১৫ নভেম্বর, ২০০৭, সকাল ৯:৩৭
আজ আমরা মিশর যাচ্ছি৷ এটুকু লিখেই একটা অদ্ভুত অনুভুতি হল৷ যেন এখনো বিশ্বাসই করতে পারছি না৷ মনে হচ্ছে একটা স্বপ্ন দেখছি, এখনি ভেঙে যাবে৷ মিশরের সাথে প্রথম কবে পরিচয়! ..... অনেক ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে৷ কোন এক আনন্দমেলা পুজোসংখ্যায় বেরিয়েছিল শৈলেন ঘোষের গল্প৷ এক ফারাও আর তার ছোট্টো মেয়েকে নিয়ে৷ সেই প্রথম ভালো লাগা৷ সুর্যদেবতা রা, মৃত্যুদেবতা আনুবিসের সাথে মিশরের রহস্যমাখা ইতিহাসে প্রথম প্রবেশ৷ বোধহয় জীবনের প্রথম রোম্যান্স!!
আজ থেকে পাঁচবছর আগেও কল্পনা করিনি এই রূপকথার মাটিতে আমার পা পড়বে৷ কিন্তু গত কয়েকবছরে পৃথিবী এমন ছোটো হয়ে এসেছে - এখন বুঝি রূপকথাকেও ছোঁয়া সম্ভব৷ আমিও ছুঁতে চলেছি আর কিছুক্ষনের মধ্যেই৷ এখন আমরা প্লেনে৷ নিউ ইয়র্ক যাচ্ছি৷ জন এফ কেনেডী এয়ারপোর্ট থেকে বিকেলে ছাড়বে কায়রোর ফ্লাইট৷ বেশি না৷ আর মাত্রই চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধান৷ তারপর? নাহ .... এখনো ভাবতে পারছি না :) এই ফাঁকে আমরা কোথায় কোথায় যাবো তার একটা হিসেব দিয়ে নিই৷
১৬ নভেম্বর - কায়রো পৌঁছাবো দুপুর নাগাদ৷ যদি খুব টায়ার্ড না থাকি তাহলে খাল-এল-খালিল নামে কায়রোর বিখ্যাত বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা আছে৷ প্রাচীন এই বাজার মশলার জন্য বিখ্যাত৷ শুভর ইচ্ছা আছে এই বাজারে বসে হুঁকো টানার :) দেখা যাক এই প্ল্যান কতদুর সফল হয়৷
১৭ তারিখ আমরা ঘুরছি ভ্যালি অফ কিংস, ভ্যালি অফ কুইন্সে৷ এই সমাধিগুলো আনুমানিক দেড়হাজার খ্রীষ্টপুর্বাদের৷ পিরামিডের পরের যুগের ফারওরা এখানে সমাধিস্থ হয়েছে৷ শুধু ফারাও নয়, তাদের আত্মীয়রাও৷ এমনকি অনেক সময় রাজ পরিবারের সাথে সম্পর্কিত অভিজাতরাও৷এদিন আরো দেখছি রানী হশেপসুতের মন্দির৷ ক্লিওপেট্রাকে বাদ দিলে এই রানীই মিশরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মহিলা ফারাও৷ আনুমনিক দেড়হাজার খ্রীষ্টপুর্বাব্দ নাগাদ ইনি বাইশ বছর রাজত্ব করেন৷ এর মৃত্যুর পর এর সব চিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছিল রাজপরিবারের ইতিহাস থেকে৷ মেয়ে হয়ে পুরুষের কাজ করার শাস্তি!!
১৭ তারিখ আরো দেখছি কলোসি অফ মেনন৷ নীলনদের তীরে আমেনহোতেপের এই বিশাল মুর্তি থেকে একসময় অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোতো৷ লোকে ভাবতো দেবতা অসন্তুষ্ট হয়েছেন৷ তারপর একবার মুর্তিটি মেরমত করতে গিয়ে এই আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায় :)
১৮ নভেম্বর - এদিন যাবো কার্নাক টেম্পলে৷ প্রাচীন পৃথিবীর সব চেয়ে বড়ো ধর্মস্থান যা আজও টিকে আছে৷
২০ নভেম্বর - এইদিন যাচ্ছি অসোয়ানের বিখ্যাত বাঁধ দেখতে৷ এটা অবশ্য প্রাচীন পৃথিবীর নিদর্শন নয় ষাটের দশকে তৈরী৷ তারপর যাবো রানী হশেপসুতের আমলে তৈরী হওয়া অসমাপ্ত ওবেলিস্ক দেখতে৷ তৈরী শুরু হওয়ার কিছুদিন পর এটা কোন কারনে পরিত্যক্ত হয়৷ সাড়ে তিন হাজার বছর আগের মানুষেরা কি ভাবে পাথর কেটে কেটে এই বিশাল তোরনগুলো বানিয়েছিল তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায় এই অসমাপ্ত ওবেলিস্কটা দেখলে৷ তারপর যাবো ফিলিতে আইসিসের মন্দির দেখতে৷ আইসিসের গল্প তো আগেই বলেছি৷ আইসিসের পুজা একসময় মিশরে এতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে আইসিসের নাম মিশর ছড়িয়ে পৌঁছে যায় গ্রীস-রোমে৷ গ্রীক দেবী আফ্রোদাইত আর আইসিসের মধ্যে মিল খুঁজে পান কেউ কেউ৷
২১ নভেম্বর - পিরামিড, স্ফিংক্স আর ইজিপ্সিয়ান মিউসিয়াম দেখবো৷ তুতানখামুনের সোনার মুখোশ - আনন্দমেলায় প্রচ্ছদে যার ছবি দেখে প্রথম পাগল হয়েছিলাম - সেই মুখোশ দেখবো নিজের চোখে - স্বপ্ন নয়, সত্যিকারের মুখোশ!!
