About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Saturday, December 25, 2010

ছায়াপথের কথা - ৩

গল্প – ৩ (স্যান উপজাতি, কালাহারি)
-----------------------------

অনেক অনেক দিন আগের কথা। কৈশোরের উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে তার মায়ের হাত ধরে জীবনে প্রথমবার গ্রামের বাইরে যাচ্ছিল। কোন উত্তেজনা নয়, একরাশ ভয় কিলবিল করছে তার ছোট্ট মাথায়। সে দেখতে পেয়েছে একটা হায়না স্যাঁত করে লুকিয়ে পড়ল বুকসমান উঁচু ঘাসের জঙ্গলে। মেটে রঙের টিলাটার ওপর কিচমিচ করছে তিনটে বেবুন। একটা ধেড়ে ইঁদুর ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল তার পায়ের ওপর দিয়ে। গেল ওদিকেই যেখানে তার মা রিড ঘাসের চাটাই দিয়ে তার জন্য একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে রেখেছে। যতদিন না সে পূর্ণ নারী হয়ে ওঠে ততদিন তাকে এই ঘরেই থাকতে হবে। তার বুক ফেটে কান্না এল। ইচ্ছে হল মা ’ কে বলে, ‘ দোহাই তোমার, ফেলে যেও না এখানে আমায়। ত্রিসীমানায় মানুষ নেই কোন। কেমন করে থাকব আমি একা একা? ’ কিচ্ছুটি বলতে পারল না সে। তাদের সমাজে এমনটাই নিয়ম। এখানেই থাকতে হবে তাকে পূর্ণিমা পর্যন্ত – যতক্ষণ না সে পূর্ণতা পায়। সে দেখল আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। অ্যাকাশিয়ার জঙ্গলে মিলিয়ে যাচ্ছে তার মায়ের ছায়া।

একটা করে দিন যায়। রাতের চাঁদ একফালি বাড়ে। নিঝুম অন্ধকারে কুঁড়েঘরের দুয়োরে বসে সে আকাশের একমাত্র আলোটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলায় শোনা গল্প মনে পড়ে তার। এই চাঁদ, তারা, সূর্য, জল, জঙ্গল, মরুভূমি – সবকিছু তৈরী করেছেন ক্কাগেন – কালাহারির পবিত্র পোকা। একসময় যখন চাঁদ ছিল না, যখন সূর্য ডুবলেই নিকশ অন্ধকার, তখন ক্কাগেন তাঁর পায়ের জুতো খুলে বললেন, তোমাকে দিয়ে আমি চাঁদ বানালাম। জুতো যেমন মানুষকে নিয়ে যায় ঘাসের জঙ্গল পেরিয়ে মরুভূমির এপার থেকে ওপারে, তুমিও তেমন ঘুরে বেড়াবে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে আলো নিয়ে। অন্ধকারকে তুমি ফিকে করবে।

কিন্তু ফিকে কই! অন্ধকার যে এখনও বড্ড জমাট – মেয়েটি ভাবে। ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয় আকাশে আরও একটু আলো জুড়ে দিলে কেমন হয়! সে তো জানে কোন গাছের মূলে আলো জ্বলে ভালো, কোন মূলে সুগন্ধ ছড়ায়। আধভাঙা চাঁদের ফ্যাকাশে আলোতেই সে একটা গাছের ডাল খুঁজে নেয়। মাটি খুঁড়তে থাকে। একটা-দুটো না, অনেক অনেক মূল চাই তার। অনেক অনেক আলো সে জ্বালতে চায় আকাশে – অন্ধকার তার একদম পছন্দ নয়।

