সেটা সাতানব্বই সাল। উচ্চমাধ্যমিকের বছর। আমার বাবা-মা ছিয়াত্তর সাল থেকে শিমূলতলা যেতে শুরু করেছিলেন। জাঁদরেল কোন ট্রিপ না থাকলে প্রতি বছরের পুজোর ছুটি আমাদের শিমূলতলাতে কাটত। সেবারেও ব্যতিক্রম নয়। মধুরাশ্রমে মোহন মালির আতিথ্যে আছি। বাবার অ্যাকাডেমিক সিনিয়র কমলজ্যেঠু আর তাঁর স্ত্রী বীথি জ্যেঠিমাও সেবার শিমূলতলাতে একই বাড়ির সামনের অংশে। লক্ষ্মীপুজোর দিন দিদার বাড়িতে ফোন করতে দিদা বলল, ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে দিদানের পরীক্ষার চিঠি এসেছে। সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা। তোমরা এক্ষুনি ফিরে এসো। মফস্বলের মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ব্রেবোর্ণে পড়তে গিয়ে ইংরিজি বলতে না পারার জন্য কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিত হয়েছিলাম। পরীক্ষার পরের ছুটিটায় তাই ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্পোকেন ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম ইংরিজি শেখার আশায়। শিক্ষা বিশেষ হয়েছিল বলতে পারিনা, উপরন্তু পরীক্ষার চোটে পুজোর ছুটিটাও তারা বানচাল করে দিল। বাবা-মাও শিমূলতলা ছেড়ে ছুটির মাঝে বৈদ্যবাটি গিয়ে থাকতে হবে এই ভাবনায় নিরাশ। শুধু ভাই খুব খুশী। শিমূলতলার ইলেকট্রিক লাইট বর্জিত সন্ধ্যেগুলো সে খুব অপছন্দ করত। বাড়ি ফেরার সম্ভাবনায় তার আনন্দ বাঁধ মানে না। তবে বাবা-মা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। তারা ঠিক করল, কমলজ্যেঠুর ঘরে মালপত্র রেখে আমাদের দুই ভাই-বোনকে দিদার বাড়ি রেখে আবার ফিরে আসবে শিমূলতলায়। এই ব্যবস্থা যাকে বলে উইন-উইন সিচুয়েশন। দিদা খুশী, মামা-মামীমা খুশি, আমরা খুশী, বাবা-মাও খুশী। সবাই মিলে একসাথে খুশী হওয়ার মত ঘটনা শুধু সেকালে কেন, কোনকালেই খুব একটা ঘটে না। আমরা অমৃতসর মেল ধরে বিনা রিজার্ভেশনে চলে এলাম। দিদার বাড়ি এক রাত থেকে মা-বাবা আবার ফিরবে শিমূলতলায়।
মায়ের হঠাৎ মনে হল দুদিনের জন্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ঘুরে গেলে কেমন হয়! অনেক নাম শুনেছে জায়গাটার। যাওয়া হয়নি। বাবা তখনই টাইমটেবলে দেখে নিল হাওড়া থেকে ছাড়ে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। তাতেই যাওয়া হবে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। সমস্যা একটাই। ট্রেন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ পৌঁছবে রাত দুটোয়। অত রাতে একটা অচেনা জায়গায় থাকবে কোথায়! সে সমস্যার সমাধানও হয়ে গেল পাঁচ মিনিটেই। বাবার এক ছাত্রের সম্পর্কিত দাদা বোকারোতে থাকে। সে নাকি বারবার বলে তার দাদার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। উপরন্তু সেই দাদার বাবা নাকি আমাদের দাদুর প্রাণের বন্ধু ছিলেন। বাবা স্থির করল সেই রাতে বোকারোতে থেকে পরের দিন সকালে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যাবে। মা এই ব্যবস্থাপনায় খুবই সন্দিগ্ধ। কিন্তু বাবা ততক্ষণে দাদুর সাথে ছাত্রের দাদার বাবার প্রাণের বন্ধুত্ব নিয়ে দুর্দান্ত সব নজির পেশ করে ফেলেছে। মা আর আপত্তি করল না।
