About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Saturday, July 11, 2020

আয়া সোফিয়া

 আয়া সোফিয়ার সামনে যতবার দাঁড়িয়েছি একটা কৃতজ্ঞতা বোধ হয়েছে। কারণটা ব্যাখ্যা করি। ইস্তাম্বুল বা কনস্ট্যান্টিনোপল শহর যতদিন পৃথিবীতে আছে, আয়া সোফিয়াও প্রায় ততদিন। মনে করা হয় কনস্ট্যানটাইন খ্রীষ্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করার আগে এখানে মন্দির ছিল যেখানে মূর্তিপুজো হত। কনস্ট্যানটাইন দক্ষ রাজনীতিক ছিলেন। খ্রিস্টান এবং মূর্তিপূজক দুইপক্ষকেই খুশি রেখে চলতেন। তবে মারা যাওয়ার আগে নিজে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে মূর্তিপুজো লোপ পেল। গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ হিসেবে আয়া সোফিয়া তৈরি হল। দেখবার মতো স্থাপত্য। চার্চের ভিতরের দেওয়ালে অসাধারণ সব মোজাইকে যীশুর জীবনের নানা ঘটনা আঁকা। কনস্ট্যান্টিনোপলের ইতিহাস ঘটনাবহুল। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে আয়া সোফিয়ারও। একবার এক আইকনোক্লাস্ট পাগলা রাজা এসেছিল। তখন ইসলাম সবে জন্ম নিয়েছে। মুসলিমদের দেখাদেখি তার মনে হল ঈশ্বরের ছবি আঁকা পাপ। তখন তার নির্দেশে ঈশ্বরের পুত্রের সব ছবি মুছে দেওয়া হল আয়া সোফিয়া থেকে। সেই পাগলের যুগ শেষ হলে আবার পরের রাজা এসে ভালো ভালো মোজাইক করিয়ে দিলেন। এইভাবে চলে। চতুর্থ ক্রুসেডের সময় রোমান ক্যাথলিকদের সাথে গ্রীক অর্থোডক্সদের ঝগড়া বাধল। কনস্ট্যান্টিনোপলে ব্যাপক লুঠতরাজ চলল। কিছুদিনের জন্য গ্রীক অর্থোডক্স চার্চ হল রোমান ক্যাথলিক। তবে রোম থেকে কনস্ট্যান্টিনোপল শাসন করা সহজ ছিল না। বস্তুত সেই কারণেই কনস্ট্যান্টিনোপল শহর তৈরি হয় হাজার বছর আগে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য শুরু হয়েছিল ইস্টার্ন রোমান সাম্রাজ্য হিসেবে। পরে সুতো আলগা হয়ে যায়। এবারেও চতুর্থ ক্রুসেডের পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই আয়া সোফিয়া আবার গ্রীক অর্থোডক্স হয়ে যায়। আরও দেড়শো বছর পর কনস্ট্যান্টিনোপলে বড়সড় পরিবর্তন আসে। অটোমান রাজারা শহর দখল করে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য চিরতরে শেষ হয়। আয়া সোফিয়া হয়ে যায় মসজিদ। শহরের নাম ইস্তাম্বুল।

