About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Friday, September 17, 2010

জুলিয়া

জুলিয়ার সাথে যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল তা কিন্তু নয়। জুলিয়াকে যতদিন ধরে চিনি তার পঁচানব্বই শতাংশ সময়ই আমরা আলাদা টিমে ছিলাম। ও অ্যাকুইজিশন। আমি পোর্টফোলিও। এক প্রোজেক্টে কাজ করারও সুযোগ হয় নি সেভাবে। হলওয়েতে বা রেস্টরুমে দেখা হত। টুকটাক কথা। মাঝেসাঝে এক সাথে লাঞ্চেও গেছি। জুলিয়াকে চেনা এভাবেই। তাও কি করে জানি বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কৃতিত্ব অবশ্য ওরই। এমন মিষ্টি মেয়ে – ভালো না বেসে উপায় নেই।

তখন অ্যান্টনি হবে। কাজের চাপ, শরীরের অবস্থা সব কিছু ভেবেচিন্তে আড়াই বছরের সোফিয়াকে রেখে আসা হল চায়নাতে ওর দাদু-দিদিমার কাছে। ক্যালেন্ডারের পাতায় যেমন পুতুলের মত সুন্দর বাচ্চাদের দেখা যায়, সোফিয়াকে দেখতে একদম তেমনটি। রেস্টরুমে দেখা হলেই জুলিয়ার মুখে তখন সোফিয়ার কথা – জানো, আজ আমার শাশুড়ি ফোন করে বলছে, সোফিয়ার কান বিঁধিয়ে দিলাম, তোমার আপত্তি নেই তো? ভাবো তো, আমার আড়াই বছরের সোফিয়া! ওইটুকু বাচ্চার কান বেঁধালো! আর তারপর কিনা আমাকে জিজ্ঞাসা করছে, আপত্তি আছে কিনা! আপত্তি থাকলেই যেন শুনতো! পরিষ্কার বুঝতে পারতাম সোফিয়াকে আদর করার জন্য জুলিয়ার মনটা ছটফট করছে। ঐ টুকু মেয়ে, কান বেঁধাতে গিয়ে না জানি কত কেঁদেছে। আমরা বলি, জুলিয়া, তুমি ওকে যেতে দিলে কেন? জুলিয়ার মুখ আরও ম্লান হয়। ইচ্ছে করে কি আর মা মেয়েকে ছাড়ে!

তারপর অ্যান্টনি হওয়ার পরেও তো তাকে নিয়ে গেল ওর দাদু-দিদিমা। সোফিয়া তখন ফিরে এসেছিল ওর মা-বাবার কাছে। জুলিয়ার সাথে তখন দেখা হলেই আই-ফোনে অ্যান্টনির ভিডিও দেখাত। এই দ্যাখো, অ্যান্টনির দুটো দাঁত গজিয়েছে। জানো ও কেমন ইন্টেলিজেন্ট! এখন থেকেই সবাইকে চিনতে পারে। কাল ভিডিও চ্যাট করছিলাম, আমাকে দেখে হেসেছে, জানো! আমার মনে হয় ও সোফিয়ার থেকেও তাড়াতাড়ি সব কিছু শিখে যাচ্ছে। সেকেন্ড চাইল্ডরা কি এই রকমই হয়?

তা’বলে ভাবার কোন কারন নেই জুলিয়ার মন সবসময় চায়নাতে পড়ে আছে। ভীষন কাজের মেয়ে জুলিয়া। কখনও অ্যাকুইজিশন নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকলেই জুলিয়ার কাছে গেছি। দেখেছি ওর কাজ কেমন পরিষ্কার, নিখুঁত ভাবে ডকুমেন্টেড। কর্পোরেট জগতে অনেকেই মুখে মিষ্টভাষী হলেও অন্যকে সাহায্য করাটা প্রতিযোগিতার পথে বাধা হিসেবে দেখে। জুলিয়ার মধ্যে সে ধরনের কোন মালিন্য ছিল না। মাসখানেক আগে আমাদের টিম আয়তনে বাড়লো। তখন জুলিয়া আমাদের টিমে এল ক্রেডিট লাইন অ্যাসাইনমেন্টে ওর ছ’বছরের এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে। তখনই নিশ্চয় মনে মনে জানতো যে এই কাজ বেশিদিনের জন্য নয়। কারন, দুই সপ্তাহের মধ্যেই নোটিস এল জুলিয়া চায়নাতে ফিরে যাচ্ছে। ওর ননদের একটা ছোট গারমেন্টসের ব্যাবসা আছে। ওর বর ব্রায়ান ঠিক করেছে দেশে ফিরে গিয়ে বোনের সাথে ব্যাবসাটা বাড়াবে। জুলিয়াও তাই দেশে ফিরছে অ্যামেরিকার পাট চুকিয়ে, দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে, আট বছরের প্রবাসকে পিছনে ফেলে।