পরদিন শেষ সন্ধ্যায় বোকারোতে গিয়ে ছাত্রের দাদার ঠিকানা খুঁজে বার করতে করতেই হেমন্তের শহর রাতের চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি। দাদাটি কোলাপসিবল গেটের ওপার থেকে জানিয়ে দিলেন তাঁর বাবা শুয়ে পড়েছেন। ভাই-এর মাস্টারমশাইয়ের পরিচয়েও বিশেষ লাভ হল না। মা লজ্জায়, অপমানে একসা। বাবা বলল, চিন্তার কিছু নেই, স্টেশনের ওয়েটিং রুমে রাত কাটিয়ে দেব। অন্য কেউ হলে অচেনা মানুষের বাড়ি রাত কাটানোর এমন অসম্ভব প্ল্যান করতই না। কিন্তু আমার বাবা অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। নিজেরও অচেনা লোক নেমন্তন্ন করে আনতে জুড়ি নেই। আর মাও মাঝরাতে অতিথি এলে আধঘণ্টায় ফ্রায়েড রাইস-আলুর দম রেঁধে টেবিল সাজিয়ে দিতে পারে। অথচ আশ্চর্যের কথা, এই ভদ্রলোকটি একেবারেই গল্প করতে পারেন না। মহিলাটিরও মিশুকে বলে নাম নেই।
বোকারোর ওয়েটিং রুমে একখানি পুরোনো দিনের বড় টেবিল। লোকজন বিশেষ নেই। ঠিক হল, প্রথম রাতে মা ঘুমোবে, শেষ রাতে বাবা। তারপর ভোরের প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। ঘুম তো নয়, ঐ টেবিলের ওপরেই শুয়ে নেওয়া একটু। মাঝরাতে জনা তিনেক পাগড়ী বাঁধা লোক এসে ওয়েটিং রুম দেখে গেল। মা তখন শুয়ে আছে। বাবা রয়েছে পাহারায়। এছাড়া বলার মত কিছু ঘটেনি সে রাত্রে।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নাকি অপূর্ব জায়গা। আমি যাই নি। কাজেই বর্ণনা করতে পারব না। ব্রিটিশ আমলের বাংলো আছে অনেক। অনেক বাঙালী সেলিব্রিটিরাও বাড়ি রেখেছেন ওখানে। ওরা যে কটেজ ভাড়া নিল সেও অদ্ভুত সুন্দর। একটি ঘরে নীল রঙের কাঁচের সিলিং। সারাদিন মায়াময় নীলাভ আলোতে ভরে থাকে সেই ঘর। কিন্তু এমন একখানি সরল নির্ঝঙ্ঝাট বাড়িতে থেকে মা-বাবার সুখ হল না। পরের দিন সকালে তারা শহর ঘুরতে বেরল। শহর ঠিক বলা চলে না। ছোটনাগপুরের নেশা ধরানো প্রকৃতি, শাল-সেগুন-ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। আর মাঝে মাঝেই সুন্দর সুন্দর বাংলো বাড়ি। একটি বাড়ির নামের ফলক পড়ে জানা গেল সে বাড়ি বুদ্ধদেব গুহের। বাড়িতে কেউ নেই। বাগানের গাছ গন্ধরাজ লেবুর ভারে নুয়ে পড়ছে। "আতার পায়েস" গল্প পড়েই জানি এসবক্ষেত্রে গুণীজন আপনপর ভেদ করেন না। বাবা কিছু লেবু পকেটে ভরল। সেই রাস্তা ধরেই ফেরার পথে দেখে এক ভদ্রলোক তাঁর বাংলোর গেটে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে এসে আলাপ করলেন। খুব করে ধরলেন তাঁর বাড়িতে গিয়ে চা খাওয়ার জন্য। মা কি ভাবছিল জানি না, বাবা তো আতিথ্য দিতে ও নিতে সদা তৎপর। সে বাড়িও দারুন সুন্দর। এনারা কলকাতাতে থাকেন। ম্যাকলাস্কিগঞ্জে নিজেদেরই বাড়ি। ছুটি কাটাতে এসেছেন। রান্নাঘর থেকে লুচি ভাজার গন্ধ আসছে। কিছু পরে একটি মেয়ে এসে চায়ের ট্রে নিয়ে দাঁড়াল। মুখটি নিচু করা। ভদ্রলোক