স্থান - আইআইটির লেকচার থিয়েটার, পাওয়াই; কাল - অজানা
Thursday, October 25, 2018
নামহীন
Tuesday, April 17, 2018
বাস্তুহারার শহর
আলি জিজ্ঞেস করল, ‘‘এটা কি তোমাদের প্রথম হট এয়ার বেলুন রাইড ?’’ আমরা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। সে মুচকি হেসে উত্তর দিল, ‘‘আমারও’’। আমি নিশ্চিত রোজ সকালে যাত্রীদের নিয়ে আকাশে ওঠার আগে ও একই কথা বলে। তাও সেদিন ভোরে কাপাদোচিয়া শহরের আশ্চর্য ভূপ্রকৃতিতে আলির কথায় একটা শিহরণ হল।
বেলুনের সাথে লাগানো বেতের ঝুড়িতে আমরা জনা দশেক গা ঘেঁসাঘেঁসি করে দাঁড়িয়েছি। সূর্য তখনও ওঠেনি। বেলুনের ভেতরের হাওয়া গরম হচ্ছে বার্নারে। একটু পরেই সেই গরম হাওয়া বাইরের ঠান্ডা হাওয়ার চেয়ে হালকা হয়ে যাবে। আমাদের নিয়ে বেলুন ভেসে চলবে শিরা-উপশিরার মত জেগে থাকা অজস্র ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর দিয়ে। আগ্নেয়গিরির ছাই জমে তৈরি নরম সে পাথর। সেই পাথর কুঁদে অজস্র পায়রার খোপের মত ঘর বানিয়েছে মানুষ, গত সাড়ে তিনহাজার বছর ধরে। যখনই শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে পালানোর দরকার হয়েছে কোনো গোষ্ঠীর, তারা এসে আশ্রয় নিয়েছে এই নরম পাথরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গুহাবাড়িতে। পাথর কেটে আটতলা সমান শহর তৈরি হয়েছে বহিঃশত্রুর চোখের আড়ালে। সেইসব গুহার মুখ, ছোট ছোট কালো বিন্দুর মত দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা। কখনও আলি নিয়ে যাচ্ছিল তাদের খুব কাছে। কখনও ওপরে উঠছিলাম আমরা। আকাশে আরো কত নীল-হলুদ-সাদা বেলুন। ভোরের নতুন আলোয় কাপাদোচিয়া উপত্যকা সোনার মত চকচক করছে। এই ভরন্ত যৌবন দেখে বিশ্বাস হয় না এই পাথর আসলে রক্তেভেজা। সাড়ে তিনহাজার বছরের পাপদীর্ণ।
খ্রিষ্টজন্মের দেড়হাজার বছর আগে আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনরের এই অঞ্চলে (এশিয়ান তুরস্ক) হিটাইটরা রাজত্ব করত। এখনকার তুরস্ক, সিরিয়া, প্যালেস্তাইন থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাদের রাজত্বের সীমানা। কালের নিয়মে সে সীমানা সংকুচিত হল। দক্ষিণ থেকে মিশরিয়রা, পূর্বে মেসোপটেমিয়া থেকে আসিরিয়ানরা মাঝে মাঝেই হামলা করত। দক্ষিণপূর্ব ইউরোপে কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে সেই সময় আরো কিছু জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে যারা শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এরকমই কোন গোষ্ঠীর আক্রমণে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে হিটাইট রাজধানী হাতুসা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আন্দাজ করা যায় সেই সময়ের আশেপাশেই ঘরছাড়া মানুষেরা কাপাদোচিয়া অঞ্চলে প্রথম পাথর কেটে মাটির নিচে গুহাবাড়ি বানালো। শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে বেঁচে থাকার এই কৌশল তাদের উত্তরসূরীরাও আয়ত্ত করে নেবে অচিরেই।
সেদিন বেলুন থেকে নেমে আমরা গেলাম গোরেমে ওপেন এয়ার মিউজিয়াম দেখতে। গোরেমে কাপাদোচিয়ার একটা ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রাম কীভাবে ওপেন এয়ার মিউজিয়াম হল তা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে দুহাজার বছর। যিশু নামের এক ইহুদি যুবক তখন সদ্য ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন। জেরুজালেমে রোমান শাসন। সমস্ত বুদ্ধিমান বিদেশি শাসকের মতই তারা শাসিতের ধর্মগুরুদের বিশেষ ঘাঁটায় না। সেই ধর্মগুরুরা যখন এই জনদরদী বিদ্রোহী যুবকটির থেকে আসা সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের নিদান দিল তখন প্রায় বিনা প্রতিবাদেই তা কার্যকর করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। যুবকটির