জুলিয়ার চলে যাওয়ার খবরে মন খারাপ করার সময়টুকুও পেলাম না। যতদিন জুলিয়ার জায়গায় নতুন কেউ না আসছে ততদিন ওর বেশ কিছু কাজ আমাকে দেখতে হবে। এর আগে লাইন অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করি নি কখনও। একেবারে নতুন জিনিসপত্র। ভালো করে বোঝার আগেই হুড়মুড় করে গাদা খানেক প্রজেক্ট ঘাড়ে চেপে গেল। তখন আবার জুলিয়াকে চিনলাম। কি কাজ করতে হবে, কি রকম পড়াশোনা করতে হবে, এমনকি কি ভাবে ভাবা উচিত নতুন স্ট্রাটেজি নিয়ে – সবকিছু জুলিয়া আমাকে মোটে দু’সপ্তাহের ট্রেনিং-এ বুঝিয়ে দিল। একা আমাকে তো না। আমি আর মাইক – দুজনে মিলে ভাগ করে নেবো জুলিয়ার কাজ – দুজনকেই।

আজ ছিল জুলিয়ার শেষদিন। সকালে কফি নিয়ে ফিরছি, ওর কিউবের মানি প্ল্যান্টটার দিকে চোখ গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তো কেটে পড়ছো, মানি প্ল্যান্টটার কি হবে এখন? ও বললো, তুমি নেবে প্লীজ? – নিতে তো পারি। কিন্তু কি ভাবে পরিচর্যা করবো তা তো জানি না। - কিচ্ছু না, সপ্তাহে একবার জল দিও, তাহলেই হবে। নিয়ে এলাম জুলিয়ার মানি প্ল্যান্টকে নিজের কাছে। প্রথমবারের জলটা জুলিয়াই দিল নিজের হাতে। ওর কাছে শেষবারের মত। সব ফার্নিচার বিক্রি হয়ে গেছে। এখন মেঝেতে স্লিপিংব্যাগ পেতে শুচ্ছে ওরা। সোফিয়া বেচারি কিছুই বুঝতে পারছে না, লোকে কেন ওদের বাড়ি থেকে আজকে সোফাটা, কালকে খাটটা, পরশু টিভিটা নিয়ে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত যখন ওর গোলাপি রঙের মিনির ছবি দেওয়া ডিভিডি প্লেয়ারটাও একজন এসে নিয়ে গেছে তখন খুব কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা। জুলিয়া বলছে, ওকে বললাম চলো আমরা চায়না যাই, তারপর আবার সব হবে আমাদের। সত্যি কি সব হয়! যেমনটি ছেড়ে যেতে হয় ঠিক তেমনটি কি আর কখনও ফিরিয়ে আনা যায়!

দুপুরে লাঞ্চ করলাম একসাথে। জুলিয়া শেষবারের মত মনে করিয়ে দিল, তোমার ফোনটা ইনসিওর করিয়েছ? বলা বাহুল্য, করাইনি। ভুলে মেরে দিয়েছি। আসলে ব্রায়ানের আই-ফোনটা ওদের গতবারের চায়না ট্রিপে হারিয়ে গেছে। এদেশে সার্ভিস প্রোভাইডারের সাথে কনট্রাক্টে থাকলে খুব সস্তায় ফোন পাওয়া যায়। কিন্তু কনট্রাক্টের বাইরে ফোনের ভীষন দাম। ব্রায়ানের ফোনে লস্ট অ্যান্ড স্টোলেন ইনসিওরেন্স ছিল না। তাই ফোন হারানোর পর ওকে প্রচুর দাম নিয়ে নতুন ফোন কিনতে হয়েছে। তারপর থেকেই জুলিয়া আমাদের বলে যাচ্ছে ফোন ইনসিওর করিয়ে নেওয়ার জন্য। আমি যথারীতি ল্যাদ খেয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই করা হয়ে উঠছে না কাজটা। তবে এবারে করে ফেলতে হবে। জুলিয়া তো আর থাকবে না মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।