বললেন, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা। মা ভাবছে, চেনা চেনা লাগে মুখটা, কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। তখন মেয়েটি ঢিপ করে একটি পেন্নাম ঠুকে নিজের পরিচয় দেয়, দিদি আমি আপনার ছাত্রী, আপনি পড়িয়েছেন আমাদের। ততক্ষণে মায়ের মনে পড়ে, আরে তাই তো, এই মেয়ে তো ছাত্রী ছিল। বিয়ে হয়েছে অনেকদিন, চেহারা ভারী হয়েছে, তবু এতো সেই। আস্তে আস্তে আরো দুই মেয়ে বেরিয়ে এসে প্রণাম করে। তিনবোনেই মায়ের ছাত্রী। সবচেয়ে ছোট বোনটি এখনও স্কুলে পড়ে। বাবার ছাত্রের দাদার ভরসায় বেরিয়ে মায়ের ছাত্রীর দিদির বাড়ি জলযোগ হল অবশেষে। বুদ্ধদেব গুহর বাড়ির গন্ধরাজ লেবু বিতরণ হয় তাদের মধ্যে।
তারপর নিজেদের কটেজে ফিরছে, রাস্তায় পড়ে এক বিশাল বাগান। এক মালি সেই বাগানে কাজ করছে। কাছাকাছি কোন বাড়ি দেখা যায় না। মালি বলে, এই বাগান ধরে হেঁটে যান, শেষে বাড়ি পাবেন। - কার বাড়ি এটা? মালিক কোথায় থাকে? জানা গেল, মালিক বাড়িতেই আছেন। বাড়িতে গেলেই পাওয়া যাবে তাকে। ততক্ষণে এই বিশাল বাগান আর বাগান শেষের প্রাসাদপম বাংলোটাকে না দেখেই পছন্দ হয়ে গেছে মা-বাবার। তারা ভাবছে, আহা এখানে যদি থাকা যায়! বাড়ির মালিক এক স্থানীয় বৃদ্ধ। বাংলো ভাড়া পাওয়া যাবে জানা গেল। বাবা-মা জানিয়ে দিল সেদিন বিকেলেই চলে আসবে তারা।
মা বলে সেদিন ঐ বাংলোতে যখন ঢুকলো তখন সন্ধ্যে হব হব করছে। বসার ঘরের দরজা খুলতেই একটা চামচিকে উড়ে পালালো। ব্রিটিশ আমলের ফায়ারপ্লেস, বেলজিয়ান গ্লাসের ধুলি ধূসরিত আয়না, তার সামনে দাঁড়ালেই মনে হয় এখুনি আরেকটা মুখ উঁকি মারবে ঘাড়ের পাশ থেকে। একটা অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ। রাতের জন্য মালি মুর্গী রান্না করে দিল। অতিথি দুজন, মালি, মালির বৌ, তিন ছেলে সবাই ভাগ করে খেল। তারপর সেই বিশাল বাড়ি, যেখানে শোয়ার ঘর থেকে বাথরুমে পৌঁছতেই মানুষ হারিয়ে যেতে পারে, সেখানে দুটি মাত্র প্রাণী। মালিক বাইরের একটি ঘরে।
পরের দিন ভোরে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটল যার বর্ণনা আমরা অনেকবার শুনেছি। দিনের আলো ফুটব ফুটব করছে, বাবা তখনও ঘুমে, মা ভাবল বাথরুম সেরে ফেলা যাক। বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় দেখে পুরোনো দিনের দরজা গিয়েছে আটকে। খোলা যাচ্ছে না কিছুতেই। বাবা যে ঘরে শুয়েছে তা বহু দূরে। ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ পৌঁছনোর কোন আশা নেই। মা যা করল তা আজকের পায়ের ব্যাথায় কাতর সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে অপারগ মহিলাকে দেখলে অবিশ্বাস্য লাগবে। বাথরুমে একখানি জানলা ছিল বাগানের দিকে। বাথটবের ওপর উঠলে তার নাগাল পাওয়া যায়। মা সেই জানলা দিয়ে অর্ধেকটা শরীর বার করে কৈ হ্যায়, কৈ হ্যায় বলে চিৎকার শুরু করল। বাথরুমে যে গামছাখানা নিয়ে গেছিল তা দিয়ে নাকি সিগনাল দেওয়ারও চেষ্টা করেছে অনেক। বেশ কিছুক্ষণ হাঁকডাকের পর মালির কানে আওয়াজ পৌঁছলো। সে বাগান দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। মায়ের গলা শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে উদ্ধার করল। বাবা তখনও ঘুমন্ত। পরে নেহাতই স্বাভাবিক স্বরে বলল, না জানিয়ে বাথরুমে যাওয়া মোটেই উচিত কাজ হয়নি।
