মাছ খেতে যে আমি বাস্তবিকই ভালোবাসি সেটা বুঝেছিলাম দেশ ছাড়ার পর। বাড়িতে সব রকমের মাছ খাওয়া হলেও রোজকার মাছ বলতে রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি কার্প গোত্রের মাছই আসতো। আর দুর্ভাগ্য বশত এই মাছগুলো চল্লিশ বছর ধরে খেয়েও আমি ভালোবাসতে পারি নি। বর্ষাকালে মা বাজেট মানতো না। ইলিশ আসতো ঘনঘনই। পাবদা, ট্যাংরা, পার্শে ইত্যাদি মুখোরোচক স্বাদের ছোট মাছ হয় বাজারে নিয়মিত পাওয়া যেত না অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারে রোজ কেনার ক্ষমতা ছিল না - কিছু একটা হবে। গুরজালি, আড়, বোয়াল, শোলের মত বড় মাছ বরং সেই তুলনায় বেশি আসতো। তা সত্বেও মাছের চেয়ে মাংসের দিকে ঝোঁক বেশি ছিল। এমন কি মুরগীর মাংসও ভালো লাগতো সে সময়। সাধে কি বলি, সে ছিল অন্য জন্ম!
তারপর এক সময় আমেরিকা চলে এলাম। আমেরিকার বাঙালীদের সাথে বাংলাদেশী দোকানে মাছ কেনাও অভ্যেস হল। লোটে, কাজলী, কাচকি এসব মাছ আমি সেই প্রথম দেখলাম। ফরিদপুরের উত্তরাধিকার যে রক্তে বহন করছি তার পরিচয়ও পেলাম যখন নিজে নিজেই কাচকি মাছের রেসিপি আবিষ্কার করে ফেললাম। প্রথম বার ইলিশের কালোজিরে কাঁচালঙ্কার ঝোল রেঁধে দেখলাম সর পড়ল না। তখন নিজেই বুদ্ধি করে বেগুন, কুমড়ো বা কচু দিয়ে রাঁধতে শুরু করলাম। সদ্য রাঁধুনির আনাড়িপনা ঢাকা পড়ে যায় এসব যোগ করলে।
প্রথম কিছুদিনের আড়ষ্টতা কাটলে আমেরিকান সুপার মার্কেট থেকেও মাছ কিনতে শুরু করলাম। তবে সুপার মার্কেটের মাছ মূলত ফিলে হিসেবে বিক্রি হয়। হাড় ছাড়া মাংসের মতো কাঁটা ছাড়ানো মাছেও তৃপ্তি নেই। তবু বাংলাদেশী দোকানের বরফের মাছের তুলনায় এ মাছ টাটকা। স্বাদ তাই একটু বেশি।
কাজাখস্তানে দুর্দান্ত ভালো স্যামন পেতাম। সেই মানের স্যামন আমেরিকায় যেসব দোকানে বাজার করি তারা রাখে না। হাফ চামচ তেল দিয়ে কড়ায় বসাতাম। যখন নামাতাম তেল উপচে পড়ত। ওখানেই স্মোকড স্যামন খেলাম প্রথম বার। আর সঙ্গে সঙ্গে যাকে বলে লাভ এট ফার্স্ট বাইট। তবে দুঃখের সাথে জানাচ্ছি ইশিম নদীর নেটিভ মাছ এই টেস্টবাডে সয় নি। বার তিনেক আলাদা আলাদা মাছ নিয়ে এসে খাওয়ার চেষ্টা করে রণে ভঙ্গ দিয়েছি। আশ্চর্যের বিষয় ওরা ফিলেও বেচত না। নিখুঁত কাঁটাওয়ালা মাছ মুখে তোলা যাচ্ছে না। ভাবা যায়!