মৃত্যুর পর তাঁর অনুগত গুটিকয় শিষ্য রোমান শাসকের নজর এড়িয়ে পালাল দূর দেশে। সঙ্গে নিল যুবকের মা মেরিকেও। ক্ষুদ্রমেয়াদি জীবনে যেসব প্রশ্ন যুবকটিকে বিচলিত করেছিল তার বীজ তিনি পুঁতে দিয়েছিলেন তাঁর অনুগামীদের মনে। অনুগামীরা যেখানে গেল সেইসব শিক্ষা সহজ কথায় ছড়াতে লাগল স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। এইভাবে ইহুদি যুবকের মৃত্যুর পর তাঁর অজান্তেই জন্ম নিল এক নতুন ধর্ম। তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মসিহা বলে চিনেছিল। গ্রিক ভাষায় মসিহা হল ক্রিস্টোস। সেখান থেকে এই নতুন ধর্ম পরিচিত হল খ্রিষ্ট ধর্মরূপে।
আব্রাহামের একেশ্বরবাদ তখনও সারা পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীই তখনও পৌত্তলিক। প্রবল প্রতিপত্তিশালী রোমান শাসকেরা পৌত্তলিকতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এই অবস্থায় একেশ্বরবাদী নতুন ধর্মটি বেশ কোনঠাসা হয়ে পড়ল। যিশুর মৃত্যুপরবর্তী প্রথম তিনশো বছরে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার পেল শুধুই লোকমুখে। যিশু অনুগামী ছোট ছোট গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুর আড়ালে কোনমতে নিজেদের টিকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করতে লাগল। এইসময় হেলেনা নামের একটি খ্রিষ্টান মেয়ে কোনওভাবে কনস্টানটিয়াস নামে এক রোমান সিজারের চোখে পড়ে যায়। তাদের বিয়ে হয়। সন্তান হয় যথাক্রমে। এই সন্তান কনস্টানটাইন একদিন রোমান সম্রাট হয়ে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) নামের শহরের পত্তন করলেন ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে। আজকের যুগের হিসেবে কনস্টানটাইনকে সেকুলার বলা চলে। তাঁর রাজ্যে খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক উভয় জনগোষ্ঠীই তাদের ধর্ম পালনের অনুমতি পেল।
তবে কনস্টানটাইনের আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই গোটা এশিয়া মাইনর জুড়ে ক্রিশ্চান হত্যা থেমে গেল এমন ভাবার কারণ নেই। কাপাদোচিয়া আসার রাস্তায় আমরা ঘুরে এসেছিলাম হিয়েরোপলিস থেকে। খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতকে তৈরি এই বাইজান্টাইন শহরে কিছু প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। তখন থেকেই এই শহর লাক্সারি রিসোর্ট হিসেবে বিখ্যাত। এই শহরে খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতকে উল্টো করে ঝুলিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল সেন্ট ফিলিপকে। সেই জায়গায় পরে তৈরি হয়েছে যে চার্চ, সেখানে ঘুরে এসেছি আমরা। আধুনিক চার্চের থেকে গঠনশৈলীতে বেশ আলাদা। একটি খোলামেলা অষ্টভুজাকৃতি মন্দিরের মত সেই চার্চ। খিলানের গায়ে নকশায় বৃত্তের মধ্যে ক্রস চিহ্ন। এই ক্রস আধুনিক ক্রসের মত নয়, যার একটি বাহু অন্যটির চেয়ে বড়। এখানে দুটি বাহু পরস্পরকে সমদ্বিখণ্ডিত করেছে। উৎসাহীরা ‘গ্রিক ক্রস’ নামে খুঁজে দেখতে পারেন। খ্রিষ্টধর্মের সেই তরুণ অধ্যায়ে এই ক্রস বহুল ব্যবহৃত হত। সেই সময়েই রোমান শাসকের চোখ এড়াতে ছোট ছোট খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী কাপাদোচিয়ায় হিটাইটদের (মতান্তরে ফ্যারেঞ্জিয়ান) ফেলে যাওয়া গুহাবাড়িতে থাকতে শুরু করে। নিজেরাও বানিয়ে নেয় নতুন থাকার জায়গা। গোরেমে গ্রামে তৈরি হয় একাধিক মনস্টারি। পাথুরে এই অঞ্চল চাষবাসের জন্য খুব একটা উপযুক্ত ছিল না। তাই আত্মগোপন হয়েছিল সহজ। তার ওপর যিশুর শিক্ষা অনুসারে দারিদ্র, সংযম, কষ্টসহিষ্ণুতা এসবই ছিল ঈশ্বরকে পাওয়ার মাধ্যম। প্রথম যুগের সেই খ্রিষ্টানরা এই জীবনযুদ্ধকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবেই নিল। মাটির নিচে গড়ে উঠল আস্ত শহর। গোরেমের চার্চগুলো ভরে উঠল সহজিয়া নকশায়। পাঁচশো বছর পরের খ্রিষ্ট উপাসনাস্থলগুলোর চেয়ে এই চার্চের চরিত্র একেবারেই আলাদা। কিছু কিছু নকশা আজও টিকে আছে দেড় হাজার বছরের রোদজল সয়ে।
৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একশো বছর হল পৃথিবীর নবতম ধর্মটির জন্ম হয়েছে। এটিও আব্রাহামের অনুসারী একেশ্বরবাদী। নতুন এই ধর্মের নাম ইসলাম, যার অর্থ ‘সমর্পণ’। মহম্মদ এই ধর্মের নবী। জীবন্ত কোন প্রাণীর ছবি আঁকা এই ধর্মে নিষিদ্ধ। ৭৩০ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে বেশ কয়েকবারের মুসলিম আক্রমণে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত। উপরন্তু থেরা দ্বীপে (বর্তমান সান্তোরিনি) একটি আগ্নেয়গিরিতে হঠাৎ করেই অগ্নুৎপাত শুরু হয়েছে। এসব দেখে সম্রাট তৃতীয় লিওর ধারণা হল ভগবান রুষ্ট হয়েছেন এবং তিনি জীবন্ত প্রাণীর ছবি আঁকাকে সেই রোষের কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। বাইজান্টাইন চার্চগুলো যিশুর জীবনের নানা ঘটনা এবং সম্রাটদের চার্চে প্রণামী দেওয়ার মুহূর্তগুলোকে মোজাইক ও ফ্রেস্কোর মাধ্যমে চিত্রিত করার জন্য বিখ্যাত। লিওর আদেশে সব ছবি নষ্ট করে সেই জায়গায় ক্রশ আঁকা হল। কাপাদোচিয়ার লোকবিবর্জিত গণ্ডগ্রামেও রাষ্ট্রীয় আদেশে মানুষের প্রতিমূর্তি আঁকা বন্ধ হল। তবে সেও কিছুকালের জন্য।
ইতিমধ্যে কাপাদোচিয়ার রাজনৈতিক চালচিত্রে পরিবর্তন এসেছে। প্রবল পরাক্রান্ত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে কনস্ট্যান্টিনোপলের গণ্ডিতে। আনাতোলিয়ায় রাজত্ব করছে সেলজুক তুর্কিরা। ১০৮০ সালে সেলজুক সুলতান সুলেইমান শাহ কোনিয়ায় সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। এই সেই কোনিয়া যেখানে জন্ম নেবেন সুফিসাধক মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি। কাপাদোচিয়া আসার পথে আমরা ছুঁয়ে এসেছি রুমির সমাধিও। সেলজুক রাজারা পরধর্ম সহনশীল ছিলেন। অনেক মসজিদ, অনেক মাদ্রাসা, অনেক ক্যারাভ্যানসরাই তৈরি হল আনাতোলিয়া জুড়ে। কিন্তু কাপাদোচিয়ার চার্চগুলোর গায়ে আঁচড় লেগেছিল এমন তথ্য নেই। বরং বাকি পৃথিবী যখন একটার পর একটা ক্রুসেডে মেতে আছে, সেই একাদশ-দ্বাদশ শতক জুড়েই নতুন নতুন ফ্রেস্কো আঁকা হচ্ছে কাপাদোচিয়ায়। অন্ধকার চার্চে টিমটিমে আলোয় দেখতে পাই সেই রঙ আজও অম্লান। ছবি তোলা নিষিদ্ধ – সে মনে হয় ভালোর জন্যই। চার্চের বাইরে যেটুকু ফ্রেস্কো আছে, অথবা যেসব চার্চে ছবি নেই শুধু সেখানেই ক্যামেরা বার করা যায়। একটি চার্চের বাইরে ছবি ছিল যিশু কোলে মেরি এবং দুই অ্যাপোস্টলের। তাদের চোখ খুবলে নেওয়া। মনে পড়ে গেল, এ জিনিস মিশরে দেখেছিলাম আইসিস মন্দিরে। মন্দিরের দেওয়ালে দেবীর ছবির চোখ তুলে নেওয়া হয়েছে। কখনও পুরো মুখই বিকৃত। সেখানে জেনেছিলাম পৌত্তলিক মিশর যখন সবে একেশ্বরবাদী খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নিচ্ছে তখন স্থানীয় মানুষেরা এই কাজ করত। তারা তখনও বিশ্বাসের দোলাচলে। নতুন ধর্ম গ্রহণ করার জন্য পুরোনো দেবী রেগে গিয়ে কোন ক্ষতি করবেন কিনা তা নিয়ে ভয় তাদের মনে। তারা তাই দেবীর চোখ খুবলে নিয়ে ভাবে দেবী আর দেখতে পাবেন না। গোরেমের খোবলানো যিশুমুখও সম্ভবত বিশ্বাসের দুনৌকোয় পা দিয়ে চলা কিছু মানুষের কীর্তি।
