About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Saturday, August 8, 2009

ব্রাইস-জায়ন-ইয়েলোস্টোন

৮ই অগাস্ট, ২০০৯ – ভোর ৫:৪৫ - ব্লুমিংটন

আজ বেড়াতে যাচ্ছি অনেকদিন পর। আলাদা করে বলার মত কিছু নয়। তবে তিরিশ বছরের জীবনে এই প্রথম একদম নিজের খেয়ালে একা একা বেরোনো। সেদিক দিয়ে একটা গুরুত্ব আছে বইকি। ভোরের ফ্লাইট ভাল্লাগে না। কিন্তু উপায় কি! ৬:১৫তে ফ্লাইট। ভেবেছিলাম সোয়া চারটে নাগাদ উঠলেই হবে। কিন্তু বিধি বাম। সোয়া তিনটেয় বেড়েপাকা আমেরিকান এয়ারলাইন্স এসেমেস করে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। আর কি ঘুম আসে। চারটে পর্যন্ত চোখ চেপে শুয়ে থেকে হাল ছেড়ে দিলাম। চান করে কফি পানান্তে সাজুগুজু করতে করতেই ক্যাব এসে গেল। বুড়ো ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে লাস ভেগাসে জুয়ো খেলতে যাচ্ছি কি না! নারে ভাই, ছাপোসা মফস্বলী বালিকা, জীবনে প্রথম একা বেড়াতে যাচ্ছি – তাও এই তিরিশ বছর বয়সে। জুয়ো খেলার সাহস কোথায়! আপাতত ব্লুমিংটন এয়ারপোর্টে বোর্ডিংযের অপেক্ষায়। ফির মিলেঙ্গে ব্রেক কে বাদ।

৮ই অগাস্ট, ২০০৯ – সকাল ৮:০০ – আকাশপথে

ব্লুমিংটন থেকে শিকাগো প্লেন রাইড হগওয়ার্টসের ভাষায় অ্যাপারেট করার মত। ফ্লাইট টেক অফ করলো ৬টা ২০ নাগাদ। আর ৬টা ৩৮শেই পাইলট সাহেব ঘোষনা করলেন – ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গন, আপনারা কুর্সিবন্ধনে আবদ্ধ হউন। আমরা অবতরন করিব। ল্লেহ! খুললাম কখন যে বাঁধব!!

এক একটা দিন অদ্ভুত ভাবে আসে। এর আগেও তো কতবার ভেবেছি ইয়েলোস্টোনে যাওয়ার কথা। যবে থেকে আমেরিকা এসেছি তবে থেকেই ভেবেছি। বারবার ভেস্তে গেছে। এবারেও তো ভেবেছিলাম আসা হবে না। কিন্তু জোর করে চলে এলাম। আমার রোজ রোজ মেলবাক্স চেক করায় বড় আলিস্যি। আমি ওটাকে ডেইলি রুটিনের জায়গায় উইকলি করে নিয়েছি। ফলে যখনই বাক্স খুলি কেজো-অকেজো চিঠির ভারে তা উপচে থাকে। কালও তেমনই একটা দিন ছিল। চাবি ঘোরাতেই পাপা জোন্স পিজ্জা, ওভেন বেকড স্যান্ডুইচ, বেড অ্যান্ড বাথের কুপন, নিকটবর্তি স্টেট ফার্ম এজেন্টের উপদেশাবলী ইত্যাদি অতীব গুরুত্বপূর্ন খেজুরের সাথে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের লেটেস্ট ইস্যু মাটিতে ঝরে পড়লো। অ্যান্ড গেস হোয়াট? এবারের কভার স্টোরী ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক। ফ্লাইটে বসে সেটাই পড়ছি।

“কখনো সময় আসে জীবন মুচকি হাসে
ঠিক যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা
অনেক দিনের পর মিলে যাবে অবসর
আশা রাখি পেয়ে যাবো বাকি দু-আনা” :-)