বাকি দিনটা কাটলো নিরুপদ্রবেই। গোল বাঁধল পরের দিন দুপুরে বাড়ি ছাড়ার সময়। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ থেকে বিকেল পাঁচটার ট্রেনে আসানসোল এবং সেখান থেকে শিমূলতলা - এই হল প্ল্যান। হিসেবমত দুটো নাগাদ বেরোলেই যথেষ্ট। মালিকের সাথে বচসা বাঁধল ঠিক তখনই। বাবার হিসেব মত পরশুদিন বিকেল পাঁচটায় ঘরে ঢোকা হয়েছে, বেরোনো হচ্ছে দুপুর দুটোয়, অর্থাৎ এরা থেকেছে দুদিন। মালিক বলছে, তা হবে না, আজকের দিনটাকেও হিসেবে ঢুকিয়ে মোট তিনদিনের ভাড়া দিতে হবে। ঐ পরিস্থিতিতে আমি থাকলে যা করতাম মা'ও সেটাই করার চেষ্টা করল - যা চাইছে দিয়ে দাও, ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু বাবা অনড়। দুদিন থেকে তিনদিনের ভাড়া কিছুতেই দেবে না। মালিক রেগেমেগে বলল, তিনদিনের ভাড়া না নিয়ে আমি কিছুতেই তোমাদের ছাড়ব না। এই বলে বৈঠকখানার দরজায় শিকল টেনে লোক ডাকতে বেরিয়ে গেল। মা ভয় পাচ্ছে কি করে এদের হাত থেকে নিস্তার পাবে। বাবাও খুঁজছে পালানোর রাস্তা, কিন্তু জেদে অটল। এমন অবস্থায় মালি উঁকি দিল জানলা দিয়ে। মালির বোধহয় আগে থেকেই রাগ ছিল মালিকের ওপর। সে বলল, মালিকটা খুব বদ লোক। চিন্তা নেই, আমি তোমাদের শেকল খুলে দিচ্ছি। তারপর টেবিলের ওপর দুদিনের ভাড়ার টাকা রেখে নিজেদের ব্যাগ নিয়ে মালির দেখানো পথ দিয়ে দৌড় স্টেশনের দিকে।
মেয়ের মত মায়েরও বিপদের সময়ে ভয়ংকর সব গল্পের বইয়ের প্লট মাথায় আসে। মা ভাবছে বাড়ি ফিরে এসে ওদের দেখতে না পেয়ে মালিক হয়ত চেলা-চামুণ্ডা দিয়ে ধাওয়া করবে স্টেশনেই। কতক্ষণে ট্রেন আসবে তার জন্য মিনিট গুনছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। এই বৃষ্টিই কি ওদের বাঁচিয়ে দেবে শেষ পর্যন্ত? নাকি নিয়ে আসবে বাড়তি বিড়ম্বনা? একসময় দেখা গেল, ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে স্টেশনে। কিন্তু সুরাহা হল কি? রিজার্ভ কামরা তো বটেই, এমনকি জেনারেল কামরাগুলোর দরজাও যে বৃষ্টির জন্য ভেতর থেকে বন্ধ!!
এমন অবস্থায় এই দম্পতি আগেও পড়েছে, ভবিষ্যতেও পড়বে আবার। কখনও তাদের সবাইকে, কখনও বা শুধু একজনকে ফেলে রেখে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম করবে। ট্রেনের কামরায় মা'টি ছোট দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন অপেক্ষায়। বাবা'টি কি স্টেশনেই রয়ে গেল? পরের ট্রেনে আসবে? নাকি উঠেছে এই ট্রেনেই , অন্য কোন কামরায়? জানার কোন উপায় নেই যতক্ষণ না এই নবঘনজলধরশ্যাম উপত্যকা পেরিয়ে ট্রেন পৌঁছয় পরের স্টেশনে। ততক্ষণ মা আর ছেলেমেয়েদুটি ঘন হয়ে বসে, নিজেদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে।
No comments:
Post a Comment