যাওয়ার আগে যেটা করল তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। জুলিয়ার টেবিলে একটা বানি ছিল, একটা মিষ্টি মত খরগোস ছানা একটা ছোট ঝুড়ি ধরে আছে বুকের কাছে। ঝুড়িটাকে পেনস্ট্যান্ড বা সেল-ফোন হোল্ডার হিসেবে ব্যাবহার করা যায়। জুলিয়ার কাছে যখনই যেতাম বানিটার লম্বা লম্বা তুলতুলে কানে একটু আদর করে দিয়ে আসতাম। বেলা তিনটে নাগাদ, জুলিয়ারই কাগজপত্রগুলো তখন আরেকবার রিভিউ করছি, জুলিয়া এল আমার কিউবে। - শুচি, তুমি আমার বানিকে রাখবে? যখন প্রথম ইউ এসে এসেছিলাম, সেই ২০০২ থেকে এই বানিটা আমার কাছে আছে। তুমি নেবে একে? – অনেকদিন এতটা আবেগতাড়িত হই নি। আমি তো এর যোগ্য নই। তোমার আট বছরের প্রবাসকে তুমি আমার হাতে তুলে দিচ্ছো জুলিয়া! কিছুই বলতে পারলাম না। চুপচাপ হাসলাম শুধু।

তারপর আর কি! আমার ডেস্কে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে জুলিয়ার বানি। আমি ভাবছি আমাকেও একদিন দিয়ে যেতে হবে কাউকে। এভাবেই তো চলে রিলে রেস। এভাবেই তো বৃত্তটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আর ছড়িয়ে পড়তে থাকি পরিধি জুড়ে। কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। অথচ তাও কেমন হাতে ধরা থাকে হাত!

Thursday, September 16, 2010

অবান্তর কথামালা - ৬

এতো জানাই ছিল, নাকছাবিটা হারিয়ে যাবে। গমের ক্ষেতে খুঁজবে তাকে সারা বিকেল। হাঁটতে হাঁটতে যেই ভাবছ সূর্যকে ছুঁয়ে ফেলেছি বুঝি, অমনি আকাশ কালো করে রাশি রাশি কাক উড়ে আসে। ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে – ঠোকরায়, খুবলে নিতে চায় চোখ। তাড়াতে তাড়াতে তোমায় পাঠিয়ে দিল ফ্রেমের বাইরে।

নাকছাবিটি আটকে আছে গমের শীষের ফাঁকে। শেষ বিকেলের লালচে আভায় টলমল। রাত্রি নামলে সন্ধ্যাতারাটি হয়ে অপলক চেয়ে আছে তোমার দিকে...

Wednesday, September 15, 2010

অবান্তর কথামালা - ৫

এভাবেই শব্দেরা ঝরে। ন্যাড়া ছাদে, লাট খাওয়া ঘুড়ির মত চুপচাপ রোদ খায়। নড়ে চড়ে। কথা বলে ফিসফাস, নিজেরাই নিজেদের সাথে।
কবেকার খড়কুটো, কার্নিসে জমে থাকা ভয়, অসময়ে পিছু ডাক, আঁচড়ের দাগ, মায়াময় - বাঁধা ছিল আঁচলের খুঁটে।
এভাবেই শীতবেলা মরে।
তার অশেষ কাঁথাকানি। লাল-নীল পাড় ছেঁড়া সুতো। টুপটাপ ফোঁড় তোলে। ভাসমান বিহানবেলায়। অকারণ বিষাদে ও জ্বরে।

Tuesday, September 14, 2010

অবান্তর কথামালা - ৪

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। অল্প অল্প শীত করে। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি বৃষ্টি নেমেছে। বাতিদানের তলায় জলকণাগুলোকে একটি একটি করে গোনা যায়। শান্ত নিরুত্তাপ বৃষ্টি। নিশ্চুপ রাত। থুম মেরে ভিজছে। শার্সী তুলে দিই। ভিজে হাওয়াতে ঘর ভরে যায়। গুটিসুটি মেরে বসে থাকি। বৃষ্টি পড়ে। পড়েই যায়।