৮ই অগাস্ট, ২০০৯ – দুপুর ২:৩০ – লাস ভেগাস

অবশেষে নষ্ট শহরে পা রাখা হল। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই দেখি এক খানা গাম্বাট গীটার আকাশপানে চেয়ে আছে। দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। টাইম স্কোয়ারে ইহাকেই তো দেখিয়াছি হার্ডরক কাফেতে। তফাত একটাই। টাইম স্কোয়ারে যাকে নিউ ইয়র্কের জীবনের স্পন্দন মনে হয়েছিল এখানে সেটাকেই নির্লজ্জ বেলেল্লাপানার বেহায়া টুকলি মনে হল। তবে গোটা লাস ভেগাস শহরটাই তো নকলে ভরা। হাতে কিছু সময় ছিল। আমার অফিস কলিগের রেকমেন্ডশনে গেলাম ভেনিশিয়ানে। ইটালীর ভেনিসের অনুকরনে নাকি এই হোটেল তৈরী। কিছু ক্যানাল, কিছু সোনালী বর্ডার দেওয়া সাদা সেতু আর সিলিং জোড়া রেনেসাঁ পেইন্টিং-এর অক্ষম অনুকরনে যা তৈরী হয়েছে তার নাম যদি ভেনিস হয় তাহলে আর ইহজীবনে আসল ভেনিস দেখে আমার কাজ নেই। যে কোন শিল্প – বিশেষ করে তা যদি আর্কিটেকচার হয় – তার সাথে পারিপার্শ্বিকের মেলবন্ধন খুব জরুরী। মিশর থেকে একটা ওবেলিস্ক খুলে এনে প্যারিসের রাস্তায় লাগিয়ে দিলে যেমন তার শোভা বাড়ে না, তেমনি ব্যস্ত চৌরাস্তায় পৃথুলা স্ট্যাচু অফ লিবার্টিকে তৃতীয় শ্রেনীর কার্টুন মনে হয়। তার চেয়ে বরং ক্যাসিনোগুলো ভালো। এর আগে তো শুধু সিনেমাতেই দেখেছি। ঘরভর্তি সারি সারি স্লট মেশিন, পোকার টেবল এবং আরো যেগুলোর আমি নাম জানি না – সেসব দেখে বেশ রোমাঞ্চিত হলাম। এমনকি দানী হতচ্ছাড়ার পাল্লায় পড়ে সকালের উপলব্ধি ভুলে একটু জুয়াও খেলে নিলাম। আসলে আপত্তিটা জুয়ো নিয়ে নয়। আমার মফস্বলী জেনেটিক ডিসঅর্ডার আমাকে ছোটোবেলাতেই জানিয়ে দিয়েছে আমি একটি ট্যালা এবং সারা পৃথিবীর মানুষ অপেক্ষা করে আছে কখন আমি একটি ট্যালামি করব আর তারা প্রান ভরে আমায় দেখে হাসবে। ক্যাসিনোতে কি ভাবে খেলতে হয়, কোথায় টাকা ঢোকাতে হয় কিছুই তো জানি না। কিছু একটা কেলেঙ্কারী করি আর হাসির খোরাক হই আর কি! কিন্তু এহেন সরল স্বীকারোক্তিতে আমার সাহসিকতার ঝুঁটি ধরে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। আর সাহসে কটাক্ষপাত হলে খাঁটি বাঙালী রক্তে কেমন আলোড়ন ওঠে তাতো জানেন ঈশ্বর এবং ক্ষুদিরাম বোস। তার ওপর জানা গেল এমনকি দেবপ্রিয়াও স্লট মেশিনে খেলেছে। এখানে একটা কথা বলে নিই। দেবপ্রিয়া যদিও আমার থেকে হাজার গুনে স্মার্ট কিন্তু বালুরঘাটের মেয়ে বলে আর আমার মতই আর্মানির স্যুট অথবা গুচ্চির ব্যাগ সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল নয় বলে আমি মাঝে মাঝেই ওকে আমার সমগোত্রীয় ভেবে নিই। তাই দেবপ্রিয়ার পরামর্শ মত পাকড়াও করলাম এক কালো স্যুট পরা অ্যাটেন্ডেন্টকে আর সমস্ত মফস্বলী জড়তাকে পেন্নাম ঠুকে তাকে জানিয়ে দিলাম আমি এক নাদান বালিকা। কিন্তু জুয়ো খেলার বড় শখ। এখান তিনি যদি একটু সাহায্য করেন। কালো স্যুট মধুর হেসে বলল – তা কি খেলতে চাও তুমি? বোঝো! সেটাই যদি জানবো তাহলে তোমাকে জিগালাম কেন। সে বোধহয় এমন জিনিস এর আগে দেখে নি। সংশয়ান্বিত চোখে সে আমার আই ডি দেখতে চাইল। লজ্জার মাথা খেয়ে তাও দেখালাম। জুয়ো না খেলে আজ আমি ঘরেই ফিরব না। আমার তিরিশ বছরের সঞ্চিত নির্বুদ্ধিতা আপাদমস্তক জরীপ করে সে বলল – ফলো মি। আর কি ভাগ্যি তখনই তার ফোন বেজে উঠলো। আমাকে এক জ্যানিটারের হাতে সঁপে দিয়ে কালো স্যুট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আফটার অল জ্যানিটার তো আর স্যুট পরে নি। তাকে তবু অ্যাপ্রোচ করা যায়। সে জানতে চাইল – কত টাকার খেলবে? আমি একটি ডলার বাড়িয়ে দিলাম। জ্যানিটারই টাকা ঢোকালো আর দেখিয়ে দিল কি ভাবে খেলতে হবে। প্রথমেই হারলাম। পরের দানে অহো কি বিস্ময়! টাকা দ্বিগুন হল। কিন্তু ট্যালার ভাগ্যে আর কতই বা বিস্ময় জমতে পারে। পরপর ছ’বার খেলে এবং হেরে সব টাকা শেষ করে উঠে পড়লাম। যাক বাবা! লাস ভেগাসে এসে জুয়ো খেলিনি এই বদনামটা আর কেউ দিতে পারবে না!!

৮ই অগাস্ট, ২০০৯ – রাত ৯ঃ১৫ – সেন্ট জর্জ, উটা

অবশেষে বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার ট্যুর গাইডের দেখা মিলল। ট্রপিকানা হোটেলের লবিতে হল মধুর মিলন। অবশ্য মধুর না কষায় সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কারন সে চীনদেশীয়। চাইনীজ সে কি ভাষায় বলে ঠিক বলতে পারবো না, তবে সে ইংরিজী বলে চিনে ভাষায়। অতএব বুঝ সে লোক যে জানো সন্ধান!

আপাতত সেন্ট জর্জ, উটাতে ঘাঁটি গেড়েছি। হোটেলের ঘর থেকে চমৎকার একখানা সুর্যাস্ত দেখে নিলাম। আমেরিকার এই অঞ্চলে যতবার আসি মুগ্ধ হই। এখানে প্রকৃতি পুরুষ। গঁগ্যার পেইন্টিং-এর মত রুক্ষ, প্রকান্ড পুরুষ। সারা দিনের শেষে সূর্যের নরম লাল সে দু-বাহু দিয়ে শুষে নেয়। বারবার দেখেও পুরনো হয় না। কাল যাচ্ছি জায়ন আর ব্রাইস ক্যানিয়নে। ভোরে উঠতে হবে। আজ এখানেই শেষ।

৯ই অগাস্ট, ২০০৯ – রাত ৮ঃ৩০ – সল্টলেক সিটি, উটা

আমার সহযাত্রীরা সকলেই এশীয়। তার মধ্যে আবার ষাট শতাংশ চাইনীজ। তবে আমি একা এসেছি শুনে সবাই আমাকে বেশ প্যাম্পার করছে। আর আমিও এই প্যাম্পারিং-এর সুযোগ নিয়ে “কাকু একটা ছবি তুলে দিন”, “বৌদি চলুন ওই ক্লিফটা থেকে ঘুরে আসি”, “গাইড-দা, এই জায়গাটা কি সুন্দর – এখানে একটা ফোটোস্টপ দিন” ইত্যাদি করে বেড়াচ্ছি।