মেক্সিকোতেও টাটকা কাঁটাসহ মাছ বিক্রি হত সুপার মার্কেটে। বাজারে গেলে নীল কাঁকড়া, মাথাসহ চিংড়ি, কুমড়ো ফুল - কি না মিলতো! আমেরিকায় ফেরত আসার পর মিঠুন যে শহরে থাকতে শুরু করল সেখানে একটি স্বর্গাদপি গরিয়সী চাইনিজ স্টোর ছিল। তারা একোয়ারিয়ামে জীবন্ত তেলাপিয়া আর বাস রাখতো। কমলা ঘিলুওয়ালা চিংড়ি, নীলচে হাঁসের ডিম, তন্বী ফুলকপি - কি না পেয়েছি ওখানে! ফ্রোজেন চাইনিজ মাছও থাকত প্রচুর। মিঠুনের সংশয় অগ্রাহ্য করে কিনে এনেছি এবং ফরিদপুরের উত্তরাধিকার প্রতিবারই মান রেখেছে। ইংইং এর কথা এ প্রসঙ্গে না বললে পাপ হবে। আমার একাডেমিক সিস্টার এই মেয়েটি একটি লক্ষ্মীমন্ত বয়ফ্রেন্ড জুটিয়েছিল যার নেশা ছিল মাছ ধরা। কিন্তু সে মাছ খেতে ভালোবাসতো না। আর ইংইং জানতো না রাঁধতে। সোনার টুকরো ছেলেটা যে কতবার মাছ ধরে, পরিস্কার করে আমায় পাঠিয়েছে!
এবার চাকরি জুটেছে আমেরিকার একটা ছোট্ট গ্রামে। এখানে কোনো চাইনিজ দেবতা নেই। সুপার মার্কেটের চিংড়িগুলো অখাদ্য লাগে। ফিলে করা মাছও তাই। এনিভার্সারির দিন ইলিশ বার করব ভাবছিলাম। গ্রসারী করতে সুপার মার্কেটে গিয়ে গোটা ট্রাউট পেলাম। গ্রিলের অভাবে তাওয়াতেই সেঁকলাম। খেলাম লেবু ছড়িয়ে, অরেঞ্জ সালসা দিয়ে। সাথে র্যাস্পবেরী লিকর মার্গারিটা। আনন্দে চোখে জল এল।
সাথের ছবিটা কাল দুপুরের লাঞ্চের। আগের দিন লাঞ্চ মিসের দুঃখ ভুলতে একটা মাছের দোকান খুঁজে সেখানে গেলাম। ছবিতে যে মাছগুলো দেখা যাচ্ছে তার ইংরিজি নাম সারমুলেট। গ্রীকে বলল কুচোমুড়া। তপসে ফ্রাইয়ের মতো লাগলো। সাথে এক প্লেট বেগুন ভাজাও নিয়েছিলাম। সামনে নীল এজিয়ান দুপুরের চড়া আলোয় স্থানে স্থানে তীব্র রূপোলী।
মাছের সাথে ভালোবাসায় যতই জড়িয়ে পড়ছি ততই বুঝছি ভালো মাছের স্বাদ ঠিকঠাক পেতে গেলে তাতে যত কম মশলা দেওয়া যাবে ততই মঙ্গল। ব্যাটারসহ বা শুধুই নুন মাখিয়ে ভাজা অথবা সেঁকা। খাওয়ার সময় লেবু ছড়িয়ে দিলেই চলবে। যদি আঁশটে গন্ধ নিয়ে সংশয় থাকে তাহলে লেবুর রস বা সামান্য রসুনবাটা মাখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তাহলে বাঙালি মতে রান্না কি বন্ধ? তা নয়। তবে সেখানেও যদ্দুর সম্ভব কম মশলা হলেই ভালো। বাঙালরা সবেতেই কালোজিরে কাঁচালঙ্কা চালাই। সব্জির মধ্যে সীম, বেগুন, বেল পেপার। বিশেষ ক্ষেত্রে ঝিঙে, মূলো, লাউ, কুমড়ো। দয়া করে পেঁয়াজ নয়, যদি না খুব পাকা মাছ হয়। মাছ জিনিসটা এতই স্বাদু ওতে গুচ্ছের পেঁয়াজ রসুন না পড়লেই ভালো। ওগুলো নাহয় মুরগীকে খাদ্যযোগ্য করার জন্য তোলা থাকুক।
No comments:
Post a Comment