোরি”ও কাছাকাছি সময়েই এল। “এক লড়কি কো দেখা তো অ্যায়সা লাগা”, “রিমঝিম রিমঝিম রুমঝুম রুমঝুম” “কুছ না কহো” – সবকটাই নব্বইয়ের প্রথম ভাগের মেলোডির চেয়ে অন্য রকমের ছিল। পুজো প্যান্ডেলে যে গানগুলো বাজে সেগুলো আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করছিল। এফেম চ্যানেলগুলোও ঐ সময়ে পপুলার হতে থাকে। আমার রেডিও ছিলনা। মৌমিতা ক্লাসে গল্প করতো। স্কুল জীবনের শেষের দিকে যা কিছু সাংস্কৃতিক চর্চা তার বেশির ভাগই হয়েছে দোতলায় নাইন এ-র সেই ঘরটাতে। আমরা চার মাথা ঘন হয়ে আছি – আমি, রাখী, মৌমিতা, শর্মিলা।



ক্লাস নাইনে আমরা সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব নিলাম। আমি খুব একটা কাজ করেছিলাম মনে পড়ে না। গৃহস্থালীর ক্লাসে আমি তখনও একেবারেই ঢ্যাঁড়শ।  নাইন এ থেকে একটা দেওয়াল পত্রিকা বেরোল। নাম দেওয়া হল “সারণা” – সরস্বতীর বীণা। ছোটগল্প, কবিতা, ছবি, ভ্রমণকাহিনী – সাধারণত যা থাকে সে সবই ছিল। সব থেকে বড় সাইজের যে আর্টপেপারটা পাওয়া যেত সেটা ভরাট করা হয়েছিল হাতে লিখে।  ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে লেখা হত। অনেক সময় বাড়িতেও নিয়ে আসা হয়েছে। রাখীর হাতের লেখা ভালো ছিল। রাখী লিখেছিলি কি? নাইন বি থেকে আর্ট এক্সিবিশন করেছিল। পুজোর দিন দেখতে এসেছিল সবাই। 



চুরানব্বইতে হইহই করে বিশ্বকাপফুটবল এসে গেল। প্রায় সারা ক্লাস ব্রাজিলের সাপোর্টার। রোজই রোমারিও আর বেবেতো নতুন স্টাইলে নাচে। আনন্দবাজারের ছবিটা ভালো, নাকি আজকালের তাই নিয়ে গবেষনা চলে। ওদিকে আমি আর জয়শ্রী এমন বিচ্ছিরি ভাবে বাজ্জিও’র প্রেমে পড়েছি যে দুই পিরিয়ডের ফাঁকে বা টিফিন পিরিয়ডে যেটুকু সময় পাওয়া যায় তার সবটাই ব্যয় হয় সেই সবুজ চোখের পনিটেলের আলোচনায়। সে বছর ভূগোলের সিলেবাসে যদি ইটালী থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে রেকর্ড মার্কস পেতাম। নীল রং গায়ে দিয়েও তখন কি সুখ! ফাইনালে আমাদের স্বপ্নের পুরুষ পেনাল্টি মিস করল। পরের দিন স্কুলে এসে আমি আর জয়শ্রী গলা জড়িয়ে কাঁদলাম।


চেনা দুঃখ, চেনা সুখ, চেনা চেনা হাসি মুখ

চেনা আলো, চেনা অন্ধকার...

চেনা মাটি, চেনা পাড়া, চেনা পথে কড়া নাড়া

চেনা রাতে চেনা চিৎকার...

Wednesday, February 18, 2015

আবার বছর কুড়ি পরে – ৭

 কোন এক অজ্ঞাত কারনে গার্গী আমাকে “তুমি” বলত। আমিও গার্গীকে “তুমি” বলতাম। আমরা দুজনে কখনও এক সেকশনে পড়িনি। গার্গীর সাথে আমার বন্ধুত্ব গাঢ় হয় স্কুল ছাড়ার পরে।প্রথম আলাপের ছয় বছর পর আমরা “তুমি” থেকে “তুই”তে নামি। স্কুলের দিনগুলোতে একটা গোপন রেষারেষি চলত আমাদের দুজনের। অন্য সব সাবজেক্টে ভালো নম্বর পেলেও ইংরিজিতে আমি কখনও গার্গীকে হারাতে পারি নি। এই নিয়ে আমার চেয়ে বেশি দুঃখ ছিল আমার মায়ের। গার্গীকে হারানোর জন্য নয়। ইংরিজি দিদিমনির মেয়ে হয়ে ইংরিজিতে কাঁচা বলে। এইট পর্যন্ত তাও কোনমতে চলছিল। নাইন-টেনে আমরা যেসব নম্বর নিয়ে ঘরে ঢুকতাম তা প্রকাশ পেলে ভদ্র সমাজে আর স্থান হবে না। নাইন এবং টেনে দুই বছরে চারটি পরীক্ষায় আমাদের ইংরিজির হায়েস্ট উঠেছিল একান্ন। সেই নম্বরটি অবশ্যই পেয়েছিল গার্গী। আমি একবারও পঞ্চাশ ছুঁতে পারি নি।


আমাদের এ হেন দুর্দশার কারন ছিলেন ছোট দীপ্তিদি আর রীতাদি। ছোট দীপ্তিদি তাও একটু ভদ্রস্থ নম্বর দিতেন। রীতাদির হাতে হামেশাই দশে একের চার বা একের আট জুটত। দুই কি তিন পেয়ে যাওয়া তো প্রায় নোবেল পাওয়ার সমান। এই অভিনব নম্বর দেওয়া ছাড়াও ছোট দীপ্তিদি আর রীতাদির বৈশিষ্ট্য  ছিল ওনা ইংরিজির ক্লাসে ইংরিজিতে পড়াতেন। এই জায়গাটায় এসে আমার ইংরিজি মিডিয়ামে পড়া পাঠকরা হোঁচট খাবে। কাজেই খুলে বলা যাক। সেই সময়ে ক্লাস সিক্স থেকে ইংরিজি পড়ানো শুরু হত। লার্ণিং ইংলিশ নামে একটা বই ছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রথাগত ভাবে ব্যাকরণ মুখস্থ না করিয়ে ব্যাবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে ইংরিজি ভাষা শেখানো। উদ্দেশ্য খুব মহৎ। কিন্ত সমস্যা হল এই নতুন পদ্ধতিতে পড়ানোর মত টিচার যথেষ্ট সংখ্যায় ছিলনা। লার্ণিং ইংলিশ যখন প্রথম চালু হয় তখন কয়েকটা ওয়ার্কশপ করানো হলেও সরকারের বেশীর ভাগ প্রকল্পের মত এই প্রকল্পটিও অচিরেই ঝিমিয়ে পড়ে এবং বছরের পর বছর অশ্বডিম্ব প্রসব করে যেতে থাকে। ছোট দীপ্তিদি আর রীতাদি দুজনেই উঁচু ক্লাসে পড়াতেন। সিক্স থেকে এইট – নিচের ক্লাসগুলোতে যারা ইংরিজি পড়াতেন তাঁদের লার্ণিং ইংলিশের ট্রেনিং ছিল না। এনারা টিচার হিসেবে খারাপ ছিলেন না। আমরা টুকটাক ইংরিজি লিখতে শিখছিলাম।সহজ ইংরিজিতে লেখা একটা প্যারাগ্রাফ পড়ে মানেও বুঝতে পারতাম। কিন্তু লার্ণিং ইংলিশে ছোট ছোট বাক্য গঠন করে কথাবার্তা বলার যে এক্সসারসাইজগুলো ছিল সেগুলো আমরা একেবারেই করিনি।  দিদিরা ইংরিজি প্যাসেজ পড়ে বাংলাতে মানে বুঝিয়ে দিতেন। কিছু লিখতে হলে আমরা বাংলাতে আগে ভেবে নিতাম, তারপর ইংরিজিতে অনুবাদের চেষ্টা করতাম। অর্থাৎ শিখছিলাম পুরনো পদ্ধতিতেই, কিন্তু ব্যবহার করছিলাম নতুন বই। ফলে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছিল ব্যাপারটা। শুধু চারুশীলা নয়, আরো অনেক বাংলা মিডিয়াম স্কুলেই এভাবে পড়াশোনা হত। ইংরিজি বলা তো দূরের কথা ইংরিজি শুনতেও আমরা অভ্যস্ত ছিলাম না।


