আমি ছোটবেলায় দিদার বাড়ি থাকতে খুব ভালোবাসতাম। যে সময়কার কথা আমার স্মৃতিতে ধরা নেই, সেই সময়ে আমায় জোর করে বাড়ি নিয়ে আসলে খানিক পরে ফেরত দিয়ে যেতে হত। দিদার হাতে আমায় দিয়ে বাবা করুণ মুখে বলত - খুব কাঁদছে। দিদার বাড়ির দিনগুলো আরোই স্বর্গপুরীর মত হয়ে উঠত যখন মাঝে মাঝে একজন লম্বা একহারা চেহারার সাদা শাড়ি পরা মহিলা কিছুদিনের জন্য এসে থাকতেন। ইনি আমার মায়ের পিসিমনি। আমার পিসিদিদু। মায়ের বাবাকে আমি কচ বলে ডাকতাম। পিসিদিদু আমায় ডাকতেন কচদিদু। পিসিদিদুর কোলের কাছটা কেমন পুরনো বাড়ির লাল মেঝের মত ঠান্ডা ছিল। আমি অবাক হয়ে দেখতাম এমব্রয়ডারী ফ্রেমের ভিতর কেমন নানা রঙের সুতোয় ফুল পাতার নকশা তুলছে পিসিদিদু। এই জিনিসটা আমার কাছে এক মুগ্ধতার বস্তু ছিল। মা, দিদা কেউই সেলাই করত না। ঠাকুমা খুব ভালো আসন বুনতো, কিন্তু কাঠের ফ্রেমে কাপড় আটকে অভিজাত ফোঁড় তুলতে আমি পিসিদিদু ছাড়া আর কাউকে তখনও দেখিনি।
আমার যবে থেকে মনে আছে তার আগেই পিসিদিদুর জীবন রংহীন হয়ে গেছে। খুবই নিষ্ঠার সাথে সমস্ত আচার পালন করতেন। দূর থেকে গল্প শুনলে হয়ত কৃচ্ছসাধন মনে হবে, কিন্তু তিনি এমনই আনন্দের প্রতিমূর্তি হয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে আচার পালন করতেন যে তাঁকে করুণা করার স্পর্ধা কারোর হবে না। আমি বিশেষ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ি যখন জানতে পারি আমার বাবা-মায়ের অসবর্ণ বিবাহ পরিবারের মধ্যে অল্প যে কয়জন সাদরে মেনে নিয়েছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন পিসিদিদু। যিনি নিজে অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ ছিলেন তাঁর এই উদারতা আমায় অভিভূত করে। বুঝতে পারি, তাঁর আচারনিষ্ঠা গোঁড়ামী ছিল না। এই আচরণ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও বিরল মনে হয়। জাতিভেদ সংক্রান্ত নিয়মকানুন হয়ত সময়ের সাথে শিথিল হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও হামেশাই দেখতে পাই প্রথিতযশা অধ্যাপক, বিজ্ঞানীরাও নিজেরা যে মতটিতে বিশ্বাসী তার বাইরে কিছু দেখতে চান না। পিসিদিদু নিজে আচারনিষ্ঠ হয়েও নিয়মের শিকল যেখানে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে মেরে ফেলছে সেখানে শুকনো নিয়মকানুনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