সকালে সাড়ে সাতটা নাগাদ বেরোনো হল জায়ন ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশ্যে। জায়নে প্রথমেই নজর কাড়ে সবুজের সমারোহ। আমেরিকার এই অঞ্চলের অন্য কোন ন্যাশনাল পার্কে এত সবুজ দেখি নি। নাভাহো স্যান্ডস্টোনের বুক চিরে বয়ে গেছে ভার্জিন রিভার – সেই নদীই জায়নকে সবুজ করে রেখেছে। জায়নে যে জায়গাগুলোতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল সেগুলো চড়া রোদের আলোতে ভালো লাগার কথা নয়। জায়নে যাওয়া উচিত ছিল গোধুলির সময়। কিন্তু আমার ট্যুর আর সমস্ত মেড ইন চায়না প্রোডাক্টের মতই সস্তা এবং কমপ্লেইন্ট-রেজিস্টান্ট। তাই জায়নে বুড়ি ছুঁয়ে আমরা চললাম ব্রাইস ক্যানিয়নের পথে।

যাত্রাপথ বড় সুন্দর। দুদিকে যতদুর চোখ যায় ঢেউ খেলানো পেশীর মত রকির বিস্তার। কোথাও এক গোছা সবুজ ঐ রুক্ষতার থেকেই প্রানরস শুষে নিচ্ছে। আবার কোথাও নির্মম দাবানলের সাক্ষী রেখে গেছে ঝলসানো গাছের গুঁড়ি, এবড়ো-খেবড়ো প্রানহীন শিকড়। এই পথে আমি যখনই এসেছি আমার ছাপোষা জীবনের থেকে অনেক বড় কিছু এক অন্যতর জীবনের স্পন্দন টের পেয়েছি। ঘোড়ার খুরের ধুলো উড়িয়ে সূর্যাস্তের দিকে ছুটে যাওয়ার জীবন। কলোরাডো নদীতে উজান বাইবার জীবন। তারাভরা আকাশের নীচে ভুট্টা পুড়িয়ে খাওয়ার সেই সব জীবন – যা আমার নাগালের অনেক বাইরে – এই রাস্তা আমাকে সেই জীবনে বড় প্রলুব্ধ করে।

ব্রাইস ক্যানিয়নে না এলে পৃথিবীর এক অনন্য সৌন্দর্য আমার চিরদিনের মত অধরা থেকে যেত। মাইলের পর মাইল জুড়ে কমলা-গোলাপী-হলুদ পাথরের সারি। আমি বৈজ্ঞানিক নই। এই পাথর - যার পোষাকি নাম হুডু - কি ভাবে এখানে এল তার অক্ষম ব্যাখ্যায় আমি যাবো না। দিগন্তবিস্তৃত প্রস্তর স্তম্ভ দেখে আমার মহাভারতের এগারো অক্ষৌহিণী সেনার কথা মনে পড়ছিল। কোটি কোটি বছর ধরে নির্জন সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক সৈনিকের দল। পাঞ্চজন্যের একটি ফুঁ তে যেন এখনই প্রান ফিরে পাবে। চড়াই ভেঙে খানিক উঠে একটা পাতাহীন গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসলাম। আমার সামনে দুই কোটি বছরের নিরন্তর কর্মশালায় তৈরী হওয়া এক নিখুঁত শিল্প। অবিশ্বাসী মন এইখানে এসে তাঁকে খুঁজে পায়।

মাটি জানবে তুমি আস্থার পায়ে দাঁড়িয়েছ তাই স্নিগ্ধ
তার জীবন স্তন্যে ধন্য
ধন্য হল বিশ্ব।

১১ই অগাস্ট, ২০০৯ – ভোর ৫:৩০ – ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক

ইয়েলোস্টোন ন্যশনাল পার্কের লগ কেবিনে বসে এই লেখা লিখছি। চারদিন শুনশান। নিস্তব্ধ। ঘন পাইনের সারির মধ্যে এই কটা কেবিন – যার একটায় আমি আছি। আমার জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে পাইনের বন নিকষ কালো দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি বলতে কি এমন জায়গায় যে আমাকে একা রাত কাটাতে হবে তা আমি আগে ভাবি নি। বাইরের পৃথিবীর থেকে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন এই এলাকা। এমনকি যে 911 এর অটূট নিরাপত্তায় আমি এদেশে একা থাকি – তার ওপরেও আর ভরসা করতে পারছি না। আমার সেল ফোনে কোন সিগনাল নেই। কেবিনে নেই কোন ইন্টারকম। মিনিট সাতেক হেঁটে গেলে সার্ভিস ডেস্ক। এখন যদি একটি ভাল্লুক এসে আমার জানলায় নক করে তাহলে সার্ভিস ডেস্ক পর্যন্ত গিয়ে জানাতে পারলে তবে মিলবে সাহায্য। কোন সিগন্যাল না থাকার জন্যই বোধহয় আমার সেলফোন তার নিজস্ব লোকাল টাইমে সেট হয়ে গেছে। সাড়ে পাঁচটাতে অ্যালার্ম দিয়েছিলাম। উঠে স্নান করে তৈরী হয়েও দেখি বাইরের আঁধার একটুও ফিকে হয় নি। মনে হয় আমি জেগেছি সাড়ে চারটেতে। আর এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই। কারন ঘরে কোন ঘড়ি নেই। আর যে ইন্টারনেট আমাকে রনে-বনে-জলে-জঙ্গলে উদ্ধার করে সেই পরম অগতির গতিও এখানে অচল। আমি এখন তাই ভোর হওয়ার অপেক্ষা করছি আর লিখে রাখছি গতকালের কথা।

