About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Friday, July 30, 2010

আরশীনগর

আরশীতে মুখ খুঁজেছি অন্যমনা
চেনাদাগ বদলে গেছে কার আদলে
বেখেয়াল একলষেঁড়ে সে ভ্রাম্যমাণ
ভয়ানক অবাধ্যতায় তুলছে ফণা
খড়কুটো বাস্তুভিটে যাচ্ছে ভেসে
উড়োমেঘ সেই ঠিকানা বক্ষে নিলো
বালিঝড় ছদ্মপ্রেমিক ধূর্ত রাখাল
রুনুঝুন নাচছে পায়ে ইচ্ছেদানা
কোনোদিন কলজ়ে ছিঁড়ে জ্বালবে আগুন
ঝলকাবে লাস্যমুখর বৃষ্টিমাতাল
রোজকার তর্কপ্রিয় বিপন্নতায়
অনাবিল উড়বে তারই দগ্ধডানা

Sunday, July 25, 2010

তাওবাদের তত্ত্ব-তলাশ

একটা কাজে নর্থ ক্যারোলাইনা গেছিলাম। ফেরার পথে র‌্যালে এয়ারপোর্টে একটা পুরোনো বই-এর দোকান আবিষ্কার করলাম। বেশ অনেক বই। চার-পাঁচ ডলার করে দাম। অ্যান আরবরে সেন্ট্রাল ক্যাম্পাসের রাস্তায় এক বুড়ো লোক যেমন পুরোনো বই নিয়ে টেবিল সাজিয়ে বসতেন তারই একটা বড়সড় সংস্করণ। তো সেই দোকানে এটা সেটা বই-এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা বই হাতে উঠে এল – “দ্য তাও অফ পুহ”। লেখক বেঞ্জামিন হফ। পেঙ্গুইনের পাবলিকেশন। নেড়ে চেড়ে বুঝলাম সেটা তাওইজমের একটা বিশ্লেষণ। আর সেই বিশ্লেষণের কাজে উইনি দ্য পুহ-কে ব্যবহার করা হয়েছে একটা মডেল চরিত্র হিসেবে। আমার নানা রকমের ধর্মমত সম্পর্কে জানতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু ধর্মগ্রন্থগুলো এত গুরুপাক হয় যে কখনো শেষ পর্যন্ত পড়ে উঠতে পারি না। এই বইটার প্রচ্ছদে ঘুড়ি ওড়ানো উইনি দ্য পুহ-র ছবি দেখে মনে হল একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