একরাশ মূল জোগাড় করে কুঁড়েতে ফেরে সে। একটুকরো আগুন্ন জ্বালিয়ে গেছিল তার মা। তা এখনও জ্বলছে ধিকিধিকি। সে মূলগুলো ছুঁড়ে দেয় আগুনে। সুগন্ধী সাদা ধোঁয়ায় ঘর ভরে ওঠে। আগুন থেকে কিছুটা ছাই তুলে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। ‘ তোমার নাম দিলাম ক্কো – ছায়াপথ – রাতের অন্ধকারে তুমি আলো ছড়াবে, পথহারাকে পথ দেখাবে ’ – এই বলে সে মুঠোভরা ছাই ছুঁড়ে দেয় আকাশে। বিন্দু বিন্দু সাদা ছাই ছড়িয়ে পড়ে আকাশের এপার থেকে ওপারে। রাতের অন্ধকারে দ্যুতি ছড়ায়। যারা পথ চলছে একা একা, আলো দেখায় তাদের।

Friday, December 24, 2010

ছায়াপথের কথা - ২

গল্প – ২ (উৎসঃ টোবা ইন্ডিয়ান, আর্জেন্টিনা)
--------------------------------

[ টোবা ইন্ডিয়ানদের দেখা পাওয়া যাবে দক্ষিণ আমেরিকার গ্র্যান চাকো অঞ্চলে। বলিভিয়া, প্যারাগুয়ে আর আর্জেন্টিনার সীমান্তবর্তী এই এলাকা দক্ষিণ আমেরিকার উষ্ণতম অঞ্চলগুলির একটি। টোবারা ছিল যাযাবর। পঞ্চাশ-ষাট জনের ছোট ছোট দলে ঘুরে বেড়াত। খরাপ্রবণ এই অঞ্চলে খাবার খুঁজে পাওয়াই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা। তাদের ছায়াপথের গল্পও তাই খিদের গল্প।

টোবাদের কল্পনায় সূর্য হল এক জরাগ্রস্ত বুড়ি। কচ্ছপের মত খসখসে ভারী শরীর সে অতি কষ্টে বয়ে নিয়ে চলে আকাশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। দিন যেন ফুরোতেই চায় না।

দক্ষিণ আমেরিকার ঐ অঞ্চলে গ্রীষ্মের দিনগুলি দীর্ঘ, অগ্নিবর্ষী – তাই কি সূর্যের তুলনা কচ্ছপের সাথে? ]


সেটা ছিল গ্রীষ্মকাল। সূর্যবুড়ি সবে ঘুম ভেঙে উঠেছে। আমাদের গল্পের নায়ক চিন্নি, একটি চাতকপাখী, মন দিয়ে খাদের ওপর বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে থাকা নড়বড়ে সাঁকোটা মেরামত করছিল। সাঁকো বলতে কিছুই না – একখানি গাছের গুঁড়ি। যেন আধশোয়া হয়ে ঠেস দিয়েছে এই পাহাড় থেকে ঐ পাহাড়ে। মধ্যিখানে গভীর খাদ। এপার থেকে ওপারের গাছগুলিকে দেখায় ঘন সবুজ। এদিকের মত ঝলসানো নয়। খাবারের আকাল পড়লে ওদিক পানে যাওয়া ছাড়া উপায় কি! অথচ দেখ, পারাপারের ধকল নিতে নিতে কেমন জীর্ণ হয়েছে সাঁকোটা। এখনই না সারালে যে কোন মুহুর্তে ভেঙে পড়বে। এইসব ভাবতে ভাবতে জলদি ঠোঁট চালায় চিন্নি। কারোব গাছের ঝুরি দিয়ে কষে বাঁধতে থাকে সাঁকোটাকে পাথরের সাথে।