সন্ধ্যাবেলায় অনেক তারা ফুটেছিল। এখন আকাশের রঙ লাল। ব্লটিং কাগজের মত ধেবড়ে গেছে এদিক ওদিক। তারাগুলি ঝরে পড়ছে অবিশ্রাম। বাদল হাওয়ায় স্যাঁতস্যাঁতে কাগজের মত নত হয়ে বৃষ্টি ধরি। নক্ষত্ররা মুছে যায়।

Monday, September 6, 2010

সত্যিকারের গল্প

[গুরুচণ্ডালী ২০১০ পুজোসংখ্যায় প্রকাশিত।
http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=21&pid=jcr://content/pujo09/2010/1288018714994 ]

“সব সত্যি। মহিষাসুর সত্যি, হনুমান সত্যি, ক্যাপ্টেন স্পার্ক সত্যি, টারজান সত্যি, অরণ্যদেব সত্যি, ...”

এমনকি ধরো মা দুগগার শাড়ীতে অসংখ্য চুমকি, বিসর্জনের পর সেগুলোই যে কোজাগরীর আকাশে তারা হয়ে ফোটে – তাও তো সত্যিই। ভারী ইচ্ছে হয় একবার হাতে ছুঁয়ে দেখি কতটা সত্যি। ভাসানের আগে ছুঁলে দোষ নেই – সেটা আমি জানি। অনেকেই সে সময় টুকটাক পকেটে পোরে মহিষাসুরের বাজুবন্ধ কিংবা গণেশের উত্তরীয় থেকে খসে পড়া একফালি জরির পাড়। সবচেয়ে বেশী নজর থাকে অবশ্য ময়ূরের পেখমের দিকে। পাওয়া যায় যদি দু-একটা! পুজোর ছুটির পর ইশকুল খুললে বন্ধুদের অপার ঐশ্বর্য দেখে আমি ঈর্ষায় সবুজ হই। মহিষাসুরের মত? যাহ! তা কেন হবে? সে ভারী বদ লোক।

আসলে আমার কপালটাই মন্দ। পুজো আসল মানেই বেড়াতে চল। মাঝেমধ্যে দু-একবার রাজস্থান বা দিল্লী-আগ্রার মত জায়গাতে যাওয়া হলেও বেশীর ভাগ পুজোতেই আমাদের গন্তব্য শিমূলতলা। নবমীর রাতে গোছগাছ সারা। দশমীর ভোরে উদ্যান আভা তুফান। সারাটি দিনের শেষে সূর্য যখন নিভু নিভু, ছোটোনাগপুরের পাথুরে মাটিতে স্তরে স্তরে কুয়াশা জমে, দু-একটি আলো দেখা যায় স্টেশন চত্ত্বরে, ম্রিয়মান, গোধূলিতে প্রায় হারিয়ে গেছে তারা – আমরা তখন ট্রেন থেকে নামি। ইস্টার্ণ রেলের পুকুরটাতে তখন দুগগা ঠাকুর ভাসান যাচ্ছে। ঢাকের আওয়াজ শোনা যায় আবছা মত। বাংলাদেশের মত আহ্লাদী বোল নয়। বেশ খটখটে। সেই খটখটে বোল ছাপিয়ে আসন্ন সন্ধ্যার বিষন্নতাকে লবডঙ্কা দেখিয়ে ভক্তিগীতি ভেসে আসে – “দূর্গা হ্যায় মেরি মা, অম্বে হ্যায় মেরি মা”। বাবা কুলির সাথে দরাদরি করে। আমি আর ভাই একচ্ছুট্টে ওভার ব্রীজের মাথায় উঠে যাই। দেখতে পাই স্টেশন রোড ধরে সাইকেল হাতে হাঁটছে দেহাতি যুবক। পরিপাটি চুল তেল দিয়ে আঁচড়ানো। পাশে মেরুন জরিদার শাড়ী পরা নতুন বউ। ঘোমটার আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি টুকটুকে মুখখানি – কমলা সিঁদুরে ডগমগ। বিহারের এই ছোট গ্রামে দশেরা, রাবণ পোড়ানো – এইসব বড়সড় ব্যাপার-স্যাপার হয় না। ঠাকুর ভাসান, লাড্ডু বিতরণ। ব্যস, এইটুকুই। এককালে বাঙালিরা যখন পশ্চিমে ছুটি কাটাতে আসত তখন এইসব পুজো-টুজোর সূত্রপাত। এখন আর কেউ আসে না। পুজোটা থেকে গেছে।