“তাও” কথার মানে “দ্য ওয়ে” – পথ। কিসের পথ? বাড়ির সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে – যেখান দিয়ে রোজ ঘুম চোখে আপিস যাই, নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরি – আমার পথ চেনা বলতে সেটুকুই – আর শুনতে পাই হাজার হাজার মানুষ হাজার রকম ভাবে তারই কোটিখানেক ব্যাখ্যা ফেঁদেছেন! এই বইটাই যেমন শুরু হচ্ছে কনফুসিয়াস, বুদ্ধ আর লাও সুহ-র (তাওবাদী দার্শনিক) তুলনামূলক আলোচনা দিয়ে। তিন প্রৌঢ়কে এক চামচ করে ভিনিগার খেতে দেওয়া হয়েছে। ভিনিগার খেয়ে কনফুসিয়াসের মুখ সদ্য বউল ধরা আমের মত যখ্যি টক। জীবনের টকভাব সরাতে কনফুসিয়াস দাওয়াই দিলেন – “চল নিয়ম মতে, চল সমান পথে”। পুহ-র বয়েই গেছে অত নিয়মকানুন মেনে চলতে! সে বুদ্ধের মুখের দিকে তাকালো। তাঁর মুখ তেঁতো বিষ – জীবন ভারী দুঃখময়, মায়ার প্রলোভনে ভরা – নির্বাণেই মিলবে মুক্তি, বুঝলে ছোকরা! এসব কঠিন কথা পুহ-র এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বেরিয়ে গেলো। লাও সুহ-র দিকে তাকিয়ে দেখলো, তিনি হাসছেন আর আপনমনে গুনগুন করছেন - “এই তো ভালো লেগেছিল, আলোর নাচন পাতায় পাতায়, শালের বনের খ্যাপা হাওয়া এই তো আমার মনকে মাতায়... ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো, আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই না হতে আরো বড়”। পুহ নেচে উঠলো। বাহ! এতক্ষণে কেউ একজন নাচ-গানের কথা বলেছে। পুহ-র তো সেটাই কাজ। সকালে উঠে ফুরফুরে মেজাজে সে তার বন্ধু পিগলেট-কে বলে – ‘আহা অলম্বুশ! আজকে আমার মেজাজ বড়ই খুশ!’ চলো একটু ঘুরে আসা যাক! তারপর পুহ আর পিগলেট দুজনে মিলে নেচে-কুঁদে মধু খুঁজতে বেরোয়। পুহ-র বাকি বন্ধুরা অবিশ্যি ঠিক এইরকম নয়। খরগোশ যেমন ভারী চালাক-চতুর। সারা দুনিয়ার খবর তার নখদর্পণে। অন্য কেউ তার চেয়েও বেশী বুদ্ধিমান হয়ে যাবে এই তার বড় ভয়। আবার প্যাঁচাকে দেখো। সারাদিন ধরে সে প্রচুর পড়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের পাহাড়। পৃথিবীতে কিছু আছে, আর প্যাঁচা সেটা জানে না – সে ভারী লজ্জা! ইয়র, মানে ওই ভুরু কোঁচকানো, সব সময় গুম হয়ে থাকা গাধাটা আবার আরেক রকম। সেও বিস্তর পড়াশোনা করে রেখেছে – আর সব কিছুতেই খুঁত ধরে যাচ্ছে। কিছুই ঠিক মনের মত হয় না তার।

বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করে
– কি হে পুহ? কাজকর্ম নেই?
- নাহ! কাজ কি! দিনটা ভারী খাসা!
- তো?
- এমন খাসা দিনকে নষ্ট করার মানে হয়?
- সে কি হে! কোন জরুরী কাজে তো লাগাতে পারতে এমন পরিস্কার দিনটাকে!
- জরুরী কাজই তো করছি!
- কি রকম?
- শুনছি।
- কি শুনছো?
- পাখীদের গান শুনছি। তারপর দেখো, ঐখানে একটা কাঠবেড়ালী কেমন কিচিরমিচির করছে! ওর কথাও শুনছি।
- কি বলছে ওরা?
- ওরা বলছে – শোনো ভাই, তাক ধিনা ধিন তা! খাসা বটে আজকের দিনটা!
- এ আর নতুন কথা কি! এতো তুমি জানতেই!
- হুঁ, জানতাম। কিন্তু অন্য কেউও আমার মতই ভাবছে জানলে মনটা খুশী লাগে, ঠিক কিনা?
- তা হবে! তবে তুমি কিন্তু ভাই দিনটাকে অন্যভাবেও কাটাতে পারতে। এই ধরো রেডিওতে খবর শুনলে একটু! কত কিছু জানা যায় বলতো!
- রেডিও?
- হ্যাঁ, রেডিও। না’হলে জানবে কি করে বাইরে কি হচ্ছে?
- কেন? বাইরে বেরোলেই তো জানা যায়। এই যেমন আমি বেরিয়েছি এখন। পাখীরা বলছে – শোনো ভাই, তাক ধিনা ধিন তা! খাসা বটে আজকের দিনটা!