এমন সময় হাসির আওয়াজ শোনা যায়। টুকটাক দুয়েকটা কথা। দীর্ঘশ্বাস। চিন্নি দেখতে পায় দশ-বারোটি মেয়ের একটি দল এদিক পানে আসছে। - ‘ সেই সকাল থেকে খুঁজে খুঁজে কি পেলাম দেখ! এক টুকরো কন্দ। তাও আবার পচা। এটা তুই কার মুখে দিবি বল! ’ – ‘ এখনই হাল ছেড়ে দিলি! সূয্যিবুড়ি তো এখনও খাপই খোলে নি ’ । - ‘ চল ঐ কারোব গাছের ছায়ায় জিরৈ দু ’ দন্ড। তারপর ঠিক করা যাবে কোন দিকে যাওয়া যায় ’ । ওরা চিন্নির পাশে এসেই বসে। খেয়ালই করে না চিন্নিকে। গ্রীষ্মকাল। এই সাত সকালেও রোদ্দুর ঠা ঠা করছে। ওরই মধ্যে একটু হাওয়া খেলে। চানার ফলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে সেই হাওয়ায়। - ‘ কি মিষ্টি বাস গো! ’ – মেয়ের দলের সবচেয়ে ছোটটি পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় খাদের দিকে – ‘ ঐ দেখ, ঐ পারে ফল ধরে আছে গাছে! কেমন রাঙা, আগুনরঙা ফল! ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে গাছটা! চল দিদি, ওপারে যাই আমরা ’ । চানার ফলের গন্ধে সকলেরই মরে থাকা খিদে চনমন করে উঠেছে। - ‘ কিন্তু যাবি কি করে? এই গভীর খাদ পেরোব কি করে আমরা? ’ – ‘ আরে! এই দেখ! এই ঝোপের আড়ালে একখানা গাছের গুঁড়ি পাতা রয়েছে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। আর চিন্তা কিসের? চল চল! ’ – ‘ না না, এখনও কাজ শেষ হয়নি আমার, এখনই উঠো না তোমরা সাঁকোতে ’ – চেঁচিয়ে ওঠে চিন্নি। কিন্তু চিন্নির ভাষা মেয়েরা বুঝতেই পারে না। তাদের চোখে তখন আগুনরঙা ফল, পেটে গনগনে খিদে। সাঁকোর ওপর ছুটতে থাকে তারা। ওপারে পৌঁছতে হবে জলদি! খাদের মধ্যে শোঁ শোঁ করে হাওয়া দেয়। পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে সে হাওয়া পাক খেতে খেতে উল্টো ধাক্কা দেয় জরাজীর্ণ সাঁকোতে। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে নড়বড়ে কাঠের গুঁড়ি সবকটা মেয়েকে নিয়ে। তাদের আর ওপারে যাওয়া হল না কোনদিন।

চিন্নি থুম মেরে বসে আছে খাদের কিনারে। সূর্যবুড়ি আগুন ঢালছে মাথার ওপর। একটু আগে যেখানে সাঁকোটা ছিল এখন সেখানে সেখানে হাঁ হাঁ করছে খাদ। ঝোপের মধ্যে খড়মড় শব্দ হয়। চিন্নি নড়চড়ে বসে। লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে আসে এক সারস। - ‘ কে হে তুমি? কোত্থেকে আসছ? ’ – শুধোয় চিন্নি। - ‘ আসছি বহুদূর থেকে। সেখানে সব খাবার ফুরিয়েছে ’ । - ‘ যাবে কোথায়? ’ – ‘ আর কোথায়! যেখানে খাবার আছে সেইখানে! শুনেছি ওদিকের পাহাড়ে এখনও খরা নামে নি। কিন্তু পেরোব কি করে? কাছাকাছি কোন সাঁকো নেই? ’ – ‘ ছিল হে। এখানেই ছিল ’ – বিমর্ষ চিন্নি বলে – ‘ ভার নিতে পারল না। ভেঙে পড়ল চোখের সামনে। নড়বড় করছিল যখন সারাবার চেষ্টা করেছিলাম। নতুন সাঁকো বানাব এমন কারিগর তো আমি নই! ’ – ‘ কিচ্ছুটি ভেবো না তুমি। আমি বানিয়ে দেব নতুন সাঁকো ’ – বলল সারস। লম্বা শক্ত ঠোঁট দিয়ে কাঠ চিরে তক্তা বানাতে শুরু করে দিল। গাছের ঝুরি দিয়ে কষে বাঁধল তাদের। তারপর পাম গাছের পাতা দিয়ে সুন্দর রেলিং বানিয়ে দিল একখানা। সূর্যবুড়ি ততক্ষণে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। - ‘ কই হে চিন্নি! নতুন সাঁকোটা কেমন হল দেখে যাও একবার! ’ – হাঁক দেয় সারস। – ‘ বাহ! তুমি তো ভারি কাজের মানুষ হে! সাঁকোর মত সাঁকো হয়েছে একটা ’ – তারিফ করে চিন্নি – ‘ চলো যাওয়া যাক তাহলে ওপারে ’ । - ‘ দাঁড়াও, কাজ বাকি থেকে গেছে একটা ’ – বলল সারস – ‘ এখানে বড় ঝোপঝাড়। একটা পথ বানাতে হবে যাতে সবাই সাঁকোটা দেখতে পায়। খাবারের খোঁজে এসে সাঁকো খুঁজে না পেয়ে ফিরে যেতে হলে সে ভারী বিশ্রী ব্যাপার হবে ’ । পশ্চিম আকাশ লাল করে সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। সারস সেই রঙে রঙ মিলিয়ে ঝোপে আগুন ধরিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ল গাছ থেকে গাছে। মস্ত বড় সাদা ধোঁয়ার কুন্ডলী পাক খেতে খেতে উঠতে লাগল আকাশপানে। চিন্নি দেখল অন্ধকার আকাশের বুক চিরে এগিয়ে চলছে একটা উঙ্কÄল সাদা পথ – নাগাইক – সেই পথ ধরে হাঁটলে খাওয়া-পরার আর একটুও অভাব থাকবে না।