প্রথম ইংরিজি শুনলাম নাইনে উঠে ছোট দীপ্তিদির ক্লাসে এসে। দিদি থেমে থেমেই বলতেন। কিন্তু শোনার অভ্যাস যেহেতু একেবারেই ছিল না, কানের জড়তা কাটতেই অনেক সময় লাগতো।তার ওপর দিদি নিয়ম করে দিয়েছিলেন ক্লাসে কথা বলতে হবে ইংরিজিতে। এর ফলে নিজেদের মধ্যে গল্প করা তো বন্ধ হলই (সেটা না হয় ভালোর জন্যই হল), উপরন্তু কারোর যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে সেটা পেশ করার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল। ইংরিজিতে প্রশ্ন করতে হবে ভাবলেই মনে হত থাক আর জেনে কাজ নেই। তোরা বোধহয় জানিস, আমার মা সুরেন্দ্রনাথে পড়াতেন। মা’ও ছোট দীপ্তিদি, রীতাদিদের মত ইংরিজিতে পড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কারন অভিযোগ আসে মেয়েরা বুঝতে পারছে না, প্রশ্ন করতে পারছে না। তার চেয়ে মেয়েরা বুঝবে এমন ভাষায় পড়িয়ে মাধ্যমিকের জন্য তৈরী করে দেওয়ার দাবী আসে।


আমার মনে হয় আমাদের ইংরিজি শিখতে যে সমস্যাগুলো হয়েছে তার কারন ছিল – এক)আমাদের স্কুলে ইংরিজির টিচার ছিলেন সাকুল্যে তিনজন – ছোট দীপ্তিদি, রীতাদি আর হৈমন্তীদি।ওনাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না নিচু ক্লাস থেকে আমাদের তৈরী করা। ক্লাস নাইনে যখন ঘাড়ের ওপর মাধ্যমিক নিঃশ্বাস ফেলছে সেই সময়ে আমরা ছোট দীপ্তিদির নতুন পড়ানোর স্টাইল নিতে পারি নি। দুই) আমাদের এক একটা সেকশনে কম করে চল্লিশটা মেয়ে থাকতো। একজন দিদির পক্ষে সম্ভব হত না এই চল্লিশজনের তত্বাবধান করা। আর সর্বোপরি, আমাদের মনের মধ্যে কেমন একটা গেঁথে গেছিল যে ইংরিজি শক্ত সাবজেক্ট। ওটা আমরা পারব না। যে জিনিসটা শুরু করার আগেই মন হাল ছেড়ে দিতে চায় তাতে বেশি দূর এগোনো যায় কি?


আগের প্যারাগ্রাফেই এই পর্ব শেষ করব ভেবেছিলাম। কিন্তু তার আগে আমাদের স্কুলের আরেকজন অসাধারণ মহিলার কথা মনে পড়ে গেল। ভূগোলের টিচার কল্পনাদি। আমরা তখন ক্লাস টেনে পড়ি। কোন একটা ক্লাস ফাঁকা যাচ্ছে। সেই সময় ক্লাস ফাঁকা গেলে আমরা নিজেদের মধ্যেই গুজগুজ ফুসফুস করি। দীপুদিকে ছোটদের জন্য ছেড়ে দিই। কল্পনাদি এলেন। তারপর এমনিই আমাদের সাথে গল্প করতে শুরু করলেন। কথায় কথায় ইংরিজির প্রসঙ্গ উঠল। ইংরিজি বুঝতে পারি না, বলতে পারি না এসব। উনি সঙ্গে সঙ্গে ভাষা পরিবর্তন করে ইংরিজিতে গল্প করতে শুরু করে দিলেন। “গল্প করছিলেন” বলাটা ঠিক হল না। কারন গল্প করতে দুই পক্ষ লাগে। কল্পনাদি ইংরিজি ধরা মাত্র আমরা বোবা হয়ে গেছি। দিদি আমাদের জোর করলেন না।উনি নিজেই অনেক কথা বলে গেলেন। ওনার বাড়ির কথা, মেয়েদের কথা। যেহেতু এই গল্পগুলোর সাথে পড়াশোনার কোন সম্পর্ক নেই, আমাদের শুনতেও খুব ভালো লাগছিল। আর আশ্চর্যের বিষয়, যদিও বোঝার কোন বাধ্যবাধকতাছিল না, কিন্তু আমরা দিদির বেশির ভাগ কথাই বুঝতে পারছিলাম। আসলে দিদির ঘরের খবর জানার ইন্টারেস্ট ছিল। তাই কান খাড়া করেছিলাম। খানিকক্ষণ এসব গল্প করে উনি বললেন, তোমরা ভয় পাও কেন? যা ইচ্ছে হয় বলবে। ঠিক হল কি ভুল হল ভাববে না। পরে যখন বেঁচে থাকার জন্যই ইংরিজি বলার দরকার পড়ল তখন কল্পনাদির কথা মনে করার চেষ্টা করেছি। কাজটা খুব সহজ নয়।কারন সব সময়েই মনে হতে থাকে এক্ষুনি একটা ভুল করব আর বিশ্ব সংসার আমার দিকে আঙুল তুলে হাসবে।  আজকাল এই ভাবটা একটু কমেছে। এখন বুঝতে পারি আমি অত বড় কেউকেটাও নই যে সারা পৃথিবী আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমিই বা তাহলে এত কিছু ভেবে মরি কেন! 