কাল সল্টলেক সিটি থেকে বেরিয়েছি সাড়ে সাতটা নাগাদ। গাইড আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেল উটার স্টেট ক্যাপিটালে। সুন্দর মার্বেলের বাড়ি – ওই যেমন হয় আর কি। কিন্তু আমার মন তো তখন উড়ে বেরাচ্ছে রকির আঁকে বাঁকে – হলুদ-সবুজ উপত্যকার অনাবিল মুক্তিতে। মর্মর সৌধে কি তখন মন ওঠে!
তারপরই সোজা ইয়েলোস্টোনের পথে। সর্পিল রাস্তা রকির বুক চিরে এগিয়ে চলেছে। পাহাড়ের বুক-জোড়া সূর্যমুখীর ক্ষেত আকাশের দিকে চেয়ে হাসছে। কালো পাহাড়ের বুকে সবুজ পাহাড়, তার বুকে লাল পাহাড়, তার কোলে সোনালী চারনভূমি। ঠিক ছবির মত – ছোটোবেলায় ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতায় যেমন আঁকতাম। মাঝে মাঝেই ধরা দিচ্ছে স্নেক রিভার – সার্থকনামা নদী একটি – পাইনের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে তরতর করে খরস্রোতে বয়ে চলেছে। লাঞ্চ করতে থামা হল জ্যাকসন হোলে। রকি দিয়ে ঘেরা একটি ছোট্ট শহর। সামান্য কয়েকটি রেস্টোর‌্যান্ট। আর সামান্য কিছু মানুষ। লাঞ্চের পর একটু হেঁটে বেড়ালাম। শহরের বড় রাস্তাটিকে বাদ দিলে বাকি ছোটো রাস্তাগুলোতে ট্রাফিক লাইট নেই। লোকজন এদিক ওদিক তাকিয়ে পরস্পরের সম্মতি নিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছে। বেশ বন্ধুবৎসল শহর। আমাকে একবারও অপেক্ষা করতে হল না। গাড়িওয়ালারা মিষ্টি হেসে পথ করে দিল।

এর পরেই শুরু হয় গ্র্যাণ্ড টেটন ন্যাশনাল পার্ক – যা গিয়ে মিশেছে ইয়েলোস্টোনে। পার্কের শুরুতেই রকি পাহাড় অভ্যর্থনা করলো তার বরফে ঢাকা চুড়ো দিয়ে। রকি যে আসলে নেহাত এক সাধারন পাহাড় নয় – এ যে পর্বত – হিমালয়-অ্যাল্পস-আন্দিজদের জাতভাই তা তো প্রায় ভুলেই গেছিলাম কলোরাডো নদীর দাপটে। বরফের শৃঙ্গ সে কথা মনে করিয়ে দিল। তবে রকি ঠিক হিমালয়ের মত ধ্যানগম্ভীর নয়। তার হাবভাব অনেকটাই চ্যাংড়া ছোঁড়ার মত। সেই ফিচেল রকিকে পাশে নিয়ে আমাদের বাস চলতে থাকলো পৃথিবীর সব চেয়ে পুরোনো ন্যাশনাল পার্কের পথে।

১২ই অগাস্ট, ২০০৯ – ভোর ৪:০০ – ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক

কাল সারাদিন ধরে যা যা দেখলাম তা ভালো করে দেখার জন্য গোটা একটা জীবন ও বোধহয় যথেষ্ট নয়। লিখছি একে একে।

ইয়েলোস্টোন ভোরের দিকে বেশ ঠান্ডা হয়ে যায়। আমি একটা হাল্কা ফ্লিস জ্যাকেট সাথে এনেছি। সকাল বেলা সেটা গায়ে দিয়েও শীতে কাঁপছি। তবে ভোরবেলা পাইনের পথ ধরে হাঁটতে খুব ভালো লাগছিল। ছোটোবেলায় প্রায় প্রতি বছরই শিমুলতলা যাওয়া হত। কুয়াশা মাখা ভোরে চাদর জড়িয়ে কুঞ্জ-কুটীরে খেজুর রস খেতে যাওয়ার সেই সব দিন। বহুদিন পর আবার সেই রকম ভোরবেলা হাঁটতে বেরোলাম।

আমরা যেখানে আছি সেখানে ইয়েলোস্টোন রিভার রকির বুকে একটা ক্যানিয়ন তৈরী করেছে। সবাই বলে ইয়েলোস্টোনের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। বিশালত্বে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাথে যদিও কোন তুলনাই হয় না, কিন্তু নদীটি যেখানে পাহাড়ের বুকে জলপ্রপাত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই সৌন্দর্য অতুলনীয়। খুব আফসোস হচ্ছিল ফোটোগ্রাফিটা ভালো করে শিখি নি বলে। কি আর করবো। স্মৃতির ক্যামেরাতেই গেঁথে নিলাম ছবিটি।

ফোটোগ্রাফির প্রসঙ্গ যখন উঠলোই তখন একটা গল্প করেই নিই। এখানে সবার ধারনা হয়েছে আমি খুব বড় ফোটোগ্রাফার। আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করি যে আমার কাঁধে যে যন্তরটা ঝুলছে তার অর্ধেক ফাংশানই আমি জানি না – লোকে ভাবছে আমি বুঝি বিনয় করছি। শুভ থাকলে বলতো – জালিগিরির শেষ নেই। কিন্তু আমি কি করবো! ওরা ভাবলে আমার কি দোষ!