মিঠুনকে বিয়ে করার সময় আমার মা-বাবা উভয় পক্ষের দাদু-দিদাই গত হয়েছেন। আমাদের অশেষ ভাগ্য পিসিদিদু, তাঁর পরের ভাই ছোট দাদু এবং ছোট দিদা আমাদের আশীর্বাদ করে গেছেন। ছোট দাদু এক বর্ণময় চরিত্র। আমার মনে হত উনি সব সময় ছোটেন, তাই ওনার নাম ছোটদাদু। তাঁকে নিয়ে লিখতে হবে পরে কখনও। আমাদের বিয়ের পর দিল্লিতে একটি কাজে গিয়ে পিসিদিদুর সাথে দেখা করেছিলাম। রূপোর কয়েন দিয়ে নাতজামাইয়ের মুখ দেখলেন। শীর্ণ শরীর তখন শীর্ণতর ও জীর্ণ হয়েছে। প্রাণখোলা হাসিটি অটুট ছিল। তখন এবং আজও ভেবে অবাক হই - শোক তাঁর আত্মাকে তিক্ত করতে পারেনি। কখনও কোনও অভিযোগ করেছেন বলে শুনিনি মায়ের কাছে। আমাকে তো শুধু আদরই দিয়েছেন। সেবারে পিসিদিদুর ছেলে পাপ্পুমামাকেও দেখেছিলাম। তাঁর সাথে অল্প আলাপেই বোঝা যায় মানুষটি মোটেই সংসারী নন। আমরা ফিরে আসার আগে তিনি মিঠুনকে একটি টাই উপহার দিলেন। সংসার উদাসীন একজন মানুষ নিজে নিজে ভেবে এই কাজটি করলেন এটা আমার মনে থেকে গেছে। পরে আরও একবার দিল্লি যাই এবং একা যাচ্ছি জেনে পিসিদিদু জোর করেন তাঁর কাছে থাকতে। সেটাই শেষ দেখা ছিল। সেদিন ওনার জ্বর এসেছিল। নিষ্ঠাবতী পিসিদিদু পাপ্পুমামাকে রান্নাঘরের গ্যাসে রান্না করে দিতেন। নিজের খাবার বানাতেন ঘরের মধ্যে স্টোভে। আমি গিয়ে দেখলাম পাপ্পুমামা দুধ জ্বাল দিয়েছেন। স্টোভে পাঁউরুটি সেঁকার চেষ্টা করছেন। আমি বললাম - তুমি যাও, আমি করি। ভালোমানুষ পাপ্পুমামাও ছেড়ে দিলেন। মনে আছে, বোধহয় চিমটে খুঁজে না পেয়ে খালি হাতেই পাঁউরুটি এপিঠ ওপিঠ করছিলাম। পাপ্পুমামা বারবার বলছিলেন - তিতুম, বি কেয়ারফুল, হাত পুড়ে যাবে। পাপ্পুমামাকেও আর দেখিনি। দেখবও না। না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
আমার আনন্দস্বরূপা সন্ন্যাসিনীসমা পিসিদিদু শ্রীমতী তৃপ্তি ভট্টাচার্য গত নয়ই সেপ্টেম্বর তাঁর জীর্ণদেহখানি ত্যাগ করলেন। যাওয়ার সময়েও কারোর কোনো অসুবিধার কারণ ঘটালেন না। ছোটদাদু, ছোটদিদা আগেই চলে গেছিলেন। পিসিদিদুর সাথে ভট্টাচার্য পরিবারের একটি প্রজন্মের অবসান হল। গতকাল পারলৌকিক কাজ উপলক্ষে তাঁর ভাইপো-ভাইঝিরা এবং তাঁদের পরিবার একত্রিত হয়ে এই অসামান্য মানুষটির অনন্যসাধারণ জীবনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিলেন।
দিল্লিতে তোলা ছবিখানি খুঁজে পাচ্ছি না। এজন্যই ফেসবুকের এলবামে তুলে রাখি যেখানে যা পাই। হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে কোনোদিন কোনো হার্ডড্রাইভে, হয়ত বৃথা আশা, কালের গর্ভে চিরতরে তলিয়ে গেছে। ততদিন মধু হোক পৃথিবীর ধুলি, মধু হোক বাতাস, নদ ও নদীতে মধুক্ষরণ হোক - মধুবাতা ঋতয়তে, মধুক্ষরন্তি সিন্ধব। যে সুহাসিনী মানুষটি ছিয়াশি বছরের নশ্বর জীবন থেকে সবে মুক্তি পেলেন, মধুময় পৃথিবীতে তিনি মিশে থাকুন।