মেয়ে হিসেবে আমি সেভাবে কোন বৈষম্যের শিকার হইনি কখনও। হয়তো এমন অনেক কিছু হয়েছে যার সাথে আমার মতাদর্শে মেলেনি। মন খারাপ হয়েছে অনেক সময়। কিন্তু মেয়ে হওয়ার জন্য এমন কোন সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হইনি যা আমার প্রাপ্য ছিল। বাবা-মা দুজনেই সচেতন ছিলেন এই ব্যাপারে। তাঁদের নিজেদের জীবনেও তাঁরা কিছুটা ব্যতিক্রমী। যে যুগে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে "দেওয়া" হত সেই যুগে তাঁরা বিয়ে "করেছিলেন"। তাঁদের প্রগতিশীল চিন্তা যদি তাঁরা জীবনের সবক্ষেত্রে দেখাতে পারতেন তাহলে তো খুবই ভালো হত, কিন্তু সব ভালো তো একসাথে হয় না, যেটুকু হয়েছে সেটুকুকে স্বীকৃতি দিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারি। এমএ ফার্স্ট ইয়ারে মায়ের বিয়ে হয়। এমএ আর বিএড দুটো পরীক্ষাই মা বিয়ের পর পাশ করেন। বাবার খুব আগ্রহ ছিল মায়ের পড়াশোনায়। বাড়ীর অবস্থা অনুকূল ছিল না, কিন্তু তার মধ্যেও বাবার জেদে আর মায়ের অধ্যব্সায়ে মায়ের পড়াশোনা শেষ হয়। দুজনেই একই চাকরী করতেন - শিক্ষকতা। বাবাকে বহুবার দেখেছি ইংরিজিতে কিছু লিখলে মাকে দেখিয়ে নিচ্ছেন। এই জায়গাটায় কোন ইগো নেই। যদিও অন্য নানা বিষয়ে আছে। দুজনের কেউই পারফেক্ট নন এবং আমাদের পরিবারও পিতৃতন্ত্র থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু শিক্ষা যে মেয়েদের মুক্তি আনবে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিল না। আর আমারও হয়তো সেই কারণেই নিজেকে বঞ্চিত মনে হয় না, কারণ অন্য কোথাও যদি কোন খামতি থেকেও থাকে শিক্ষা মানুষকে যে প্ল্যাটফর্মটা দেয় সেখান থেকে সে অনেক কিছু অপ্রাপ্তিই পুষিয়ে নিতে পারে।
আমার শাশুড়ীর গল্পটা আবার একটু অন্যরকম। তাঁর বিয়েটা পড়াশোনা শেষ করার আগেই হয়ে যায়। আর শ্বশুর খুবই নির্বিরোধী, নিরীহ মানুষ। এবং যে বাড়ীতে বিয়ে হল সেখানে মেয়েদের পড়াশোনাটাকে বাহূল্য মনে করা হত। কাজেই কাকীমার ডিগ্রী কমপ্লিট হল না। চাকরী করার কথা ভাবা তো ব্লাসফেমির সমতুল্য। তাই সেই বাড়ীতে থেকেই কিছু বছর পরে যখন তিনি স্বাধীন ব্যবসা শুরু করলেন তখন যে তিনি কোথা থেকে সাহস পেলেন, কি করেই বা বুদ্ধি করে ব্যবসা বাড়ালেন তা আমি আজও হিসেব করে উঠতে পারি না। কাকীমাকে দেখে এটাও কখনও মনে হয় না ফেমিনিজম নিয়ে ওনার কোন ভাবনাচিন্তা আছে। বরং অনেক ব্যাপারেই বেশ রক্ষণশীল। কিন্তু একটা সহজাত আত্মমর্যাদাবোধ সম্ভবত ওনাকে দিয়ে এই অসাধ্য সাধন করিয়েছে। আর সেই সাথে ওনাকে এমন করে গড়ে তুলেছে যাতে প্রথাগত শিক্ষা শেষ না করেও তিনি পৃথিবী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং বেশ খোলা মনের মানুষ। দীর্ঘদিনের সামাজিক অভ্যেস তাঁর একরকম চিন্তাধারা তৈরী করে দিয়েছে বটে, কিন্তু খেয়াল করে দেখেছি যুক্তি দিয়ে বোঝালে তিনি বোঝেন। হয়তো নিজের জীবনে সবটা মানতে পারেন না, কিন্তু অন্যের ওপর নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না। এই সহিষ্ণুতা শুধু আজকের যুগে নয়, চিরকালই বিরল।
সেদিক দিয়ে দেখলে আমার বড় হওয়াটা একেবারেই মেয়েমানুষ থেকে মানুষ হয়ে ওঠার গল্প নয়। আমার শুরুটা মানুষ হিসেবেই হয়েছিল। আমি সেখান থেকে আরো উন্নততর মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি। বৈষম্য যেটুকু পেয়েছি তা বাইরের লোকের থেকে। সে আমার মনে তেমন দাগ কাটেনি। অনেকদিন পর্যন্ত আমি তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রয়োজন অনুভব করিনি। এইদিনটা ক্যালেন্ডারে বিশেষ জায়গা করে নিল কাজাখস্তানে যাওয়ার পর। সমস্ত সোভিয়েত দেশেই এই দিনটা ধুমধাম করে পালন হয়। আটই মার্চ মেয়েদের জন্য বিশেষ দিন। সেদিন তারা কোন কাজ করবে না। বাড়ির ছেলেরা সারা দিনের রান্না করবে। মেয়েদের গিফট দেবে। তাদের