২২ তারিখ ঘরে ফেরা৷
১৫ নভেম্বর, বিকেল ৩:৪৬, জে এফ কে এয়ারপোর্ট
১৬ নভেম্বর, বিকেল ৪:৩০, কায়রো
১৮ নভেম্বর, সকাল ৮:৪৫, নীলনদ
গত দুদিনে যা যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করবো এমন ক্ষমতা আমার নেই৷ কথাটা খুব ক্লিশে শোনালেও সত্যি৷এতোদিন যা শুধু বইএর পাতায়, টিভির পর্দায় আর কল্পনার চালচিত্রে দেখে এসেছি তা নিজের চোখের সামনে দেখা, শুধু দেখাই নয় হাত দিয়ে ছোঁয়া - আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে৷
১৬ তারিখের সন্ধ্যা দিয়ে শুরু করি৷ বাসে করে আমাদের ওল্ড কায়রো নিয়ে যাওয়া হল৷ অনেকক্ষনের রাস্তা৷ কায়রোর রাস্তায় সিগনালের কোন বালাই নেই৷ যে যার নিজের ইচ্ছামত গাড়ি চালাচ্ছে এবং অবশ্যম্ভাবী অ্যাক্সিডেন্টগুলো ও নিপুণ কুশলতায় বাঁচিয়ে চলেছে৷ সেদিন ছিলো শুক্রবার৷ কায়রো শহরে অজস্র মসজিদ৷ খুব সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো৷ একটা মসজিদে বেশ ভীড় দেখলাম৷ আমাদের গাইড মিমো জানালো ওখানে বিয়ে হচ্ছে৷ আমাদের হোটেলেও সেদিন একটা বিয়ের রিসেপশন হচ্ছিলো৷
কায়রোর মেয়েদের পোষাক বেশ বৈপরিত্যে ভরা৷ বিয়েতে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আপদমস্তক বোরখাধারিনীও আছে, আবার অফশোল্ডার সাহসিনীও আছে৷ তবে রাস্তায় কোন অফশোল্ডার চোখে পরলো না, এমনকি কোন ওয়েস্টার্ন আউটফিটও না৷ রাস্তায় সবাই বোরখা৷ মুখ খোলা অবশ্য৷ ছেলেরা বেশিরভাগই সাধারন শার্টপ্যান্ট৷ কিছু এখান্কার ট্র্যাডিশনাল পোষাক পরা৷ লম্বা ঢিলেঢালা আলখাল্লা টাইপের পোষক - নাম গালাবা৷ কায়রোর রাস্তা দেখতে দেখতে দেশের কথা মনে পড়ছিলো৷ ঐ রকমই ট্রাফিক আইন না মানা মানুষ, ঐ রকমই স্টেশনারী দোকান রাস্তার ওপর৷ কতোদিন পর টিনের শাটার দেখলাম :) পথে পড়লো মহম্মদ আলি মস্ক৷ আঠারো শতকের তৈরী এই মসজিদের অপুর্ব স্থাপত্য৷ রাতের আলোয় আরো মোহময়ী লাগছিলো৷ আমার ইচ্ছা ছিলো এটা দেখার৷ কিন্তু আমাদের আইটিনেরারীতে ছিলো না৷ রাস্তায় দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগলো৷ তবে ছবি নেওয়া গেল না - এই যা দু:খ৷
মিমো আমাদের নিয়ে এলো একটা ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে৷ পাশে কোন মসজিদ থেকে তখন জোরে আজান দিচ্ছে৷ গাড়ীর হর্ণ, অজস্র বাস, গিজগিজে ভীড় - মনে হচ্ছিল দিল্লীতে আছি৷ একটা বড় দেওয়ালের
সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শোতে স্ফিংক্সের মুখ দিয়ে মিশরের ইতিহাস বলানো হল৷ জানা গল্প, নেট ঘাঁটলেই আজকাল পড়া যায়৷ কিন্তু ঐ সময়ে পিরামিডের সামনে বসে ঐ শোনা গল্পগুলো ই আবার শুনতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো৷ সাড়ে চারহাজার বছরের পুরোনো এই পিরামিড৷ একসময় বাইরের পাথরগুলো এতো চকচকে ছিলো যে সুর্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে সারা মিশর এর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো৷ আমুন-রায়ের পুরোহিতেরা দেখেছে এই পিরামিড, রামেসিস, আমুনহোতেপ, রানী হাতশেপসুত, কিশোর রাজা তুতানখামুন, ব্যক্তিত্বময়ী ক্লেওপেট্রা, ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস, দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার, শত শত গ্রীক, রোমান, মুসলিম, খ্রীষ্টান সৈনিক - আর আজ আমরাও দেখলাম এই অতুলনীয় সৃষ্টি৷ অতুলনীয় কারন এটা মানুষের হাতে গড়া৷ আজকের মানুষ নয়, সাড়ে চারহাজার বছর আগের মানুষ - এমন পুর্বপুরুষের কথা ভাবলে মনে গর্ব হয়, অনুপ্রেরনা জাগে৷ আর কিছুদিন পর আমরা কোন অতলে চলে যাবো৷ কিন্তু এই পিরামিড থাকবে৷ আমরা যে এখানে এসেছিলাম মনে রাখবে কি? আমরা এই ইতিহাসের একটা বিন্দু হয়ে বেঁচে থাকবো কি? এই বিশালত্বের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম অনুভব করতে পারছি মানুষের অমর হওয়ার ইচ্ছা কি প্রবল! মানুষ শুধু বাঁচতে চায় না৷ ছাপ ফেলে যেতে চায়৷ "আনন্দাত্ জায়তে বিশ্ব, আনন্দাত্ পল্যতে তথা, আনন্দাত্ লীয়তে বিশ্ব, আনন্দ পরিপুরত:"৷ মানুষ চলে যাওয়ার পরেও এই পৃথিবীতে তার আনন্দটুকু রেখে যায়৷ পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে তার আনন্দকণা ভেসে থাকে৷ পরের প্রজন্মের মানুষ সেই আনন্দ আঁজলা ভরে তুলে নেয়৷ আজ যেমন আমরা আড়াইহাজার খ্রীষ্টপুর্বাব্দের বুদ্ধি-শ্রম আর সৃষ্টির আনন্দ আকণ্ঠ পান করলাম৷