Thursday, December 23, 2010

ছায়াপথের কথা - ১

ছায়াপথ নিয়ে পৃথিবীর নানা দেশে নানা গল্প আছে। তারই কিছু অনুবাদ করব।


গল্প – ১ (উৎসঃ সপ্তম শতাব্দীর জাপান। তবে আদতে নাকি গল্পটি চীন থেকে জাপানে এসেছে)
----------------------------------------------------------------

জাপানদেশে কামি নামে এক দেবতা ছিলেন। তিনি হলেন স্বর্গের রাজা। ইন্দ্র বলা চলে, তবে আমাদের ইন্দ্রের মত ফাঁকিবাজ নন মোটেই। পৃথিবীটা নিয়ম মেনে চলছে কিনা, সবাই মন দিয়ে নিজের কাজ করছে কিনা সেসব দিকে কামির কড়া নজর। কামির একটি মেয়ে। তার নাম তানাবাতা। যেমন তার রূপ, তেমনি গুণ। তার মত সুতো কাটতে আর কাপড় বুনতে আর কেউ পারত না। তার বোনা কাপড় ছাড়া কামির মনই উঠত না। রোজ ভোরে সূর্যের প্রথম আলোটি যে মুহুর্তে স্বর্গপূরীর দুয়োরে এসে কড়া নাড়ে, তানাবাতা অমনি তার তাঁতটি নিয়ে কাজে লেগে যায়। সারাদিন ধরে সূর্য চলে আকাশপথে, তানাবাতার তাঁত থামে না। সুতো ঘুরতে থাকে সামনে পিছে, তার থেকে নামে ছন্দ, ছন্দ থেকে আসে কবিতা। দিনের শেষে সূর্য যখন পরিক্রমা শেষ করে, সবাই দেখে তানাবাতা তার বাবার জন্য বানিয়ে ফেলেছে সবচেয়ে সূক্ষতম কাপড়, আর নিজের জন্য আস্ত একখানি কবিতা।