পুহ-র দিনগুলো এমনি ভাবেই কাটে। তাওবাদী দার্শনিকরা যার গালভরা নাম দেন – “the state of Uncarved Block” – আঁচড় কাটা হয় নি এমন পাথর। মন যখন এমন অবস্থায় থাকে তখন সত্য আসে সহজ ভাবে, শান্ত পায়ে, অনায়াসে – “জীবনপ্রান্তে হে নীরবনাথ, শান্ত চরণে এসো”। পুহ অবশ্য এত ভাবনাচিন্তার ধার ধারে না। পিগলেট-টা প্যাংলা আর কুচোমত হলে কি হবে, ভারী সুন্দর কথা বলেছে একখানা – “পুহ-টার বুদ্ধি-সুদ্ধি বিশেষ নেই, কিন্তু ও কারোর ক্ষতি করবে না কখনো। মাঝে মাঝেই বোকা বোকা কাজ করে ফেলে বটে, কিন্ত কি করে যেন সেই কাজগুলোই ঠিক-ঠাক সময়ে ঠিক-ঠাক কাজে এসে যায়।”

ইয়রের জন্মদিনের কথাই ধরা যাক। ইয়রের জন্মদিনের দিন পুহ আর পিগলেট ভাবলো ইয়র-কে কিছু দেওয়া যাক। পুহ-র মনে পড়লো এক শিশি মধু রাখা আছে ঘরে – সেটাই তো দেওয়া যেতে পারে ইয়র-কে। সে মধু আনতে গেলো। আর পিগলেট ভেবেচিন্তে বার করলো – জন্মদিনে ইয়রকে যদি একখানা বেলুন দেওয়া যায় ইয়র কি খুশীই না হবে! পিগলেট গেলো বেলুন নিয়ে আসতে। পুহ মধু নিয়ে ফিরছে আর শুনছে পাখীরা গাইছে – শোনো ভাই, তাক ধিনা ধিন তা! খাসা বটে আজকের দিনটা! ফুর্তির চোটে সে ভুলেই গেলো কোথায় যাচ্ছিল। হাতে মধুর শিশি, এমন খাসা দিন, একটু একটু খিদেও পাচ্ছে – সে মধুর শিশি খালি করে ফেললো। তারপরেই মাথায় বজ্রাঘাত – যাহ! মধু তো নেই! ইয়রের জন্মদিনের কি হবে এখন! যাই হোক, মধু নেই তো কি, মধুর শিশিটা তো আছে! সে শিশিটা নিয়ে প্যাঁচার কাছে গিয়ে বললো – এটাতে সুন্দর করে হ্যাপি বার্থ ডে লিখে দাও দিকি! প্যাঁচা অবিশ্যি লিখে দিলো খুশী মনেই। পুহ তখন খালি শিশি নিয়েই চললো ইয়রের বাড়ি। ওদিকে পিগলেট বেলুন নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছিল – আহা, যদি কোনক্রমে পুহ-র আগে পৌঁছে যেতে পারি তাহলে আমিই প্রথম ইয়রকে হ্যাপি বার্থ ডে বলতে পারবো – ফার্স্ট হওয়ার মজাই আলাদা! ভাবতে ভাবতেই ধপাস। পথে গর্ত ছিলো খেয়াল করে নি। বেচারা পিগলেট তো আছাড় খেলোই, বেলুনটাও ফুস করে ফুটো হয়ে গেলো। গুটলি পাকিয়ে যাওয়া রবারের টুকরোটা নিয়েই ও পৌঁছালো ইয়রের বাড়ি।
- ইয়র, তোমার জন্য একটা বেলুন এনেছিলাম হে!
- বেলুন? মানে ঐ বিশাল ফোলা ফোলা রঙীন বলগুলো? ট্রা লা লা লা! ট্রা লা লা লা! কই? কই? কই?
- ইয়ে মানে... বেলুনটা ফেটে গেছে। আমি রাস্তায় পড়ে গেলাম ইয়র। আর তখনই বেলুনটা ফেটে গেলো।
- ফেটে গেলো? আমার বেলুনটা ফেটে গেলো? আমার জন্মদিনের বেলুনটা??
- হ্যাঁ, ইয়র।
এই বলে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পিগলেট চুপসে যাওয়া রবারের টুকরোটা ইয়রের হাতে তুলে দিয়ে বলে – হ্যাপি বার্থ ডে ইয়র! ঠিক তখনই পুহ এসে ঢোকে।
- এই দেখো ইয়র, আমি তোমার জন্য কি এনেছি। কি সুন্দর শিশি দেখো! আবার তার ওপর হ্যাপি বার্থ ডেও লিখিয়ে এনেছি। পছন্দ নয়?
ইয়রের একহাতে খালি মধুর শিশি, অন্য হাতে চুপসে যাওয়া বেলুন। দুই বন্ধুর দেওয়া বার্থ ডে প্রেজেন্ট।
- আরে, দেখো দেখো! বেলুনের টুকরোটা শিশির মধ্যে ঢোকানো যাচ্ছে!
- বাহ রে! তাই তো! দেখেছো ইয়র, আমি কেমন তোমাকে একটা শিশি এনে দিলাম, যাতে তুমি পছন্দ মত জিনিস এনে রাখবে।
- আর আমার জিনিসটাও দেখো ইয়র, আমিও কেমন তোমাকে একটা প্রেজেন্ট দিলাম যেটা তুমি পুহ-র শিশিটার মধ্যে ভরে রাখতে পারবে।
ঠিকই তো! বেলুনটা যদি না ফাটতো, তাহলে কি সেটা শিশির মধ্যে ঢোকানো যেত! ভারী খুশী হয় ইয়র তার জন্মদিনের উপহারে। সে বারবার বেলুনটা শিশির মধ্যে ঢোকাতে আর বার করতে থাকে। কেমন কাজের শিশি যাতে ইচ্ছেমত জিনিস রাখা যায়! আর কেমন কাজের বেলুন যেটা ইচ্ছেমত শিশির মধ্যে ঢোকানো যায়!