দুপুরের দিকে গেলাম ওজকোনাক নামের মাটির তলার শহরে। মাটির তলার শহর এই অঞ্চলে আরো আছে। কায়ামাকি, দেরিনকুয়ু – এগুলো সবই বয়েসে সমসাময়িক। বিপদের সময় বটগাছের কোটরের মত আশ্রিতকে লুকিয়ে রাখাই এদের কাজ। দেরিনকুয়ুতে নাকি কুড়ি হাজার লোক লুকিয়ে থাকতে পারে। ওজকোনাকে দেখলাম এক বিশাল গোল পাথর সুড়ঙ্গমুখের পাশে রাখা। এই পাথর ব্যবহার হত দরজা হিসেবে। প্রথমেই গবাদি পশু ও ঘোড়া থাকার জায়গা। তারপর শুরু হয়েছে মূল শহর। শহর না বলে হয়ত আধুনিক গেটেড অ্যাপার্টমেন্ট কমিউনিটি বললে বুঝতে সুবিধে হবে। মাটির ওপরে এরকম একটা জায়গায় যা যা থাকা উচিত তার প্রায় সবই মজুত। সবাই রান্না করবে এমন রান্নাঘর, ওয়াইন বানানোর চৌবাচ্চা, চ্যাপেল, নিজস্ব শোবার ঘর – কিছুই বাদ নেই। দেরিনকুয়ুতে একটা স্কুলও আছে। আমাদের গাইড রজবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম বাথরুম আছে কিনা। সে বলল নিচের তলায় তাও রয়েছে। কিন্তু রিস্টোরেশনের কারণে সে জায়গা বন্ধ। বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতের জন্য টানেল রয়েছে। মাঝে মাঝে সে টানেল খুবই সংকীর্ণ। একটা জায়গা পেরোতে হল হামাগুড়ি দিয়ে। মনে পড়ে, সেই হামাগুড়ি পর্বের শেষে একটুকরো প্রশস্ত জায়গা অপেক্ষা করে ছিল যেখানে এসে দাঁড়াতেই এক ঝলক টাটকা বাতাস এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিল। ভেন্টিলেশনের জন্য এমন সব আশ্চর্য ব্যবস্থা করা আছে সবকটা শহরেই। আর আছে প্রতিটির সংলগ্ন কুয়ো। হবে নাই বা কেন! শুধু সেই প্রথম যুগের পৌত্তলিক শাসকের ভয় তো নয়! বারবার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে মাটির তলার এই শহরগুলোতে। চতুর্দশ শতকে তৈমুর লঙের আক্রমণের সময়, পরবর্তীতে অটোমান সুলতানদের খামখেয়ালিপনা থেকে নিজেদের বাঁচাতে, এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও আর্মেনিয়ান ক্রিশ্চানরা ব্যবহার করেছে এই সুড়ঙ্গপথ।
এখন এইসব শহর, গোরেমের চার্চ, বলাবাহুল্য, পরিত্যক্ত। তুরস্কের সরকার অবশ্য যত্নসহকারেই রক্ষা করছেন তাঁদের সহস্রাধিক বছরের ইতিহাস। চার্চগুলো এবং বড় বড় গুহা শহরগুলো মিউজিয়াম হয়েছে। বেশ কিছু গুহাবাড়িতে হোটেল হয়েছে, রেস্তোরাঁ হয়েছে। কিছু বাড়ি ধনী মানুষেরা কিনে রেখেছে ছুটি কাটানোর জন্য। এইসব বাড়িতে বিংশ শতকের শুরুতেও যেসব মানুষ থাকত তারা ছড়িয়ে পড়েছে নানা জায়গায়। বেশিরভাগই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। ১৯২৩ সালে গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে নাগরিক বিনিময়ের চুক্তি হয়। বারো লক্ষ আনাতোলিয়ান ক্রিশ্চান চলে আসতে বাধ্য হয় গ্রিসে। সাড়ে তিনলাখ মুসলিম গ্রিককে যেতে হয় তুরস্কে। ভারত-পাকিস্তান ভাগের মতই এই চুক্তিও কেবলমাত্র ধর্মভিত্তিক। ভাষাভিত্তিক বা জনগোষ্ঠীভিত্তিক নয়। ১৯২৩ সালে ইস্তাম্বুল এই চুক্তির বাইরে ছিল। কিন্তু পরবর্তী আট দশকে ইস্তাম্বুলের ক্রিশ্চান জনসংখ্যাও একত্রিশ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে প্রায় শূন্যতে। তবে ভরসার কথা এই, আটানব্বই শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী থাকা সত্ত্বেও তুরস্ক এখনও সেকুলার রাষ্ট্র। যদিও কতদিন তা বজায় থাকবে জানা নেই। কাপাদোচিয়ার নরম আগ্নেয় পাথর সাড়ে তিনহাজার বছর ধরে বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে এখন মহিমান্বিত জাদুঘরের সম্মান পেয়েছে। তা বলে বাস্তুচ্যুতির যুগের অবসান হয়নি। কখনও ঘুপচি ভ্যানে, কখনও নড়বড়ে নৌকোয় রাষ্ট্রের সতর্ক নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে মানুষের স্রোত ভেসেই চলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। কখনও সে কূল পায়। সব কিছু হারিয়ে, শুধু প্রাণটুকু নিয়ে অন্য দেশে এসে ওঠে। কখনও তার লাশ মাটির উত্তাপটুকুর আশায় কাঙালের মত জড়িয়ে ধরে বেলাভূমি। তবু মানুষের স্বপ্ন অপার। এক জীবনে অজস্র জন্মকে সে দেখে যেতে চায়। তার সেই দর্শনের সুষমা বোতলবন্দি করে ফেলে রেখে যায় ভবিষ্যতের জন্য। কে জানে কোন উত্তরসূরী কোন আগামীতে তার সযত্নঅর্জিত অনুভবের আশ্রয় নেবে! সেই দিনটিকে সামনে রেখে মানুষ পাথর কেটে চলে।
