About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Friday, January 26, 2018

খারাপ মেয়ে

 বাঙালীর "খারাপ মেয়ে" সুপ্রিয়া দেবী চলে গেলেন। "শুভবিবাহ", "মেঘে ঢাকা তারা", "মন নিয়ে"র মত ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের পরেও মানুষের স্মৃতিতে তিনি ছিলেন শুধু সেই মেয়ে যার জন্য মহানায়কের সুখের সংসারে ভাঙন ধরেছিল। মজার বিষয়, সেই একই সম্পর্কে জড়িত পুরুষটিকে নিয়ে মানুষ কিন্তু কোনকালেই খুব একটা ক্রিটিকাল ছিল না। বাঙালীর চোখে পুরুষটি ছিলেন এক অসহায় স্বামী যিনি একটি মেয়ের ফাঁদে পড়েছিলেন। এই সমস্ত ঘটনাই যদিও আমার জন্মেরও আগে, তবু এর আঁচ পেতে আমার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদেরও অসুবিধে হয়নি কারন নারীটি আমাদের কিশোরবেলায় লিখছিলেন তাঁর আত্মজীবনী "আমার জীবন, আমার উত্তম"। তিনি কেন "আমার উত্তম" বলবেন তা নিয়ে অসন্তোষ, তাঁর "আপনাদের দাদা" বলা নিয়ে বিদ্রুপ - এসবের মধ্যে দিয়েই আমরা বড় হয়ে উঠলাম। তিনি বিবাহিত স্ত্রী হলে এসব কিছুই বলা হত না এতে আমি নিশ্চিত। শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল "মহানায়ক" নামের টিভি সিরিয়াল। নারীটির আদলে একজন অবাস্তব খলনায়িকা তৈরী করে তারা তাঁকে মাথা মুড়িয়ে, ঘোল ঢেলে সমাজের বাইরে পাঠিয়ে দিল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অর্ধেক তখন "সিরিয়াল দেখিনা" বলে পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন, বাকি অর্ধেক বোধকরি নিজেদের চাকরী বাঁচাতে ব্যস্ত। আয়রনি হল, আজ তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে আমিও তো তাঁর উত্তম-অধ্যায় নিয়েই লিখছি। তাঁর অভিনয় প্রতিভা নিয়ে কিছু বলা ধৃষ্টতা, তবু উত্তম পরবর্তী যুগে তাঁর পারফর্ম্যান্স দেখে সন্দেহ জাগে তিনিও হয়ত ভালো অভিনেত্রী হওয়ার চেয়ে ভালো ঘরনী হওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলেন। নইলে "শুভবিবাহ", "মেঘে ঢাকা তারা", এমনকি "শুন বরনারী"র পরে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের কথা ভাবতে গেলেই কেন অতিরিক্ত মেক`আপ করা, কৃত্রিম বাচনভঙ্গীর এক অভিনেত্রীকে মনে পড়ছে যার সাথে একই মানুষের আগের কাজের কোন সাযুজ্য নেই! অবিশ্বাসী তো "যেখানে গেছেন ভালো থাকুন" জাতীয় অলীক আশ্বাস দিতে পারে না; অবিশ্বাসী বরং বলছে - বাংলা ছবির শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যিনি এসেছিলেন, অথচ মানুষ যাঁকে মহানায়কের অবৈধ সঙ্গিনী ও ভালো রাঁধুনীর বেশি মর্যাদা দিল না, এমনকি যিনি নিজেও নিজের ওপর বিশ্বাস বজায় রাখতে পারলেন না, পূর্বমানুষ ও সহমানুষদের এই মূঢ়তার জন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী। অবিশ্বাসী ভাবে, আসবে কি এমনদিন যেদিন মেডুসার চুলে সাপের ফণা দেখার সংস্কৃতি থেকে মানুষ বেরোবে!