এটাই তাওবাদ। জীবনকে তারই মত স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে মেনে নেওয়া। আগলি ডাকলিং-এর গল্পটা মনে আছে? আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা রাজহাঁস থাকে। সেটাকে শুধু খুঁজে নেওয়ার অপেক্ষা। প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু দুর্বলতা আছে, কিছু ত্রুটি আছে, কিছু না পাওয়া আছে। আবার একটা রাজহাঁসও তো আছে – যেটা আমাদের “Inner Nature”। তাতে বিশ্বাস রাখা। মরীয়া হয়ে কিছু বদলানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতেই পরিবর্তন আসবে – হঠাৎ করে একদিন পুকুরের জলে নিজের ছায়া দেখে চমকে উঠতে হবে – আরে! ‘এইটুকুনি মানুষগুলো এততো বড় কেমন করে হয়?’ তাও জানো না – বলবে পুহ – ‘তালুক-তুলুক-মালুক-মুলুক যত, চেংলি পাহাড়, গুম্ফি আরো কত, সব দেখেছি,’ গান গেয়েছি জোরে, জীবন জুড়ে সুর নিয়েছি ভরে। এবার জিরোই খানিক। যেইদিকে চাই, শুধুই দেখি মানিক। ভুল যা কিছু ছিলো, চৈতি রাতের মাদল নাচে কোথায় উড়ে গেলো! এইভাবেতেই থাকি। খড়-কুটো সব ধুলো-বালি বয়াম ভরে রাখি!