একদিন তানাবাতা নিজের ঘরে বসে তাঁত বুনছে, এমন সময় এক মানুষ এসে দাঁড়ায় তার দুয়োরে। মানুষটি বড় রূপবান। একপাল গরু-মহিষ নিয়ে সে চরাতে যাচ্ছে কোথাও। তানাবাতাকে সে বলল, ‘ আমি রোজ যাই এই পথে আর তোমাদের উঠোনে কাপড় শুকোতে দেখি। এত সুন্দর কাপড় আমি আর কোত্থাও দেখি নি। তুমি বুঝি এই কাপড় বোনো? ’ তানাবাতা ভারী লাজুক মেয়ে। সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। মানুষটি এবার বলল, ‘ আমার নাম হিকোবুশি। তোমার নামটি তো বললে না? ’ তানাবাতা চোখ তুলে হিকোবুশির দিকে তাকাল আর দেখা মাত্র মানুষটিকে খুব পছন্দ হয়ে গেল তার। কোনমতে নিজের নামটি বলল তাকে। হিকোবুশিরও ভারী ভালো লেগেছে এই মেয়েটিকে। সে সাহস করে বলল, ‘ আমি যাচ্ছি এই গরু-মহিষ চরাতে সামনের সবুজ মাঠে। হাঁটবে একটু আমার সাথে? ’ যদিও সারাদিন ধরে কাপড় বোনাই তানাবাতার কাজ, তবু তার খুব ইচ্ছে হল এই মানুষটির সাথে খানিক ঘুরে আসে। সে তার তাঁত রেখে হিকোবুশির সাথে বেরোল। সবুজ মখমলের মত মায়াবী মাঠে খরগোস ছুটে বেড়াচ্ছে, কাঠবেড়ালী তিড়িং-বিড়িং করছে ইতি-উতি, একটি ইঁদুর গর্ত থেকে মুখ বার করেই আবার লুকিয়ে পড়ল – তানাবাতা বহুদিন এভাবে বাইরে বেরোয় নি। হিকোবুশি তার কোমরবন্ধ থেকে ছোট্ট বাঁশিটি বার করে বাজাতে লাগল। সুর ভাসছে আকাশে-বাতাসে। গুচ্ছ গুচ্ছ উঙ্কÄল রঙীন ফুল ফুটে আছে। তানাবাতা ভারী যত্ন করে হিকোবুশির জন্য বুনোফুলের কোমরবন্ধ বানিয়ে দিল। কবিতা জন্মাল আবার – হিকোবুশির সুরে, সেই মায়াভরা মাঠের উঙ্কÄলতায় আর তানাবাতার যত্নে।

সন্ধ্যে নামে। হিকোবুশিকে নিয়ে তানাবাতা ঘরে ফিরল। কামির কাছে গিয়ে বলল, ‘ বাবা, আমি হিকোবুশিকে বিয়ে করতে চাই ’ । কামি অরাজি হলেন না। তানাবাতা আর হিকোবুশির বিয়ে হল। কাছেই একটি ছোট্ট কুটিরে নতুন সংসার পাতল তারা। তানাবাতার তাঁত বসল বসার ঘরে। হিকোবুশির গরু-মহিষের পাল সবুজ মাঠে চরে বেড়াতে লাগল। নবদম্পতি নিজেদের নিয়ে মগ্ন। হিকোবুশি বাঁশিতে সুর তোলে, তানাবাতার মনে কবিতারা জন্ম নেয়। সূর্যদেবতা কতবার আকাশ এপার-ওপার করল – হিকোবুশির সুর থামল না, তানাবাতার কবিতারা পথ ভুলল না। আর এদিকে তাঁতে জমল ধুলো, গরু-মহিষের দল কে কোথায় ছিটকে গেল কে জানে!

কামি বহুদিন ধরে দেখছিলেন আর ক্রমশই তাঁর রাগ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রইল না। ‘ দিনের পর দিন কাজে অবহেলা করেছ তোমরা। তাই তোমাদের আলাদা করে দেব চিরকালের মত ’ – এই বলে কামি স্বর্গের বাঁধ খুলে দিলেন আর তক্ষুনি সাপের ফণার মত উন্মত্ত জলরাশি আছড়ে পড়ল হিকোবুশি আর তানাবাতার মাঝখানে। তানাবাতা দেখল হিকোবুশি বহুদূরে সরে যাচ্ছে। আবছা হতে হতে শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেল সে। তাদের দুজনের মধ্যে যোজনবিস্তৃত অনন্ত জলধারা বয়ে চলল আজীবন। পৃথিবীর মানুষেরা তাকেই চেনে ছায়াপথ বলে।

