আজ থেকে একবছর আগে এই দিনটিতে - ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৫ ঢাকা শহরে লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে খুন করা হয়। খবরটা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নি। অভিজিৎ রায়কে তাঁর লেখার মাধ্যমে চিনতাম। তাঁর অনেক লেখার সাথেই সহমত প্রকাশ করতাম। এবং সেই লেখাগুলোই ছিল তাঁকে কুপিয়ে মারার কারন। আমার চেনা-পরিচিতের বৃত্তে একা অভিজিৎ রায় বিশ্বাসের ভাইরাসের বিরুদ্ধে কলম ধরেন নি। অনেক বন্ধু এ বিষয়ে লেখেন, যদি কলমের তেমন জোর থাকত তাহলে আমিও লিখতাম। অভিজিৎএর মৃত্যু আমাদের সকলের সংখ্যালঘুত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এবং ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। এর তিনমাসের মধ্যে আরো দুজন লেখক ওয়াশিকুর রহমান বাবু এবং অনন্ত বিজয় দাস একই ভাবে প্রাণ দিলেন। কিছুদিন লেখালেখি হল। তারপর আমরা এদের নাম ভুলে গেলাম। খুবই স্বাভবিক। মৃতদেহের অভাব পড়ে নি। মধ্যপ্রাচ্য থেকে, আফ্রিকা থেকে নৌকা বোঝাই মৃতদেহ রোজই তীরে এসে ভিড়ছে। মৃত্যুর গল্প ছাড়া বিশেষ গল্প নেই আমাদের। তবু কিছু কিছু মৃত্যু বড্ড অবিশ্বাস্য লাগে। অনেকবার যাচাই করেও বিশ্বাস হতে চায় না যে এমন হতে পারে। যখন শুনলাম মহম্মদ ইকলাখ নামে একজন মানুষকে তার বাড়ি থেকে টেনে বার করে পিটিয়ে মারা হয়েছে কারন কিছু মানুষের নাকি "মনে হয়েছিল" তিনি ফ্রিজে গরুর মাংস রেখেছেন তখন আমি একটার পর একটা খবরের কাগজ ঘেঁটে গেছি এই আশায় যে এটা ভুয়ো খবর। আমি ভাবতে পারি নি কাউকে তার নিজের বাড়ির ফ্রিজে কিছু রাখার জন্য মেরে ফেলা যায়। আরো ভাবতে পারি নি - এই খবর পাওয়ার পরেও পুলিশ প্রথমে ফ্রিজে রাখা মাংসের ফরেনসিক তদন্ত করায় সেটা সত্যিই গরুর মাংস কিনা যাচাই করতে। যেন ফ্রিজে রাখা মাংসটা গরুর হলেই আর কিচ্ছু বলার থাকত না।
অথচ শুনতে পাই এই উপমহাদেশে এখনও নাকি অবস্থা তেমন আশঙ্কাজনক নয়। শুনতে পাই অযথাই দুশ্চিন্তা করছি। আসলে নাকি সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে সম্প্রীতি অক্ষুন্ন। অনেকে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। তাঁদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতার উদাহরণ দেন। আমি তাঁদের অবিশ্বাস করি না। এমনকি যাঁদের কট্টর সাম্প্রদায়িক পোস্ট করতে দেখি আমার ধারনা তাঁদেরও ব্যক্তিগত জীবনে অন্য সম্প্রদায়ের বন্ধু আছে। সেই বন্ধুদের সাথে তাঁরা আড্ডা মারেন, কাজ করেন, হয়ত কিছুটা জীবনও ভাগ করে নেন। ব্যক্তিগত পরিসরে অন্য সম্প্রদায়ের কোন মানুষের প্রতি এঁদের আচরণ সবটাই শত্রুভাবাপন্ন নয়। কিন্তু এই মানুষেরাই যখন কোন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন তখন তাঁদের কাছে ব্যক্তিগত পরিচিতি ঝাপসা হয়ে আসে। প্রতিবেশীকে তখন আর প্রতিবেশী বলে চিনতে মন চায় না। সে তখন অন্য দলের মুখ হয়ে যায়।
একবছর আগেও আমি ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ সম্পর্কে বেশ উদাসীন ছিলাম। বন্ধুদের সাথে এই নিয়ে তর্ক হয়েছে। আস্তিকদের কাছে আমি নাস্তিক হয়েছি। নাস্তিকেরাও আমায় দলে নিতে চায়নি কারন তাদের কাছে আমি আস্তিক মানুষের ধর্মাচরণের অধিকার নিয়ে সওয়াল করেছি। আমি তখনও দেখতে পাইনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে ব্যক্তিগত আচরণ বলে কিছু থাকতে পারে না। ধর্মস্থানগুলো কোনটাই একা মানুষের ঈশ্বরকে খোঁজার জায়গা নয়। ধর্মস্থান আসলে চিহ্নিতকরণের জায়গা। যে চিহ্ন দেখে বোঝা যাবে পাশে ব্সা মানুষটি আমার দলের, নাকি অন্য দলের। তারপর চিহ্ন অনুযায়ী কোনও হত্যালীলায় অংশ নিতে হবে। অথবা তার বদলা নিতে হবে। এবং কোন অবস্থাতেই দলচ্যুত হওয়া চলবে না। কারন একাকীত্বকে আমরা ভয় পাই। মহম্মদ ইকলাখের মৃত্যুর পর বহু মানুষকে বলতে শুনেছি - পিটিয়ে মারা উচিৎ হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওদের গরুই বা খেতে হবে কেন! অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর শুনেছি - কুপিয়ে খুন খুবই অন্যায়, কিন্তু ও এত কিছু না লিখলেও তো পারত! এই "কিন্তু"টা বড় বিপজ্জনক। একটা খুনকে নিন্দা করার সময়েও যদি "কিন্তু" শব্দটা আসে তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার চিহ্নিতকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। আপনার ধর্মাচরণ আর ব্যক্তিগত নেই, তা দলগত। এই দলগত ধর্মাচরণের অধিকারের প্রতি আজ আর আমার সহানুভূতি নেই।
No comments:
Post a Comment