Saturday, July 24, 2010

S আর K

আচ্ছা তা’লে খুলেই বলা যাক। একদিন – যখন কিনা S-এর বেশ রাত আর K-এর বেশ সকাল তখন তাঁরা দুজনে গপ্পো করছিলেন। K কিনা ভারী ছেলেমানুষ – বিস্ময়ের মত খাঁটি অনুভূতি তাঁকেই মানায়। S যাই বলেন, অবাক বিস্ময়ে K প্রশ্ন করেন – হ্যাঁ, তাই নাকি? সে কি রকম? S-ও এই সুযোগে সাত বছরের বালিকাবেলায় ছোটো ভাই-বোনেদের নিজের বাসের টিকিটের সম্ভার বা খেলাঘরের ঐশ্বর্য দেখিয়ে যেমন আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেন, তেমনই সহজতায় K–এর কাছে নিজের গল্পের ঝুলি উজাড় করে দেন। এবং সেই ঝুলি থেকে বেরোয় একটি বিকেল ও তৎসংলগ্ন একটি সিঁড়ি। S-এর বাসার খিড়কি দোরের সেই সিঁড়িতে বসে S তাঁর বিকেলগুলি কাটান। আপনমনে ছবি আঁকেন, রং ভরান, মুছে দেন, আবার আঁকেন। এই সিঁড়ির ধাপেই জমা আছে S-এর যাবতীয় সূর্যোদয়, তাঁর বেলাশেষের অস্তরাগ, তাঁর উঠোনভাঙা বৃষ্টি, তাঁর দুকূলপ্লাবী বসন্ত। সর্বোপরি তাঁর রাত্রি – নিঝুম লোকালয়ে ফুটে ওঠা একটি-দুটি তারা – কদাচিৎ চৈত্রের নির্মেঘ আকাশে বশিষ্টের কাঁধের কাছে জেগে থাকা অরুন্ধতীর আশ্বাস। S-এর একাকী শহর – জ্যোৎস্নাবিলাসিনী!

S-এর সিঁড়ি আর বিকেলের গল্পে K খুব আপ্লুত হয়ে পড়েন। ছেলেমানুষ কিনা! সেদিন গল্প শেষে S-কে তিনি একখণ্ড কবিতা লিখে পাঠান। S আবেগপ্রবণ মানুষ। এমন হঠাৎ খুশীর ভার বইতে তিনি কোনদিনই বিশেষ পটু নন। যদিও K-এর সামনে তাঁর কাব্যপ্রতিভা সাঁঝবাতির পাশে হ্যালোজেনের মতই দৃষ্টিকটু ও উচ্চকিত, তবু আবেগের বশে তিনিও লিখে ফেলেন দু’লাইন। K কিনা জাত কবি। S-এর মনের কথা তাঁর নিজের থেকেও নিপুণ ভাবে প্রকাশ করার সহজাত ক্ষমতা K-এর। তাই আরো ক’লাইন যোগ করে তিনি কবিতাটি সম্পূর্ণ করেন। সেটি কেমন হলো? দেখে নেওয়া যাক –

K: বিকেল, তোকে এই সিঁড়িতে রাখি
এইখানে হোক গল্প গল্প খেলা
বাসায় যখন ফিরবে দোয়েল পাখি
ডানায় মেখে অল্প অল্প বেলা

S: বিকেল, আমার রূপকথা সন্ধান
বৃষ্টিশেষের হলুদ আলোয় ঘেরা
সিঁড়ির বাঁকে থমকে গেছে দিন
তোরই কাছে গল্প শেষে ফেরা

K: যখন আমায় খোলা আকাশ ডাকে
জানলা বেয়ে ডাকে গাছের সারি
রূপকথারা চুপটি করেই থাকে
তাদের সাড়া না দিয়ে কি পারি?

K: বিকেল, আমার নেই তো ওঠানামা
সিঁড়ির কাছে, অনেক কাজের ঝোঁকে
আমার শুধু একটুখানি থামা
একটুখানি জড়িয়ে নেওয়া তোকে

Friday, July 23, 2010

অস্থিরতা ভাত চেয়েছে

অস্থিরতা একটা পাগল
খুঁজছে আমায় সকাল-সাঁঝে
যেইখানে যাই, জটপড়া চুল
নোংরা জামা, সামনে আসে -
চাইছে খেতে, আমায় নিতে
ঘর চেনে না, ভাঙছে আগল!
ভাত দিই নি, তবুও দেখো
কপাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে!
জ্বরের মত আসছে কাছে
কপাল জুড়ে, শরীর জুড়ে
জরীপ করে আঠালো চোখ -
অতর্কিতে কামড় বসায়
ঘাড়ের কাছে, হ্যাঁচকা টানে
ফেলছে এনে শানের ওপর -
কাঁটা বেছে খায় তৃপ্ত বেড়াল!
অস্থিরতা ভাত চেয়েছে -
সাপটে ধরে বুকের মাঝে
তাকিয়ে আছে অষ্টপ্রহর -
দেয় না হতে চোখের আড়াল!