Thursday, January 4, 2018

বিহারী বাবুকা বাংলো

 সেটা সাতানব্বই সাল। উচ্চমাধ্যমিকের বছর। আমার বাবা-মা ছিয়াত্তর সাল থেকে শিমূলতলা যেতে শুরু করেছিলেন। জাঁদরেল কোন ট্রিপ না থাকলে প্রতি বছরের পুজোর ছুটি আমাদের শিমূলতলাতে কাটত। সেবারেও ব্যতিক্রম নয়। মধুরাশ্রমে মোহন মালির আতিথ্যে আছি। বাবার অ্যাকাডেমিক সিনিয়র কমলজ্যেঠু আর তাঁর স্ত্রী বীথি জ্যেঠিমাও সেবার শিমূলতলাতে একই বাড়ির সামনের অংশে। লক্ষ্মীপুজোর দিন দিদার বাড়িতে ফোন করতে দিদা বলল, ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে দিদানের পরীক্ষার চিঠি এসেছে। সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা। তোমরা এক্ষুনি ফিরে এসো। মফস্বলের মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ব্রেবোর্ণে পড়তে গিয়ে ইংরিজি বলতে না পারার জন্য কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিত হয়েছিলাম। পরীক্ষার পরের ছুটিটায় তাই ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্পোকেন ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম ইংরিজি শেখার আশায়। শিক্ষা বিশেষ হয়েছিল বলতে পারিনা, উপরন্তু পরীক্ষার চোটে পুজোর ছুটিটাও তারা বানচাল করে দিল। বাবা-মাও শিমূলতলা ছেড়ে ছুটির মাঝে বৈদ্যবাটি গিয়ে থাকতে হবে এই ভাবনায় নিরাশ। শুধু ভাই খুব খুশী। শিমূলতলার ইলেকট্রিক লাইট বর্জিত সন্ধ্যেগুলো সে খুব অপছন্দ করত। বাড়ি ফেরার সম্ভাবনায় তার আনন্দ বাঁধ মানে না। তবে বাবা-মা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। তারা ঠিক করল, কমলজ্যেঠুর ঘরে মালপত্র রেখে আমাদের দুই ভাই-বোনকে দিদার বাড়ি রেখে আবার ফিরে আসবে শিমূলতলায়। এই ব্যবস্থা যাকে বলে উইন-উইন সিচুয়েশন। দিদা খুশী, মামা-মামীমা খুশি, আমরা খুশী, বাবা-মাও খুশী। সবাই মিলে একসাথে খুশী হওয়ার মত ঘটনা শুধু সেকালে কেন, কোনকালেই খুব একটা ঘটে না। আমরা অমৃতসর মেল ধরে বিনা রিজার্ভেশনে চলে এলাম। দিদার বাড়ি এক রাত থেকে মা-বাবা আবার ফিরবে শিমূলতলায়।

মায়ের হঠাৎ মনে হল দুদিনের জন্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জ ঘুরে গেলে কেমন হয়! অনেক নাম শুনেছে জায়গাটার। যাওয়া হয়নি। বাবা তখনই টাইমটেবলে দেখে নিল হাওড়া থেকে ছাড়ে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। তাতেই যাওয়া হবে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। সমস্যা একটাই। ট্রেন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ পৌঁছবে রাত দুটোয়। অত রাতে একটা অচেনা জায়গায় থাকবে কোথায়! সে সমস্যার সমাধানও হয়ে গেল পাঁচ মিনিটেই। বাবার এক ছাত্রের সম্পর্কিত দাদা বোকারোতে থাকে। সে নাকি বারবার বলে তার দাদার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। উপরন্তু সেই দাদার বাবা নাকি আমাদের দাদুর প্রাণের বন্ধু ছিলেন। বাবা স্থির করল সেই রাতে বোকারোতে থেকে পরের দিন সকালে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ যাবে। মা এই ব্যবস্থাপনায় খুবই সন্দিগ্ধ। কিন্তু বাবা ততক্ষণে দাদুর সাথে ছাত্রের দাদার বাবার প্রাণের বন্ধুত্ব নিয়ে দুর্দান্ত সব নজির পেশ করে ফেলেছে। মা আর আপত্তি করল না।
পরদিন শেষ সন্ধ্যায় বোকারোতে গিয়ে ছাত্রের দাদার ঠিকানা খুঁজে বার করতে করতেই হেমন্তের শহর রাতের চাদর মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি। দাদাটি কোলাপসিবল গেটের ওপার থেকে জানিয়ে দিলেন তাঁর বাবা শুয়ে পড়েছেন। ভাই-এর মাস্টারমশাইয়ের পরিচয়েও বিশেষ লাভ হল না। মা লজ্জায়, অপমানে একসা। বাবা বলল, চিন্তার কিছু নেই, স্টেশনের ওয়েটিং রুমে রাত কাটিয়ে দেব। অন্য কেউ হলে অচেনা মানুষের বাড়ি রাত কাটানোর এমন অসম্ভব প্ল্যান করতই না। কিন্তু আমার বাবা অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। নিজেরও অচেনা লোক নেমন্তন্ন করে আনতে জুড়ি নেই। আর মাও মাঝরাতে অতিথি এলে আধঘণ্টায় ফ্রায়েড রাইস-আলুর দম রেঁধে টেবিল সাজিয়ে দিতে পারে। অথচ আশ্চর্যের কথা, এই ভদ্রলোকটি একেবারেই গল্প করতে পারেন না। মহিলাটিরও মিশুকে বলে নাম নেই।
