About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Thursday, January 4, 2018

কুম্ভলগড়ের সাধু

 ১৯৯২ এর পুজোর ছুটিতে রাজস্থান যাওয়া হল। পঞ্চমীর দিন স্কুল ছুটি হয়ে বেরোনো। ফেরা ভাইফোঁটা কাটিয়ে স্কুল খোলার আগের দিন। ইন্ডিয়ান রেলে সার্কুলার টিকিট বলে একরকম টিকিট পাওয়া যায়। আগে থেকে কোথায় কোথায় থামা হবে প্ল্যান করে রেলওয়েকে জমা দিতে হয়। শুরু এবং শেষের স্টেশন এক হতে হবে - এই হল শর্ত । একমাস বা চল্লিশ দিন - এইরকম কিছু একটা সময়ের জন্য ভ্যালিড থাকে এই টিকিট। একসময় ইউরোপে ঘোরাঘুরির জন্য ইউরোরেলের খোঁজখবর নিয়েছিলাম। সেখানেও আছে এমন ব্যবস্থা।

আমি তখন ক্লাস এইট, ভাইয়ের ফোর। কোথায় কোথায় যাওয়া হবে তার একটা মোটামুটি ধারনা ছিল বাবার। তবে কোন শহরে কতদিন থাকা হবে, কোন হোটেলে সেসব জানা ছিল না। যখন যেখানে যাওয়া হচ্ছিল হোটেল খুঁজে নেওয়া হচ্ছিল। আর সেই সাথে স্টেশনে গিয়ে পরের গন্তব্যের জন্য রিজার্ভেশন। একান্তই রিজার্ভেশন না পাওয়া গেলে জেনারেল কামরা ভরসা। এইভাবে দিল্লি-ভরতপুর-জয়পুর-আজমের-চিতোরগড় পেরিয়ে আমরা এলাম উদয়্পুরে। পরের গন্তব্য মাউন্ট আবু। সেখানে রয়েছে শ্বেতপাথরের অপরূপ কারুকার্যমন্ডিত দিলওয়রা জৈন মন্দির। উদয়্পুরে এসে স্থানীয় মানুষের থেকে জানা গেল, নাকি আগেই পড়া ছিল সে আর এখন মনে নেই; তবে রণকপুর নামে একটি নতুন জায়্গা ঢুকে গেল ভ্রমণসূচিতে। সেখানেও আছে একটি জৈন মন্দির, আকারে দিলওয়ারার চেয়েও বড়। পাশেই কুম্ভলগড় ন্যাশনাল ফরেস্ট। রাণা কুম্ভের নামে আমরাও চনমন করে উঠলাম। তখনও রণকপুর ট্যুরিস্টস্পট হিসেবে বিখ্যাত হয়নি। মূলত জৈন তীর্থযাত্রীরা যেতেন। সাধারণ ট্যুরিস্টদের জন্য উদয়্পুর থেকে সকালে একটা বাস ছিল। সেই বাসই বিকেলের দিকে যাত্রীদের ফেরত আনত। আমরা যখ্ন রণকপুর যাচ্ছি তখনও ঠিক ছিল সকালে গিয়ে বিকেলে ফেরত আসা হবে। কিন্তু বেড়ানোর ব্যাপারে আমার বাবা-মা চরম আনপ্রেডিক্টেবল। রণকপুরে নেমেই অবিন্যস্ত সবুজের মাঝে শ্বেতপাথরের অপূর্ব মন্দির দেখে বাবা বলে দিল, এখানে তো কদিন না থাকলেই নয়। মা একটু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে - এই জায়গায় কোন ট্যুরিস্ট রাতে থাকে না, থাকার জায়গা আদৌ আছে কিনা তাও জানা নেই, সাথে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে - থাকবো বললেই থাকা যায় নাকি! কিন্তু এও জানে মা, থাকার ইচ্ছে যখন হয়েছে যেভাবেই হোক বাবা থাকার ব্যবস্থা করবেই। সত্যি করেই তখন ওখানে জৈন তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি ধর্মশালা ছাড়া আর কোন থাকার জায়গা ছিলনা। সেখানেই ব্যবস্থা হল। সমস্যা বাধল খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। জৈনরা সূর্যাস্তের পর অন্নগ্রহণ করেন না। দুপুরবেলা ধর্মশালার খাবার ঘরে গাট্টে কি সবজি আর চাউল মিলল বটে, কিন্তু রাতে কি ব্যবস্থা হবে কেউ জানে না। যদ্দুর মনে পড়ে সাথে থাকা শুকনো খাবার দিয়ে সে রাতের বন্দোবস্ত হয়েছিল। সূর্য ডোবার পর পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। ধর্মশালায় আমরা ছাড়া আরো গোটাদুয়েক অতিথি আছে। তারাও যে যার ঘরে।