Tuesday, July 13, 2010

কাটুম-কুটুম

একটা থাই রেস্তোরাঁ থেকে বেরোচ্ছি – দেখি সদর দরজার পাশেই ক’টা বেলফুলের গাছ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাছের দিকে নিচু হলাম। একটুও বদলায় নি তো! একদম একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোটোবেলা! গ্রীষ্মকালের লোডশেডিং-এর সন্ধ্যে। আমি আর ভাই ল্যাম্পের আলোয় অঙ্ক কষছি। বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে তারা দেখছে। মা গুনগুন করছে – যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকাবনে... সুর লাগছে না। তবু যা গাইছে সেটাই যেন সুর হয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের দেড়তলার ছাদ থেকে ম ম করে ভেসে আসছে বেলফুলের গন্ধ!

টবের নিচে কিছু বেলফুল ঝরে ছিল। সেগুলো কুড়িয়ে নিলাম। বার বার ঘ্রাণ নিচ্ছি – আর ম্যাজিকের মত, আলিবাবার গুহার মত, প্রফেসর শঙ্কুর বোগদাদের বাক্সের মত আমার সামনে পর্দার পর পর্দা খুলে যাচ্ছে – একের পর এক প্রিয় মুখের সারি, প্রিয় দৃশ্যের অভিনয় – আমাদের গঙ্গাতীরের নরম হলুদ আলোর ফিল্টারে পরিশ্রুত! ব্লুমিংটনের বিকেলে তখন চাপ চাপ কালো মেঘের ফাঁকে কমলা সূর্যের ঝলক। হয়তো একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। পৃথিবীকে এতো সুন্দরও হতে হয়! শিউরে উঠি!

খেলাঘরের ছড়া

সেদিন তাদের খেলাঘরে সবই ছিল
কাটুম-কুটুম বুদ্ধু-ভুতুম ভালুকছানা
এমনকি এক নীলনয়না ঝাঁকড়া চুলও!

সেদিন তাদের খেলাঘরে দারুন ঘটা
পাতার লুচি, বেগুনভাজা পাথর কুচির
নিমন্ত্রণের নীলচে খামও তৈরী ছিল...


কিন্তু তাদের পুতুলখেলায় কেউ আসে নি।
কাগজফুলের শিকল গাঁথা সমস্তদিন...
অলক্ষুণে বৃষ্টিতে সব পণ্ড হল!

Sunday, July 11, 2010

স্বপ্নসম্ভব

আজ সকালে আমি ট্রেনে চড়ে যাচ্ছিলাম। দূরপাল্লার ট্রেন। নীল রঙের। ফ্যাকাসে হলুদ গমক্ষেতের মধ্যে দিয়ে, রুখু রুখু কালো মাটির মধ্যে দিয়ে, লাল কাঁকরে ভরা ঝুরঝুরে পথের মধ্যে দিয়ে – ট্রেনটা ছুটছে ছুটছে ছুটছে। খোলা জানলা দিয়ে গরম হাওয়া আর পাটকিলে ধুলো আমার মুখে এসে লাগছে। আমার রোমকূপগুলো গোগ্রাসে ধুলো খাচ্ছে। আমার চুল উড়ছে। আমি ক্রমশই ধূসর হয়ে যাচ্ছি। আর ট্রেনটা ছুটে চলেছে। শুকিয়ে আসা নদীর খাত পার হয়ে, রেলের ব্রিজে ঝমঝম শব্দ তুলে, পাকা খরমুজার গন্ধে বিভোর হয়ে টেনটা শুধুই ছুটছে।