বোকারোর ওয়েটিং রুমে একখানি পুরোনো দিনের বড় টেবিল। লোকজন বিশেষ নেই। ঠিক হল, প্রথম রাতে মা ঘুমোবে, শেষ রাতে বাবা। তারপর ভোরের প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। ঘুম তো নয়, ঐ টেবিলের ওপরেই শুয়ে নেওয়া একটু। মাঝরাতে জনা তিনেক পাগড়ী বাঁধা লোক এসে ওয়েটিং রুম দেখে গেল। মা তখন শুয়ে আছে। বাবা রয়েছে পাহারায়। এছাড়া বলার মত কিছু ঘটেনি সে রাত্রে।
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ নাকি অপূর্ব জায়গা। আমি যাই নি। কাজেই বর্ণনা করতে পারব না। ব্রিটিশ আমলের বাংলো আছে অনেক। অনেক বাঙালী সেলিব্রিটিরাও বাড়ি রেখেছেন ওখানে। ওরা যে কটেজ ভাড়া নিল সেও অদ্ভুত সুন্দর। একটি ঘরে নীল রঙের কাঁচের সিলিং। সারাদিন মায়াময় নীলাভ আলোতে ভরে থাকে সেই ঘর। কিন্তু এমন একখানি সরল নির্ঝঙ্ঝাট বাড়িতে থেকে মা-বাবার সুখ হল না। পরের দিন সকালে তারা শহর ঘুরতে বেরল। শহর ঠিক বলা চলে না। ছোটনাগপুরের নেশা ধরানো প্রকৃতি, শাল-সেগুন-ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। আর মাঝে মাঝেই সুন্দর সুন্দর বাংলো বাড়ি। একটি বাড়ির নামের ফলক পড়ে জানা গেল সে বাড়ি বুদ্ধদেব গুহের। বাড়িতে কেউ নেই। বাগানের গাছ গন্ধরাজ লেবুর ভারে নুয়ে পড়ছে। "আতার পায়েস" গল্প পড়েই জানি এসবক্ষেত্রে গুণীজন আপনপর ভেদ করেন না। বাবা কিছু লেবু পকেটে ভরল। সেই রাস্তা ধরেই ফেরার পথে দেখে এক ভদ্রলোক তাঁর বাংলোর গেটে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এগিয়ে এসে আলাপ করলেন। খুব করে ধরলেন তাঁর বাড়িতে গিয়ে চা খাওয়ার জন্য। মা কি ভাবছিল জানি না, বাবা তো আতিথ্য দিতে ও নিতে সদা তৎপর। সে বাড়িও দারুন সুন্দর। এনারা কলকাতাতে থাকেন। ম্যাকলাস্কিগঞ্জে নিজেদেরই বাড়ি। ছুটি কাটাতে এসেছেন। রান্নাঘর থেকে লুচি ভাজার গন্ধ আসছে। কিছু পরে একটি মেয়ে এসে চায়ের ট্রে নিয়ে দাঁড়াল। মুখটি নিচু করা। ভদ্রলোক বললেন, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা। মা ভাবছে, চেনা চেনা লাগে মুখটা, কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না। তখন মেয়েটি ঢিপ করে একটি পেন্নাম ঠুকে নিজের পরিচয় দেয়, দিদি আমি আপনার ছাত্রী, আপনি পড়িয়েছেন আমাদের। ততক্ষণে মায়ের মনে পড়ে, আরে তাই তো, এই মেয়ে তো ছাত্রী ছিল। বিয়ে হয়েছে অনেকদিন, চেহারা ভারী হয়েছে, তবু এতো সেই। আস্তে আস্তে আরো দুই মেয়ে বেরিয়ে এসে প্রণাম করে। তিনবোনেই মায়ের ছাত্রী। সবচেয়ে ছোট বোনটি এখনও স্কুলে পড়ে। বাবার ছাত্রের দাদার ভরসায় বেরিয়ে মায়ের ছাত্রীর দিদির বাড়ি জলযোগ হল অবশেষে। বুদ্ধদেব গুহর বাড়ির গন্ধরাজ লেবু বিতরণ হয় তাদের মধ্যে।
তারপর নিজেদের কটেজে ফিরছে, রাস্তায় পড়ে এক বিশাল বাগান। এক মালি সেই বাগানে কাজ করছে। কাছাকাছি কোন বাড়ি দেখা যায় না। মালি বলে, এই বাগান ধরে হেঁটে যান, শেষে বাড়ি পাবেন। - কার বাড়ি এটা? মালিক কোথায় থাকে? জানা গেল, মালিক বাড়িতেই আছেন। বাড়িতে গেলেই পাওয়া যাবে তাকে। ততক্ষণে এই বিশাল বাগান আর বাগান শেষের প্রাসাদপম বাংলোটাকে না দেখেই পছন্দ হয়ে গেছে মা-বাবার। তারা ভাবছে, আহা এখানে যদি থাকা যায়! বাড়ির মালিক এক স্থানীয় বৃদ্ধ। বাংলো ভাড়া পাওয়া যাবে জানা গেল। বাবা-মা জানিয়ে দিল সেদিন বিকেলেই চলে আসবে তারা।