১৯৩৫ সালে কামাল আতাতুর্ক আধুনিক তুরস্কের ভার নেন। সহস্রাধিক বছরের হানাহানির সাক্ষী আয়া সোফিয়াকে তিনি মিউজিয়াম বানিয়ে দেন। সেই মিউজিয়ামে মুসলমান ও খ্রীষ্টান দুই ধর্মের স্মারকই জায়গা পায়।
২০১৪ সালে আমার প্রথম ইস্তাম্বুল যাওয়ার সুযোগ ঘটে। সেই সময় এই মিউজিয়ামটির ইতিহাস আমি জানি এবং আমার মনে হয় আয়া সোফিয়া নামের মর্যাদা এই মিউজিয়ামটি রাখতে পেরেছে। গ্রীক ভাষায় সোফিয়া শব্দের অর্থ প্রজ্ঞা। জাতি, ধর্ম বা লিঙ্গচিহ্নের জন্য মানুষের প্রতি ঘৃণা ও বঞ্চনা তো প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে না। অথচ আয়া সোফিয়ার দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে এ জিনিস হয়েই চলেছে। কামাল পাশার কথা জেনে মনে হয়েছিল আগে যা হয়েছে সেসব পুরনো দিনের কথা বাক্সবন্দি করে রেখে দেওয়া যায়। নতুন পৃথিবী এমন হবে না। ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে যারা বিভেদ সৃষ্টি করে নতুন পৃথিবী তাদের বুজরুকি ধরে ফেলে হো হো করে হাসবে। মধ্যযুগের অন্ধকার যাদের মনে বাসা বেঁধে আছে তাদের মোজাইকের ধুলো ঝাড়া অথবা মিউজিয়ামের সামনের সবুজটুকুর পরিচর্যার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হবে। বাইজান্টাইন শিল্পীর আঁকা যীশুর করুণাঘন চোখ আর অটোমান ক্যালিগ্রাফিতে ঈশ্বরের নাম পাশাপাশি দেখে তাদের মনে হয় দুজনের প্রতিই প্রেম জন্মাবে অথবা ধর্মের খোলস ছাড়িয়ে তারা নিখাদ শিল্পটুকুকে ভালোবাসতে শিখবে। এইসব ভেবেই কৃতজ্ঞতা জেগেছিল কামাল পাশার প্রতি। এই মাস্টার স্ট্রোক ফেল করতেই পারে না - এমন ভেবেছিলাম। সামনের পৃথিবী পুরনো পৃথিবীকে গোহারান হারিয়ে দেবে এমন ভেবেছিলাম।
আজ বিশ্বাসভঙ্গ হল। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রজব এরদোগান ধর্মনিরপেক্ষ আয়া সোফিয়া মিউজিয়ামকে আবার মসজিদ করে দিলেন। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে অপরাধবোধ জাগছে। লজ্জা হচ্ছে। আর কি বলব!

Thursday, June 4, 2020

মিঠুন্দার মাস্কতুতো ভাই

 স্থানঃ বৈদ্যবাটির একটি পাড়ায় সবজিবিক্রেতার ঠেলাগাড়ি

কালঃ সকাল নয় ঘটিকা
পাত্রঃ ঠেলাগাড়ির সামনে জটলারত প্রতিবেশীদ্বয় - একজন অধমের জনক প্রদীপবাবুস্যার, অন্যজনের নাম ধরা যাক শ্যামল (কাল্পনিক)
প্রদীপবাবুস্যারঃ একি শ্যামল! তুমি মাস্ক পরো নি?
শ্যামলঃ না না স্যার, এখন তো বাজার করছি। মাস্কটা এখন পরি না।
প্রদীপবাবুস্যারঃ তাহলে কখন পরো?
শ্যামলঃ এই তো বাড়ি গিয়ে চান করে চা খাবো। তারপর মাস্ক পরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবো।