আমরা হাঁটি কুঞ্জ কুটীরের দিকে। বাবা কুলির সাথে গল্প জোড়ে। “কি গো এবারে বৃষ্টি কেমন হল... পুজোতে লোকজন আসা শুরু হয়েছে... কৈলাস ডাক্তারের খবর কি... আর মনীন্দর, তার বৌয়ের অসুখ সারল?” একে একে পেরিয়ে যাই তারামঠ, বিহারী বাবুকা বাংলা, মধুরাশ্রম। আশীর্বাদের বুড়ি ঠাকুমা সিঁড়িতে বসে আছেন। ভিতর বারান্দার একখানি ল্যাম্পের আলো তাঁর মুখে তেরচা ভাবে লেগে থাকে। পায়ের আওয়াজ পেয়ে ডাকেন, কে যায়? আমরা গিয়ে প্রণাম করি। বিজয়ার প্রথম প্রণাম। বাবার মুখখানি ধরে বলেন, গোপাল এলি? দাঁড়া দাঁড়া, আমার ঘরের গোপালকে আজ ভোগ দিয়েছি। খেয়ে যা। আমরা শান বাঁধানো সিঁড়িতে বসে নিখুঁতি খাই। টুকটাক কথা হয়, কে কেমন আছে, আম কেমন হল – এই সব। তারপর আসি কুঞ্জ কুটীরে। কুঞ্জ কুটীরের মালি উল্লাসদা, কাঁচা-পাকা চুল, চৌকো মত চেহারা – মালিকদের অনুপস্থিতিতে ওই ঘর ভাড়া দেয়, গোছগাছ করে, আতার সিজনে পাহারা বসায় আতা গাছে, শীতের শুরুতে খেজুর রসের বন্দোবস্ত করে। আমাদের আসার কথা জানানোই ছিল। উল্লাসদা যদিও পড়তে পারে না। পোস্টাপিসের ওরাই পড়ে-টড়ে দেয় আর কি!

উল্লাসদা ঘর খুলে দেয়। বিছানা পেতে দেয় তক্তপোষের ওপর। কুয়ো থেকে জল তোলা দেখতে আমাদের ভারি ভাল লাগে। মায়ের বারণ অগ্রাহ্য করে কুয়োপাড়ে যাই। উল্লাসদা বালতি ডোবায়। গুবগুব শব্দ হয় জলে। কুয়োর আলসেতে সন্তর্পণে ভর দিয়ে দেখি চকচকে অন্ধকারে এক ফোঁটা চাঁদের আলো নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। উল্লাসদা জোর করে ঘরে টেনে নিয়ে যায়। বাবা ততক্ষণে হারিকেনের পলতে কেটে আলো জ্বালিয়ে ফেলেছে। কুঞ্জ কুটীরের দেওয়ালে আমাদের ছায়াগুলি ছোট বড় হাল্কা গাঢ় হয়ে ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। আমরা আঙুলের ভাঁজে কুকুর বানাই, হরিণ বানাই, টিয়াপাখি বানাই। আরো অনেক কিছু বানিয়ে ফেলি যাদের নাম জানি না। আমাদের আশ্চর্য বাড়ি আশ্চর্য সব জীবজন্তুতে ভরে যেতে থাকে। রাত্তিরে যখন হ্যারিকেনের আলো নিভে যায়, দশমীর চাঁদের আলো তখনও জেগে থাকে। পেয়ারা গাছের পাতাগুলি অবিরাম ছবি এঁকে যায় আমাদের দেওয়ালে। অনেক রাতে কুটুর-কুটুর শব্দে ঘুম ভাঙে। মা বলে, ও কিছু না, ইঁদুর। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে ইঁদুর তখন কুট কুট করে মাটি কেটে পথ বানায়। কোথায় যায় সে পথ? কে জানে! আমাদের দেওয়াল জোড়া অনেক ছায়া, আমাদের চন্দ্রগ্রস্ত রাত, ঝুরো ঝুরো মাটির গর্ভে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে। ঘুমের ওপার থেকে আবছা শুনি – কুট কুট। খুট খুট। দে ছুট! দে ছুট! দলছুট? দলছুট? রং রুট! রং রুট!