মা বলে সেদিন ঐ বাংলোতে যখন ঢুকলো তখন সন্ধ্যে হব হব করছে। বসার ঘরের দরজা খুলতেই একটা চামচিকে উড়ে পালালো। ব্রিটিশ আমলের ফায়ারপ্লেস, বেলজিয়ান গ্লাসের ধুলি ধূসরিত আয়না, তার সামনে দাঁড়ালেই মনে হয় এখুনি আরেকটা মুখ উঁকি মারবে ঘাড়ের পাশ থেকে। একটা অদ্ভুত গা ছমছমে পরিবেশ। রাতের জন্য মালি মুর্গী রান্না করে দিল। অতিথি দুজন, মালি, মালির বৌ, তিন ছেলে সবাই ভাগ করে খেল। তারপর সেই বিশাল বাড়ি, যেখানে শোয়ার ঘর থেকে বাথরুমে পৌঁছতেই মানুষ হারিয়ে যেতে পারে, সেখানে দুটি মাত্র প্রাণী। মালিক বাইরের একটি ঘরে।
পরের দিন ভোরে একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটল যার বর্ণনা আমরা অনেকবার শুনেছি। দিনের আলো ফুটব ফুটব করছে, বাবা তখনও ঘুমে, মা ভাবল বাথরুম সেরে ফেলা যাক। বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় দেখে পুরোনো দিনের দরজা গিয়েছে আটকে। খোলা যাচ্ছে না কিছুতেই। বাবা যে ঘরে শুয়েছে তা বহু দূরে। ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ পৌঁছনোর কোন আশা নেই। মা যা করল তা আজকের পায়ের ব্যাথায় কাতর সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে অপারগ মহিলাকে দেখলে অবিশ্বাস্য লাগবে। বাথরুমে একখানি জানলা ছিল বাগানের দিকে। বাথটবের ওপর উঠলে তার নাগাল পাওয়া যায়। মা সেই জানলা দিয়ে অর্ধেকটা শরীর বার করে কৈ হ্যায়, কৈ হ্যায় বলে চিৎকার শুরু করল। বাথরুমে যে গামছাখানা নিয়ে গেছিল তা দিয়ে নাকি সিগনাল দেওয়ারও চেষ্টা করেছে অনেক। বেশ কিছুক্ষণ হাঁকডাকের পর মালির কানে আওয়াজ পৌঁছলো। সে বাগান দিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। মায়ের গলা শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে উদ্ধার করল। বাবা তখনও ঘুমন্ত। পরে নেহাতই স্বাভাবিক স্বরে বলল, না জানিয়ে বাথরুমে যাওয়া মোটেই উচিত কাজ হয়নি।
বাকি দিনটা কাটলো নিরুপদ্রবেই। গোল বাঁধল পরের দিন দুপুরে বাড়ি ছাড়ার সময়। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ থেকে বিকেল পাঁচটার ট্রেনে আসানসোল এবং সেখান থেকে শিমূলতলা - এই হল প্ল্যান। হিসেবমত দুটো নাগাদ বেরোলেই যথেষ্ট। মালিকের সাথে বচসা বাঁধল ঠিক তখনই। বাবার হিসেব মত পরশুদিন বিকেল পাঁচটায় ঘরে ঢোকা হয়েছে, বেরোনো হচ্ছে দুপুর দুটোয়, অর্থাৎ এরা থেকেছে দুদিন। মালিক বলছে, তা হবে না, আজকের দিনটাকেও হিসেবে ঢুকিয়ে মোট তিনদিনের ভাড়া দিতে হবে। ঐ পরিস্থিতিতে আমি থাকলে যা করতাম মা'ও সেটাই করার চেষ্টা করল - যা চাইছে দিয়ে দাও, ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই। কিন্তু বাবা অনড়। দুদিন থেকে তিনদিনের ভাড়া কিছুতেই দেবে না। মালিক রেগেমেগে বলল, তিনদিনের ভাড়া না নিয়ে আমি কিছুতেই তোমাদের ছাড়ব না। এই বলে বৈঠকখানার দরজায় শিকল টেনে লোক ডাকতে বেরিয়ে গেল। মা ভয় পাচ্ছে কি করে এদের হাত থেকে নিস্তার পাবে। বাবাও খুঁজছে পালানোর রাস্তা, কিন্তু জেদে অটল। এমন অবস্থায় মালি উঁকি দিল জানলা দিয়ে। মালির বোধহয় আগে থেকেই রাগ ছিল মালিকের ওপর। সে বলল, মালিকটা খুব বদ লোক। চিন্তা নেই, আমি তোমাদের শেকল খুলে দিচ্ছি। তারপর টেবিলের ওপর দুদিনের ভাড়ার টাকা রেখে নিজেদের ব্যাগ নিয়ে মালির দেখানো পথ দিয়ে দৌড় স্টেশনের দিকে।
মেয়ের মত মায়েরও বিপদের সময়ে ভয়ংকর সব গল্পের বইয়ের প্লট মাথায় আসে। মা ভাবছে বাড়ি ফিরে এসে ওদের দেখতে না পেয়ে মালিক হয়ত চেলা-চামুণ্ডা দিয়ে ধাওয়া করবে স্টেশনেই। কতক্ষণে ট্রেন আসবে তার জন্য মিনিট গুনছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে। এই বৃষ্টিই কি ওদের বাঁচিয়ে দেবে শেষ পর্যন্ত? নাকি নিয়ে আসবে বাড়তি বিড়ম্বনা? একসময় দেখা গেল, ট্রেন এসে দাঁড়িয়েছে স্টেশনে। কিন্তু সুরাহা হল কি? রিজার্ভ কামরা তো বটেই, এমনকি জেনারেল কামরাগুলোর দরজাও যে বৃষ্টির জন্য ভেতর থেকে বন্ধ!!