এতক্ষন কেবিনে বসে লিখছিলাম৷ এবার ডেকে উঠে এলাম৷ ভীষন ভালো লাগছে নীলনদের ওপর ভেসে বেড়াতে৷ আমার এক পাশে রুক্ষ পাহাড়, অপর পাশে সবুজ৷ কিন্তু সে কথা পরে৷ আগে কালকের গল্প বলে নিই৷
কাল ভোর দুটোতে উঠতে হয়েছে৷ লুক্সরের ফ্লাইট ছিল ভোর পাঁচটায়৷ লুক্সরে নেমে লাগেজ কালেক্ট করেই সাইট সিইং নাইলের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে৷ নীলনদের পশ্চিম উপকুল রুক্ষ, ধুষর, পাথুরে৷ ফারওরা তাই এই তীরটাকে বেছে নিয়েছিল তাদের শান্তিতে ঘুমনোর জায়গা হিসেবে৷ এই সমাধিগুলো কিন্তু পিরামিড নয়৷ পিরামিডগুলো সবই চার সাড়েচারহাজার বছর আগে তৈরী৷ পিরামিডের প্রবেশপথ যদিও গোপন রাখা হত, কিন্তু তা সজ্জ্বেও চুরিডাকাতি সেই প্রাচীনকালেও কিছু কম হয়নি৷ পিরামিডের অতুলনীয় ধনসম্পদের লোভে সেই যুগেও বহু লোক পিরামিড ভেঙে ঢুকেছে৷ তাই পরবর্তীকালের ফারওরা লুক্সরের কাছে নীলনদের পশ্চিমকুলের পাথুরে জমিকে বেছে নিয়েছিল তাদের সমাধির জন্য৷ মাঠির নিচে সমাধিকক্ষ তৈরী করে তার মুখ এমনভাবে বন্ধ করে দেওয়া হত যাতে কেউ খুঁজে না পায়৷ এই সমাধিস্থলই ভ্যালি অফ কিংস আর ভ্যালি অফ কুইনস৷ ভ্যালি অফ কিংসে মুলত ফারওদের সমাধি দেওয়া হত৷ ভ্যালি অফ কুইনসে রাজপরিবারের অন্যান্য সদস্যদের৷
এর পর গেলাম ভ্যালি অফ কিংসে৷ এখানেও ছবি নেওয়া যাবে না৷ আমরা গেলাম চতুর্থ রামেসিস, নবম রামেসিস আর তুতানখামুনের সমাধিতে৷ তুতানখামুনের জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হল ৮০ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড দিয়ে৷ বাকিগুলো আমাদের প্যাকেজে ইনক্লুডেড৷ চতুর্থ রামেসিসের সমাধি বেশ বড়ো৷ এই সমাধি অব্যশ্য বহুদিন
তারপর গেলাম বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিখ্যত ফারাও তুতানখামুনের সমাধি দেখতে৷ খুব ছোটো সমাধি৷ তুতানখামুন তো খুব একটা বিখ্যাত রাজা ছিলেন না৷ খুব অল্প বয়সেই মারা যান৷ তুতানখামুন বিখ্যত হয়েছেন মৃত্যুর তিনহাজার বছর পরে যখন জেমস কার্টার তাঁর প্রায় অবিকৃত সমাধিমন্দির আবিষ্কার করে৷ আর কোনো ফারওএর সমাধি থেকে এতো সম্পদ পাওয়া যায়নি৷ তার মানে অবশ্য এই নয় যে তুতানখামুনের সময় মিশর কিছু অতিরিক্ত সমৃদ্ধিশালী ছিল৷ সব ফারাওদের সমাধিতেই প্রচুর ধনসম্পদ ছিলো, কিন্তু সে সবই চুরি গেছে৷ সৌভাগ্যবশত তুতানখামুনের কথা সবাই ভুলে গেছিল৷ তাই তাঁর সমাধির ওপর হামলা হয়নি৷ বিশ শতকে তাঁর সমাধির অতুলনীয় সম্পদ দেখে আজকের মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে৷ এই তুতানখামুনের ছবি আনন্দমেলার প্রচ্ছদে দেখেই আমার মিশর মুগ্ধতার সুত্রপাত৷ তুতানখামুনের সমাধির করিডরে বিশেষ ছবি নেই৷ রাজার মৃত্যু যেহেতু অপ্রত্যশিত ছিল তাই খুব তাড়াহুড়োয় বানানো হয় এই সহ্মাধি৷ ইনার চেম্বারে কাচের বাক্সে রাখা রয়েছে তুতানখামুনের মমি৷ এবছরের নভেম্বর মাসের চারতারিখে তুতানখামুনের মমি খোলা হয়েছে৷ তাই এই মুহুর্তে ইজিপ্টোলজিতে তুতানখামুনের মমি হল সবচেয়ে বড়ো খবর৷ মমি আমরা আগেও দেখেছি৷ ঐতিহাসিক গুরুত্ব যতই হোক না কেন, আমাদের অশিক্ষিত চোখে এটা যে আলাদা কিছু তা কিন্তু নয়৷ কিন্তু মাটির তলায় সমাধিমন্দিরে তিনহাজার বছরের পুরোনো কিশোরের দেহাবশেষ দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো৷ তিনহাজার বছর! মহাকালের নিয়মে হয়তো কিছুই নয়৷ কিন্তু আমাদের নশ্বর জীবনে আমরা তো কল্পনাই করতে পারি না৷ আত্মাই শুধু জন্মরহিত ও শাশ্বত নয়, প্রাচীন মিশরীয়দের দেহকেও শাশ্বত করে রাখার উপায় জানা ছিল!! তুতানখামুনের সমাধির দেওয়ালের ছবিগুলো আশ্চর্য জীবন্ত৷ হয়তো মানুষের আনাগোনা বেশি হয়নি বলেই রঙ বিশেষ নষ্ট হয়নি৷ তুতানখামুনের সাথে আইসিসের ছবি আছে দেওয়াল জুড়ে৷ এতো উজ্জ্বল যে দেখে মনে হচ্ছে কালই আঁকা হয়েছে বুঝি৷
এতো টায়ার্ড ছিলাম যে ভালো করে খেতেও পারলাম না৷ ঘরে ফিরে আধঘন্টা শুয়েই বেরিয়ে পড়তে হল৷