সারাদিন খুশিতে রাখবে। এইদিন ফুলের দাম আকাশছোঁয়া। যে তিনবছর ওখানে ছিলাম প্রতিবারই ছেলে কলিগরা ফুল দিত, লাঞ্চ খাওয়াতো। আটই মার্চ ছুটি থাকতো। সাত তারিখে অফিসের সেলিব্রেশন হয়ে যেত। কাজাখ্স্তান যাওয়ার আগে আমার সোভিয়েত দেশগুলো সম্পর্কে একটা ভাসা ভাসা রূপকথা রূপকথা ধারনা ছিল। সেদেশে ছেলে-মেয়ের তফাৎ নেই, সবার সমান অধিকার - এসব ভাবতাম। কিন্তু যাওয়ার পর ধারনাগুলো বেশ ধাক্কা খেল। এই যে আটই মার্চের প্যাম্পারিং - এসব কিন্তু ঐ একটা দিনের জন্যই। ন'তারিখ থেকেই কাজাখ পুরুষ আবার তার সংসারে প্রভু। আর তার মেয়েদের সাথে ঘরের কাজে হাত লাগানোর দরকার নেই। আরো যেটা অবাক করতো তা হল তা হল আটই মার্চের যা কিছু দামী ফুল আসতো, যা কিছু খাবার - সে সব শুধু আমাদের জন্যই। ঝাঁট দেওয়া, মোছা, বাথরুম পরিষ্কার করার মহিলা কর্মচারীদের জন্য কখনও কাউকে ফুল কিনতে দেখি নি। জানি না বাড়ি ফিরলে তাদের কেউ শুভেচ্ছা জানায় কিনা। ফুল না পাক, অন্তত ঐ একটা দিনের জন্যও বাড়ির পুরুষরা তাদের রান্না করে খাওয়ায় কিনা!
এইসব ভাবতে গিয়েই নিজের দেশের কথা মনে পড়ে। আমি যে বাড়িতে জন্মেছি সেখানে আমার সাথে কোন বৈষম্য হয়নি। আমার বাবার বাড়িতে মেয়েদের জন্মদিনে পায়েস করার রীতি নেই বলে মা আমার ভাইয়ের জন্মদিনেও কখনও পায়েস করেননি। আমি নিজে এইসব অর্থহীন পারিবারিক রীতিনীতি টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী নই, কিন্তু মা-ও তাঁর মত করে বৈষম্যের প্রতিবাদ করে গেছেন। সবাই এই পরিবেশে জন্মায় না। নিজের মায়ের কাছে বৈষম্যের স্বীকার হয়েছে এমন উদাহরণ রাশি রাশি আছে। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দুর্ব্যবহার পাওয়া তো এই সমাজে স্বাভাবিক ধরা হয়। কাজেই আলাদা করে একটা নারীদিবসের দরকার আমাদের এখনও আছে। তবে সেটা সোভিয়েত দেশের নারীদিবসের মত হলে সে আদিখ্যেতায় না যাওয়াই ভালো। তাৎপর্য্যপূর্ণ ভাবে এই বছরের নারীদিবসের আগের দিনটাই ছিল শিবরাত্রি। হাজার হাজার মেয়ে এইদিন নির্জলা উপোস থেকে ব্রত পালন করেছে। কি চেয়েছে আমি নিশ্চিত জানি না। মা-দিদাকেও এই পুজো করতে দেখেছি ছোট থেকে। শেষ বয়েসে অসুস্থতার মধ্যেও দিদা উপোস ছাড়ার কথা ভাবেনি। বহু বহু মেয়ে এভাবেই জীবন কাটায়। ভেবে দেখে না পৃথিবীর কোন ধর্মেই মেয়েদের জন্য কোন সুবিধের কথা বলা হয় নি। কোন ধর্মই মেয়েদের সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে ভাবেনি। হিন্দু ধর্মে একসময় মেয়েদের পুড়িয়ে মারা হত। একবার বিধবা হলে সারা জীবন সাদা থান পরিয়ে মাথা মুড়িয়ে আলোচাল খাইয়ে রাখা হত। লেখাপড়ার অধিকার ছিল না। যে দুজন মানুষের মেরুদন্ডের জোরে হিন্দু মেয়েরা রক্ষা পেল - সেই রামমোহন রায় আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে মেয়েরা ভুলে গেছে। ঠাকুরঘরে নুড়ি-পাথর আর নারীস্পর্শে যাদের শরীর অশুচি হয় সেইসব দিব্যপুরুষদের পট সাজিয়ে মেয়েরা আজও পুতুলখেলা খেলে যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তি কবে? একই রকম চাকরী করেও আমার মাকে চিরকাল দেখেছি ঘরের সমস্ত কাজ একা হাতে করতে। কাকীমাকে শুনেছি বাড়ির সবার খুঁটিনাটি যোগান দিয়ে তারপর অপরাধীর মত নিজের কাজে বেরোতে। নিজের কাজের জন্য অপরাধবোধ থেকে মুক্তি কবে? ঘরের কাজে পুরুষসঙ্গীটির থেকে নিঃসঙ্কোচে সাহায্য দাবী আর কবে?
আমাদের আগের প্রজন্ম কিছু চেষ্টা করেছেন, কিছু করেন নি। তাঁদের থেকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় আমাদের প্রজন্ম অনেক এগিয়ে। আগের প্রজন্মের মেয়েরা যে সংস্কারগুলো মেনে চলতে বাধ্য হয়েছেন সেই বাধ্যতা এই প্রজন্মের নেই। অন্তত এই প্রজন্মের শহুরে মেয়েদের তো অবশ্যই নেই। ইচ্ছে করলে তারা পারে মুক্তি এনে দিতে - নিজেদের ও আরো অনেককে।
No comments:
Post a Comment