পরের দিন সকাল হতেই বেড়াতে বেরোই। অক্টোবরের মাঝামাঝি ছোটনাগপুরের এইসব অঞ্চলে হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা থাকে ভোরের দিকে। হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে আমরা দৌড়ে বেড়াই বিহারীবাবুদের বাগানে। চটাস চটাস করে শিশিরের দানা ঠিকরে এসে পায়ের গোছ ভিজিয়ে দেয়। কুয়াশা কাটিয়ে ফিকে কমলা রঙের সূর্য ওঠে। মা বেসুরো গলায় গুনগুন করে – ‘শুভ্র আসনে বিরাজ অরুণ কিরণ মাঝে’। সুর লাগে না, তবু সকালটা কেমন সুরেলা হয়ে থাকে। অনিলকাকুর দোকানে গরম কচুরী আর খোসাওলা আলুর তরকারী দিয়ে জলখাবার সারা হয়। আমি সবসময় দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসি। দেওয়ালে অনেক পোস্টার লাগানো। আমি আড়চোখে, যেন সামনে বসা মা’কেই দেখছি এমনিভাবে, পোস্টার দেখি। গোলাপফুল আঁকা সাদা চুড়িদার পরা একটা মেয়ে, আমি জানি ওর নাম ভাগ্যশ্রী, এবার পুজোয় ঐ জামাটা খুব উঠেছে।

খাওয়ার পর বাজারের দিকে যাই। মা-বাবা মিলে মাছের দরদাম করে। আমরা দুটিতে গুটি গুটি মন্দির চত্বরের দিকে হাঁটি। আসলেতে বজরং বলীর মন্দির। কমলা রঙের মোটাসোটা বজরং বলী গাল ফুলিয়ে গদা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাশেই মাঠের মধ্যে একটু জায়গা করে দূর্গা পুজো হয়। ঠাকুর ভাসান গেছে কাল। টুকটাক ছেঁড়া ফুল, পাতা, নারকেলের ছোবড়া – এইসব চিহ্ন পড়ে আছে। আমি আর ভাই সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঘুরি। যদি কিছু পাওয়া যায়, রাংতা, জরির টুকরো, যা হোক! লাডলীকি মায়ী, আমাদের বাসন মাজে, সে দেখতে পেয়ে বলে, তোমরা এখানে? বউদি তোমাদের বুলাচ্ছে। বেজার মুখে আমরা মন্দির থেকে বেরোই। ভাই বলে, দিদি ওই দেখ! সিঁড়ির খাঁজে আলো পড়ে ঝিলিক মারছে ময়ূরকন্ঠী রঙ। কাল ভাসানের সময় খসে পড়েছে কোনভাবে কার্তিকের বাহনটির থেকে। গোটা নয় অবশ্য। ছেঁড়া ময়ূরের পালক। তা একখানা সত্যিকারের ছেঁড়া ময়ূরের পালকই বা কবে হাতে ছুঁয়ে দেখেছি আমরা! নাচতে নাচতে ঘরে ফিরি সাত রাজার ধন এক মাণিকটিকে নিয়ে। সত্যি সত্যি ময়ূরের পেখম! ভাবা যায়!