কার্নক টেম্পল দেখার পরেও যে কিছু দেখে ভালো লাগতে পারে তা ভাবি নি৷ ভুল ভাঙলো বাস এসে যখন দাঁড়ালো লুক্সর টেম্পলে৷ তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে৷ লুক্সর টেম্পল আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ অসাধারন লাগছে মন্দিরের প্রবেশপথের দুইপাশে দ্বিতীয় রামেসিসের বিশাল মুর্তিদুটোকে৷ লুক্সরের মন্দির প্রাচীন কালে কর্নাক মন্দিরের সাথে
লুক্সর থেকে জাহাজে ফিরেই ডিনার৷ খুব ভালো ডিনার ছিল৷ ভালো খেয়েছি৷ তারপর টানা ঘুম৷ঘুম ভাঙলো সাড়ে পাঁচটায়৷ শুভ তখন আমায় ডাকছে সানরাইজ দেখতে যাওয়ার জন্য৷ একটা হাল্কা সোয়েটার চাপিয়ে ডেকে উঠে এলাম৷ তখনো আবছা অন্ধকার৷ দুইপাশে ঘুমন্ত মিশর৷ আমরা ভেসে চলেছি নীলনদের ওপর দিয়ে৷ পাঁচহাজার বছরের মিশরীয় সভ্যতার কত উত্থানপতনের সাক্ষী এই নীলনদ৷ আজ আমরাও তার হিসেবের খাতায় ঢুকে গেলাম৷ পুব আকাশ ফরসা হয়ে সোনালী সুর্য মুখ বাড়ালো৷ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো৷ মনে হল পাঁচহাজার বছরের কল্পনায় গড়ে তোলা সুর্যদেবতা রা আমাদের অভ্যর্থনা করলেন৷ এই পৃথিবীর প্রতিটি ধুলিকণায় মিশে আছে যে অপরিসীম বিস্ময় - সেই বিস্ময়ে বিস্মিত হওয়ার আশীর্বাদ আমরা পেয়ে গেলাম৷
ব্রেকফাস্ট খেয়ে লিখতে বসেছিলাম৷ এখন বেলা গড়িয়ে দুপুর৷ বিকেলে পৌঁছবো এডফুতে৷ সে গল্প পারলে লিখে ফেলবো আজ রাতেই৷
২০ নভেম্বর, বিকেল ৩:৪৫, অসওয়ান এয়ারপোর্ট
অসওয়ান এয়ারপোর্টে বসে আছি৷ কায়রো যাবো৷ কাল সারাদিন কায়রো ঘোরা৷ তারপর মিশরকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ফেরা৷ গত দুদিন যে কেমন ভাবে কেটে গেল! সারাদিন নীলনদে ভেসে বেড়ানো৷ মাঝে মাঝে তরী ভিড়ছে তীরে৷ দুহাজার বছরের পুরোনো মানুষের অপুর্ব সৃষ্টি ভেসে উঠছে চোখের সামনে৷ এখানে সবাই দেখছি ভারতীয়দের বেশ পছন্দ করে৷ পরশু সালোয়ার কামিজ পড়েছিলাম৷ সন্ধ্যাবেলা আমাদের বোট এডফু পৌঁছালে আমরা টাঙ্গায় চেপে চললাম হোরাসের মন্দির দেখতে৷ এডফু একেবারে পশিমবঙ্গের সাধারন মফস্বল শহরের মতই৷ রাস্তার মোড়ে মোড়ে, দোকান ঘরের সামনে ছেলেছোকরাদের জটলা৷ আমাদের দেখেই তারা চেঁচিয়ে উঠছে "ইণ্ডিয়া! অমিতাভ বচ্চন! রানী মুখার্জী!!" যা বুঝলাম বলিউডের দেবতারা বেশ ভালই পুজো পান এখানে :)
এডফুর হোরাসের মন্দির দুহাজার বছরের পুরোনো৷ এবং রঙ বাদে প্রায় পুরোটাই অক্ষত৷ হোরাসের গল্প আগেই বলেছি৷ মৃত্যুদেবতা ওসিরিস আর
সেদিন আমাদের ক্রুজে ইজিপশিয়ান ডিনার ছিল৷ দুর্দান্ত খেলাম৷ কালোজিরে দেওয়া একরকম রুটি - অনেকটা আমাদের খাস্তা নিমকির মত৷
ওহো - বলতে ভুলে গেছি৷ দুপুরে বোট যখন লকগেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তখন দেখি একগাদা ছোটো ছোটো নৌকা আমাদের ছেঁকে ধরেছে৷ ঐ নৌকাগুলো আসলে ছোটো ছোটো দোকান৷ দোকানীরা নৌকো থেকে আমাদের ডেকে ছুঁড়ে দিচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা গালাবা আর জিলাবিয়া৷ গালাবা আর জিলাবিয়া হল ট্র্যাডিশনাল মিশরীয় পোষাক৷ ছেলেদের গালাবা আর মেয়েদের জিলাবিয়া৷ দুটো ই পা পর্যন্ত লম্বা আলখল্লা টাইপের পোষাক৷ রাতে আমাদের ক্রুজে ইজিপসিয়ান নাইট ছিল৷ তাই অনেকেকেই কিনে নিল পার্টির পোষাক৷ আমিও আমার কেবিনের জানলা দিয়ে কিনে নিলাম একটা শাল৷ নৌকা থেকে প্লাস্টিকে ভরে আমায় শাল ছুঁড়ে দিল৷ প্রথমে চাইলো দুশো ইজিপশিয়ান পাউন্ড৷ শুভ সেটাকে দরাদরি করে পঞ্চাশে নামিয়ে আনলো৷ প্লাস্টিকে ভরে টাকা ছুঁড়ে দিলাম নৌকায়৷
মিশরের আরো অনেক মন্দিরের মত এই মন্দিরের দেওয়ালেও লোটাস, প্যাপিরাস, বিভিন্ন শস্যের ছবি আঁকা৷ তার এক পাশে রাজার, আরেকপাশে দেবতার ছবি৷ রাজা এই সব কিছু দেবতাকে নিবেদন করবেন৷ ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে গেল এক জায়গায় যেখানে হায়রোগ্লিফিক্সে প্রাচীন মিশরীয় ক্যালেন্ডার খোদাই করা আছে৷ বছরের প্রতিটা দিন খোদাই করা আর তার পাশে সেই দিনে দেবতাকে কি নৈবেদ্য দেওয়া হবে তার ছবি৷ আরেকটি দেওয়ালের একাংশে শুধু দুটো চোখ আর কান আঁকা আছে৷ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সব শুনছেন, সব দেখছেন৷