এমন অবস্থায় এই দম্পতি আগেও পড়েছে, ভবিষ্যতেও পড়বে আবার। কখনও তাদের সবাইকে, কখনও বা শুধু একজনকে ফেলে রেখে ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার উপক্রম করবে। ট্রেনের কামরায় মা'টি ছোট দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন অপেক্ষায়। বাবা'টি কি স্টেশনেই রয়ে গেল? পরের ট্রেনে আসবে? নাকি উঠেছে এই ট্রেনেই , অন্য কোন কামরায়? জানার কোন উপায় নেই যতক্ষণ না এই নবঘনজলধরশ্যাম উপত্যকা পেরিয়ে ট্রেন পৌঁছয় পরের স্টেশনে। ততক্ষণ মা আর ছেলেমেয়েদুটি ঘন হয়ে বসে, নিজেদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে।

কুম্ভলগড়ের সাধু

 ১৯৯২ এর পুজোর ছুটিতে রাজস্থান যাওয়া হল। পঞ্চমীর দিন স্কুল ছুটি হয়ে বেরোনো। ফেরা ভাইফোঁটা কাটিয়ে স্কুল খোলার আগের দিন। ইন্ডিয়ান রেলে সার্কুলার টিকিট বলে একরকম টিকিট পাওয়া যায়। আগে থেকে কোথায় কোথায় থামা হবে প্ল্যান করে রেলওয়েকে জমা দিতে হয়। শুরু এবং শেষের স্টেশন এক হতে হবে - এই হল শর্ত । একমাস বা চল্লিশ দিন - এইরকম কিছু একটা সময়ের জন্য ভ্যালিড থাকে এই টিকিট। একসময় ইউরোপে ঘোরাঘুরির জন্য ইউরোরেলের খোঁজখবর নিয়েছিলাম। সেখানেও আছে এমন ব্যবস্থা।

আমি তখন ক্লাস এইট, ভাইয়ের ফোর। কোথায় কোথায় যাওয়া হবে তার একটা মোটামুটি ধারনা ছিল বাবার। তবে কোন শহরে কতদিন থাকা হবে, কোন হোটেলে সেসব জানা ছিল না। যখন যেখানে যাওয়া হচ্ছিল হোটেল খুঁজে নেওয়া হচ্ছিল। আর সেই সাথে স্টেশনে গিয়ে পরের গন্তব্যের জন্য রিজার্ভেশন। একান্তই রিজার্ভেশন না পাওয়া গেলে জেনারেল কামরা ভরসা। এইভাবে দিল্লি-ভরতপুর-জয়পুর-আজমের-চিতোরগড় পেরিয়ে আমরা এলাম উদয়্পুরে। পরের গন্তব্য মাউন্ট আবু। সেখানে রয়েছে শ্বেতপাথরের অপরূপ কারুকার্যমন্ডিত দিলওয়রা জৈন মন্দির। উদয়্পুরে এসে স্থানীয় মানুষের থেকে জানা গেল, নাকি আগেই পড়া ছিল সে আর এখন মনে নেই; তবে রণকপুর নামে একটি নতুন জায়্গা ঢুকে গেল ভ্রমণসূচিতে। সেখানেও আছে একটি জৈন মন্দির, আকারে দিলওয়ারার চেয়েও বড়। পাশেই কুম্ভলগড় ন্যাশনাল ফরেস্ট। রাণা কুম্ভের নামে আমরাও চনমন করে উঠলাম। তখনও রণকপুর ট্যুরিস্টস্পট হিসেবে বিখ্যাত হয়নি। মূলত জৈন তীর্থযাত্রীরা যেতেন। সাধারণ ট্যুরিস্টদের জন্য উদয়্পুর থেকে সকালে একটা বাস ছিল। সেই বাসই বিকেলের দিকে যাত্রীদের ফেরত আনত। আমরা যখ্ন রণকপুর যাচ্ছি তখনও ঠিক ছিল সকালে গিয়ে বিকেলে ফেরত আসা হবে। কিন্তু বেড়ানোর ব্যাপারে আমার বাবা-মা চরম আনপ্রেডিক্টেবল। রণকপুরে নেমেই অবিন্যস্ত সবুজের মাঝে শ্বেতপাথরের অপূর্ব মন্দির দেখে বাবা বলে দিল, এখানে তো কদিন না থাকলেই নয়। মা একটু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে - এই জায়গায় কোন ট্যুরিস্ট রাতে থাকে না, থাকার জায়গা আদৌ আছে কিনা তাও জানা নেই, সাথে ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে - থাকবো বললেই থাকা যায় নাকি! কিন্তু এও জানে মা, থাকার ইচ্ছে যখন হয়েছে যেভাবেই হোক বাবা থাকার ব্যবস্থা করবেই। সত্যি করেই তখন ওখানে জৈন তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি ধর্মশালা ছাড়া আর কোন থাকার জায়গা ছিলনা। সেখানেই ব্যবস্থা হল। সমস্যা বাধল খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। জৈনরা সূর্যাস্তের পর অন্নগ্রহণ করেন না। দুপুরবেলা ধর্মশালার খাবার ঘরে গাট্টে কি সবজি আর চাউল মিলল বটে, কিন্তু রাতে কি ব্যবস্থা হবে কেউ জানে না। যদ্দুর মনে পড়ে সাথে থাকা শুকনো খাবার দিয়ে সে রাতের বন্দোবস্ত হয়েছিল। সূর্য ডোবার পর পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। ধর্মশালায় আমরা ছাড়া আরো গোটাদুয়েক অতিথি আছে। তারাও যে যার ঘরে।