আবার বছর কুড়ি পরে – ৬

 মেয়েদের জীবনের অত্যন্ত স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা নিয়ে আমাদের লুকোচুরির অন্ত ছিলনা। পিরিয়ড বা মেন্সট্রুয়েশন জাতীয় শব্দগুলো তখনও ছিল অপ্রচলিত। শরীর খারাপ বললেই সবাই বুঝে যেত। আমরা সবাই নারী হয়ে উঠছিলাম কোন ট্রেনিং ছাড়াই। যাদের বড় দিদি ছিল তারা হয়তো কিছু জানতো। কিন্তু অনেকের কাছেই জীবনের প্রথম রক্তপাত আসতো খুব আকস্মিক ভাবে। আমি যখন সিক্সে উঠি তখন দেখতাম রীনা আর আরেকটা কেউ (কিছুতেই মনে পড়ে না সে কে ছিল) মাঝে মাঝে একটা রহস্যময় হাসি হাসে। কিছুতেই বুঝতে পারি না হাসির কারন। তারপর খুব চেপে ধরতে রীনা বলল – প্রতি মাসে মেয়েদের শরীর থেকে দুষিত রক্ত বেরিয়ে যায়। তোর হলে তুইও বুঝবি। আমি সত্যিই বুঝিনি রক্তে দূষন আসছে কোথা থেকে। মেয়েদেরই বেছে বেছে এটা হচ্ছে কেন। তবে এটুকু বোঝা গেল এটা নিয়ে বেশি কথা বলতে নেই বা বললেও ফিসফিস করে বলতে হয়।


যে সময়ের কথা বলছি সেটা সম্ভবত টিভিতে “চুপচাপ রয়েছে বল না কি হয়েছে” বা “অনুভব করেছি তাই বলছি” অ্যাডগুলোর আগে। সম্ভবত লিখলাম কারন আমার বাড়িতে টিভি দেখায় বাধা ছিল। খুব বেশি টিভি আমি দেখিনি। এই অ্যাডগুলো যখন আমার চোখে পড়ে তখন এইট-নাইনে পড়ি মনে হয়। কাজেই ঐ যুগে আমরা হঠাৎ করেই একদিন একটা গোপন জগতে প্রবেশ করতাম। আর সেই জগত ছিল সিক্রেট সোসাইটির মত। সেখানে কি হয় সে কথা বাইরের কাউকে বলা যাবে না।


আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান যা ছিল তাতে “অনুভব করেছি তাই বলছি”-র কাস্টোমার আমরা অবশ্যই ছিলাম না। দু-একটি ব্যাতিক্রম বাদে সকলেই কাপড় ব্যবহার করত। আজকে এটাকে আনহাইজিনিক বলেই জানি। কিন্তু সেদিন আমাদের এগুলো কেউ শেখায় নি। চিরাচরিত কাল ধরে যা চলে আসছে তাকে মেনে নেওয়াই ছিল আমাদের এবং আমাদের মায়েদের অভ্যাস। স্কুলেও পুরোনো কাপড় পরিস্কার করে রাখা থাকত। কারোর যদি স্কুলের মধ্যে প্রয়োজন হয় তাহলে মীনাদির কাছে চাইলে পাওয়া যেত। এমনিতে খুব দরকার না পড়লে স্কুলের বাথরুম আমরা ব্যবহার করতাম না। তিনতলায় তিনটে বাথরুম থাকলেও সেগুলোর অবস্থা খুব পরিস্কার থাকত না।


এইভাবেই আমরা আস্তে আস্তে বড় হওয়ার গোপনীয়তাগুলো শিখে নিচ্ছিলাম। শরীর খারাপের দিনগুলোতে বসার আগে জামা সরিয়ে বেঞ্চের ওপর নিজেকে ন্যাস্ত করার কৌশল রপ্ত করছিলাম। তা সত্বেও যদি কখনও জামায় দাগ লাগে তাহলে সব ক্লাসেই দু-একজন এক্সপার্ট পাওয়া যেত যারা সেফটিপিন দিয়ে জামা বা শাড়ি প্লিট করে দেবে যাতে দাগ দেখা না যায়। কারন বাড়ি ফিরতে হবে হেঁটে অথবা ভিড় বাসে। আর আমরা সবাই জানতাম যতই আমরা সিক্রেট সোসাইটির সদস্য হই না কেন, আসলে আমাদের সিক্রেটটা উটপাখীর বালিতে মুখ গোঁজার মত। যে গোপনীয়তার দূর্গ আমরা নির্মান করেছিলাম তাতে দরকার পড়লে কোন ছেলের কাছে সাহায্য চাওয়া অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু জামার দাগ বাইরের কেউ দেখতে পেলে হাসাহাসি আর লাঞ্ছনা থেকে নিষ্কৃতির কোন উপায় ছিল না।


এমন এক সময়ে আমাদের লাইফ সায়েন্স পড়াতেন ইলাদি। কড়া টিচার ছিলেন। কিন্তু এতটাই ভালো পড়াতেন যে আমাদের সকলেরই ওনাকে পেতে ইচ্ছে করত। কল্পনাদির মতই উনিও কথা বলতেন জোরে। বই দেখতেন না কখনও। লাইফ সায়েন্স আমার পছন্দের বিষয় ছিল না। কিন্তু তা সত্বেও চল্লিশ মিনিট ধরে উনি যা যা বলতেন তা আমি ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিতাম। আমরা তখন বোধহয় ক্লাস নাইন। টেন ও হতে পারে। কোন এক সাহসী মেয়ে একদিন ক্লাসের শেষের দিকে ইলাদিকে বলল, দিদি আমাদের শরীর খারাপ কেন হয় বলবেন?  দিদি মুচকি হেসে বলে গেলেন, পরের দিন বলব।


পরের লাইফ সায়েন্স ক্লাসের দিনে সম্ভবত একটি মেয়েও অনুপস্থিত ছিল না। ইলাদি বোর্ডে ছবি এঁকে নিঁখুত ভাবে ঋতুচক্র বোঝালেন। বুঝলাম মেয়েদের রক্ত দুষিত হয়না। বরং আরেকটা প্রাণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এই রক্ত অপেক্ষা করে। একটা কথা মনে আছে, উনি রজঃ স্রাবকে বলেছিলেন ব্যর্থ জঠরের কান্না। বেশ কাব্যিক লেগেছিল উপমাটা। আমাদের অনেকেই মাধ্যমিকের পর সায়েন্স পড়ে নি। আমি হায়ার সেকেন্ডারীতে বায়োলজি নিয়েছিলাম। কিন্তু ফিজিওলজিতে রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেম যতদিনে এল ততক্ষণে প্রি-টেস্ট কাছে চলে এসেছে। সিলেবাস শেষের তাড়া। আর কলকাতার কলেজের টিচাররাও ঐ চ্যাপ্টার পড়াতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। টুয়েলভে আদৌ কিছু জেনেছিলাম কিনা তা মনে পড়ে না। আজ পর্যন্ত নিজের শরীরের এই অপরিহার্য ঘটনাটা নিয়ে আমার যা কিছু ধারনা তা ইলাদির দান।