কম-অম্বোর এই মন্দিরের গর্ভগৃহ দুটি৷ একটা সোবেকের জন্য৷ আরেকটা হোরাসের জন্য৷ দুই গর্ভগৃহের মধ্যে যে দেওয়াল তার ভেতরটা ফাঁপা৷ সেখানে নেমে গেছে একটা সুড়ঙ্গ৷ রাজা যাখন মন্দিরে প্রার্থনা করতে আসতেন প্রধান পুরোহিত তখন নেমে যেতেন ঐ সুড়ঙ্গে৷ রাজা দেবতার সাথে কথা বলতেন৷ দেবতার হয়ে উত্তর দিতেন পুরোহিত৷ রাজা এই চালাকিটা ধরতে পারলেও তাঁর কিছু করার ছিল না৷ এতো জানাই আছে ধর্মের আফিম রাজার তলোয়ারের চেয়েও শক্তিশালী৷
হোরাসের মন্দিরে বেশ কিছু জায়গায় রঙ এখনো মুছে যায়নি৷ দুহাজার বছরের রোদ-জল উপেক্ষা করে এখনো ঝলমল করছে৷ আমরা যখন গেছিলাম তখন ওখানে আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না৷ নীলনদের হাওয়া দুহাজার বছরের পুরোনো ইতিহাসের গন্ধ বয়ে আনছিল৷ প্রায় ফাঁকা মন্দিরে আমরা দুজনে অনেকক্ষন ঘুরে বেড়ালাম৷ একটা ঘুপচি ঘরে স্টেথোস্কোপ কানে দেওয়া এক ডাক্তারের ছবি পাওয়া গেল৷ তার পাশে ঐ রকমই একটা অন্ধকার ঘরে এক রানীর ছবি দেখিয়ে স্থানীয় এক মানুষ বললো ক্লিওপেট্রা৷ সত্যি করেই ক্লিওপেট্র কিনা জানি না, তবে লোকটা দুই ডলার বখশিশ আদায় না করে পিছু ছাড়লো না৷ আমরাও বোটে ফিরে এলাম৷ ভেসে চললাম অসওয়ানের দিকে৷
২২ নভেম্বর, দুপুর ১২:৩৮, ফেরার বিমানে অ্যাটলান্টিকের ওপর
আজ ফিরছি৷ খানিক পরেই নিউ ইয়র্ক পৌঁছাবো৷ সাত দিনের এই মিশর ভ্রমনে মন এমন কানায় কানায় ভরে আছে যে ঘরে ফিরে কাজে মন দেওয়া মুশকিল হবে৷ ১৯ তারিখের রাতে অসওয়ান পৌঁছলাম৷ রাতে ভিভিয়ান আমাদের অসওয়ানের বিখ্যাত স্পাইস মার্কেটে নিয়ে গেল৷ মশলার গন্ধে ম ম করছে৷ আমি অবশ্য মশলা কিনিনি৷ কিছু প্যাপিরাস কিনলাম৷ এখানে বাজারে ভীষন দরদাম করতে হয়৷ ওরা যা চাইবে তার ১/৬ দিয়ে শুরু করা দস্তুর৷ আমাদের সঙ্গী আমেরিকানরা এসব দেখে ভ্যবাচ্যাকা৷ আমরা কয়েকজনের হয়ে বার্গেন করে দিলাম৷ অসওয়ানই আমাদের ক্রুসের গন্তব্য ছিল৷ ২০ সকালে ক্রুসে চেক আউট৷ তারপর সারাদিন অসোয়ান সাইট সিয়িং৷ বিকেলের প্লেনে কায়রো ফেরা৷
মন্দিরের দেওয়ালের ছবি থেকে দেবতার মুখ খুবলে নেওয়া হয়েছে৷ খ্রীষ্টধর্ম প্রসারের সময় যারা বাধ্য হয়েছিল ধর্মান্তরিত হতে, অথচ মনে মনে বিশ্বাস করতো মুর্তিপুজাতেই - তারা হয়তো ভয় পেয়েছিল দেবতার রোষের৷ তাই বিকৃত করে দিয়েছিল মুর্তির মুখ৷ ভেবেছিল মুখ বিকৃত করে দিলে হয়তো দেবতা আর দেখতে পাবেন না তাদের৷ আরেকটা ইন্টারেস্টিং তথ্য বলে নিই এই ফাঁকে৷ প্রাচীন পেগান সভ্যতাগুলোর মত মিশরীয়রাও বিশ্বাস করতো সিমেট্রিতে৷ তাই মিশরীয় মন্দিরগুলো বামদিকটা অনেকসময়ই ডানদিকের মিরর ইমেজ৷ অনেক মন্দিরের ধ্বংসস্তুপে তাই দেখেছি শুধু বামদিকটা বা শুধু ডানদিকটা বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে৷ একদিকটা নষ্ট করে দিলেই সিমেট্রি নষ্ট হয়ে গেল৷ আর সেই সাথে নষ্ট হয়ে গেল সংশ্লিষ্ট দেবতার শক্তিও - এই রকমই বিশ্বাস৷

এর পর আর বিশেষ কিছু দেখার ছিল না সেদিন৷ পথে অসওয়ান হাই ড্যামে বাস থামলো একবার৷ বিশাল এই ড্যামের পাশেই মানুষের তৈরী পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো জলশয় লেক নাসের৷ মিশরের রুক্ষ দক্ষিনপ্রান্তে এই জলাশয় মিশরের বর্তমান অর্থনীতিতে অসামন্য গুরুত্বপুর্ন হলেও প্রাচীন মিশরের নেশায় এমন বুঁদ হয়েছিলাম যে এই লেকটির দিকে বিশেষ মন দিতে পারলাম না৷ বাস চললো এয়ারপোর্টে৷ পড়ন্ত বিকেলের আলোয় রুক্ষ ধুষর অসওয়ানকে বিদায় জানিয়ে আমরা উড়ে চললাম কায়রোর দিকে৷
২৬ নভেম্বর, ব্যাটেলক্রিক, সকাল ৯:৩৭
মিশর থেকে ফিরেছি তিনদিন হয়ে গেল৷ আসার পর থেকেই সেমেস্টার শেষের চাপ আর বাড়ী ফেরার অপরিসীম আলস্য যেভাবে একসাথে সাঁড়াশী আক্রমন চালিয়েছিল যে ভাবছিলাম আমার আরো পাঁচটা কাজের মত এই মিশর ডায়েরীও অসমাপ্ত রয়ে যাবে বুঝি৷ আজ অফিসে এসে দেখি কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ রেসপন্ড করছে না৷ কাজকর্ম শিকেয় তুলে তাই মিস্তিরীর অপেক্ষায় বসে আছি৷ আর সেই অবসরে চলছে ডায়েরী লেখা৷
২১ তারিখ সকালটা ছিল পিরামিড আর স্ফিংক্সের জন্য৷ ভোরে ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে দেখি হোটেলের লবি থেকে পিরামিড দেখা যাচ্ছে৷ ব্রেকফাস্ট খাওয়া মাথায় উঠলো৷ ছবি তুলতে ছুটলাম৷ তারপর সত্যিই যখন বাসে চেপে বসলাম আর আমাদের গাইড জানালো আমরা এখন চলেছি গিজাতে