প্রথম প্রকাশঃ https://bengali.indianexpress.com/travel/cappadocia-istanbul-travelogue/
Sunday, March 25, 2018
অমার্জিতের অধিকার
আজ থেকে বছর পঁচিশ আগেও মফস্বল শহরগুলো অন্যরকম ছিল। তখন সাজগোজ বলতে চোখের তলায় কাজল, হাল্কা লিপস্টিক আর কপালে টিপ। প্রায় সব কিশোরীরই তখনও লম্বা ঢালা চুল থাকত। ভেজা চুলের নিচের দিকে আলগোছে বিনুনী বেঁধে তারা ইশকুলে যেত। মায়ের অত্যাচারে অথবা কারো কারো ক্ষেত্রে নিজের শখেই মুসুরডাল বাটা কি দুধের সরের প্রলেপ পড়ত মুখে মাঝেসাঝে। এর চেয়ে বেশি কেউ করতও না। যারা করার কথা ভাবত তাদের যেন একটু দূরেই সরিয়ে রাখা হত। যে রূপচর্চা করে তার লেখাপড়ায় মন নেই এমন নিদান দেওয়া একেবারেই বিরল ছিল না। আমার জীবনও এভাবেই চলছিল। পরিবারের সদ্য বিয়ে হয়ে আসা যুবতীটির নিখুঁত ভ্রূযুগল দেখে কখনও হয়ত ইচ্ছে জাগত নিজেরটিও অমন হোক। কিন্তু সে ইচ্ছা আর বাস্তবের মাঝে "সাজগোজে মন চলে গেছে, এর আর লেখাপড়া হবে না" জাতীয় মন্তব্যের উঁচু দেওয়াল থাকত। তখন ভাবতাম, শুধু মফস্বলের বাংলা মিডিয়ামেরই বুঝি এমন কপাল পোড়া। কলকাতার কলেজে পড়তে এসে বেশির ভাগ সহপাঠিনীর অসংস্কৃত ভুরু দেখে সে ব্যাথার খানিক উপশম হল। লম্বা বিনুনী, তেলতেলে মুখ, এবড়োখেবড়ো ভুরু আর লোমশ হাত-পা নিয়েই কলেজ জীবন পেরিয়ে গেল। এমনকি প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রেও এই অমার্জিত রূপ বিশেষ বাধার সৃষ্টি করেছিল সেরকম খবর নেই।
অবস্থা বদলালো মুম্বইতে এসে। যোগেশ্বরীতে ফাইজারের অফিসে যাচ্ছিলাম মাস্টার্স থিসিসের কো-অ্যাডভাইসারের সাথে দেখা করতে। লেডিস কম্পার্টমেন্টে সাঙ্ঘাতিক ভীড়। কোনমতে একটি ঝুলন্ত হ্যান্ডেলের অংশবিশেষ পাকড়াতে পেরেছি। আমার হাতের পাশে হ্যান্ডেলের ভাগীদার আরো গোটা পাঁচেক হাত। প্রতিটি হাত নির্লোম, মসৃণ। তাদের পাশে আমার হাতটি রোঁয়া ওঠা খসখসে কম্বলের মত বিসদৃশ। খুব ইচ্ছে করে হাতখানা সরিয়ে নিতে। নিজেকে জোরে ধমকাই। চেপে ধরি হ্যান্ডেল। মাথার ভিতরে দুই দৈত্যের লড়াই শুরু হয়। একজন বোঝাতে চায় মানুষের গায়ের লোম কোন অস্বাভাবিক জিনিস না, বরং তার অনুপস্থিতিই কৃত্রিম। অন্যজন ঝগড়া করে, হোক কৃত্রিম, তবু তা সুন্দর। সে যুধিষ্ঠিরের মুখে দ্রৌপদীর রূপবর্ণনার উদাহরণ দেয়। মেয়েদের নির্লোম শরীরের প্রশস্তি কোন নব্যযুগের বৈশিষ্ট্য না, এ হয়ে আসছে চিরকাল। প্রতিপক্ষ পাল্টা যুক্তি সাজায়। সে বলে মহাকালের নিরিখে দুতিনহাজার বছর নেহাতই ছেলেমানুষী। নির্লোম নারী যদি প্রকৃতির বিধান হত, তাহলে বিবর্তনের নিয়মেই তার শরীর থেকে ঝরে যেত সব অতিরিক্ত চুল। যাকে বলে সে নিয়ম বোঝে না। সে জানে নারীর নির্লোম ত্বক আকাঙ্খিত। এই আকাঙ্খাও বিবর্তনের সহকারী নয় কি? কূটতত্ত্বে কাল কাটে। স্টেশন এসে যায়। ঘরে ফিরি।
ফোর্থ সেমেস্টারে পরপর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ হতে থাকে। শুধু সাবজেক্ট জানলে চলবে না, গুছিয়ে কথা বলতে হবে। আরো একটা কথা শিখলাম "প্রেজেন্টেবল"। নিজেকে প্রেজেন্টেবল করতে হবে। মফস্বলের স্কুলে, কলকাতার কলেজে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলে সবাই মাথায় তুলে নেচেছে। পরীক্ষার নম্বরটুকু যে কর্পোরেট স্কিলসেটের পঞ্চাশ শতাংশও নয় তা তো কেউ বলে নি। যাঁরা বলার জন্য ছিলেন, তাঁরা নিজেরাও জানতেন না এমনও হতে পারে। প্রেজেন্টেবল হওয়ার আশায় প্রথমবারের মত ফেসিয়াল আর ওয়াক্সিং করিয়ে এলাম। চাকরী হল। মেধার জন্য হল, এমনটাই ভাবতে ভালো লাগে। সেদিনের মসৃণ হাতটির বদলে লোমশ অনারীসুলভ হাতখানি থাকলে বিচারকের সিদ্ধান্তের বদল হত না, এমনটাই হয়ত আমরা সকলেই আশা করি। কিন্তু পরীক্ষা করার সাহস হয় না। কাজে যোগ দেয়ার পর একটাও পরিচর্যাহীন মহিলা হাত দেখি নি, তাই কি?