পরদিন ভোর হতে আমরা আবার মন্দিরে এলাম। সত্যিই আর সব জায়গার চেয়ে এ জায়গা আলাদা। চিতোরের দুর্গ যতই সম্ভ্রম উদ্রেককারী হোক না কেন, অত মানুষের ভীড়ে রাজকাহিনীতে পড়া "ম্যায় ভুখা হুঁ" দেবীকে থোড়াই অনুভব করা যায়! রণকপুরের এই মন্দিরের কথা কোন বইতে পড়িনি। অথচ কুম্ভলগড়ের অরণ্যের মাঝে এই বিশাল মর্মর সৌধ দেখে গায়েব-গায়েবীর সূর্যমন্দিরের গল্প মনে আসে। সকালটা মন্দিরচত্ত্বরে হেসেখেলে কাটে। মন্দিরের সামনেই বিশাল গাছে অজস্র বাঁদর কিচমিচ করছে। এদিকে যতই বেলা বাড়ে গাট্টে কি সবজির কথা ভেবে মন দমে যায়। আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল কুম্ভলগড় ফরেস্টে আরটিডিসির একটা হোটেল আছে। সেখানে খাবার মিলতে পারে। জায়গাটা বেশ দূরে। বাসে করে সেখানে পৌঁছানো গেল। সেখানেও কোনো ট্যুরিস্ট নেই। আমাদের দেখে তারা রাঁধতে বসল। নিরামিশ স্টাফড আলু আমরা চমৎকার খেলাম। মায়ের আলুটাই পচা পড়ল। তবু বেসনের গোলা যে খেতে হল না এতেই খুশি। বিকেলে বাবা বলল রাতের খাবার আনতে একাই শহর যাবে। আবারও বাসের রাস্তা। মা আমাদের নিয়ে রইল ধর্মশালাতে। এই অঞ্চলের বাসিন্দারাও মূলত জৈন হওয়াতে রাতের খাবার হোটেল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এক দোকানীকে অনেক অনুরোধ করায় সে রুটি আর একটা সবজি বানিয়ে দিতে রাজি হল। কিন্তু রান্না করতে তার এমনই দেরী হল যে শেষ বাসটিও গেল ছেড়ে। ধর্মশালায় আমরা বাবার অপেক্ষা করছি। ওদিকে বাবার ফেরার উপায় বন্ধ। যদি ফিরতে না পারত সে রাত কিভাবে কাটত জানা নেই, কারন ভাগ্যক্রমে একটি জিপ পাওয়া গেল যেটা মন্দিরের দিকে আসছিল। সেই ড্রাইভার বাবাকে লিফট দিতে রাজি হল। এমনকি কোন পয়সাও নিল না। সাধে কি বলি, ভারতবর্ষকে যেটুকু জানি তা বাবা-মার সাথে ঘুরে বেড়ানোর কল্যাণে!
অন্য কেউ হলে হয়ত ভাবতো, একদিন তো থাকা হল, এবার ফেরা যাক। বাবার মধ্যে তেমন কোন লক্ষণ নেই। পরের দিন ভোরে বেড়াতে বেরিয়ে একটা লম্বা ময়ূরের পালক নিয়ে ঘরে ফিরল। কিছু দূর গেলে নাকি এক সাধুবাবার আশ্রম আছে। বাবা সেখানে গিয়ে ভাব জমিয়েছে। আশ্রমের সীমানায় ছড়ানো-ছেটানো ময়ূরের পালক। এক অজগর সাপ ময়ূর মেরে খেয়ে নিয়েছে। সেই পালক বাবার হাতে। ময়ূর সাপ খায় জানতাম। উল্টোটা প্রথম শুনলাম। আমরাও গেলাম সাধুবাবার ডেরায়। সাধুজীর চেলা আমাদের উটের দুধের ঘন চা খাওয়ালেন। বাবা বলল, এই জায়গা তো খুবই সুন্দর, থাকতে বড়ই ভালো লাগছে, কিন্তু ছেলেমেয়েদের কি খাওয়াবো তাই নিয়ে অসুবিধেয় পড়েছি। সাধুজী বললেন, কৈ বাত নেহি। বিকেলে চলে এসো আমার আশ্রমে তোমার ধরমপত্নীকে নিয়ে। আমার রসুইতে খানা পাকিয়ে নাও। আমিও তোমার হাতে খাবো। অন্য কেউ হলে কি করত জানি না, বাবার মনে হল খাদ্যসমস্যার এর চেয়ে কার্যকরী সমাধান আর হতেই পারেনা। সাধুকে কুড়ি টাকা দিয়ে বাজার আনাতে বলে আমরা ধর্মশালায় ফিরে এলাম। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের ঘুমোতে বলা হল। আমি আর ভাই ঘরে রইলাম। বাবা-মা সাধুবাবার আশ্রমে গেল রাতের খাবার বানাতে।