এর কিছুদিন পরেই মেয়েরা আবার বায়না করে, দিদি বাচ্চা কি করে হয় বোঝান। আবার একটা চল্লিশ মিনিটের লেকচারে ইলাদি আমাদের প্রজনন বোঝান। অবশ্য এটা আজকে স্বীকার করে যাই, ওভারঅল সায়েন্সটা বুঝলেও শুক্রাণু  কি করে ছেলেদের শরীর থেকে মেয়েদের শরীরে আসে সেটা আমি ইলাদির লেকচার থেকে বুঝতে পারিনি। সেটা আমাকে বন্ধুদের থেকেই বুঝতে হয়।


এগুলো চুরানব্বই-পঁচানব্বই সালের কথা। এর প্রায় বছর দশেক পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার জীবনশৈলী নামে একটি বিষয় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু রিপোর্ট পাওয়া যায় শিক্ষকদের সেক্স এডুকেশন পড়ানোর অনীহার জন্য এই প্রকল্প খুব একটা সাকসেসফুল হয়নি। ইলাদি নিঃসন্দেহে সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এই ভেবে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় যে ওনার ছাত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।


[পুনশ্চঃ আজ যে বিষয় নিয়ে লিখলাম, জানি না এই লেখা যারা পড়ছিস তারা সকলে খোলা পাতায় এই আলোচনায় স্বচ্ছন্দ বোধ করবি কিনা। অন্য দিনের মতই আমি তোদের ট্যাগ করছি। যদি তোরা তোদের টাইম লাইনে এই পর্বটা রাখতে না চাস আমাকে পার্সোনাল মেসেজ করে দিস। আমি ট্যাগ সরিয়ে দেব। আর আমি অবশ্যই কিছু মনে করব না। আমার নিজেরই অনেক সময় লেগেছে ঋতুচক্র নিয়ে অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে।]

Tuesday, February 17, 2015

আবার বছর কুড়ি পরে - ৫

 ২রা জানুয়ারী ছিল চারুশীলা স্কুলের ফাউন্ডেশন ডে। আমরা বলতাম স্কুলের জন্মদিন।শীতের ছুটির পর আর সব স্কুল ২ তারিখে খুলে গেলেও আমাদের স্কুল খুলত তিন তারিখে।  ১৯৯৩ সালে স্কুলের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল। তখন আমরা ক্লাস এইট। পুজোর ছুটির আগে প্রতিবার যেমন ঘরে ঘরে অনুষ্ঠান হত এবার সে নিয়মের ব্যাতিক্রম হল।  দিদিরা বললেন ফাইভ থেকে সেভেন, এইট থেকে টেন আর ইলেভেন-টুয়েলভ এই তিন গ্রুপের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে ছুটিপড়ার আগের দিন। যে ক্লাসের যেমন খুশি অনুষ্ঠান করতে পারবে। সময়সীমা পনেরো মিনিট। যাদের নাচ, গান, অভিনয় ভালো হবে তারা সুযোগ পাবে সুবর্ণজয়ন্তীর প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার।ক্লাস এইটের মেয়েরা তখনও ফ্রক পরলে কি হবে তাদের ঘরের অনুষ্ঠান দেখতে প্রতি বছর দিদিমনিদের আর অন্য ছাত্রীদের ভিড় হয়। বিশেষ করে যে সেকশনে তিন্নি আর কাশ্মীরা থাকে। লিপিকা খুব ভালো আবৃত্তি করতো।  সুদর্শনার গানের কথা তো আগের পর্বেই বললাম। মিঠুও খুব ভালো গাইতো। আলপনা দিত। মোট কথা ট্যালেন্টের কমতি ছিল না। রবীন্দ্রনাথের “দুর্বুদ্ধি” গল্পটাকে নাট্যরূপ দিয়ে ফেললাম।গল্পটা আমাদের সহায়ক পাঠে ছিল বলে সকলেরই পড়া ছিল। কাস্টিং, ডিরেকশান, অভিনয়ে তিন্নি আর কাশ্মীরার জুড়ি ছিল না। মেয়ে হারানো এক চাষীর ভূমিকায় শর্মিলাও ফাটিয়ে দিল। ফলস্বরূপ দেখা গেল আমাদের গ্রুপে আমরা ফার্স্ট হয়েছি।  


পুজোর ছুটির শেষে স্কুল খোলার কিছুদিনের মধ্যেই সুবর্ণজয়ন্তী প্রোগ্রামের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেলো। পুরো অনুষ্ঠানসূচী এখন আর স্মরণে নেই। আমি, তিন্নি আর কাশ্মীরা স্থান পেলাম “তাসের দেশ” নাটকের অভিনয়ে।  যদ্দুর মনে পড়ে স্বপ্নাদি নাটক পরিচালনা করেছিলেন। গান পরিচালনা করেছিলেন লাইব্রেরিয়ান মঞ্জুদি। তবে স্বপ্নাদি আর মঞ্জুদি ছাড়াও রিহার্সালের সময় আরো অনেকে আসতেন। বলাকাদি অনেক নাচ তুলিয়ে দিয়েছিলেন। কলিকাদি,মালাদি, বাংলার মঞ্জুশ্রীদি নিয়মিত থাকতেন। মালবিকাদি, লীনাদি, জ্যোৎস্নাদি এসে দেখে যেতেন। পুরো স্কুল জুড়েই তখন উৎসব উৎসব ভাব। আমরা যারা নাটকে ছিলাম তারা মাঝেমাঝেই শেষের দুটো পিরিয়ডে ছাড় পেয়ে যেতাম। সে ছিল উপরি পাওনা।


নাচে তো অনেকেই। কিন্তু ক্লাস নাইনের রূপাঞ্জলীদি ভালো নাচিয়েদের মধ্যেও ছিল স্বতন্ত্র। নাচের ব্যাকরণ কিছুই বুঝি না। তবু বলতে পারি রূপাঞ্জলীদির নাচে যে স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল, যে মুক্তি ফুটতো তা ছিল দুর্লভ। রূপাঞ্জলীদিকে রাজপুত্রের চরিত্র দিয়ে স্বপ্নাদি একটুও ভুল করেন নি। “যাবই আমি যাবই, ওগো বাণিজ্যেতে যাবই” – রূপাঞ্জলীদির নাচ আমার এখনও চোখে লেগে আছে। নায়ক-নায়িকা রুইতন আর হরতনীর পার্ট করেছিল রাখীদি আরঝুমুরদি। এরা দুজনেই তখন ইলেভেনে পড়ে। ভীষন ভালো নাচে। নাটকের রিহার্সাল দিতে দিতেই আমি রাখীদির ফ্যান হয়ে গেলাম। রাখীদি স্কুল ছাড়ার পরেও যোগাযোগ ছিল। তারপর আস্তে আস্তে সুতো ছিঁড়ে গেল। ( কোথায় হারিয়ে গেলে রাখীদি?) আমি ইস্কাবনীর পার্ট পেয়েছিলাম। একদম নাচতে পারতাম না। আমাকে তাস বংশের জাতীয় সঙ্গীত “চিঁড়েতন হরতন ইস্কাবন”-এর নাচ তোলাতে তোলাতেই দিদিদের ঘাম ছুটে গেল। স্বপ্নাদি বললেন, তোকে আর “বল সখী বল তার নাম আমার কানে কানে”র সাথে নাচতে হবে না। তুই মেঝেতে বসে প্রসাধন করবি,পারমিতা (টেক্কানী) তোর চারপাশে ঘুরে নাচবে। আমিও বাঁচলাম, দিদিরাও বাঁচলেন। এমনকি অনুষ্ঠানের দিন পারফর্মান্সের পর স্বপ্নাদির থেকে প্রশংসাও পেয়ে গেলাম। কাশ্মীরা আর ইলেভেনের একটা দিদি ছক্কা- পঞ্জা করেছিল। তিন্নি বোধহয় দহলানী করেছিলি, তাই না রে?