তারপর তো কত দেশ দেখলাম। কত শহর ঘুরলাম। বুকে পুষে রাখা মফস্বল আমায় কিছুতেই শর্টস পরতে দিল না। কিন্তু শর্টস পরা সাদা, কালো, হলুদ, বাদামী মেয়েও কিছু কম দেখলাম না তা বলে! যেটা দেখলাম না, তা হল শর্টস পরা অনাদৃত পা। জাতি-বর্নভেদে মানুষের শরীরে লোমবাহুল্য বা লোমহীনতা হয় জানি। তবু প্রতিটি শর্টস পরা নারীই প্রাকৃতিকভাবে নির্লোম এমনটা তো হওয়া অসম্ভব। অথচ এই অসম্ভবকেই পেতে দেখি স্বাভাবিকতার তকমা। ইতিহাস খুঁড়ে দেখা যাচ্ছে একসময় ঝিনুকের খোলা, ঝামা পাথর, লেবু মেশানো গাঢ় চিনির রস ব্যবহার হত অবাঞ্ছিত লোমমুক্তির জন্য। তবে এর ব্যবহার ছিল অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে সীমিত। মেয়েদের প্রথম রেজার যদিও বিংশ শতকের প্রথম ভাগেই এসে গেছে, নির্লোম পায়ের প্রবণতা ব্যাপক হারে জন্ম নিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধের কারণে প্রচুর পরিমানে নাইলনের প্রয়োজন পড়ল দড়ি বানানোর জন্য। সেই নাইলনের জোগান দিতে গিয়ে হাত পড়ল মেয়েদের স্টকিংসে। উন্মুক্ত পায়ে মসৃণ স্টকিংসের এফেক্ট আনতে মেয়েরা সেসময় পায়ে মেকআপ করত। চল্লিশের দশকেই এসে গেল মেয়েদের ইলেকট্রিক রেজার। ষাটের দশকে জনপ্রিয় হল ওয়াক্সিং। তারপর সারাজীবনের মত মসৃণ ত্বকের প্রতিশ্রুতি নিয়ে চলে এল লেজার টেকনোলজি। প্রতিটি পদ্ধতিই সময়, খরচ ও যন্ত্রণা সাপেক্ষ। মেয়েলী আড্ডায় উঠে আসে এইসব নির্লোম হাত, পা, বাহুমূলের যন্ত্রণার গল্প। কখনও নারী ভালোবেসে নিজেকে নির্লোম দেখতে চায়, নিজের ভ্রূজোড়া নিখুঁত বাঁকা করতে চায়। কখনও করে দায়ে পড়ে। পাঁচটি হাতের চারটিই একটি বিশেষ সৌন্দর্যের সংজ্ঞায় বিশ্বাসী হলে পঞ্চম হাতটির সামনে খোলা থাকে দুটি পথ। সে নিজের ইচ্ছায় চলতে পারে বাধাবন্ধহীন, বন্ধুমহলের ফিসফাস, টীকা-টিপ্পনি উপেক্ষা করে। অথবা তাকে নিজেকে বদলাতে হয়, অন্যের ঠিক করে দেওয়া মাপকাঠি অনুযায়ী সমাজ স্বীকৃত স্বাভাবিক হয়ে উঠতে হয়। আমেরিকান লেজার সেন্টারসের একটি সার্ভে অনুযায়ী একজন আমেরিকান মহিলা অবাঞ্ছিত লোম থেকে মুক্তির জন্য মাসে $১৫.৮৭ খরচ করে। নির্লোম ত্বকের সামাজিক চাপ থাকলেও মেয়েরা কিন্তু অতিরিক্ত বেতন পায় না এই চাপ সামাল দিতে।
আমার সেই পুরোনো মফস্বল শহরে প্রথম যখন পা ওয়াক্সিং করাতে চেয়েছিলাম, বিউটি পার্লারের দিদি বলেছিল, পা করাচ্ছো কেন? তুমি কি স্কার্ট পর? জীবন গিয়েছে চলে দেড় দশকের পার। সেই মফস্বলে ফুল বডি ওয়াক্সিং এখন কোন নতুন কথা না। ভ্রূ পরিচর্যা করতে ছাত্রীরা আর ভয় পায় না। কাজল আর লিপস্টিক দিয়েই মেকাপ সারা শুনলে এখন সবাই হাসবে। মেয়েরা নিজের খুশিতে সাজে, নিজের যা ইচ্ছে পরে এসব ভালো ভালো জিনিসের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করে আমার মনে। মুম্বইয়ের ট্রেনের সেই দুই দৈত্য এখনও একই মাথায় সহাবস্থান করে। একজন বলে, দেখেছ মেয়েটা কেমন পিতৃতন্ত্রের চোখ রাঙানীর তোয়াক্কা না করে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে! ওর জামার ঝুল হাঁটুর ওপরে থেমেছে, বাহুমূল অনাবৃত। ওর শরীরের ওপর একা ওরই অধিকার। অন্যজন বিষন্ন হয়। এলোমেলো, বেপরোয়া ভাবের নিচে সযত্ন পরিকল্পনা তার নজর এড়ায় না। এর একান্ত অধিকারের শরীরটা সেজে উঠেছে কার ইচ্ছায়? কার তুষ্টিতে? কার ঠিক করে দেওয়া মাপে? গরম মোমলাগানো কাপড় চেপে ধরে তার ত্বক থেকে যখন অনাকাঙ্খিত চুল উপড়ে ফেলা হয় সেই যন্ত্রণা সে কি হাসিমুখে সয়? সকলেই কি হাসিমুখে সয়?