একটু বেলা চড়লে বাবা সাইকেল নিয়ে মনীন্দর কাকুর সাথে ঘি আনতে যায়। সে ভারী দূরের পথ। তিনখানা পাহাড় পেরিয়ে, রাজবাড়ি পেরিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে, মনীন্দর কাকুর গাঁওঘরে খাঁটি ঘি তৈরী হয়। সেই ঘি নিয়ে আসবে বাবা। অত দূরে আমাদের যাওয়া বারণ। পাহাড় অবশ্য শুনতেই, আসলে বড়সড় টিলা। আমি আর ভাই ইউক্যালিপটাসের মসৃণ সাদা গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আনন্দমেলা পড়ি। ঝিরি ঝিরি বাতাস দেয়। উল্লাসদা একরাশ পেয়ারা পেড়ে দেয় মা’কে। মা পেয়ারার ক্কাথ জ্বাল দিয়ে দিয়ে জ্যাম বানায়। একটা আঠালো মিষ্টি গন্ধে আমাদের বাড়িটা ভরে থাকে। দুপুর নাগাদ কৈলাস কাকু দেখা করে যায় একবার। স্টেশনের কাছে কৈলাস কাকুর একটা কাপড়ের দোকান আছে। সেই দোকানেই সন্ধ্যের দিকে হোমিওপ্যাথি ওষুধও পাওয়া যায়। বেশ নামডাক কৈলাস ডাক্তারের। কৈলাস কাকু মায়ের রান্নার ভারী ভক্ত। একবার বলেছিল, বৌদি বড় ভালো কুকার আছে। বৌদির ‘কুকার’ হতে আপত্তি ছিল বিলক্ষণ, কিন্তু তাতে কৈলাস কাকুর আপ্যায়নের ত্রুটি হয় নি।

বিকেল হলে রেলের পুকুরের দিকে হাঁটতে বেরোই। কিছু ছেঁড়া ফুলের মালা, পচে যাওয়া পাতা জমে আছে ঘাটের কাছে। ঠাকুরের ভাসান হয়েছে সবে একদিন হল। কদিন পরে মাটি গলে যাবে। খড়ের কাঠামোটা ভেসে থাকবে একাবোকা। একটা মা হাঁস তার ছানাপোনাদের নিয়ে জল সইছিল। অনিলকাকুর দোকানে চায়ের গেলাস ধোয় টুনটুন। এরা হল সেই টুনটুনের মায়ের হাঁস। নিজেরা কট্টর নিরামিশাষী। তবে পুজোর সময় লোকজনের আনাগোনা। তখন ডিম বেচতে বাধা নেই। আমরা হাঁসগুলোকে মুড়ির লোভ দেখিয়ে নিয়ে চলি পুকুরের এ মাথা থেকে ও মাথা। মা হাঁসটির মাথায় একটি বড়ি খোঁপা। ওর গলায় টুনটুনের মা একটা ঘন্টি ঝুলিয়ে দিয়েছে। নড়লে চড়লেই আওয়াজ হয় রুন ঝুন। সন্ধ্যে নামে। একরাশ বক ডানা ছড়িয়ে ঝগড়া করতে করতে উড়ে যায়। টুনটুনের মা বলে, কবে এলে বৌদি? আমার থিকে ডিম নিবে তো? মুরগা লাগবে না? মা হাঁস তার ছানাদের নিয়ে হেলতে দুলতে ঘরে ফেরে। আমরাও বাড়ির পথ ধরি। বিহারী বাবুদের বাগানে রাতপোকারা ঝুম ঝুম শব্দে জেগে ওঠে। আমরা সন্দেহের চোখে অন্ধকারের দিকে তাকাই। বাবা বলে, ও তো ঝিঁঝি পোকা। অন্য প্রজাতির। আমরা ভাবি, বললেই হল! এ তো সেই ঝুঁটিওয়ালা হাঁসবুড়ি। ছানাদের ঘুম পাড়াচ্ছে। ঝুম ঝুম। রুম ঝুম। কই ঘুম? আয় ঘুম। নিঃঝুম। নেই ঘুম!

আমাদের দিনগুলি কাটে ইউক্যালিপটাসের গন্ধ নিয়ে। পেয়ারা গাছের মগডালে বসে আনন্দমেলা পড়তে পড়তে। ভোর হতেই বান্ধুরামের ঝুপড়িতে ছুটি। মোটা কাঁচের গেলাসে খেজুর রস খাই। ফেরার পথে বুড়ো লছমনের ডেরাতে গিয়ে দুধ দোয়া দেখি। লছমনের ঠাকুর্দা ওকে শিখিয়েছিল দুধে জল মেশালে গরু মরে যায়। লছমন তাই ঘন ক্ষীরের মত দুধ জুগিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। শুক্রবার করে টেলুয়ার হাট বসে। আমরা টাঙায় চেপে হাট দেখতে যাই। টিনের ওপর রঙ করা চকচকে টিপ কিনি। কাঁচের চুড়ি কেনার ইচ্ছে হয় খুব। কিন্তু হাত কেটে যাবে বলে মা কিনতে দেয় না। বিকেলবেলা বেড়াতে বেড়াতে রাজবাড়ির দিকে যাই। পাহাড়ের মাথায় রাজবাড়ি। কেউ থাকে না। পলেস্তারা খসে পড়েছে। আগাছা জন্মেছে। তবু রাজবাড়ি তো বটে! পথের পাশে জমে থাকা অভ্রের চাঙড়ে সূর্যের লালচে আভা ঝলমল করে। আমরা দিব্যি দেখতে পাই শোলাঙ্কির রাজকুমারী ছুটে বেড়ায় হাতিশাল থেকে ঘোড়াশালে। সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে উঠে যায় প্রাসাদ শীর্ষে। সন্ধ্যাতারার দিকে মুখ করে বসে।