পিরামিডের সামনে একটা ছোটো কি-অস্কে টিকিট বিক্রি হচ্চে৷ টিকিট কিনে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম৷ ভিভিয়ান আমাদের আগেই সাবধান করে দিয়েছিল পিরামিডে ঢোকার পথ একটা ছোটো সুড়ঙ্গের মত৷ পাশাপাশি বড়জোর দুজন চলতে পারে৷ ছাদ এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে হবে৷ ভেতরে কোন ভেন্টিলেশন নেই৷ তাই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে পারে৷ ভিভিয়ানের কথা একান দিয়ে ঢুকে ওকান দিয়ে বেরিয়ে গেছে৷ মিশরে এসে সুযোগ পেয়েও পিরামিডে ঢুকবো এ আবার হয় নাকি৷ আর গাইডেরা অনেক সময়েই বাড়িয়ে বলে৷ সেবারে ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে রাইড নেওয়ার সময়েও অনেকে সাবধান করেছিল৷ কিছুই তো হয়নি৷ ভিভিয়ান যে ফাঁকা বুলি আওড়ায়নি সেটা বুঝলাম একটু পরেই৷ বড়োজোর তিনফুট চওড়া সুড়ঙ্গের একদিক দিয়ে মানুষ ঢুকছে, অন্যদিক দিয়ে বেরোচ্ছে৷ সুড়ঙ্গটি আবার সোজা নয়, সেটা বেঁকে গেছে নিচের দিকে৷ দেওয়ালে খানিক দুরে দুরে আলো লাগানো আছে বটে, কিন্তু মোটের ওপর জায়গাটা অন্ধকার৷ এতো লোকের আনাগোনায় একটা ভ্যপসা বাষ্প তৈরী হয়েছে যেটা আমায় ক্লস্টোফোবিক করে তুলছিল৷ পিঠ বেঁকিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল এ পথের বুঝি আর শেষ নেই৷ অথচ সত্যি করে হয়তো বড়োজোর তিনমিনিট হেঁটেছি৷ সুড়ঙ্গ একসময় একটা ছোটো সমতল কুঠুরীতে এসে শেষ হল৷ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ এখানে পাথরের দেওয়ালের গায়ে একটা ছোটো কুলুঙ্গীর মত৷ আর আমাদের ডানদিকে আরেকটা সুড়ঙ্গ অন্য একটা ঘরে চলে গেছে৷ সেটার দরজা বন্ধ৷ আন্দাজে মনে হল এটা রানীর সমাধি৷ কারন শুনেছিলাম রানীর সমাধিকক্ষটি বেশ ছোটো এবং সেটা বন্ধ আছে৷ কুঠুরী থেকে আরেকটা সুড়ঙ্গ এবার চলে গেছে ওপরের দিকে৷ সেই সুড়ঙ্গ ধরে চলতে শুরু করলাম৷ দেখলাম পিঠ বেঁকিয়ে ওপরের দিকে ওঠা অপেক্ষাকৃত সোজা৷ এবার কম কষ্ট হল৷ সুড়ঙ্গ শেষ হয়েছে একটা মাঝারী আকারের ঘরে৷ সেখানে একটা পাথরের সার্কোফেগাস (কফিন) রাখা৷ ব্যাস৷ আর কিছু নেই৷ চারহাজার বছর অগে হয়তো এই ঘরটিকে সোনাদানায় মুড়ে দেওয়া হয়েছিল৷ হয়তো সমাধিকক্ষে, সুড়ঙ্গের দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছিল ওসিরিসের সভায় শেষ বিচারের ছবি৷ এখন আর সেসবের কিছুই নেই৷ কালো পাথরের সার্কোফেগাসটার কাছে গিয়ে খানিকক্ষন দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ভ্যপসা সুড়ঙ্গপথ৷ তার শেষে এই অপ্রশস্ত প্রায়ন্ধকার সমাধিকক্ষ৷ মনে হচ্ছিল সত্যিই অন্য এক দুনিয়াতে চলে এসেছি৷ অতো লোকের মাঝেও গা ছমছম করছিল৷ হতে পারে মুক্ত বাতাসের অভাবে৷ হতে পারে এতোক্ষন কুঁজো হয়ে হাঁটার জন্য৷ হতে পারে এতোদিনের পড়া গল্প আর সত্যিকরে পিরামিডের ভেতরে পা ফেলার অভিজ্ঞতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল বলে৷ শেষবারের মত ফারাও খেফরনের গোপনতম ঠিকানায় চোখ বুলিয়ে ফেরার পথ ধরলাম৷ আবার সেই বদ্ধ সুড়ঙ্গ৷ কতক্ষনে সুর্যের আলো দেখবো সেই আশায় হামাগুড়ি দিয়ে পথ চলা৷
পিরামিড থেকে ঘুরে আসার পাঁচ দিন পর এই লেখা লিখছি৷ এখনো ঘোর কাটেনি আমার৷ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স কাকে বলে তা প্রথম বুঝেছিলাম ১৯৯৫ সালের অক্টোবর মাসে যখন পুর্ণ সুর্যগ্রহনের চুড়ান্ত মুহুর্তটিতে আকাশ-বাতাস এক অপার্থিব নীলাভ দ্যুতিতে ঢেকে গেছিল৷ আবার বুঝলাম ২০০৭ এর ২১শে নভেম্বর পিরামিডের মধ্যে পা রেখে৷ এ এমন এক বিস্ময়কর অনুভুতি যা লিখে প্রকাশ করবো এমন ভাষা আমার জানা নেই৷ দুটো ই যেন এক অন্য পৃথিবী থেকে ঘুরে আসা৷ এক চুড়ান্ত বিস্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে যাওয়া৷
অনেক প্রশ্ন ছিল মনে৷ কিছুই জিজ্ঞাসা করা হলনা ভিভিয়ানকে৷ এখন মনে হচ্ছে জানতে পারলে ভালো হত মিশরে সহমরন ছিল কিনা৷ রানীকে কি তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর পিরামিডে নিয়ে গিয়ে সমাধি দেওয়া হত, নাকি কোন বিভত্স প্রথা জড়িয়ে ছিল এর সাথে যা ভাবতে গেলেও এখন আমার হাড় হিম হয়ে আসছে৷ প্রশ্ন জাগছে ঐ সুড়ঙ্গ আর সমাধিকক্ষটুকু বাদ দিলে বাকি পিরামিডটা কি ফাঁপা? কিছুই জেনে নেওয়া হয়নি৷ ঐ সরু সুড়ঙ্গের ওপারের মৃত্যুপুরী আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল৷ পিরামিড থেকে বেরোনোর পর ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে এলো আরেকটা স্পটে যেখান থেকে স্ফিংক্সকে দেখা যায়৷