পরদিন ভোর হতে আমরা আবার মন্দিরে এলাম। সত্যিই আর সব জায়গার চেয়ে এ জায়গা আলাদা। চিতোরের দুর্গ যতই সম্ভ্রম উদ্রেককারী হোক না কেন, অত মানুষের ভীড়ে রাজকাহিনীতে পড়া "ম্যায় ভুখা হুঁ" দেবীকে থোড়াই অনুভব করা যায়! রণকপুরের এই মন্দিরের কথা কোন বইতে পড়িনি। অথচ কুম্ভলগড়ের অরণ্যের মাঝে এই বিশাল মর্মর সৌধ দেখে গায়েব-গায়েবীর সূর্যমন্দিরের গল্প মনে আসে। সকালটা মন্দিরচত্ত্বরে হেসেখেলে কাটে। মন্দিরের সামনেই বিশাল গাছে অজস্র বাঁদর কিচমিচ করছে। এদিকে যতই বেলা বাড়ে গাট্টে কি সবজির কথা ভেবে মন দমে যায়। আশেপাশের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল কুম্ভলগড় ফরেস্টে আরটিডিসির একটা হোটেল আছে। সেখানে খাবার মিলতে পারে। জায়গাটা বেশ দূরে। বাসে করে সেখানে পৌঁছানো গেল। সেখানেও কোনো ট্যুরিস্ট নেই। আমাদের দেখে তারা রাঁধতে বসল। নিরামিশ স্টাফড আলু আমরা চমৎকার খেলাম। মায়ের আলুটাই পচা পড়ল। তবু বেসনের গোলা যে খেতে হল না এতেই খুশি। বিকেলে বাবা বলল রাতের খাবার আনতে একাই শহর যাবে। আবারও বাসের রাস্তা। মা আমাদের নিয়ে রইল ধর্মশালাতে। এই অঞ্চলের বাসিন্দারাও মূলত জৈন হওয়াতে রাতের খাবার হোটেল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এক দোকানীকে অনেক অনুরোধ করায় সে রুটি আর একটা সবজি বানিয়ে দিতে রাজি হল। কিন্তু রান্না করতে তার এমনই দেরী হল যে শেষ বাসটিও গেল ছেড়ে। ধর্মশালায় আমরা বাবার অপেক্ষা করছি। ওদিকে বাবার ফেরার উপায় বন্ধ। যদি ফিরতে না পারত সে রাত কিভাবে কাটত জানা নেই, কারন ভাগ্যক্রমে একটি জিপ পাওয়া গেল যেটা মন্দিরের দিকে আসছিল। সেই ড্রাইভার বাবাকে লিফট দিতে রাজি হল। এমনকি কোন পয়সাও নিল না। সাধে কি বলি, ভারতবর্ষকে যেটুকু জানি তা বাবা-মার সাথে ঘুরে বেড়ানোর কল্যাণে!
অন্য কেউ হলে হয়ত ভাবতো, একদিন তো থাকা হল, এবার ফেরা যাক। বাবার মধ্যে তেমন কোন লক্ষণ নেই। পরের দিন ভোরে বেড়াতে বেরিয়ে একটা লম্বা ময়ূরের পালক নিয়ে ঘরে ফিরল। কিছু দূর গেলে নাকি এক সাধুবাবার আশ্রম আছে। বাবা সেখানে গিয়ে ভাব জমিয়েছে। আশ্রমের সীমানায় ছড়ানো-ছেটানো ময়ূরের পালক। এক অজগর সাপ ময়ূর মেরে খেয়ে নিয়েছে। সেই পালক বাবার হাতে। ময়ূর সাপ খায় জানতাম। উল্টোটা প্রথম শুনলাম। আমরাও গেলাম সাধুবাবার ডেরায়। সাধুজীর চেলা আমাদের উটের দুধের ঘন চা খাওয়ালেন। বাবা বলল, এই জায়গা তো খুবই সুন্দর, থাকতে বড়ই ভালো লাগছে, কিন্তু ছেলেমেয়েদের কি খাওয়াবো তাই নিয়ে অসুবিধেয় পড়েছি। সাধুজী বললেন, কৈ বাত নেহি। বিকেলে চলে এসো আমার আশ্রমে তোমার ধরমপত্নীকে নিয়ে। আমার রসুইতে খানা পাকিয়ে নাও। আমিও তোমার হাতে খাবো। অন্য কেউ হলে কি করত জানি না, বাবার মনে হল খাদ্যসমস্যার এর চেয়ে কার্যকরী সমাধান আর হতেই পারেনা। সাধুকে কুড়ি টাকা দিয়ে বাজার আনাতে বলে আমরা ধর্মশালায় ফিরে এলাম। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের ঘুমোতে বলা হল। আমি আর ভাই ঘরে রইলাম। বাবা-মা সাধুবাবার আশ্রমে গেল রাতের খাবার বানাতে।