এর পরে যা হল তা বর্ণনা করতে কিঞ্চিৎ ক্রসকাটিং টেকনিকের সাহায্য নেওয়া বাঞ্ছনীয়। একদিকে জৈন ধর্মশালার একটি ঘরে দুই ঘুমন্ত নাবালক-নাবালিকা। ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। অন্যদিকে অজ্ঞাতপরিচয় সাধুবাবার আশ্রমে বাঙালী দম্পতির রন্ধনপ্রচেষ্টা। প্রচেষ্টা শুরু হতে অবশ্য দেরী হল কিছু। বাঙালী বাবুর ধরমপত্নী এসে রাঁধবেন বলে সাধুজীর চেলা ছুটি নিয়ে গ্রামে যাবে। তার আগে কটা রুটি বানাবে সে। অতএব উনুন তার দখলে। অতিথিদের চায়ের জোগান দিয়ে গেছে অবশ্য। বাবার গল্প করার প্রিয় বিষয় তার বাগান। সেই বাগানের পাতিলেবু বাবা রাজস্থানেও নিয়ে এসেছে। একথা জানা মাত্র সাধুবাবার ইচ্ছে হল পাতিলেবু খাওয়ার। বাবা অমনি "এখুনি নিয়ে আসি" বলে ধর্মশালায়। মা একা সেই অজগরে ময়ূর খাওয়া আশ্রমে। ছেলে-মেয়ে দুটি তখনও ঘুমে। তাদের ঘুম না ভাঙিয়েই বাবা ফিরে আসে। তারপর চেলার রুটি বানানো শেষ হতে মা ঢুকেছে রান্নাঘরে কাঠের জালে রান্না করতে। বাবা বাইরে গল্প করছে সাধুজীর সাথে। উনুনে কাঠ গুঁজে আঁচ আনতেই বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে। এদিকে নাবালিকাটির ঘুম ভেঙেছে জানলায় একটি টোকায়। জানলা খুলে দেখে একটি লোক কড়ে আঙুল দেখাচ্ছে। বাথরুমে যেতে চায় সম্ভবত। কোন কথাবার্তায় না গিয়ে লোকটির মুখের ওপর জানলা বন্ধ করে সে বসে থাকে মা-বাবার ফেরার অপেক্ষায়। ওদিকে মা'টি তখন কুটনো কেটে আলু-টমেটো-ধনেপাতার তরকারী বসিয়ে দিয়েছে। তরকারী হলে ভাত চাপবে। তারপর বাসন মেজে ঘরে ফিরতে হবে। একখানি টিমটিমে কুপি জ্বলছে। দেওয়ালভরা ভুতূড়ে সব ছায়া। একবার পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকিয়েই আঁতকে চিৎকার করে ওঠে। মিশমিশে অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে দুটো কালো চোখ। সাধুবাবা বাইরে থেকে বলেন, ভয় পেয়ো না বেটি, ও আমার পোষা বনবেড়াল। জৈন ধর্মশালার ঘরটিতে তখন নাবালিকার ভাইটিও উঠে পড়েছে এবং তার স্বভাবমত আর কিছু করার না পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। সন্ধ্যে যতই গড়ায় ভাই-বোনের মনে ততই নৃশংস সব গল্পের বইয়ের প্লট ভীড় করে আসে। জঙ্গলের মধ্যে সাধুবাবা, তার পোষা অজগর ময়ূর খায়, সন্ধ্যেবেলায় বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বলি দিয়ে দেওয়া কি একেবারেই অসম্ভব? ভাইয়ের কান্না দিদিতে সংক্রমিত হয়। হাপুস নয়নে দুই ভাইবোন কেঁদে যাচ্ছে এমন সময় মা-বাবা ফেরে ভাত আর আলুর তরকারী নিয়ে। তাদের মা ন্যূনতম উপকরণেও অমৃত রেঁধে থাকেন। অমৃত সেবন করে বাচ্চারা ঘুমোয়। মা জানিয়ে দেন, অনেক হয়েছে, কালকেই পাততাড়ি গোটাতে হবে এখান থেকে।
পঁচিশ বছর পরে মেয়েটি যখন তার মা-বাবার গল্প লিখতে বসেছে সে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত। সঠিক পেরেন্টিং কি তা নিয়ে অনেক গবেষনা, অনেক বিতর্ক। বিদেশ বিভুঁইয়ে একা ঘরে ছোট দুই ছেলেমেয়েকে তালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়াকে লোকে অবিমৃশ্যকারিতাই বলবে। কিসের আকর্ষনে অনেক কষ্ট সহ্য করেও মানুষ গভীর বনের মাঝে একখানি শ্বেতপাথরের মন্দিরের কাছে থেকে যেতে চায় তাও বুঝবে খুব কম লোকেই। সেদিনের সেই কিশোরী পথের দেবতার আশীর্বাদের উত্তরাধিকার বহন করে আজ নিজেকে ধন্য মনে করে।

No comments:

Post a Comment