স্ফিংক্সের কথায় ফিরে আসি৷ ভ্যালি টেম্পলের পেছনের একটা দরজা দিয়ে বেরোতেই স্ফিংক্স একেবারে চোখের সামনে চলে এলো৷ স্ফিংক্স যে কত বিশাল তা এতোক্ষনে বুঝতে পারলাম৷ আর আরো অবাক করে দেওয়া ঘটনা হল এই বিশাল স্ফিংক্স কিন্তু পিরামিডের তুলনায় বেশ ছোটো৷ তিনটে পিরামিড আর স্ফিংক্স সহ সাহারার এই প্রান্ত এতো বিশাল যে আমাদের এতোদিনের বিশালত্বের ধারনা ওলটপালট হয়ে যায়৷ নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং বা শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার আমার মনে এই বিস্ময়ের জন্ম দেয়নি যদিও এই দুটো ই পিরামিডগুলোর চেয়ে অনেক উঁচু৷ রুক্ষ সাহারার বুকে সাড়ে চারহাজার বছরের পুরোনো মানুষের কীর্তিস্তম্ভ আমার মধ্যবিত্ত ধ্যানধারনায় সজোরে ধাক্কা মারে৷ আমার ঘোর কাটে না৷
২৭ নভেমবর, কালামাজু, রাত ৯:৪২
মিশরের গল্প প্রায় শেষ হয়ে এলো৷ গিজা থেকে ফেরার পথে ভিভিয়ান আমাদের নিয়ে গেল একটা এসেন্স শপে৷ বাহারী কাঁচের আতরদানীতে ভরা সেই দোকান যেন আরব্য উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে৷ সুদৃশ্য পেয়ালায় টার্কিশ কফিতে আমাদের আপ্যায়িত করে দোকানদার আমাদের এক হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধির গল্প শোনাতে বসলো৷ লোটাস ছিল প্রাচীন মিশরের আদরের ফুল৷ প্রায় সব মন্দিরেই তাই আমরা লোটাস আর প্যাপিরাসের ভাস্কর্য দেখেছি৷ কিন্তু পেগান সভ্যতার অবসানের সাথে সাথে প্রাচীন মিশরের এই সম্পদটিও চিরতরে হারিয়ে গেছিল৷ বিশ শতকে হাওয়ার্ড কার্টার যখন তুতানখামুনের সমাধি প্রায় অবিকৃত অবস্থায় খুঁজে পেলেন তখন আর সব জিনিসের সাথে তিনি পেলেন কিছু অ্যালবেস্টার ভাস৷ সেই ভাসের মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য সুগন্ধি যার সুবাস তিনহাজার বছর পরেও অম্লান৷ শুধু গন্ধই নয়, অ্যালবাস্টার ভাসে পাওয়া গেল তিনহাজার বছরের পুরোনো পদ্ম আর প্যাপিরাসের বীজ৷ সেই বীজ থেকে হারিয়ে যাওয়া সুগন্ধি আবার ফিরে এলো মিশরে৷ এই বলে সে আমাদের মনিবন্ধে এক ফোঁটা করে লোটাস এসেন্স লাগিয়ে দিল৷ অপুর্ব মাদকতাময় সেই গন্ধ রাত পর্যন্ত আমার হাতে ছিল৷ আমার শ্বাশুড়ি মা সুগন্ধি ভালোবাসেন৷ তাঁর জন্য লোটাস নিলাম এক শিশি৷ আমার বরটিও ওমর শরীফ নামের একটি সুগন্ধি কিনলো৷ এর পেছনে কোন খানদানী গল্প না থকলেও গন্ধটি বড় মনোরম৷
খেতে খেতে দুটো বেজে গেছিল৷ কায়রো মিউজিয়াম বন্ধ হবে পাঁচটায়৷ আমরা তাই ছুটলাম মিউজিয়ামের দিকে৷ সেই ফাঁকে কায়রো শহরও দেখা হল খানিকটা দিনের আলোতে৷ কারয়োতে বেশির ভাগ বাড়িই দেখি অসমাপ্ত৷ প্রায় কোনো বাড়িরই প্লাস্টার নেই৷ ইঁটের কাঠামোর ওপর নতুন রঙ করা জানলার গ্রিল কদর্য ভাবে শোভা পাচ্ছে৷ ভিভিয়ান আমাদের বললো এখানে বেশির ভাগ মানুষই বাড়ি শেষ করেনা৷ কারন বাড়ি শেষ হলেই প্রপার্টি ট্যাক্স দিতে হবে৷ বাইরে থেকে যে বাড়িগুলোকে ইঁটের কঙ্কাল মনে হচ্ছে সেগুলোর ভেতরের ছবিটা একেবারেই অন্যরকম৷ মিউজিয়াম যাওয়ার রাস্তায় বেশ কিছুটা জায়গা খুঁড়ে ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে৷ আমার গড়িয়াহাটের কথা মনে পড়ে গেল৷ প্রচুর ট্র্যাফিক৷ এর মধ্যেই কারো কারোর সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনোর চেষ্টা৷ কলকাতার মতই অবস্থা৷ তবে কায়রোতে পাবলিক ট্রানস্পোর্ট খুব বেশি চোখে পড়লো না৷ বাস আছে৷ ট্রামও দেখেছিলাম ১৬ তারিখ রাতে৷ কিন্তু সংখ্যায় খুব বেশি নয়৷
অবশেষে আমরা যখন মিউজিয়ামে এসে পৌঁছালাম তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে৷ টিকিট কেটেই সবার আগে ছুটলাম তুতানখামুনের কালেকশন দেখার জন্য৷ আগে বলা হয়নি, তাই এই সুযোগে তুতানখামুনের কথা আরেকটু বলে নিই৷ তুতানখামুনের আসল নাম তুত-আনখ-আতুম৷ তুতানখামুনের বাবা আখেন-আতুম পৌত্তলিকতার অসারতা উপলব্ধি করে একেশ্বরবাদের প্রবর্তন করেন৷ সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নাম তিনি দেন আতুম এবং সেই নামটি নিজের ও ছেলের নামের সাথে জুড়ে নেন৷ স্বাভাবিক কারনেই মিশরের পুরোহিততন্ত্রের এই পরিবর্তন পছন্দ হয়নি৷ আখেন-আতুমের মৃত্যুর পর তার কিশোর পুত্র তুত-আনখ-আতুম ফারাও হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পুরোহিততন্ত্র সফল হল তাদের পুরোনো দেবতা আমুনকে ফিরিয়ে আনতে৷ তখন থেকে তুত-আনখ-আতুমও তাঁর পুরোনো নাম পরিবর্তন করে তুত-আনখ-আমুন নামে পরিচিত হলেন৷