Sunday, May 17, 2020

আরুগ্রামে

 আরু গ্রামের বিশ্রামাবাস থেকে সকাল বেলা হাঁটতে বেরিয়ে মনে হল সামনের সবুজ পাহাড়টায় চড়া যাক। সেবারে ফিরে এসে জেনেছিলাম রক্তের হিমোগ্লোবিন বিপদসীমার নিচে। তখন উপসর্গ বলতে চড়াই উঠতে দমের অভাব। মিঠুন যত্ন করে বিশ্রাম করিয়ে করিয়ে গল্প করতে করতে নিয়ে যায়। মে মাসের নবীন সতেজ উপত্যকা, বুনো ফুল, তিরতিরে নদী সবাই মিলে উতসাহ দেয়। খানিক পথ উঠে একটা ছোট গুহা। একটা ক্ষীনতোয়া প্রস্রবণের মুখ। সেখানে একটা পাথরের ওপর কাওয়ার সরঞ্জাম নিয়ে বসেছে একটা লোক। সেখানেই ছেলেটার সাথে দেখা। এক পাল ভেড়া নিয়ে উপত্যকার নিচে বাসা বাঁধা বকরওয়ালদের গুষ্টি উদ্ধার করছিল চা-ওলার সাথে। আমি সুযোগ পেয়েই বসে পড়ি। মিঠুন গল্প জোড়ে। কাওয়া খেতে খেতে সেই বছর পনেরোর রাখালছেলের সাথে আলাপ। ছেলেটা তার মায়ের প্রথম সন্তান। রীতি অনুযায়ী নাম পেয়েছে মহম্মদ।এরা গুজ্জর। জম্মুর নিচের কোন গ্রাম থেকে শীতের শেষে ভেড়া নিয়ে বেরিয়েছে মা আর চার ভাইবোন নিয়ে। পাহাড়েই কাটবে গ্রীষ্মের মাসগুলো। চিকন সবুজ উপত্যকায় আগের বছরের ফেলে যাওয়া কাঠের ঘরের কাঠামো মেরামত করে পশুপালন চলবে। রোম্যান্টিক জীবন মনে হয় দূর থেকে। কাজাখ সহকর্মীর কথা মনে পড়ে। চীনের বর্ডারে থাকতো তারা। পশুপালন পেশা। গোটা গরমকালটা সবুজ সবুজ উপত্যকায় পশু চরায়। মধু সংগ্রহ করে। জীবনের প্রথম আঠেরো বছর কোনো ওষুধ কোম্পানির তৈরি গুলি খায় নি সে। কাওয়া খেয়ে এই ছেলেটার সাথে হাঁটতে থাকি। কথায় কথায় বলে ইসলামাবাদে গতকাল ঝামেলা হয়েছে। খট করে কানে বাজে। শ্রীনগরকে স্থানীয়রা ইসলামাবাদ বলে। তবে ট্যুরিস্টদের সামনে বলে না। এ ছেলের সে খেয়াল নেই। সিনেমায় অভিনয়ের খুব শখ। মিঠুন কিনা টালিগঞ্জের ছেলে। উত্তমকুমারের পরেই তার নাম। মহম্মদ মিঠুনকে বলে, তোমাদের ওখানে আমার কোনো সুযোগ হয় না? ইংরিজি জানি একটু একটু। তোমাদের ভাষাও শিখে নেবো। আমরা অতি কষ্টে সামলাই। - বকরওয়ালদের ওপর রাগ কেন ভাই? - ওরা নোংরা করে রাখে পাহাড়টা। লোক ভালো না ওরা। হিমালয়ের অবর্ণনীয় ঐশ্বর্যে শিহরিত আমরা জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলি। আমার বিশ্রামও হয়। মহম্মদ ছবি তোলা দেখে। - তুমি তুলবে? সলজ্জ ঘাড় নাড়ে সে। জুম, এক্সপোজার শিখে নেয় সঙ্গে সঙ্গেই। দেখতে দেখতে উপরের উপত্যকায় উঠে আসি। সবুজ মখমলে মোড়া সমতল। দুইখানা কাঠের ঘর। - তোমাদের ঘর নাকি? - না না, আমরা আরও ওপরে উঠে গেছি। এখন কেউ নেই এখানে। ঘরের সামনে একটা বড় পাথরের স্ল্যাব। যেন চেয়ার পাতা আছে উঠোনে। আমি পা ছড়িয়ে বসে হা হা করে নিশ্বাস নিই। আর উঠবো না। রাখাল ছেলে আমাদের ক'টা ছবি তুলে দিয়ে ভেড়ার দল নিয়ে আরও উপরে উঠতে থাকে।