দেখতে দেখতে কোজাগরী চলে আসে। পরিত্যক্ত রাজবাড়িটি হলদে চাঁদের আলো মেখে রূপসী হয়। মাধবীভিলায় এখনও একঘর বাঙালী থাকে। পুজো হয় তিথি মেনে। দূর থেকে কাঁসরের আওয়াজ ভেসে আসে। আমাদের ইউক্যালিপটাস গাছে রাশি রাশি জোনাকি ভর করে। মনে হয় তারারা নেমে এসেছে। ছোট জনতা স্টোভটিতে মা লুচি ভাজতে বসে। গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ নিতে আমরা বসে থাকি রান্নাঘরের চৌকাঠে। নতুন আলুর দম আর লুচি খেয়ে আমরা কলঘরের ধরে রাখা জলে মুখ ধুয়ে নিই। মা কুয়োতলায় যায় এঁটো বাসন রেখে আসতে। হ্যারিকেনের আলোয় আবার আনন্দমেলা নিয়ে বসেছি, জানলা দিয়ে মা ডাকে নিচু স্বরে, এসো একবার। কোন আওয়াজ না করে বাইরে বেরিয়ে এসো। তোরাও আয় পা টিপে টিপে। আমরা চুপিসাড়ে বেরোই। কোজাগরী রাতে দুধসাদা আলোয় চান করছে অফসলী জমি, লাট্টু পাহাড়, ইউক্যালিপটাসে বাসা বাঁধা অসংখ্য জোনাকি। মা আঙুল তুলে দেখায়, কুঞ্জ কুটীরের কার্নিসে কোথা থেকে উড়ে এসে বসেছে এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা। নিশ্চুপ। স্থবির। ভাবলেশহীন। যেন আলোর প্রাবল্যে জ্বরাক্রান্ত। আমরা চারজন আড়াল থেকে সেই নৈঃশব্দকে ছুঁই।

জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে আমাদের বিছানায় কোজাগরী ভেসে বেড়ায়। মা বলে, কোজাগরীর রাতে যে বাড়িতে লক্ষ্মী প্যাঁচা এসে বসে, সেই বাড়িতে লক্ষ্মীঠাকুর আসেন। আমরা বলি, যাহ! তাও কি হয়? মা বলে, হয় তো! লক্ষ্মীঠাকুর ছোট্ট একটা মেয়ে, ঘুরে বেড়ান এ ঘর থেকে ও ঘরে। আমরা মেয়েটিকে দেখার আশায় এদিক ওদিক তাকাই। চোখ যায় জানলায় আটকে থাকা কোজাগরী চাঁদে। আমরা বলি, সত্যি? চাঁদের বুড়ি মুচকি হেসে বলে, সত্যি বইকি! দেখতে পাই লক্ষ্মীপ্যাঁচা তার সাদা ডানায় আড়মোড়া ভেঙে ধীরে ধীরে উড়ে গিয়ে বসে আতা গাছের ডালে। তার পালক থেকে সম্মতি ঝরে পড়ে – সত্যি! সত্যি! ঠিক তখনই তক্তপোষের পায়ের কাছে শব্দ হয় – কুট কুট কুট – ঠিক ঠিক ঠিক! এক পশলা হাওয়া দেয়। দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ছেঁড়া ময়ূরের পেখমটি পূর্ণিমা চাঁদে চান করে ভারী এক প্রশ্রয়ের হাসি হাসে।