সে সময় থুতনির নিচে ডানদিক ঘেঁসে তিলকে সৌন্দর্জের পরাকাষ্ঠা মানা হত। আমরা বলতাম বিউটি স্পট। প্রোগ্রামের দিন মেকআপের সময় যারা মেয়ের রোল করছি তারা প্রায় সকলেই একটা করে বিউটি স্পটের বায়না ধরলাম। একসাথে অতগুলো একই জায়গায় তিলযুক্ত মেয়ে সম্ভবত তার আগে কেউ দেখেনি। তিনদিনের প্রোগ্রাম ছিল। তাসের দেশ অভিনয় হল প্রথমদিনেই। বাবা-মায়েরা দেখতে এল। অনেক প্রশংসা কুড়োলাম। দ্বিতীয়দিনে এসেছিল রুমা গুহঠাকুরতার ক্যালকাটা ইউথ কয়ার। তার আগে এই রকম কোন গোষ্ঠীর প্রোগ্রাম দেখার সুযোগ হয়নি। নচিকেতা চক্রবর্তী তখনও নীলাঞ্জনা গান নি। সুমন চাটুজ্যে শুরু করেছেন বটে, কিন্তু মফস্বলে তাঁর আবেদনছিল সীমিত। সেদিন রুমা গুহঠাকুরতা যে গানগুলো গেয়েছিলেন তেমন গান আমি এর আগে শুনিনি। আস্তে আস্তে টের পাচ্ছিলাম একটা অন্য বাতাস বইছে। অচেনা হাওয়ার ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে।


আবার বছর কুড়ি পরে – ৪

 আজকের নিরিখে দেখলে আমাদের তৎকালীন জীবনযাত্রা বড্ড বেশি সাধারণ ছিল। বন্ধুত্ব এমন ছিল যে একদিন স্কুলে যেতে না পারলে ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। গরমের ছুটি, পুজোর ছুটিতে পোস্টকার্ড ভরে চিঠি লিখতাম। একটু বড় হওয়ার পর, যখন কাছাকাছি থাকা বন্ধুদের বাড়ি যাওয়ার পার্মিশন পাওয়া যায় মায়েদের থেকে,  তখন কোনদিন স্কুলে যেতে না পারলে বেস্ট ফ্রেন্ডদের থেকে চিরকুটও আসতো। অথচ আজকের মত জন্মদিনের পার্টি ছিল না। আমরা কেউ কারোর জন্মদিন জানতামই না। আসলে সকলেই তো ছিলাম মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে। অত ঘটাপটার জন্মদিন আমাদের বাড়িতে হত না। ক্লাস সিক্সেই একবার আমাদের সেকশনের একটি মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে স্কুলের মধ্যে। ডাক্তার ডাকা হয়। জানা যায় মেয়েটি বেশ কদিন ধরে কিচ্ছু না খেয়ে স্কুলে আসছিল। 


আমাদের জীবনে প্রাচুর্যের কোন জায়গা ছিল না। অভাবও যে তেমন বুঝেছি সেই সময়ে তা বলা যায় না। এক এক দিন এক একটা গান দিয়ে স্কুল শুরু হত। নাইন থেকে টুয়েলভ –এই চার ক্লাসের বাছাই করা কিছু মেয়ে ছিল লীড সিঙ্গার। গানের আগে হত পাঠ। একটা কোটেশনের খাতা ছিল। সুপ্রিয়াদি সেটার দেখভাল করতেন। রোজ সকালে সেই খাতা থেকে একটি কোটেশান পাঠ করা হত। খাতাটা জীর্ণ হয়ে এসেছিল। টেনে পড়ার সময় সুপ্রিয়াদি আমাকে কোটেশানগুলো একটা নতুন খাতায় তুলতে দেন। কিছু কোটেশান তুলেছিলাম। সব কটা পারি নি। জানি না সে খাতা আজও আছে কিনা। পাঠের পর গান হত। “জন গন মন অধিনায়ক”, “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে”, “শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান” – এই গানগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হত। আমাদের ব্যাচের সুদর্শনা অবাক করা গান গাইতো। এমনিতে সুদর্শনা ছিল খুব দুষ্টু। সব সময়ে ওর মাথায় কিছু না কিছু চলত। কিন্তু গান গাওয়ার সময় ওর সব দুষ্টুমি কোথায় যে উধাও হয়ে যেত! কোন জগতে যে চলে যেত ও কে জানে! আর যারা ওকে শুনতো তারাও। এখনও মনে পড়ে আমরা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি লাইন করে। সুদর্শনা গাইছে – “আমার যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে”।  আস্তে আস্তে সেই মাঠ, চারুশীলা স্কুল, আমাদের দিদিমনিরা, আমরা কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছি। বার বার ঘুরে ফিরে শুধু ধাক্কা খাচ্ছি – “তার ছিঁড়ে গেছে কবে , তার ছিঁড়ে গেছে কবে – একদিন কোন হাহারবে তার ছিঁড়ে গেছে কবে – সুর হারায়ে গেল পলে পলে...”


মেয়েদের স্কুলে সারাদিন মেয়েদের সাথেই মেলামেশা। ছেলেদের প্রতি কৌতুহল তো ছিলই। তার অনেকটাই অজানা ভয় মিশ্রিত। ছেলে আর মেয়ে যে বন্ধু হওয়া যায় তা অনেকদিন পর্যন্ত জানতাম না। বা জানতাম হয়তো, কিন্তু দেখতাম না। আসলে খোলাখুলি মেলামেশার সুযোগ ছিল না তো। তাই যদি বা কখনো মেলামেশার সম্ভাবনা তৈরী হয়, লোকজন ধুপধাপ প্রেমে পড়ে যেত। তার মধ্যে অনেকগুলো টিকতো না। আবার কয়েকটা সসম্মানে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। রাখী যখন প্রসেনজিতের প্রেমে পড়ল, রাখীর চেয়ে আমরা কিছু কম উত্তেজিত ছিলাম না। সরস্বতীপুজোর দিন আড়চোখে রাখীর সাইকেলাসীন হার্টথ্রবকে দেখে নেওয়া। তারপর তার চুলচেরা বিচার। সেই সম্পর্ক আজ একুশ বছরে পা দিল। বড় হয়ে ওঠার কোন গল্পই কি সম্পূর্ণ হয় ওদের ছাড়া!