তারপর ওরা বললো এখানেই নামতে হবে। আমি জায়গাটা চিনি না। কেমন পুরোনো পুরোনো লালচে স্টেশন। চকচকে মেরুনরঙের জরিওলা শাড়ী পরা এক বুড়ী চুবড়ী ভরে লিচু বিক্রী করছিল। তার কালো রোগা হাতে রুপোর বালা। কোঁচকানো চামড়ায় উল্কিতে কালীয়দমনের কৃষ্ণ বাঁশী বাজাচ্ছে। আমি স্টেশন থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা বুড়ো মত টাঙ্গাওয়ালা – নীল-সবুজ চৌখুপ্পি লুঙ্গী পরা – আমায় বললো কোথায় যাবে? আমার তো মনে নেই কোথায় যেতে হবে। স্টেশনের ধারে একটা লাড্ডু-জিলিপির দোকান। কমলা রঙের জিলিপির ঝুড়ির ওপর একটা বিশাল কালো মাছি বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। একটা বটগাছ – তার গায়ে অনেক সিঁদুর লেপা। আমি ওদিকেই চললাম।

রাস্তাগুলো সরু সরু। দুই দিকে উঁচু উঁচু বাড়ি। মাঝে কোন ফাঁক নেই। আলো ঢোকে না একটুও। তবু গলিপথ কেমন আলো আলো। চৌকো পাথর সাজানো পথ। ফ্যাকাসে হলুদ পাথর। তার খাঁজে খাঁজে অনেক ধুলো। সেই ধুলোর সাথে জল মিশে শিরা-উপশিরা ছড়িয়েছে। আমি ওই শিরাওলা পথ ধরে এগিয়ে চলি – যেদিকে জল বয়েছে। আমার দুপাশে ভেজা ভেজা বাড়িগুলোর জাফরির ফাঁকে সময় বাঁধা আছে। গলির শেষে যেখানে সিঁড়ি নেমেছে ধাপে ধাপে সেখানে একটা পাথরের কুয়ো। কুয়োর ধারে একটা মেয়ে। লালহলুদ ঘাগরা পরা। তার তেলহীন চুল বাদামী রঙের। সরু হাতে লাল প্লাস্টিকের চুড়ি সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। মেয়েটাকে আমি চিনি না। তবু মনে হয় দেখেছি কোথাও। থমথমে দুপুরে তখন ‘কুব’ ‘কুব’ করে একটা পাখী ডাকছিল। কেউ কোত্থাও নেই। এই হলুদ ধুলো ধুলো শহরে খালি আমি আর ওই মেয়েটা। যার চোখদুটো আয়নার মত। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরি। তারপর হাঁটতে থাকি ওর সাথে এই অচেনা শহরের গলিপথ ধরে – যেখানে রোদ ঢোকে না, অথচ কেমন আলো আলো।

এভাবেই

এভাবেই ঝরে যায় টুপটাপ
জলকণা, মেঘে আধোলীন।
এভাবেই তারাদের কিংখাব -
আঁধারেও ভীষন রঙীন।

এভাবেই গল্পেরা নিষ্পাপ -
শীতঘুম গেলো বালুচরে।
এভাবেই হৃদয়ের উত্তাপ
শোধে ঋণ, বিষাদে ও জ্বরে।

এভাবেই শুষে নিই জলছাপ
নিভৃতি এভাবেই এলো -
এভাবেই সোনা হয় চুপচাপ
যাবতীয় ভ্রমণের ধুলো।

Wednesday, July 7, 2010

আমি ও তিনি


- কেমন আছিস শুনি?
- কেমন আবার! রঙে-রসে জাল বুনি।
- রঙের গুমোর বড়!
- গুমোর তো নেই! যা আছে সব কাড়ো।
- কাড়লে কোথায় যাবি?
- দেখবো খুঁজে – হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নলোকের চাবি।
- অতই সহজ পাওয়া?
- নাই বা পেলাম। থাকবে ছুঁয়ে পাগল প্রভাত হাওয়া।
- পথ হারালে পরে?
- ভয় কি তাতে! হারাই বলেই পাই যে নতুন করে!
- হাত ধরবি কার?
- খুঁজবো তোকেই। পরাণসখা, বন্ধু রে আমার!


************************************************
[জয়কে টুকলেই কি গোঁসাই হওয়া যায় মামনি?]