এর পরে যা হল তা বর্ণনা করতে কিঞ্চিৎ ক্রসকাটিং টেকনিকের সাহায্য নেওয়া বাঞ্ছনীয়। একদিকে জৈন ধর্মশালার একটি ঘরে দুই ঘুমন্ত নাবালক-নাবালিকা। ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। অন্যদিকে অজ্ঞাতপরিচয় সাধুবাবার আশ্রমে বাঙালী দম্পতির রন্ধনপ্রচেষ্টা। প্রচেষ্টা শুরু হতে অবশ্য দেরী হল কিছু। বাঙালী বাবুর ধরমপত্নী এসে রাঁধবেন বলে সাধুজীর চেলা ছুটি নিয়ে গ্রামে যাবে। তার আগে কটা রুটি বানাবে সে। অতএব উনুন তার দখলে। অতিথিদের চায়ের জোগান দিয়ে গেছে অবশ্য। বাবার গল্প করার প্রিয় বিষয় তার বাগান। সেই বাগানের পাতিলেবু বাবা রাজস্থানেও নিয়ে এসেছে। একথা জানা মাত্র সাধুবাবার ইচ্ছে হল পাতিলেবু খাওয়ার। বাবা অমনি "এখুনি নিয়ে আসি" বলে ধর্মশালায়। মা একা সেই অজগরে ময়ূর খাওয়া আশ্রমে। ছেলে-মেয়ে দুটি তখনও ঘুমে। তাদের ঘুম না ভাঙিয়েই বাবা ফিরে আসে। তারপর চেলার রুটি বানানো শেষ হতে মা ঢুকেছে রান্নাঘরে কাঠের জালে রান্না করতে। বাবা বাইরে গল্প করছে সাধুজীর সাথে। উনুনে কাঠ গুঁজে আঁচ আনতেই বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে। এদিকে নাবালিকাটির ঘুম ভেঙেছে জানলায় একটি টোকায়। জানলা খুলে দেখে একটি লোক কড়ে আঙুল দেখাচ্ছে। বাথরুমে যেতে চায় সম্ভবত। কোন কথাবার্তায় না গিয়ে লোকটির মুখের ওপর জানলা বন্ধ করে সে বসে থাকে মা-বাবার ফেরার অপেক্ষায়। ওদিকে মা'টি তখন কুটনো কেটে আলু-টমেটো-ধনেপাতার তরকারী বসিয়ে দিয়েছে। তরকারী হলে ভাত চাপবে। তারপর বাসন মেজে ঘরে ফিরতে হবে। একখানি টিমটিমে কুপি জ্বলছে। দেওয়ালভরা ভুতূড়ে সব ছায়া। একবার পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকিয়েই আঁতকে চিৎকার করে ওঠে। মিশমিশে অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে দুটো কালো চোখ। সাধুবাবা বাইরে থেকে বলেন, ভয় পেয়ো না বেটি, ও আমার পোষা বনবেড়াল। জৈন ধর্মশালার ঘরটিতে তখন নাবালিকার ভাইটিও উঠে পড়েছে এবং তার স্বভাবমত আর কিছু করার না পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। সন্ধ্যে যতই গড়ায় ভাই-বোনের মনে ততই নৃশংস সব গল্পের বইয়ের প্লট ভীড় করে আসে। জঙ্গলের মধ্যে সাধুবাবা, তার পোষা অজগর ময়ূর খায়, সন্ধ্যেবেলায় বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে বলি দিয়ে দেওয়া কি একেবারেই অসম্ভব? ভাইয়ের কান্না দিদিতে সংক্রমিত হয়। হাপুস নয়নে দুই ভাইবোন কেঁদে যাচ্ছে এমন সময় মা-বাবা ফেরে ভাত আর আলুর তরকারী নিয়ে। তাদের মা ন্যূনতম উপকরণেও অমৃত রেঁধে থাকেন। অমৃত সেবন করে বাচ্চারা ঘুমোয়। মা জানিয়ে দেন, অনেক হয়েছে, কালকেই পাততাড়ি গোটাতে হবে এখান থেকে।
পঁচিশ বছর পরে মেয়েটি যখন তার মা-বাবার গল্প লিখতে বসেছে সে কিঞ্চিৎ দ্বিধাগ্রস্ত। সঠিক পেরেন্টিং কি তা নিয়ে অনেক গবেষনা, অনেক বিতর্ক। বিদেশ বিভুঁইয়ে একা ঘরে ছোট দুই ছেলেমেয়েকে তালা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়াকে লোকে অবিমৃশ্যকারিতাই বলবে। কিসের আকর্ষনে অনেক কষ্ট সহ্য করেও মানুষ গভীর বনের মাঝে একখানি শ্বেতপাথরের মন্দিরের কাছে থেকে যেতে চায় তাও বুঝবে খুব কম লোকেই। সেদিনের সেই কিশোরী পথের দেবতার আশীর্বাদের উত্তরাধিকার বহন করে আজ নিজেকে ধন্য মনে করে।

Tuesday, January 2, 2018

নামহীন

 কাল একটা সিনেমা দেখলাম। সিনেমার নাম আফটার ইমেজ। পোলিশ সিনেমা। অ্যাশেস অ্যান্ড ডায়মন্ড খ্যাত আন্দ্রে ওয়াজদার শেষ কাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পোল্যান্ডে যখন কমিউনিস্ট শাসন, সেই সময়ে একজন শিল্পীর স্বাধীন চেতনাকে কিভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির সাথে এক ছকে বেঁধে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া হয়, এবং সেই শিল্পী রাষ্ট্রীয় নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে অস্বীকার করলে কিভাবে তাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দেওয়া হয় তা নিয়ে গল্প। চেনা গল্প হলেও পরিচালনার গুণে বেশ ভালো লাগল দেখতে। তবে আজকে সিনেমার গল্প লিখতে বসিনি। বরং সিনেমাটা যে রেকমেন্ড করেছে তার কথা লিখি।