ছেলেতে মেয়েতে মেলামেশায় বাধা ছিল। অথচ সেই সদ্য কিশোরীবেলায় – “আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল”। হৃদয় টইটম্বুর, মেলে ধরি কার হাতে? ফলত স্কুলের পেছনের দেওয়ালে ছেলের নাম প্লাস মেয়ের নামের পাশাপাশি মেয়ের নাম প্লাস মেয়ের নাম দেখতে পাওয়া আশ্চর্য ছিল না। উঁচু ক্লাসের কোন কোন মেয়েকে ভালো লেগে যায়। ছুতোয় নাতায় তাদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। তাদের একটা কাজ করে দিতে পারলে জীবন ধন্য মনে হয়। কয়েক বছর পর কলেজে অ্যাডমিশন মিললে উঁচু ক্লাসের দিদিদের গোহারান হারিয়ে দিয়ে উঁচু ক্লাসের দাদারা হৃদয়াকাশে বিরাজ করতে লাগল।


এইখানে একটা কথা লিখে রাখা দরকার। তখন আমরা হোমোসেক্সুয়ালিটির নামও শুনিনি। হয়তো সে কারনেই মেয়েতে মেয়েতে ভালোবাসা, চিঠি দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে আমরা অস্বাভাবিক কিছু দেখিনি। শরীর সম্পর্কে সচেতনতাও একেবারেই ছিল না। আমাদের মধ্যে যারা পরবর্তী কালেও সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষন বোধ করেছে তারা সেই মত জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছে। কাজটা সহজ হয়নি। কাছের লোকের থেকেই বাধা এসেছে বেশি। তবুও রোজ যুদ্ধ করতে করতে একটু একটু করে নিজের বিশ্বাসের কাছে পৌঁছচ্ছে তারা।


এই স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বেয়ে ক্ষয়ে যাওয়া মানুষ গুলোর জন্য; রাখী-প্রসেনজিতের মত যারা দীর্ঘ দুই দশক ধরে নিজের বিশ্বাসে স্থিত তাদের জন্য; যাদের বিশ্বাস ভেঙেছে বার বার, তবুও যারা উঠে দাঁড়িয়েছে কারন বিশ্বাসই এক মাত্র পথ – এদের সবার জন্য, তোদের জন্য এই গান –


Imagine there's no heaven

It's easy if you try

No hell below us

Above us only sky


Imagine all the people

Living for today


Imagine there's no countries

It isn't hard to do

Nothing to kill or die for

And no religion, too


Imagine all the people

Living life in peace


You may say I'm a dreamer

But I'm not the only one

I hope someday you will join us

And the world will be as one


আবার বছর কুড়ি পরে – ৩

 দীপুদির কথা মনে পড়ছে। এক মুখ পান, পূর্ণিমার চাঁদের মত বড় একখানা টিপ। হাঁটুতে ব্যাথা ছিল। শেষের দিকে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে খুব কষ্ট পেতেন। দীপুদির পুরো নাম কি ছিল কেউ জানি না। খুব আদর দিতেন। কাছের মানুষ ছিলেন সবার। কাছের মানুষকে কি কেউ আর ভালো নাম ধরে ডাকে! দীপুদি কোন সাবজেক্ট পড়াতেন আমার জানা নেই। ফাইভ থেকে টেন – যেকোন ক্লাসে সাবজেক্ট টিচার অ্যাবসেন্ট হলে দীপুদিকে ডেকে আনা ছিল দস্তুর। দিদি, আমাদের ক্লাসে চলুন, গল্প বলতে হবে। দিদিও আরেকটি পান মুখে দিয়ে ক্লাসে আসতেন। তারপর চল্লিশ মিনিট কোথা দিয়ে কেটে যেত কেউ জানে না। গ্রীম ভাইদের রূপকথা দীপুদির মুখে শুনতে শুনতে মনে হত সিনেমা দেখছি। সাবজেক্ট টিচাররা কেন বেশি করে অসুস্থ হন না এই নিয়ে ক্ষোভ জন্মাত মনে।


ফাইভ থেকে টেনের প্রত্যেকটা মেয়ে যাকে যমের মত ভয় করত তিনি হলেন সেলাইয়ের টিচার গীতাদি। সেই যে ক্লাস সিক্স থেকে গীতাদির বকুনি খাওয়া শুরু হল তা থামল মাধ্যমিক পাশ করার পর। গীতাদির ক্লাস শুরু হলেই লাস্ট বেঞ্চে দেওয়ালের কোণ ঘেঁষে বসতাম। কিন্তু শ্যেন দৃষ্টিকে এড়ায় কার সাধ্য। কথিত আছে, নাইন এ-র একটি মেয়ের সেলাই পছন্দ না হওয়ায় তিনি সেটি জানলা গলিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। আরো অনেক গল্প ঘুরত গীতাদির নামে। সোয়েটারের বোনা সমান না হওয়ায় পুরো সোয়েটার খুলে দেওয়া, লাস্ট বেঞ্চে বসে গল্প করার অপরাধে চক ছুঁড়ে মারা – সব গল্প সম্ভবত সত্যি নয়। স্কুলে থাকাকালীন শেষ যে ম্যাগাজিনটা বেরিয়েছিল তাতে গীতাদি একটা লেখা দিয়েছিলেন। ওনার রিটায়ার করতে তখন বোধহয় বছরখানেক বাকি ছিল। উনি লিখেছিলেন – আমি তোমাদের খুব বকি বলে তোমরা আমায় ভয় পাও জানি, কিন্তু আমি তোমাদের ভালোওবাসি। আমি মারা গেলে সেই খবর স্কুলে আসলে তোমরা কিন্তু সেদিন ছুটি নেবে না। বরং খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করবে সেদিন। কথাগুলো হুবহু মনে নেই আর ম্যাগাজিনটাও হাতের কাছে নেই। তাই উদ্ধৃতি চিহ্ন দিলাম না। কিন্তু এই রকমই ছিল বিদায় নেওয়ার আগে মেয়েদের প্রতি দোর্দন্ডপ্রতাপ গীতাদির সম্ভাসন। পুরোনো দিনের মানুষগুলো এমনই ছিলেন। স্নেহ দেখাতে ভয় পেতেন পাছে ছেলে-মেয়ে বখে যায়। তাঁদের ছেড়ে এলে টের পাওয়া যেত উত্তাপ।


সেভেনে উঠে লাইফ সায়েন্স, ফিজিকাল সায়েন্স ভাগ হয়ে গেল।  ফিজিকাল সায়েন্স পড়াতে এলেন কলিকাদি। অপূর্ব সুন্দরী। ইরানিয়ান মেয়েদের মত গায়ের রং ছিল কলিকাদির। ওনার তখনও বিয়ে হয়নি। ঠিক মনে পড়ে না কোন ক্লাসে কলিকাদির বিয়ে হয়। শিখাদিরও কাছাকাছি সময়ে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর প্রথম যেদিন দিদিরা ক্লাসে আসতেন সেই দিনগুলো ছিল বলার মত। যারা স্মার্ট তারা তো সামনে গিয়েই দেখে নিচ্ছে। কেউ কেউ তো বলেই ফেলছে – দিদি আপনাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে। সবার তো সেটা সাহসে কুলোচ্ছে না। তাদের ঘন ঘন বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়ছে। যদি কোন ফাঁকে দিদিকে দেখা যায় – কোন করিডরে বা ক্লাসরুমে। 