আরুগ্রামে

 আরুগ্রামে আমরা ছিলাম বিলালভাইয়ের আতিথ্যে। রজত সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পহেলগাম থেকে বারো কিমি দূরে ছোট্ট গ্রাম আরু। বিলালভাই এর গেস্টহাউস মিল্কি ওয়ের সামনেই বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা। ঘন পাইন বনের ওপাশে বরফে মোড়া পাহাড়চুড়ো। তিরতির করে বয়ে চলে আরু নদী। বিলাল ভাইয়ের দাদা ফৈয়জ ভাইকে মাইক্রফট হোমসের মত দেখতে। শার্লক হোমসের দাদাকে আমি দেখিনি, কিন্তু বর্ণনা পড়ে মনে হয় তিনি নিশ্চয়ই এমনই লম্বা, এমনই খাড়া নাক তাঁর, এমনই ক্ষুরধার দৃষ্টি। গেস্ট হাউসের কাঁচ ঢাকা বারান্দা থেকেই ইশকুলটা দেখা যায়। গ্রামের একমাত্র ইশকুল। ফৈয়জ ভাই বললেন টিফিনের ছুটির সময় মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা করা যাবে। ইশকুলে সাকুল্যে চারজন শিক্ষক। দুইজন হিন্দি, উর্দু পড়ান। বাকি দুজন ইতিহাস, ভূগোল। বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইংরিজি পড়ানোর কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা কিন্তু দিব্যি বুদ্ধিমান। ছেলেরা মোটামুটি সকলেই লেখাপড়ার পাশাপাশি ট্যুরিস্ট সিজনে ঘোড়া ধরে। শুনে শুনেই চমৎকার ইংরিজি শিখে নিয়েছে। মাস্টারমশাই বললেন, কদিন আগে এক রিটায়ার্ড জেনারেল বেড়াতে এসেছেন। তাঁর ঘোড়া ধরেছে একটি বুদ্ধিদীপ্ত সপ্রতিভ ছেলে। জেনারেল রীতিমত অভিভূত হয়ে তার কথা জিগ্যেস করছেন গ্রামে। জানা গেল সে ছেলে পহেলগাম তফশিলে বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।

- ওরা কি আর পড়াশোনা করতে চায় না?
- বাবা-মায়ে ভয় পায় শহরের কলেজে পাঠাতে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে যদি! ছেলেটাই যদি আর না থাকে!
আর মেয়েগুলো? ঘরের কাজ করছে। সেলাই করছে। দরদাম করে কাশ্মীরী হ্যান্ডলুম কিনে আনছে ট্যুরিস্ট। কলেজে যাচ্ছে কয়েকজন। গেলেই তো হল না। দুমদাম কার্ফিউ জারি হয়। পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। বছরের পর বছর নষ্ট হয়।
সন্ধ্যেবেলা ট্যুরিস্টদের প্রকোপ কমলে গেস্ট হাউসের সামনে উপত্যকায় ছেলেগুলো ক্রিকেট খেলে। আমি আর মিঠুন একপাশে দাঁড়িয়ে দেখি। মিঠুনের হাত-পা নিশপিশ করে। আমি বলি - তোর খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে? সে হাসে - না না, দেখতেই ভালো লাগছে। একদিন বেলা প্রায় মরে এসেছে। এমন সময় একটা ট্যুরিস্ট বাস এসে দাঁড়ায়। সবাই নামেও না বাস থেকে। মহিলারা বিলাল ভাইয়ের পারিবারিক শালের দোকানে ঢুকে যান। পুরুষেরা সেলফি তোলেন। একজন ভদ্রলোক ইন্ডিজিনাস একটিভিটিতে অংশ নিতে এগিয়ে আসেন।
- তুমলোগ ক্রিকেট খেল রাহে হো? হাম ভি খেলেগা। ব্যাট দো মুঝে। দেখতে হ্যায় কওন মুঝে বোল্ড কর পায়েগা।
ছেলেগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ব্যাট দেয়। এক বলেই বোল্ড।
- ঠিক হ্যায়, অর এক বার।
আবার বোল্ড। তিন নম্বরটা ঠেকায়। তারপর আবার।
- হা হা! গুড জব। আচ্ছা লাগা তুমসে মিলকে। আচ্ছা, ইধার আও। এক ফটো লে লে? আচ্ছা, ওর এক ফটো। ব্যাট দো মুঝে। বহুত আচ্ছা!
এরপর ভদ্রলোকের খেয়াল হয় পাশেই উত্তরাধিকারী দাঁড়িয়ে। সুতরাং তাঁর ছেলেকেও ব্যাট করতে দিতে হয় যতক্ষণ না বাঁধিয়ে রাখার মত ছবি উঠছে। এইসব করতে করতে পাহাড়ে অন্ধকার হয়ে আসে। ছেলেগুলো খেলা গুটিয়ে ঘোড়া নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। ওদিকে মহিলাদের দোকান থেকে বার করতে হাঁকডাক শুরু হয়। আকাশছোঁয়া বরফচুড়োয় ঘেরা ওই বিস্তৃত উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আমাদের দুই শহুরে মানুষের খুব লজ্জা লাগে। আমরা প্রাণপনে শতাব্দীপ্রাচীন মহাকারুণিক মানবাত্নার ক্ষমাভিক্ষা করতে থাকি।