এর পরের স্টপে বাস থেকে নামতেই একটা খুব পরিচিত গন্ধ পেলাম। মাঝে মাঝেই ইলেভেন-টুয়েলভের কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে এই গন্ধ বেরিয়ে আমাদের স্কুলবাড়ী ভরিয়ে দিত। তারপর তো নিজেও বানিয়েছি সালফারের এই বাষ্প। একটা বিস্তীর্ন চত্বরে কাদামাটি টগবগ করে ফুটছে। কাঠের সেতু দিয়ে সেই ফুটন্ত মাটি পেরিয়ে এক গুহার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে গলগল করে সালফারের ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বেশিক্ষন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। এই গুহার নাম ড্র্যাগনস মাউথ – সত্যিই যেন এক ড্রাগনের মুখ থেকে আগুন বেরোচ্ছে – আর সেই সাথে গুমগুম আওয়াজ।

এবার আমার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে পড়া জ্ঞান একটু কাজে লাগাই। ইয়েলোস্টোন আসলে এক আগ্নেয়গিরি। শুধু ভলক্যানো নয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একে বর্ণনা করেছে সুপার ভলক্যানো বলে। শেষ অগ্নুৎপাত হয়েছিল ছশো চল্লিশ হাজার বছর আগে। তখনই ইয়েলোস্টোন তার বর্তমান রূপ নেয় – যা আমি সারাদিন ধরে দেখলাম। ইয়েলোস্টোনের আগ্নেয়গিরি এখনো অ্যাকটিভ। সরের মত পাতলা মাটির নিচে পৃথিবী এখনো উত্তপ্ত এবং চঞ্চল। তারই প্রকাশ ঘটছে এখানে সেখানে। বাসে যেতে যেতে মাঝে মাঝেই দেখছি মাটি থেকে গলগল করে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। এমন দৃশ্য তো আগে দেখি নি কখনো। অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী বানানোর কারখানায় গাইডেড ট্যুর নিয়েছি।

ইয়েলোস্টোনের যে ইনফরমেশন ব্রোশিওরটা পার্কে ঢোকার সময় হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল তাতে দেখছি লেখা আছে – Yellowstone Lake is the largest mountain lake in North America. মাউন্টেন লেক কাকে বলে আমি জানি না। তবে লার্জেস্ট হোক বা না হোক, ইয়েলোস্টোনের মত লেক যে পৃথিবীতে খুব বেশি নেই সেটা নিশ্চয়ই সত্যি। এটাই আমার দেখা প্রথম লেক যেখানে জ্বালামুখী গহ্বর থেকে বাষ্প বেরিয়ে বুদ বুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে জলের মাঝে। লেকের পাশে এই জায়গাটার নাম ওয়েস্ট থাম্ব। এখানে যে কতগুলো মাড পুল, হট স্প্রিং, গীজার আছে আমি গুনে রাখতে পারি নি। গাইড সময় দিয়েছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিট। সবকটা পুলে একবার করে উঁকি মেরে যখন বাসে ফিরলাম তখন সবাই হাততালি দিয়ে আমাকে ওয়েলকাম ব্যাক করলো – অধমের সময়ের হিসেব ছিল না – এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছিল। নীলকান্ত মনির মত টলটলে নীলকে ঘিরে সালফারের হলুদ – তাকে জড়িয়ে আছে সাদা ক্যালসিয়াম কার্বনেট। কাছে গেলে গরম বাতাসের হলকা লাগছে গায়ে। লাগারই কথা। পুলের ভেতরের ঐ তরলের উষ্ণতা যে প্রায় ১৮০ ডিগ্রী ফারেনহাইট!

এরপর লাঞ্চব্রেক ওল্ড ফেইথফুল ইন এ। ওল্ড ফেইথফুল পৃথিবীর সব চেয়ে বিখ্যাত গীজারগুলোর মধ্যে একটি। আর ইয়েলোস্টোনের সব চেয়ে পুরোনো ব্যাবসায়িক সাফল্য। প্রতি ঘন্টা দেড়েক অন্তর পৃথিবী এখানে প্রায় চার হাজার গ্যালন ফুটন্ত জল উদগীরন করে তার বুকের ভেতর থেকে। এমন রেগুলার ইন্টারভ্যালে পারফর্ম্যান্সের জন্যই নাম হয়েছে ওল্ড ফেইথফুল। কালীপুজোর রাতের ইলেকট্রিক তুবড়ির মত এই বিস্ফোরন। আসলে তার চেয়ে অনেকটাই বেশি। কারন এই তুবড়ি লাফিয়ে ওঠে প্রায় দেড়শো ফুট। বাজি ফোটানো দেখার পরও হাতে কিছুটা সময় ছিল। একটা কফি হাতে বসেছি লজের বারান্দায়। এক টুসটুসে বুড়ি আমার সাথে ভাব জমালো। ষাটের দশকে সে প্রথম ইয়েলোস্টোন আসে। ক্যানিয়নে গিয়ে পিকনিকের স্মৃতি তার এখনো অমলিন। এখন আর হাঁটতে পারে না। নাতি-নাতনীরা পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুড়ি রয়েছে বসে। সামনে ওল্ড ফেইথফুল।

ইয়েলোস্টোনের যে ছবিটা আমাকে সব চেয়ে আকৃষ্ট করতো সেটা হল একটা গাঢ় নীল গহ্বর – এক কমলা আস্তরন তাকে সূর্যের ছটার মত ঘিরে রেখেছে। জেনেছিলাম তার নাম গ্র্যান্ড প্রিসম্যাটিক স্প্রিং। মিডওয়ে গীজার বেসিনে দেখা পাওয়া যাবে তার। তাই যখন গাইড বলল এর পরের গন্তব্য মিডওয়ে গীজার, তখন উত্তেজনায় বুক ধুকপুক – তারে আমি চোখে দেখি নি, তার অনেক গল্প শুনেছি – আর গল্প শুনে তাকে অল্প অল্প নয়, ভীষন ভীষন ভাবে দেখতে চেয়েছি। অবশেষে এল তাহলে সেই মুহুর্ত। ঠিক যেমনটা ছবিতে দেখেছিলাম তেমনটা দেখা গেল না। কারন গ্র্যান্ড প্রিসম্যাটিকের ব্যাস ৩৭০ ফুট। ছবিটা আকাশ থেকে নেওয়া। তাই ওই নীল তারার মত বিচ্ছুরন দেখা যায়। আমি দেখলাম মাটি থেকে। তবে যা দেখলাম তাতেও জন্ম সার্থক। চেনা পৃথিবীর কোন চিহ্ন সেখানে নেই। ফুটন্ত ফুটিফাটা মাটি। তার মাঝে ঐ গাঢ় অপার্থিব নীল – অত বিশাল বলেই বোধহয় প্রশান্ত গম্ভীর। তার মাঝখান থেকে ধোঁয়া উঠছে – মুখে এসে ঝাপটা দিচ্ছে পৃথিবীর বুক থেকে উঠে আসা সেই উষ্ণতা। আর সেই নীলকান্ত মনিকে ঘিরে আছে কমলা চাদর। ঐ কমলা চাদর আসলে কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়ার বাসস্থান। চোখের সামনে সামনে জীবনের এই রূপ দেখে আমি নড়তে পারছিলাম না। গাইড এসে বলল এবারেও দেরি করলে বাসে উঠে গান গাইতে হবে। অগত্যা ফিরতেই হল।