এবার ফিরে আসি কায়রো মিউজিয়ামে রাখা তুতানখামুনের সমাধির অতুলনীয় সম্পদের কথায়৷ ভ্যালি অফ কিংসে তুতানখামুনের সমাধিতে ঢুকেছিলাম ১৭ তারিখ৷ তারপর কায়রো মিউজিয়ামে সেই সমাধিতে যা যা পাওয়া গেছিল সেগুলো দেখলাম৷ এখনো পর্যন্ত ভেবে চলেছি ঐটুকু জায়গা যদি এতো জিনিসে ভরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে অন্য সব নামকরা ফারাওদের অপেক্ষাকৃত বড় সমাধিগুলোতে না জানি কত সম্পদ ছিল৷ সব কিছুর বর্ণনা দেওয়া এখানে সম্ভব হবে না৷ যেগুলো প্রথম ঝটকায় মনে আসছে সেগুলো লিখি৷ প্রথমেই মনে পড়ছে দুই প্রহরীর কথা৷ ব্ল্যাক রেজিনে
এতোদিন যা শুধুই বইএর পাতায় বা ডিসকভারীর শোতে দেখেছি সেগুলো চোখের সামনে দেখেতে পেয়ে অবিশ্বাস্য লাগছিলো৷ বেশি সময় ছিল না৷ তাই ভিভিয়ান যেটুকু দেখালো সেটুকু দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হল৷ পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো সাদা পাথরের স্ল্যাবের ওপর আঁকা ছবি দেখলাম৷ পাঁচটি পাখির ছবি৷ দুটি মেয়ে৷ তিনটি পুরুষ৷ কয়েকটি পাখি জলাশয়ে খুঁটে খুঁটে শিকার করছে৷ একটি সবে ওড়ার জন্য পাখনা মেলেছে৷ পাঁচহাজার বছরের পুরোনো তুলিতে সে কি গতি, রঙের কি দীপ্তি! আলতামিরার বাইসন কোনদিন দেখতে পাবো কিনা জানি না৷ কিন্তু এই পাখির ছবি দেখে মনে হল আগন্তুকে উত্পল দত্তের মুখ দিয়ে সত্যজিত্ যা বলিয়েছিলেন তা একদম ঠিক৷ এমন আঁকতে না পারলে আঁকা শেখার কোন মানেই হয় না৷ দেখলাম সেই স্ক্রাইবের মুর্তি৷ রাজসভায় যা কথা হচ্ছে সব সে লিখে নিচ্ছে৷ চোখদুটি ফারাওএর দিকে নিবদ্ধ৷ নির্নিমেষ সেই দৃষ্টি কি অসম্ভব জীবন্ত! ভিভিয়ান তার হাতের তর্চ ফেললো স্ক্রাইবের দুই চোখের মণির ওপর৷ শিউরে উঠলাম৷ এক পুরোহিতের মুর্তি দেখলাম৷ তার চুল এবং গোঁফ দুইই আছে৷ মিশরীয় পুরোহিত মাত্রেই ক্লিনশেভড - এই ধারনাটা ভুল প্রমান হল৷ শেষ কুড়ি মিনিট ভিভিয়ান আমাদের দিয়েছিল নিজেদের মত ঘুরে দেখার জন্য৷ অতো বড়ো মিউজিয়ামে কুড়ি মিনিটে আর কি হবে৷ এলোপাথারী ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষন এবং ভিভিয়ান ছাড়া যে আমরা একেবারেই অচল সেটা অনুভব করলাম বেশ ভালো ভাবেই৷ কায়রো মিউজিয়ামের কালেকশন প্রচুর হলেও ডকুমেনটেশন বিশেষ ভালো নয়৷ আমরা একটা সার্কোফেগাসের ঘরে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষন৷ ফিফটি পার্সেন্ট সার্কোফেগাস জাস্ট এমনি পড়ে আছে৷ কার সার্কোফেগাস, কোথায় পাওয়া গেছিল, যে ছবি আঁকা আছে তার অর্থ কি - এসব কিচ্ছু লেখা নেই৷ একটা কালো পাথরের স্ল্যাব দেখলাম৷ তার গায়ে এক নগ্ন শিশুর ছবি আঁকা৷ এতোদিন যা মিশরীয় আর্ট দেখেছি এ তার চেয়ে একেবারে আলাদা৷ কিন্তু কিচ্ছু লেখা নেই৷ ওটা যে কি তা আর জানা হবে না কোনদিনও৷
পরের দিন সকাল দশটায় ছিল ফ্লাইট৷ কায়রো এয়ারপোর্টের মত বিশৃঙ্খল এয়ারপোর্ট আমি আর একটাও দেখি নি৷ আমরা টার্মিনালে পৌঁছে গেছিলাম সকাল সাতটার মধ্যে৷ অজস্র বোঁচকা-বুঁচকি ঠেলে তিনবার সিকিউরিটি চেক-ইনের মধ্য দিয়ে যখন গেটে পৌঁছোলাম তখন বাজে সাড়ে নটা৷ মাঝখানে কি হল তা জানার জন্য মুজতবা আলি পড়ে নিন৷ কাবুলের রাস্তা আর কায়রো এয়ারপোর্টে বিশেষ তফাত্ নেই৷ এবং এতো কিছুর পরেও আমার ক্যারি অন লাগেজে এক বোতল জল ছিল, সেটা আমার ব্যাগেই রয়ে গেল৷ ফেরার প্লেনে চেপে বসলাম৷ রুক্ষ বালির শহর ভুমধ্যসাগরের নীলে মিশলো৷ তারপর আর কিছু দেখা গেলনা৷
(এই লেখার শুরুতেই যাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চাই তিনি হলেন শুভাঙ্কুরদা - আমাদের সুপর্ণাদির জীবনসঙ্গী। ইউনিকোডে লেখার ব্যাপারে শত ব্যস্ততার মাঝেও দাদা আমাকে ভীষন সাহায্য করেছেন। উনি না থাকলে এই লেখা বাংলা হরফে এখানে প্রকাশ করা হয়ত সম্ভব হত না।)
No comments:
Post a Comment