Wednesday, April 8, 2020

শিভ্যলরি ইন দ্য টাইম অফ করোনা

 মাসখানেক একটানা রান্নাবাটি করে আজ অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করলো। কিছুতেই রাঁধবো না। বার্গার কিং, ওয়েন্ডিস, এমনকি ম্যাকও চলবে। সাথের লোকটি এই সংকল্পে ঘাবড়ে গিয়ে সুড়সুড় করে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল। আমি ঘরের পাজামাতেই একখানি মাস্ক সাথে নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। ও হ্যাঁ, আমার চীনে বন্ধুর বাড়ি থেকে মাস্ক এসেছে, সে আবার তার সঞ্চয় থেকে আমায় পাঠিয়েছে কয়খান। হুঁ হুঁ বাবা, বন্ধু ভাগ্য নিয়ে কেউ কম্পিট করতে এসো না। রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই। নিরিবিলি শহর। ম্যাক বা বার্গার কিংএর দুর্ভাগ্য পোহাতে হল না। একখানি আর্বিস খোলা পাওয়া গেল। ড্রাইভ থ্রুতে খাবার নেবো। তাকে বললাম, পেমেন্ট করা আর অর্ডার ডেলিভারি নেওয়ার সময়ে মাস্ক পরিস, তাহলেই হবে। সে স্বাস্থ্য সচেতন। রিমোট অর্ডার প্লেসিংএর সময়েই মাস্ক পরে নিল। তারপর প্রতীক্ষা পেমেন্ট উইন্ডোর সামনে।

- উহ, মাস্কে কি গন্ধ রে! অনুপম বলছিল, এ জিনিস পরে বেশিক্ষণ থাকা যায় না
- এখন খুলে রাখ না, পেমেন্ট নিতে এলে পরবি
- না না, পরেই থাকি
মিনিট দুয়েক বাদে জানলা খুলল। পুরনো ইংরিজি সিনেমাতে দেখেছি মহিলা দেখলে জেন্টলম্যানরা টুপি খুলে অভিবাদন জানান। আমার পাশের জেন্টেলম্যানটি অবিকল সেই ভঙ্গীতে মাস্কটি মুখ থেকে নামিয়ে পেমেন্ট সংগ্রাহক মহিলাটির দিকে "হাউ আর ইউ" ছুঁড়ে দিলেন।
- মিঠুন, মুখে চাপা
- হ্যাঁ হ্যাঁ
মুখ ঢাকলেও, নাক ঢাকতে বড়ই লজ্জা পেলেন জেন্টেলম্যানটি। পেমেন্ট চোকানো হল।
- হ্যাঁ রে, তুই গাড়ির মধ্যে মাস্ক পরে রইলি, আর লোকের সামনে এসে খুলে দিলি?
- কি করে যেন রিফ্লেক্সে হয়ে গেল। মনে হল মুখ ঢাকা থাকলে ও আমার কথা শুনতে পাবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে, খাবার নেওয়ার সময় মুখ ঢাকিস।
- এই তো, এখনই ঢেকে নিচ্ছি।
- এখন না করলেও চলবে। খাবার নেওয়ার সময় ভুলিস না।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা। খাবার নেওয়ার জানলায় মহিলাকে দেখা গেল আবার।
- মাস্ক পর, মাস্ক পর
পরলো সে তড়িঘড়ি। এবং আবার, ভদ্রা জানলা খোলা মাত্র, অভিবাদনের কায়দায় মুখোস খুলে,
- থ্যাংকস আ লট
- মিঠুন, মুখ
- ইয়েসস (মুখোস টানতে টানতে) হ্যাভ আ গুড নাইট
খাবার নিয়ে ড্রাইভ ওয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসার পথে,
- মিঠুন, তুই আবারও..
- এই তো, পরে নিয়েছি