Monday, February 16, 2015

আবার বছর কুড়ি পরে – ২

 আচ্ছা আরেকটু লেখা যাক। মাসীমার কথা লিখি? বেশি তো লেখার নেই। আমরা যখন সিক্সে পড়ি রিটায়ার করলেন। খুব বেশি চেনার সুযোগ হয়নি। তবে ছিল বটে ম্যাগনেটিক পার্সোনালিটি।এক কথায় মাসীমা বনমালা দেবী – আমাদের বড়দি ছিলেন চারুশীলা স্কুলের ইন্দিরা গান্ধী।মস্ত বড় চশমা, ঘোমটায় ঢাকা মুখ। ওনাকে যে কেমন দেখতে ছিল একদম মনে নেই। গলার আওয়াজে খুব জোর ছিল এমনও নয়। তবুও বারান্দার এক প্রান্তে ওনার সাদা শাড়ীর পাড়টুকু দেখা গেলেও ছমছমে নৈঃশব্দ নেমে আসতো। টিফিনের সময় দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেন।নিচের মাঠে মেয়েদের খেলা থামতো না, তবে খেলা হত সামলেসুমলে। তখনও শারীরিক কষ্ট করে পড়াশোনা করাকে গৌরবের বিষয় ধরা হত। শীতকালে সব ঘরে পাখা বন্ধ থাকত। গরম পড়ার পরেও সে পাখা সহজে চলত না। কতটা গরম সহ্য করা যায় তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা বেশ মজারই ছিল।শুধু আমরা তো নই, দিদিদের ঘরেও পাখা চলত না, মাসীমার ঘরেও না। তারপর মাসীমা একদিন পাখা ছাড়ার অনুমতি দিতেন। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম।


সিক্সে আমার পাশে বসত রীনা। রীনার দিদি নন্দিনীদি, প্রিয়াঙ্কার দিদি পাপিয়াদি, সুচিরার দিদি রুচিরাদি তখন হায়ার সেকেন্ডারী দেবে। আমাদের দুনিয়াতে তখন টুয়েলভের ওপরে ক্লাস নেই,হায়ার সেকেন্ডারীর ওপরে ডিগ্রী নেই, আর এই কমলাপাড় শাড়ী পরা দিদিদের চেয়ে জ্ঞানী মানুষ কোত্থাও নেই।  একদিন নবনীতার সাথে ভারী তর্কহল রবীন্দ্রনাথ কতগুলো কবিতা লিখেছেন তা নিয়ে। টিফিন পিরিয়ডে রুচিরাদির শরণ নেওয়া ছাড়াগতি কি! রুচিরাদি বলে দিল তিন হাজার, আমিও নাচতে নাচতে ঘরে ফিরলাম। কোন জটিল এরর অ্যানালিসিসে আমার উত্তরটা রুচিরাদির কাছাকাছি বলে মনে হয়েছিল।


বাংলা পড়াতেন মঞ্জুশ্রীদি। বড্ড ভালো পড়াতেন। দিদির ছোট মেয়ে পরমাদি সেবার হায়ারসেকেন্ডারী দিয়েছে আমাদের স্কুল থেকেই। সেবারে স্কুলের ম্যাগাজিনে পরমাদি একটা ভ্রমণকাহিনী লিখেছিল। কোন জায়গার গল্প ছিল সেসব কিচ্ছু মনে নেই। এটা ভেবে খুব অবাক হয়েছিলাম যে স্কুলের দিদিরাও বাড়িতে আমাদের মায়েদের মতই। মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে যান, বকেন, রান্নাকরেন, এমন কি দরদাম করে জিনিসও কেনেন! আমার মা-ও অন্য একটা স্কুলের দিদিমনি। তাও আমি কেন এমন অবাক হয়েছিলাম কে জানে! আসলে সেই বয়েসটাই ছিল অবাক হওয়ার বয়েস। লীনাাদি ইতিহাস পড়াতেন।  তাপসী আর জয়তী খুব গড়গড় করে ইতিহাস পারত।  মহেঞ্জোদরোর কথা বলতেন দিদি, সুমেরীয় সভ্যতার কথা বলতেন। আনন্দমেলাতে মাঝে মাঝে সেসব নিয়ে লেখা বেরোতো। তখন তো আর জানা ছিল না চাইলে এসব নিয়েও পড়াশোনা করা যায়। ভালো কেরিয়ার মানে তখন শুধু ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার। ভালো রেজাল্ট মানে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পাশ দেওয়া। অন্য কিছু যে হওয়া যায় তা জানাই ছিল না।


সঙ্ঘমিত্রাদি বায়োলজির টিচার হয়ে এলেন সিক্সেই। ক্লাস টেস্টের খাতায় মটরশুঁটি বা পদ্মফুল বা রুইমাছ বা অন্য কোন কিছু একটা এঁকে আমি দিদির প্রিয়পাত্রী হয়ে গেলাম। স্কুলের শেষ দিন পর্জন্ত খুব ভালোবেসেছেন আমায়। সেই সঙ্ঘমিত্রাদির ক্লাসে একবার এক কান্ড ঘটল। সিক্স সি র একজনের দাদা ক্লাস নাইনের এক দিদির জন্য চিঠি পাঠিয়েছিল। সেই চিঠি ধরা পড়ে এবং ফলস্বরূপ সঙ্ঘমিত্রাদির বকুনি। সেসব দিন মোটেই আজকালের মত ছিল না। “প্রেম” একটা নিষিদ্ধ শব্দ ছিল, প্রেম করার কথা তো কল্পনায় আনা যায় না। খুব পাকা মেয়েরা ওসব কথা বলে, ওসব কাজ করে। কাজেই সঙ্ঘমিত্রাদি যা কিছু বকুনি দিলেন তার সবটাই সান্ধ্যভাষায়। উনিও “প্রেম” কথাটা উচ্চারণ করলেন না, আমরাও “কিচ্ছু বুঝিনি” ভালো মেয়ের অভিনয় করলাম। শুধু ক্লাসের শেষে সৌজন্যা মুখ টিপে হেসে বলল – আমি ব্যাপারটা বুঝেছি। 


অথচ দেখ, ফাইভে পড়ার সময়েই আমাদের এ সেকশনের একজনের বিয়ে হয়ে গেছিল। তার নাকি কিসব কুষ্ঠির দোষ ছিল, তাই তার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কি রকম আয়রনি না?