মিডওয়ে গীজার দেখার পর আমার আর কিছু চাইবার ছিল না। গাইড নিয়ে গেল লোয়ার গীজার বেসিনে। আবার ব্যাকটেরিয়ার চাদর। আবার সেই আদিম প্রাণের স্পন্দন। দেখি এর মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে এক মরা গাছের গুঁড়ি। ১৯৮৪তে এক বিশাল দাবানলে ইয়েলোস্টোনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ পুড়ে গেছিল। ঐ মরা গাছ সেই অগ্নিকান্ডেরই শিকার।

বেলা বয়ে যায়। আমাদের বাস এল ম্যামথ হটস্প্রিং এ। এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা। হাজার হাজার বছর ধরে ক্যালসিয়াম কার্বনেট জমে মাটি এখানে মৃত্যুর মত সাদা। কিছু প্রানহীন গাছ দাঁড়িয়ে আছে ইতি-উতি। যে কোন মুহুর্তে কালো হুড পরা একটি লোক বেরিয়ে এসে বলতেই পারে – চেক মেট। আর কি আশ্চর্য – তারই মধ্যে তৈরী হচ্ছে জীবন। সাদা পাথরের ভাঁজে ভাঁজে যে বাদামী রেখা – সেখানে হাইড্রোজেন সালফাইডের ভরসায় সংসার পেতেছে ব্যাকটেরিয়ার দল।

দিনের শেষ গন্তব্য রুজভেল্ট টাওয়ার। ইয়েলোস্টোনের সব চেয়ে উঁচু জায়গা। এখানে এসে আবার দেখা হল ইয়েলোস্টোন নদীর সাথে। পাহাড় কেটে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। রকির শরীরে কোটি কোটি বছরের ভাঙ্গাগড়ার ছাপ। পাইনের বন দাঁড়িয়ে আছে কে জানে কত প্রজন্ম ধরে। আজ এই নশ্বর মানুষ – কালের সমুদ্রে একটি বুদবুদের মত যার অস্তিত্ব – সে আজ এখানে এসে দাঁড়ালো।

অনেকক্ষন লেখার পর খেয়াল হল প্রায় সোয়া পাঁচটা বাজে। জানলার পর্দা সরিয়ে দিলাম। এখনো আলো ফোটে নি। এই আদিম পৃথিবীতে অন্ধকারে চোখ মেলে চেয়ে আছি আমি একা। বাইরে পাইনের সারি জ্যোৎস্নায় ভিজে চুপ। বিষাদক্লিষ্ট সুঁড়ি পথ চলে গেছে কোন গভীরে। এখনি একটা সাদা ঘোড়া এসে দাঁড়াবে। ম্যাজিক আর রিয়েলিটির শেষ সীমানাটাও মুছে যাবে।

আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধ রাতে ডানার সঞ্চার
পুরানো প্যাঁচার ঘ্রান – অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ – মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে ডালে ডাকিয়াছে বক
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক।
১৩ই অগাস্ট, ২০০৯ – ভোর ৫:০০ – সল্টলেক সিটি এয়ারপোর্ট

যাত্রা হল শেষ। এবার বাড়ির পথে। গত দুদিনের ডায়েরীতে শুধু গন্তব্যের বিবরনই দিয়েছি। যে মানুষগুলোর সাথে সেই গন্তব্যে পাড়ী তাদের কথা বলাই হয় নি। গাইড-দা কে দিয়েই শুরু করা যাক। গাইডটা ঠিক দুটি ইংরিজি জানে – “ইউ নো” আর “কাইন্ড অফ লাইক”। মাত্র দুটি শব্দবন্ধ ব্যবহারে যাবতীয় মনের ভাব প্রকাশ করা নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ। তবে ভদ্রলোকের চেষ্টার কোন ত্রুটি নেই। কিপ গোয়িং গাইড-দা!

গাইড-দার চৈনিক ইংরিজি বোধগম্য ভাষায় অনুবাদ করে এই কদিন যে আমার পরিত্রাতার ভুমিকা পালন করেছে সে হল চাইনীজ মেয়ে শেরি। শেরির বাবা মেডিকেল সায়েন্সে রিসার্চ করে। ছমাসের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার একটি হসপিটালে এসেছে। শেরি তার মায়ের সাথে সামার ভ্যাকেশনের ছুটিতে বেড়াতে এসেছে বাবার কাছে। শেরির বাবা ভাঙা ইংরিজি বলতে পারে। তবে শেরির মা – যাকে আমি মনে মনে হাসি-বৌদি বলে ডাকছিলাম – একদমই ইংরিজি জানে না – শুধু মিষ্টি করে হাসে। আর ভারী সুন্দর দেখতে – ওর হাসিটা মনে থেকে যাবে অনেকদিন। চিনে এখন ইংরিজি শেখার দিকে ভালোমত জোর দেওয়া হচ্ছে বলেই বোধহয় এদের মধ্যে সবচেয়ে বলিয়ে কইয়ে হল শেরি। আমি ওকে একটা চকোলেট দিতেই ও খুব খুশি হয়ে জানিয়ে দিল – তুমি আমায় টিয়ান-টিয়ান নামে ডাকতে পারো – আমি খুব মিষ্টি ভালোবাসি বলে আমার চাইনিজ নাম টিয়ান-টিয়ান। চাইনিজে টিয়ান-টিয়ান মানে সুইট। দুই মিষ্টান্ন প্রেমিকের আলাপ জমতে কখনোই দেরি হয় না। এক্ষেত্রেও হল না। টিয়ান-টিয়ান শুধু মিষ্টি মেয়েই নয়, ও খুব ভালো গান গায়। হাঙ্গেরীতে গিয়ে চিনকে রিপ্রেজেন্ট করে এসেছে গত বছর।