Thursday, March 5, 2020

৮ই মার্চের গল্প

 ৮ই মার্চের গল্প (আজ সময় পেয়েছি, তাই আজকেই)

১৯৮৯র মে মাসে আমি চারুশীলা বসু বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেবছর আমার সাথে যারা ক্লাস ফাইভে বসতো তাদের সবার বয়েস এখন চল্লিশ। এদের মধ্যে দুইজন এবং আরও একজনকে নিয়ে আজকের গল্প।
আমি ছিলাম ফাইভের বি সেকশনে। পুজোর ছুটি পড়ার দিনে স্কুলের সব ক্লাসের সব সেকশনে কিছু না কিছু প্রোগ্রাম হত। নাচ, গান, নাটক - যা খুশি। সেবারে ছুটির পড়ার দিনেই শোনা যেতে লাগলো ফাইভের এ সেকশনের একটা মেয়ে ফাটিয়ে অভিনয় করেছে। এমন নাকি দেখা যায় না সহজে। সিক্সে সি সেকশনে জায়গা হল। কি সৌভাগ্য! সেই গুণের পাহাড় মেয়েটা সেবছর আমার সাথে একই সেকশনে। সেবারে আমাদের সিক্স সি-র ছোট্ট ঘরে টিচাররা, উঁচু ক্লাসের দিদিরা ভীড় করে পুজোর ছুটির প্রোগ্রাম দেখতে এলেন। তুষার কন্যা আর সাত বামনের গল্প নিয়ে নাটক হয়েছিল। হিংসুটে রাণীর চরিত্রে আবারও চমকে দিয়েছিল তিন্নি। '৯৫ সালে স্কুল ছাড়ি। ততদিন পর্যন্ত প্রতি বছরেই কালচারাল প্রোগ্রাম এই মেয়েটাকে ছাড়া ভাবা যেত না। '৯৫ এর পর ২০১৭। বাইশ বছরের ব্যবধানে আবার যোগাযোগ নিয়মিত হল। ততদিনে তিন্নি গিন্নী হয়েছে। একটা টুসটুসে অসোগোল্লাও এসে গেছে পৃথিবীতে। ২০১৮তে স্কুলের কয়েকজন বন্ধু একসাথে ছুটি কাটাতে গেলাম কলকাতার কাছেই এক টুকরো ছোট্ট সবুজে। তিন্নির থেকে জানলাম ওর কেকশপের স্বপ্নের কথা। তখনও স্বপ্নই। রান্না করতে ভালোবাসে। বাড়ির লোকজন, বন্ধুদের জন্য তো দুহাত ভরে করেই। শখটাকে যদি জীবিকায় রূপ দেওয়া যায়! আমি আর মিঠুন মিলে কেকশপের নামও ভেবে ফেললাম। তবে তখনও সবই ভাবনার স্তরে। কি ধাতুতে তৈরি এ মেয়ে কে জানে, চল্লিশে পা দিলে চালশে হওয়াই দস্তুর। কিন্তু তার বদলে চল্লিশটা জানলা যেন খুলে গেল। আত্মবিশ্বাস, কর্মদক্ষতা, উদ্ভাবনীক্ষমতার ঝোড়ো হাওয়ায় যাবতীয় গড়িমসী গেল কেটে। দোকান বাড়ি এখনও আয়ত্বে আসেনি। কিন্তু বাড়িতে অর্ডার নেওয়া শুরু হয়ে গেল। আমাদের ব্যাচের ছেলেগুলোও সব সোনার টুকরো। এরা চিরাচরিত রীতিতে চল্লিশে পৌঁছে মিডলাইফ ক্রাইসিসে ভোগে না। বরং জীবনসঙ্গিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তার স্বপ্নকে রূপ দিতে লেগে যায়। শ্বশুর-শাশুড়ির এনিভার্সারিতে তিন্নিকে কেক বানাতে বলেছিলাম। অফিস থেকে ফিরে সেই মধ্যমগ্রাম থেকে টালিগঞ্জে কেক দিয়ে গেল তিন্নির বর দেবাশীষ। এ বছর সে নিজের প্রোমোশন প্রত্যাখ্যান করেছে তিন্নির পাশে দাঁড়ানোর জন্য। আর তিন্নিও অপরিসীম আগ্রহ আর সহজাত বুদ্ধিতে নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। বাজারের কেনা ক্রিম ব্যবহার করে না। নিজে হাতে বানায়। সেই খাবারের স্বাদই আলাদা। নতুন নতুন জিনিস পরীক্ষা করতে গিয়ে ওর নিজস্ব ইনোভেশনের একটা বই তৈরি হচ্ছে ক্রমশ। সেইসব সিক্রেট রেসিপি এখানে লিখবো না। লোডশেডিংএর কল্যাণে ওভেন বন্ধ হয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কেমন একটা নতুন কেক তৈরি হয়ে গেছিল সেসব গল্প হয়ত ও নিজেই কোনো দিন করবে। শুধু এটুকু জানিয়ে যাই আমার মায়ের জন্মদিনে ব্লুবেরি চিজকেকের সাথে সেই দুর্ঘটনাজনিত আবিষ্কার বার্ণট বাটার কেকটা তিন্নি কম্পলিমেন্টারি আইটেম হিসেবে পাঠিয়েছিল। অমন জিনিস না ভারতে খেয়েছি (ভারতে অবশ্য স্বীকার করি অভিজ্ঞতা কম), না আমেরিকায়। অদ্ভুত মাদকতাময় বাটারের গন্ধযুক্ত খুব অল্প মিষ্টির সেই কেক হয়ত বা ইউরোপে পাওয়া যায়। কিন্তু সে তো বহু দূরের পথ।
চল্লিশে চাঞ্চল্য এসেছে বলছিলাম না? ঋতুপর্ণার কথা লিখি। ওর সাথে আমার কোনোদিন এক সেকশন হয় নি। স্কুলে থাকতে মুখ চিনতাম। ভাব ছিল না। ২০১৮য় বন্ধুদের সাথে বেড়াতে গিয়ে ঋতুর সাথে প্রথম সময় কাটালাম। ও-ই সব কিছু ব্যবস্থা করেছিল। টেন্ট বুক করা, কে কোথায় থাকবে, কে কি খাবে, কিভাবে যাওয়া-আসা হবে সমস্ত কিছু ঋতুর দায়িত্ব। আমরা গিয়ে আনন্দ করে এসেছি। তখনও ও পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। অফিসের চাকরির বাইরে ও যে অন্য কিছু ভাবছে সেটা জানার সুযোগ পাই নি। অতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আর বয়েসটাও ছিল উনচল্লিশ। চল্লিশ ছোঁয়ামাত্র কি কি হল বলি। ঋতু খবর দিল চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছে। আর সেই সাথে উত্তরপাড়ায় গঙ্গার ধারে একটা লাল টুকটুকে হেরিটেজ বাড়ির ছবি পাঠালো বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপে। বাড়ির নাম বইThek। সেখানে কফি-স্যান্ডুইচ সহযোগে ঠেকবাজি তো হয়ই, সেই সাথে বইও দেখা যায় নেড়েচেড়ে। পছন্দ হলে পকেটস্থ থুড়ি ঝোলাস্থ করারও উপায় আছে। কফি খেতে বইThek এ গেলে একবার ভেতরের ঘরটাতেও উঁকি মেরে আসবেন। গদি বিছিয়ে, মোড়া পেতে সে এক বৈঠকী ব্যাপার। বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান বা বই সংক্রান্ত আলোচনার জন্য এই ঘরটা রাখা আছে। এবারে জানুয়ারি মাসে আমাদের বন্ধুদের আড্ডা জমেছিল এই স্বপ্নের মতো বাড়িটায়। সেদিন হেল্পিং হ্যান্ডদের সবাই উপস্থিত ছিলেন না। আমাদের সাথে আড্ডা দিতে দিতেই ঋতু ক্ষিপ্র হাতে কাস্টমারদের জন্য ক্যাপুচিনো বানালো। বইএর ক্রেতাদের বিল কাটলো। শুনলাম আমাদের ব্যাচের আরেক সোনার টুকরো ছেলে ঋতুর বর সৌম্যও অফিস থেকে ফিরে বইThek এ ঋতুর হাতে হাতে কাজ সামলায়। এমনকি ওদের কলকলে ঝলমলে সাজুনি বুড়ি মেয়েও বিল কেটে সাহায্য করে।