তবে দুঃখের গল্প আমার ভালো লাগে না। জাপানীদেরও লাগত না। এই গল্পও তাই এখানেই শেষ নয়। তানাবাতার দিন চলে আগের মত। সূর্য এসে ঘুম ভাঙায়। সে তার তাঁতটি নিয়ে বসে কামির জন্য কাপড় বানাতে। হিকোবুশির কথা ভেবে মন ভারী হয়ে ওঠে, হাত চলে না। দিনের শেষে কামি এসে দেখেন তাঁর নতুন বানানো কাপড় মেয়ের চোখের জলে ভেজা। তানাবাতা বলে, ‘ বাবা, আমার কাজে ভুল হচ্ছে। আমি জানি আমার শাস্তিই প্রাপ্য। তোমার জন্য তিনভুবনের সেরা কাপড় বানাতাম আমি। কিন্তু সে কাপড় আমি আর বুনতে পারছি না। হিকোবুশি চলে যাওয়ার পর আমার মন ভেঙে গেছে। যদি আমাকে আবার আগের মত কাপড় বুনতে হয়, তাহলে এটুকু আশা অন্তত আমায় দাও যে একদিন না একদিন সামান্যতম সময়ের জন্যও আবার হিকোবুশির সাথে আমার দেখা হবে ’ । কামি দেখলেন এই প্রার্থনা মঞ্জুর করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি বললেন, ‘ বেশ তাই হবে। বছরে একবার, সপ্তম মাসের সপ্তম রাতে তুমি হিকোবুশিকে দেখতে পাবে। তবে হ্যাঁ, যদি সেই রাত মেঘমুক্ত থাকে তবেই। আমার নির্দেশে এক হাজার পাখি এসে তখন সেতু বেঁধে দেবে নদীর ওপর। সেই সেতুর ওপর দেখা হবে তোমার আর হিকোবুশির ’ ।

সেই থেকে প্রতি বছর অগাস্ট মাসের সপ্তমীতে হিকোবুশি আর তানাবাতা অপেক্ষা করে থাকে মেঘমুক্ত আকাশের জন্য। আগেকার দিনে অগাস্ট মাস পড়লেই জাপানীরা কচি সবুজ বাঁশের একটি টুকরো সাজিয়ে রাখত তাদের বাগানে। বাঁশের গায়ে রঙীন কাগজ ় এ কবিতা লিখে ঝুলিয়ে দিত। এই উৎসবের নাম ছিল তানাবাতা-সামা। অগাস্ট মাস তারাখসার মাস। গ্রীক পুরাণে যাকে আমরা পারসিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জ বলে জানি, আকাশের সেই প্রান্ত থেকে অগাস্ট মাসে উল্কাবৃষ্টি হয়। সপ্তমী তিথিতে যদি আকাশ পরিস্কার থাকে, যদি তারাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এদিক-ওদিক তাহলে জাপানীরা জানে কামির নির্দেশে হাজার পাখির দল সেতু গড়ছে আকাশ-নদীতে। একটু পরেই দেখা হবে হিকোবুশি আর তানাবাতার। আর যদি মেঘে ভরা থাকে আকাশ? তাহলে আবার অপেক্ষা এক বছরের জন্য। হিকোবুশি ফিরে যাবে তার গরু-মহিষের কাছে। তানাবাতা আবার বসবে তার তাঁতে। আর দিন গুনবে পরের বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিনটির জন্য। জাপানী গৃহস্থ বাগানে সাজিয়ে রাখা সবুজ বাঁশটি ভাসিয়ে দেবে নদীতে। ঢেউয়ের দোলা খেতে খেতে সেটা ক্রমশ হারিয়ে যাবে চোখের আড়ালে।