আবার বছর কুড়ি পরে - ১

 স্কুলের প্রথম দিনের কথা তোদের মনে পড়ে? ফার্স্ট পিরিয়ডে ছিল বাংলা। শিখাদির ক্লাস। দিদিও তখন সদ্য জয়েন করেছেন। নতুন ছাত্রীদের প্রথম ক্লাস নতুন দিদিমনির সাথে। “ধনধান্য পুষ্পেভরা” পড়িয়েছিলেন মনে হয়। দিদির হাসিটা এত মিষ্টি ছিল! খুবভালো লেগে গেল নতুন স্কুলের নতুন দিদিমনিকে। নতুন নতুন বন্ধুও হল কয়েকজন। মৌমিতা অ্যাডমিশান টেস্টে সেকেন্ড হয়েছিল। ও এল আমাদের বি সেকশনের রোল নাম্বার ওয়ান হয়ে। তিনতলার বাঁদিকে লম্বা হলঘরটা পার্টিশান করে তিনটে ক্লাসরুম ছিল। ফাইভ বি আর সি পাশাপাশি।ফাইভ এ বসত দোতলায়। ফাইভের দুই সেকশনেরই চেঁচামেচিতে সুনাম ছিল। কিন্তু মাসিমা যখন সি সেকশনে ক্লাস নিতে আসতেন তখন গোটা তেতলায় পিন পড়লে শোনা যেত। ইতিহাস পড়াতেন বোধহয়,তাই না? আমাদের ইতিহাস নিতেন খুশিদি। খুব ভয় পেতাম খুশিদিকে। কড়া চোখে ইউনিফর্ম চেক করতেন কিনা! চারুশীলায় ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই আমার একটা নীল কেডস ছিল। স্কুলের ইউনিফর্মে যদিও সাদা কেডস লেখা আছে, তাও আমার বাবা আমাকে নীল জুতো পরিয়েই পাঠিয়ে দিল। ভাবল জুতো পরা নিয়ে তো কথা, রং যাই হোক না কেন! কিন্তু খুশিদির নজর এড়াবে কে।আমাকে মাঠে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। আমি ছিলাম ভারী বোকা। একটা কেডসের কত দাম হয় কোন ধারনা ছিল না তো! কিছুতেই বাবা-মাকে বলতে পারছি না কেডস কিনে দেওয়ার কথা। আর খুশিদির চোখকে ফাঁকি দেওয়াও অসম্ভব। রোজই নীল জুতো পরে যাই, রোজই দাঁড়িয়ে থাকি। অবশেষে আর থাকতে  না পেরে মা-কে বললাম। পরের দিনই এসে গেল সাদা কেডস। আমিও তোদের সাথে একসাথে ক্লাসে ঢুকলাম।


আমাদের ব্যাচে যেকোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনায় সবচেয়ে ভালো ছিল তিন্নি আর কাশ্মীরা। ক্লাস ফাইভে তিন্নি এ সেকশন, কাশ্মীরা সি সেকশন। আমরা বি সেকশন কি করি! কে জানে কেন আমাদের মনে হল পুজোর ছুটি পড়ার আগেরদিন ক্লাসে ক্লাসে যে প্রোগ্রাম হয় সেখানে গাওয়ার জন্য “পুরানো সেই দিনের কথা” খুব অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে। চারমাস ক্লাস করেই কি এত পুরোনো কথা জমেছিল দেবা ন জানন্তি। মোটকথা গান হয়েছিল উপযুক্ত দরদ সহকারে। আর সেই সাথে কিশলয়ে পাঠ্য ছিল “পেটে খেলে পিঠে সয়” – সেটাই আমরা নামিয়ে ফেলেছিলাম ধুতি-টুতি পরে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড নবনীতা (কে জানে কোথায় হারিয়ে গেলি!) ভুতুবাবু সাজল। আমরা চটপট আমাদের প্রোগ্রাম সেরে ফেলে অন্য ক্লাসে ঘুরতে গেলাম। তখনই শুনলাম – এ সেকশনে একটা মেয়ে আছে তিন্নি, সি সেকশনে একজনের নাম কাশ্মীরা – দারুন নাটক করেছে ওরা।


কি মজা আমার! পরের বছর সিক্স সি তে তিন্নি এল আমার সেকশনে। পুজোর বন্ধের আগেরদিন আমরা স্নো হোয়াইট করলাম। আমি রাজকন্যা। তিন্নি আমার সৎমা। কি দারুন অভিনয় করেছিল তিন্নি। প্রিয়াঙ্কা, তুই রাজকুমার হয়েছিলি, মনে আছে? আমি তো উত্তেজনার চোটে আপেল কামড়ে চিবিয়েও ফেলেছি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভুলেও গেছি এই আপেল রাজকুমার এসে বার করবে আমার মুখ থেকে। বেচারা প্রিয়াঙ্কাকে আমার চেবানো আপেল বের করতে হল। সরিরে! তবে দেখ, তোকে কিন্তু আমায় কোলে তুলতে হয়নি। মুখ থেকে আপেল ফেলা মাত্র তড়াক করে লাফিয়ে উঠেছিল রাজকুমারী, ঠিক কিনা?


ফাইভের গল্প যা যা মনে পড়ে সেরে নেওয়া ভালো। আরেকটু সবুর করে সিক্সে উঠব। অঙ্ক করাতেন ঝর্ণাদি। তখনও আমাদের সংখ্যাগুলো বাংলায় লিখতে হত। সিক্সে থেকে ইংরিজি সংখ্যায় অঙ্ক শুরু হয়। আজ এই গল্পগুলো কেমন প্রাগৈতিহাসিক লাগে না? কারোর বাচ্চাই বোধহয় বাংলা মিডিয়ামে পড়ে না। বাংলা সংখ্যা চেনে কেউ? অথচ আমাদের সময়ে ইংরিজি অ্যালফাবেট শেখানো হচ্ছিল ক্লাস ফাইভে। অনীতাদি নিতেন ইংরিজি ক্লাস। তারপর সিক্সে পড়াতেন ভূগোল। সেই আমার ভূগোলকে ভালোবাসার শুরু। অবশ্য আরেকজনের নাম না নিলে পাপ হবে।ফাইভ সি তে ভূগোল নিতেন কল্পনাদি। পার্টিশানের এপার থেকে কল্পনাদির গমগমে গলা শুনতে পেতাম। খুব হিংসে হত ফাইভ সি কে। কেমন গল্পের মত ভূগোল পড়তে পেত ওরা! আমাদের পড়াতেন কল্যানীদি। পরের বছর রিটায়ার করলেন। উনিও খুব ভালো ছিলেন। খুব স্নেহশীলা। এখনও মনে পড়ছে আমার ম্যাপের খাতায় কল্যানীদি নীল পেন্সিল দিয়ে ভারতের উপকূল দাগিয়ে দিচ্ছেন। নীল শিরা ওঠা রোগা ফর্সা হাত। আমার দিদার মত। নাকি দিদার মত নয়? দিদা রোগা ছিলনা অত। কিন্তু হাতের ধাঁচটা যেন দিদার মত। কল্যানময়ী? তখন তো ফটো তোলার রেওয়াজ ছিলনা। তাই বোধহয় আমাদের প্রিয় মানুষরা এমন কিছু মূহুর্ত তৈরী করে যেতেন, খুব যত্ন আর খুব ভালোবাসা দিয়ে, যাতে চোখ বুজলেই তাঁদের দেখতে পাওয়া যায়, ফটোর কোন দরকারই না পড়ে!