আরেকজনের কথা না বললে এ লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এর কথা আমার আরও আগেই বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু এর জার্নি যখন শুরু হয় আমি তখন ছোট। চল্লিশের দোরগোড়ায় এসে জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করতে কতখানি সাহস ও পরিশ্রম লাগে তা আমি সেদিন বুঝতাম না। সুপর্ণাদির কথা বলছি। এই দিদির সাথে যবে থেকে আলাপ হয়েছে অর্কুটে তখন থেকেই দেখি এর অসাধ্য কিছুই নেই। এমন কোনো হাতের কাজ নেই যা জানে না। যদি কিছু না জানা থেকে থাকে সেটাও শিখে নেয় দশ মিনিটে। তারপর সেই শেখাটাকে প্রোফেশনাল লেভেলে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত থামতেই পারে না। এর চরিত্রে এই একটাই খুঁত। এ বড় পারফেকশনিস্ট। এখনকার মত ঘরে ঘরে বুটিকের ব্যবসা তখনো শুরু হয় নি। ২০১০ বা ১১ হবে। পেপার কুইলিং জুয়েলারি বানাতে শুরু করল। পুজোতে টুকটাক অর্ডার নিত। নিজের হাউসিংএর মধ্যেই। তারপর কুইলিং ছেড়ে কি জানি কি বিচিত্র উপায়ে দেখি কাগজ দিয়ে ঝুমকো দুল বানাচ্ছে, পেন্ডেন্ট বানাচ্ছে। দেখে মনে হয় জার্মান সিলভার বা পিতল। ঝুমকোর দৈর্ঘ্য দেখে ভয় হতে পারে কান ছিঁড়ে পরবে বুঝি। আসলে সব কাগজে বানানো। পালকের মতো হালকা। তার ওপরে কাগজ দিয়েই কুন্দনের নকশা। ভাবলাম মেটাল ফিনিশেই থামলো বুঝি। এনে ফেলল গ্লাস ফিনিশ। তার ওপর নিজের হাতেই এঁকে দিল মধুবনী নকশা। অন্য কেউ হলে ভাবতো যথেষ্ট হয়েছে। এগুলোই আবার করি। কিন্তু এর যাবতীয় তৃপ্তি নতুন কিছু শেখার মধ্যে। এবার শিখল বিডিং। সূক্ষ্ম সেসব নকশার নমুনা রইল কিছু। আজকাল পুজোর দুমাস আগে থেকে দেখি এর রাত জাগা শুরু হয়। আমি থাকি পৃথিবীর অন্য পিঠে। বিকেল বেলা হয়ত কখনো বলি, এখনো শুলে না? অন্যদিক থেকে উত্তর আসবে, এটা বানানোর পর বুঝলাম একটা ডিফেক্ট থেকে গেছে রে। আবার নতুন করে বানাচ্ছি। হলফ করে বলতে পারি, ঐ ডিফেক্ট আপনার আমার কারোর চোখে ধরা পড়ত না। কিন্তু এর যে স্বভাব খারাপ। পারফেকশনিস্ট!
চল্লিশে পৌঁছে অভ্যস্ত জীবনের নিশ্চয়তা থেকে বেরিয়ে নতুন কাজে ঝাঁপ দেওয়া একসময় অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল আমাদের দেশের মেয়েদের কাছে। দিন বদলাচ্ছে। বিশাল কিছু হয়ত নয়, নেহাৎ একটা ছোট পদক্ষেপ। অনেকখানি আত্মবিশ্বাস - আমি পারি, আমিও পারি।