বাবা রিটায়ার করেছিল আমার প্রথম চাকরী পাওয়ার ঠিক একমাস আগে ২০০২-র মে মাসে। মা পাক্কা দশ বছরের ছোট। ২০১৩-র জানুয়ারীতে চাকরী জীবন থেকে মুক্তি মিলল। রিটায়ার করার পর কি করবে তা নিয়ে বাবা-মাকে কখনই আমাদের সামনে বা অন্য কারোর সামনে কোন পরিকল্পনা করতে শুনিনি। তারা দুজনেই বেড়াতে ভালোবাসে। ভারতের গ্রাম-গঞ্জ আমি যেটুকু চিনি সে তাদেরই দান। রিটায়ারমেন্টের পর আরো একটু বেশি বেড়াতে পারবে এটাই ভেবেছিলাম। অবাক হয়ে গেলাম যখন শুনলাম তারা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে যোগ দেওয়ার জন্য ফর্ম তুলেছে। প্রতিবছর জুলাই-অগাস্ট মাসে এই কোর্স অফার করা হয়। রীতিমত সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া মেনে ছাত্র নেওয়া হয়। ২০১৩-এ আমার বাবা-মা যখন ফর্ম তুলল, তখন তাদের পাঁচটি ফিল্মের ওপর সংক্ষিপ্ত সমালোচনা লিখে পাঠাতে হয়েছিল। ফিল্মগুলো যে যার নিজের ইচ্ছামত বেছে নিতে পারে। বাবা কি ফিল্ম বেছেছিল আমার মনে নেই। মায়ের বাছা তিনটে ফিল্ম মনে আছে, কারন সেই তিনটেই আমি মাকে দেখিয়েছিলাম। বছর তিনেক আগে মা-বাবা যখন আমেরিকায় আমার কাছে ছিল, তখন আমরা মাঝে মাঝেই ফিল্ম দেখতাম একসাথে। লা স্ট্রাডা (ফেলিনি), চিলড্রেন অফ হেভেন (মাজিদ মাজিদি), আর ড্রিমস (কুরোসাওয়া) - এই তিনটে ছবি মায়ের খুব ভালো লেগেছিল। মা লিখেছিল এদের নিয়ে। বাবা অল্প বয়েসে নাটক ও ফিল্মের চর্চা করেছে। মায়ের এসব করার সুযোগই হয়নি কখ্নও। কিন্তু লিখতে পারে ভালো। দুজনেই নির্বাচিত হল। দেড়মাসের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে রোজ সময়্মত গিয়ে সারাদিন থেকে অনেক কিছু শিখে এল। সহপাঠীরা, কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকেরাও বয়সে অনেক ছোট। কিন্তু সেটা শিক্ষায় বাধা হবে এমনটা ভাবতেই পারেনি তারা। বাবা কোনকালেই গল্পগাছা করে না। মনে পড়ে, ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে সেদিন যে সিনেমা দেখানো হল তার কথা বলত মা। অনেক সময়েই সেই সিনেমা হয়ত আমাদের দেখা। আবার অদেখা সিনেমাও থাকত। তখন আমরা কাজাখ্স্তানে থাকি। টরেন্টে সিনেমা নামানোর স্বর্ণভূমি। অদেখা সিনেমার কথা জানতে পারলে নামিয়ে দেখে নিতাম। তারপর তা নিয়ে আলোচনা হত। মোটে দেড়মাসের কোর্স, কিন্তু ব্যাপ্তিতে অনেক। সিনেমা দেখা, আলোচনা, রিভিউ লেখা। রোজ বাড়ি ফিরে হোমওয়ার্ক নিয়ে বসত এই দুই রিটায়ার্ড শিক্ষক। ইতিমধ্যে মনোজ মিত্র একদিন মাকে আলাদা করে বললেন, আপনি বেশ লেখেন কিন্তু (এইটে প্রকাশ্যে না আনলেও চলত, কিন্তু লেখার লোভও সামলাতে পারলাম না)।
তারপর থেকে প্রতি বছরেই দুজনে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যাচ্ছে নিয়ম করে। মাঝে এক বছর মায়ের পায়ের ব্যথাটা খুব বাড়ল। ভেলোরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হল। বাবা ফেস্টিভ্যালে একটা দুটো ফিল্ম দেখে ফিরে এল। বুঝতেই পারি একা দেখে আনন্দ পাচ্ছে না। এবছর আবার যেতে পেরেছে দুজন একসাথে। প্রতিদিন ফিরে এসে কি কি সিনেমা ভালো লেগেছে লিখে পাঠিয়েছে আমাদের। যে সিনেমার কথা দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সেটা এই রেকমেন্ডেড সিনেমার একটা। অধিকাংশই গত দু-তিনবছরের সিনেমা। বিদেশী ভাষার নতুন সিনেমা এই দেশে বসে যোগাড় করা চাপ। এই সিনেমাটা অ্যামাজনে কিনতে পাওয়া গেল, তাই দেখা হল। বাকিগুলো কি হবে জানি না। একসময় মাকে সিনেমা দেখাতাম, এখন মা আমাকে সিনেমা রেকমেন্ড করছে। এসব ভেবেই মনটা খুশী খুশী লাগছে।
"আনন্দাৎ জায়তে বিশ্ব, আনন্দাৎ পল্যতে তথা, আনন্দাৎ লীয়তে বিশ্ব, আনন্দ পরিপুরতঃ"