প্রথম প্রকাশঃ http://www.guruchandali.com/default/2018/03/25/1521946224274.html#writehere
Friday, January 26, 2018
খারাপ মেয়ে
বাঙালীর "খারাপ মেয়ে" সুপ্রিয়া দেবী চলে গেলেন। "শুভবিবাহ", "মেঘে ঢাকা তারা", "মন নিয়ে"র মত ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের পরেও মানুষের স্মৃতিতে তিনি ছিলেন শুধু সেই মেয়ে যার জন্য মহানায়কের সুখের সংসারে ভাঙন ধরেছিল। মজার বিষয়, সেই একই সম্পর্কে জড়িত পুরুষটিকে নিয়ে মানুষ কিন্তু কোনকালেই খুব একটা ক্রিটিকাল ছিল না। বাঙালীর চোখে পুরুষটি ছিলেন এক অসহায় স্বামী যিনি একটি মেয়ের ফাঁদে পড়েছিলেন। এই সমস্ত ঘটনাই যদিও আমার জন্মেরও আগে, তবু এর আঁচ পেতে আমার প্রজন্মের ছেলেমেয়েদেরও অসুবিধে হয়নি কারন নারীটি আমাদের কিশোরবেলায় লিখছিলেন তাঁর আত্মজীবনী "আমার জীবন, আমার উত্তম"। তিনি কেন "আমার উত্তম" বলবেন তা নিয়ে অসন্তোষ, তাঁর "আপনাদের দাদা" বলা নিয়ে বিদ্রুপ - এসবের মধ্যে দিয়েই আমরা বড় হয়ে উঠলাম। তিনি বিবাহিত স্ত্রী হলে এসব কিছুই বলা হত না এতে আমি নিশ্চিত। শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল "মহানায়ক" নামের টিভি সিরিয়াল। নারীটির আদলে একজন অবাস্তব খলনায়িকা তৈরী করে তারা তাঁকে মাথা মুড়িয়ে, ঘোল ঢেলে সমাজের বাইরে পাঠিয়ে দিল। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অর্ধেক তখন "সিরিয়াল দেখিনা" বলে পাশ ফিরে শুয়ে ছিলেন, বাকি অর্ধেক বোধকরি নিজেদের চাকরী বাঁচাতে ব্যস্ত। আয়রনি হল, আজ তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে আমিও তো তাঁর উত্তম-অধ্যায় নিয়েই লিখছি। তাঁর অভিনয় প্রতিভা নিয়ে কিছু বলা ধৃষ্টতা, তবু উত্তম পরবর্তী যুগে তাঁর পারফর্ম্যান্স দেখে সন্দেহ জাগে তিনিও হয়ত ভালো অভিনেত্রী হওয়ার চেয়ে ভালো ঘরনী হওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলেন। নইলে "শুভবিবাহ", "মেঘে ঢাকা তারা", এমনকি "শুন বরনারী"র পরে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের কথা ভাবতে গেলেই কেন অতিরিক্ত মেক`আপ করা, কৃত্রিম বাচনভঙ্গীর এক অভিনেত্রীকে মনে পড়ছে যার সাথে একই মানুষের আগের কাজের কোন সাযুজ্য নেই! অবিশ্বাসী তো "যেখানে গেছেন ভালো থাকুন" জাতীয় অলীক আশ্বাস দিতে পারে না; অবিশ্বাসী বরং বলছে - বাংলা ছবির শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যিনি এসেছিলেন, অথচ মানুষ যাঁকে মহানায়কের অবৈধ সঙ্গিনী ও ভালো রাঁধুনীর বেশি মর্যাদা দিল না, এমনকি যিনি নিজেও নিজের ওপর বিশ্বাস বজায় রাখতে পারলেন না, পূর্বমানুষ ও সহমানুষদের এই মূঢ়তার জন্য সে ক্ষমাপ্রার্থী। অবিশ্বাসী ভাবে, আসবে কি এমনদিন যেদিন মেডুসার চুলে সাপের ফণা দেখার সংস্কৃতি থেকে মানুষ বেরোবে!