এছাড়াও আছে কাম্বোডিয়ান কাকু-কাকিমা। কাম্বো-কাকুর একমাত্র কাজ যে কোন সুদৃশ্য অথবা কুদৃশ্য জায়গায় কাকিমাকে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা। এমন কি দেখি ট্র্যাশক্যানের সামনে দাঁড়িয়েও ছবি তুলছে। তবে কাম্বো-কাকু আমার ছবিও তুলে দিয়েছে। এই ট্রিপে আমার যে কটি ছবি উঠেছে বেশির ভাগই কাম্বো-কাকু অথবা চিনে-দা (শেরির বাবা) তুলে দিয়েছে।

ফিলিপিনো জ্যেঠু-জ্যেঠিমাদের কথাও বলতে হয়। তিন জোড়া বুড়ো-বুড়ি দল বেঁধে বেড়াতে এসেছে। খুব আমুদে মানুষ। সব সময় হৈ চৈ করছে। তবে বড্ড কৌতুহলী। তুমি একা এসেছ কেন, তোমার কি কোন বয়ফ্রেন্ড বা হাজব্যান্ড নেই, তুমি একটা ব্যাগপ্যাকে পাঁচ দিনের লাগেজ কি করে ঢোকালে, তুমি ইন্ডিয়ান হয়েও স্টেক খাচ্ছো কেন। রে দুর্বিনিত, আর প্রশ্ন করিয়ো না, এবার মুন্ড খসিয়া পড়িবে! তাও মোটের ওপর মানুষগুলো ভালোই। পাড়ার গায়ে পড়া অথচ স্নেহশীল বড়রা যেমন হয় আর কি! এক জ্যেঠিমাকে তো এক খানা সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিলেই বারোয়ারী পুজোর কাজে লাগিয়ে দেওয়া যায়। সে খুব খেয়াল রেখেছিল আমার। শুচি তুমি একা থাকবে, ভয় পাবে না তো? সকালে উঠতে পারবে তো? নাকি আমি ডেকে দেব তোমায়? এমন মিষ্টি জ্যেঠিমার নাকটা লম্বা হলেও তাকে ক্ষমা করে দিতেই হয় শেষ পর্যন্ত।

আমার ফোটোগ্রাফি এক্সপার্টিসের মিথটা যে প্রথম চালু করল সেই চাইনীজ মেয়েটির কথাই বা ভুলি কি করে। তার নামটা জানা হয় নি। তবে সে সর্বক্ষন তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে বেড়াত বলে তাকে ফড়িং নামে ডাকাই যায়। ফড়িং-এর মা আমাকে দেখতে পেলেই চাইনীজে প্রচুর বকবক করে। ফড়িং এসে তার মা-কে সামলায়। ওদের থেকে আমি একটা চাইনীজ শব্দ শিখেছি। শে-শে। মানে ধন্যবাদ।

আর কথা বলতো বটে ডোনা। ডোনা যদিও তিরিশ বছর এদেশে আছে, কিন্তু ইংরিজিটা এখনো ভালো রপ্ত হয় নি। কিন্তু কথা বলতে তার ভীষন উৎসাহ। আর আমার সামনে সে কঠিন ইংরিজিতে ইয়েলোস্টোনের সৌন্দর্য বর্ণনা করবেই করবে।

কাল দুপুরে ইয়েলোস্টোন থেকে ফেরার পথে আমরা লাঞ্চ করতে গেলাম এক চিনে বাফেতে। গাইডদা বলল ওরা একটা স্যুপ বানায় ভাল্লুকের মাংসের স্টক দিয়ে। আমার তো শুনেই মনে পড়ে গেল টুম্পার কথা। টুম্পা আমার মায়ের মাসতুতো বোন, কিন্তু আমার থেকে বয়সে ছোটো। ও ছোটোবেলা থেকেই খুব ইউনিক। মুর্গি-পাঁঠা জাতীয় নিরীহ মাংসে ওর মন উঠতো না। বাঘ-সিংহ হলেই ভালো হয়। তবে একান্ত না পেলে ভাল্লুক বা গণ্ডারও চলতে পারে – এরকম একটা দাবী ছিল ওর। আমি ছোটোবেলায় এতো দুঃসাহসী ছিলাম না। তবে এখন একবার টুম্পা হওয়ার চেষ্টা করা যেতেই পারে এই ভেবে আমি এক বাটি স্যুপ নিয়ে বসলাম। বেশ ভালোই খেতে। তবে ঝোলটা ভাল্লুকের নাকি বাইসনের নাকি পাতি মুর্গির সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। হাসি বৌদির বোধহয় খুব ভালো লেগেছিল। স্যুপই খেয়ে নিল চার বাটি।

খাওয়ার শেষে আবার বাস যাত্রা। গাইড-দা একটা হিস্টোরিক চাইনীজ সিনেমা চালিয়ে দিয়েছে। আমি সাব-টাইটেলের সাহায্যে সেটা দেখছি। হিরো সবে হিরোইনকে চুমু-টুমু খেয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে - বাস ঢুকে পড়লো সল্টলেক সিটিতে।