Thursday, January 4, 2018
বিহারী বাবুকা বাংলো
সেটা সাতানব্বই সাল। উচ্চমাধ্যমিকের বছর। আমার বাবা-মা ছিয়াত্তর সাল থেকে শিমূলতলা যেতে শুরু করেছিলেন। জাঁদরেল কোন ট্রিপ না থাকলে প্রতি বছরের পুজোর ছুটি আমাদের শিমূলতলাতে কাটত। সেবারেও ব্যতিক্রম নয়। মধুরাশ্রমে মোহন মালির আতিথ্যে আছি। বাবার অ্যাকাডেমিক সিনিয়র কমলজ্যেঠু আর তাঁর স্ত্রী বীথি জ্যেঠিমাও সেবার শিমূলতলাতে একই বাড়ির সামনের অংশে। লক্ষ্মীপুজোর দিন দিদার বাড়িতে ফোন করতে দিদা বলল, ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে দিদানের পরীক্ষার চিঠি এসেছে। সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা। তোমরা এক্ষুনি ফিরে এসো। মফস্বলের মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ব্রেবোর্ণে পড়তে গিয়ে ইংরিজি বলতে না পারার জন্য কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিত হয়েছিলাম। পরীক্ষার পরের ছুটিটায় তাই ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্পোকেন ইংলিশ কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম ইংরিজি শেখার আশায়। শিক্ষা বিশেষ হয়েছিল বলতে পারিনা, উপরন্তু পরীক্ষার চোটে পুজোর ছুটিটাও তারা বানচাল করে দিল। বাবা-মাও শিমূলতলা ছেড়ে ছুটির মাঝে বৈদ্যবাটি গিয়ে থাকতে হবে এই ভাবনায় নিরাশ। শুধু ভাই খুব খুশী। শিমূলতলার ইলেকট্রিক লাইট বর্জিত সন্ধ্যেগুলো সে খুব অপছন্দ করত। বাড়ি ফেরার সম্ভাবনায় তার আনন্দ বাঁধ মানে না। তবে বাবা-মা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়। তারা ঠিক করল, কমলজ্যেঠুর ঘরে মালপত্র রেখে আমাদের দুই ভাই-বোনকে দিদার বাড়ি রেখে আবার ফিরে আসবে শিমূলতলায়। এই ব্যবস্থা যাকে বলে উইন-উইন সিচুয়েশন। দিদা খুশী, মামা-মামীমা খুশি, আমরা খুশী, বাবা-মাও খুশী। সবাই মিলে একসাথে খুশী হওয়ার মত ঘটনা শুধু সেকালে কেন, কোনকালেই খুব একটা ঘটে না। আমরা অমৃতসর মেল ধরে বিনা রিজার্ভেশনে চলে এলাম। দিদার বাড়ি এক রাত থেকে মা-বাবা আবার ফিরবে শিমূলতলায়।
কুম্ভলগড়ের সাধু
১৯৯২ এর পুজোর ছুটিতে রাজস্থান যাওয়া হল। পঞ্চমীর দিন স্কুল ছুটি হয়ে বেরোনো। ফেরা ভাইফোঁটা কাটিয়ে স্কুল খোলার আগের দিন। ইন্ডিয়ান রেলে সার্কুলার টিকিট বলে একরকম টিকিট পাওয়া যায়। আগে থেকে কোথায় কোথায় থামা হবে প্ল্যান করে রেলওয়েকে জমা দিতে হয়। শুরু এবং শেষের স্টেশন এক হতে হবে - এই হল শর্ত । একমাস বা চল্লিশ দিন - এইরকম কিছু একটা সময়ের জন্য ভ্যালিড থাকে এই টিকিট। একসময় ইউরোপে ঘোরাঘুরির জন্য ইউরোরেলের খোঁজখবর নিয়েছিলাম। সেখানেও আছে এমন ব্যবস্থা।
Tuesday, January 2, 2018
নামহীন
কাল একটা সিনেমা দেখলাম। সিনেমার নাম আফটার ইমেজ। পোলিশ সিনেমা। অ্যাশেস অ্যান্ড ডায়মন্ড খ্যাত আন্দ্রে ওয়াজদার শেষ কাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পোল্যান্ডে যখন কমিউনিস্ট শাসন, সেই সময়ে একজন শিল্পীর স্বাধীন চেতনাকে কিভাবে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির সাথে এক ছকে বেঁধে ফেলার জন্য চাপ দেওয়া হয়, এবং সেই শিল্পী রাষ্ট্রীয় নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে অস্বীকার করলে কিভাবে তাকে ধীরে ধীরে শেষ করে দেওয়া হয় তা নিয়ে গল্প। চেনা গল্প হলেও পরিচালনার গুণে বেশ ভালো লাগল দেখতে। তবে আজকে সিনেমার গল্প লিখতে বসিনি। বরং সিনেমাটা যে রেকমেন্ড করেছে তার কথা লিখি।