সল্টলেক সিটিতে একটা মর্মন চার্চ আছে। শেষ দিনের ট্যুরে আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা। জনৈক বার্মিংহ্যাম ইয়ং হাজার মাইল পরিভ্রমন এই জায়গাটিকেই চার্চ বানাবার উপযুক্ত মনে করেন এবং পঁচিশ মাইল দুরের একটি ক্যানিয়ন থেকে পাথর নিয়ে এসে এই চার্চ তৈরী হয়। ধর্মস্থান নিয়ে আমার কোন ছুঁতমার্গ নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আর্কিটেকচারগুলোর অধিকাংশই তো ধর্মস্থান। কিন্তু এই চার্চটি মোটেই সুদৃশ্য নয়। ডাউনটাউনের মধ্যে ছোট্ট একটা জায়গায় গথিক স্টাইলের বাড়ি – আমার তো একেবারেই ভালো লাগলো না। তবে লিখে রাখলাম কারন এইখানে এসে আমাদের ট্যুর শেষ হল। পাঁচদিনের পর সবাই এবার যে যার মত এয়ারপোর্টে বা হোটেলে।

আবার কাল থেকে অফিস। আবার স্যাস, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট। মাঝে কিছুদিনের জন্য রকির সান্নিধ্য ভুলিয়ে দিয়েছিল এসব। কাম্বো-কাকু, ফিলি-জ্যেঠি, চিনে-দা, হাসি বৌদি, টিয়ান-টিয়ান – এরা সবাই মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। ভেবেছিলাম টিয়ান-টিয়ানের সাথে একটা ছবি তুলবো। হোটেলে চলে আসার পর খেয়াল হল সেকথা। যাক গে! ও যখন বড় হবে কোন দিন হয়তো দেখতে পাবো ওকে টিভির পর্দায় গান গাইতে। হয়তো তখন ওকে চিনতেও পারবো না। তাহলে কি সেই অমোঘ ফেলে আসার গান দিয়ে শেষ করি?

My heart is down
My head is turning around
I had to leave my little girl in Kingston Town!

ক্লিশে? তা হোক। কবি বলে গেছেন সত্যি কথা জমলে অমনই হয়।

15 comments:

  1. আজ আার মোরা ভবঘুরে,
    মুলুক ছেড়ে যাবো দূরে-----------

    ReplyDelete
  2. আশা নিয়ে ঘর করি
    আশায় পকেট ভরি
    পড়ে গেছে কোন্ ফাঁকে চেনা আধুলি~

    ReplyDelete
  3. Armani ar Gucci bishoye abagoti-ke ekhane byango kora hoyechhe... kintu bhabte aschorjo laage amar jibon-er prothom ebong (ekhono porjonto) sesh Armani cologne-ti lekhikar-i upohaar...

    "katoi rango dekhi duniyaai"

    ---Dani

    ReplyDelete
  4. Just গিললাম!! ব্যাপক হয়েছে !!

    ReplyDelete
  5. @দানি

    উপহার চয়ন পর্বে প্রাপকের রুচির প্রতি সজাগ থাকা অবশ্য কর্তব্য। উহা দাতার জ্ঞানের পরিচায়ক নহে।

    পরিশেষে, আর্মানি সাহেব যে চোগা-চাপকানও প্রস্তুত করিয়া থাকেন তাহা আমি উপহার দান কালেই প্রথম অবগত হই। আর্মানি গন্ধটি নির্বাচলে সাহায্য করেন এক বিদ্যুৎগতি শিখরদশনা নীলনয়না - যাঁহাকে দেখিয়া শ্রী-বিশ্বাস কিঞ্চিৎ মজিয়াছিলেন।

    ReplyDelete
  6. tui sheshe bhalluk-er mangso category-tate amake tekka diye dili???

    ReplyDelete
  7. Khub shundor ekha. amar dekha jaygagulo abar ghure nilam tomar shange

    ReplyDelete
  8. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  9. বাহ,খুব ভালো লাগল...
    লেখার মধ্যে দুটো জায়গা বেশি করে মন কাড়লো - একটা হলো casino তে তোমার অভিজ্ঞতা, আর অন্যটা হলো তোমার companion দের বর্ণনা |
    আর ছবির মধ্যে গ্র্যান্ড প্রিসম্যাটিক স্প্রিং টা খুবই সুন্দর আর বিস্ময়কর লাগলো |

    আরো এরকম লেখার আশায় রইলাম...

    --বোধিসত্ত্ব (বানান ভুল এর জন্য আগের কমেন্ট টা ডিলিট করলাম !)

    ReplyDelete
  10. Telepathy bodhhoy ekei bole...amar ek bondhu Yellowstone theke berie eshe porshui orkut e chhobi upload korechhe...r tate ekgada comment likhechhi...r aji shokal e dekhi tomar lekha..shei chhotobelar rochonoboir "ekti bhromon kahini" rochonar moto....bhishon shundor...diary r pata theke uthe asha bhishon shojib ar pranobonto ekta chhobi...thik jeno nijei ghure elam ekbar....ek ni:shashe pore fele jei chokh bujlam, dekhi bheshe uthechhe tomar bornona kora sei neelakhhi hrod....opurbo.....

    ReplyDelete
  11. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  12. U r GR88888888888888888888888888888888888888...... Ki darun likhecho!!!! Ki jyanto description, othocho ki moja kore lekha!!!!! Ami purota porlam... Byapok laglo.... Tobe Tiyan-Tiyan er sathe ekta photo tulle sattyee e valo hoto.... Jaihoke, emnite ekhane jkota photo diyecho, sabkatai valo hoyeche... Ek kathay lekha ar chhobi--- APURBO....

    ReplyDelete
  13. darun likhecho. chobhi dekhe aar diary pore amar abar berate jabar ichche ta matha chara dichche.

    ReplyDelete
  14. lekha ta porte shuru korlam ei bhebe je aj anek rat hoyeche kichu ta pore kal sokale bhalo kore pore dekhbo...kintu na, purota na gile khide ta mitchilo na.....tai gograse gile fellam. aro ektu pele mondo hoto na!! tomar hashi-boudir char bati soup er moto..:-) bhishon bhalo likhecho...bhishon jibonto, pranobanto...Yellowstone, amar text book chapiye tomar lekhoni te prithibir joljyanto rosayanagar-er bornona mon bhoriye dilo....:)

    ReplyDelete
  15. ki likhbo??...ato bhalo lekha bahudin porini...just gile khelam...hajam hobar jonye tor-i akta lekha chai...

    ReplyDelete