একথা অস্বীকার করি না যে ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস মানিয়ে নিলে সংসারে বেশ শান্তি থাকে। মায়ের কথামত কপালে সিঁদুর ছোঁয়ানো, শ্বাশুড়ীর কথামত টুকটাক দুয়েকটা উপোস করা, বিয়ের পর নিজের নামের সাথে স্বামীর পদবীটা জুড়ে নেওয়া - শুধু এইটুকুতে কারোর জীবন দুর্বিষহ হয় না। একজন না, দুই দুই জন উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চ পসারসম্পন্ন আইনজীবি আমায় বলেছিলেন - বিয়ের পরে অটোমেটিকালি মেয়েদের সারনেম বদলে যায়, তোমার শ্বশুরবাড়ীর পদবীই তোমার পদবী। ক্ষতি নেই মেনে নিতে। জীবন অনেক সহজ হয়। সাময়িক ভাবে। একটা মেনে নেওয়ার ল্যাজ ধরে আরো কত মেনে নেওয়া আসবে কেউ জানে না। তাই মুখের ওপর সেই আইনজীবিদের বলা প্রয়োজন ছিল, আপনারা মূর্খ। ভদ্রতাবোধ বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে অনেক কিছুই করব বলেও করা হয় না। এটাও পারি নি। তবে এটুকু জানিয়ে এসেছিলাম যে আইনটা এমন নয়। বিয়ের পর পদবী পরিবর্তন আবশ্যিক নয়। যতই না কেন আপনার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী, মায় আইনজীবিও আপনাকে একথা বোঝানোর চেষ্টা করুক। হ্যাঁ, জন্মের পর নামের সাথে যে পদবী আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষের সাথে জুড়ে আছে তা বাবার পদবী। পিতৃতন্ত্রের সাথে যুদ্ধ করতে চাইলে সে পদবীও ঝেড়ে ফেলার দরকার আছে। আমার বেশ কিছু বন্ধু তাদের সন্তানের পদবী হিসেবে বাবা-মা দুজনের পদবীই দিয়েছে। এদের নাতি-নাতনীর পদবি কতখানি লম্বা হবে সেই ভেবে মাঝে মাঝে চিন্তা হয়, কিন্তু তাও এই উদ্যোগ প্রশংসাযোগ্য। পদবীহীন হতে পারলে বা পদবী হিসেবে জাত-গোত্রর পরিচায়ক নয় এমন কিছু ব্যবহার করতে পারলে সব চেয়ে ভালো হয়। তবে জানি না ভারতে সেটা করা কতটা সহজ।
কেন হঠাৎ করে মাথায় পদবীর ভূত চাপল বলি? আজ সকালে এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্টে জানতে পারলাম তার এক আত্মীয়া স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে চলে এসেছেন ছোট মেয়েকে নিয়ে। নতুন স্কুলে ভর্তি করাতে হবে মেয়েকে। এদিকে পুরোনো স্কুল মায়ের হাতে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেবে না। আইন, খুব নিশ্চিতভাবেই জানি, সন্তানের ওপর মায়ের পূর্ণ অভিভাবকত্ব স্বীকার করে এবং স্কুলের সেক্ষেত্রে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট না দেওয়ার কোন কারন নেই। কিন্তু আমাদের দেশের আইনজীবিরাও কতটুকু আইন জানেন বিয়ের পর পদবী পরিবর্তন সম্পর্কে দুই সফল আইনজীবির মন্তব্য থেকেই কিছুটা ধারনা করা যায়। সমস্যা তো আইনে নয়, সমস্যা মানসিকতায়। বিয়ে হলেই একটা মেয়ে শ্বশুরবাড়ীর সম্পত্তি হয়ে যাবে এই ধারনা এখনও প্রবলভাবে বিদ্যমান। অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর নাকি নড়বড়ে তা দিয়ে অবস্থার খুব একটা তফাত হতে দেখি না। বিয়ের পর একটি মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ীর লোকের সাথে যতখানি সময় কাটায়, একটি ছেলে তার শ্বশুরবাড়ীকে ততখানি সময় দেবে এটা এমনকি প্রগতিশীল মানুষেরাও আশা করেন না। নাস্তিকতা-আস্তিকতার তর্কে যাচ্ছি না। ধর্মাচারন ঘরের মধ্যে করতে চাইলে করুন। কিন্তু পুজো দেওয়ার সময় কার গোত্রটা পড়া হয় সেটা জানেন তো? যে লোকাচারগুলো আনন্দের সাথে পালন করেন, সেগুলো রোল রিভার্সাল করে পালন করার চেষ্টা করেছেন কখনও? হ্যাঁ, এগুলো খুব তুচ্ছ জিনিস। এগুলো মানলেই কেউ মধ্যযুগীয় মানসিকতার হয়ে যায় না। সবচেয়ে বড়কথা এগুলো মানলে সংসারে শান্তি থাকে। কিন্তু একবার যদি সেই শান্তিময় সংসার টাল খায়, তাহলে এই সব কিছু ফাঁস হয়ে বসে গলায়। স্কুল একজন মাকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকার করার সাহস পায়, কারন আরো হাজারজন মা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে সংসারের শান্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ একজন মানুষ মানুষের অধিকারে এ পৃথিবীতে বাস করবে এর জন্য এত জটিলতার দরকার ছিল না।
No comments:
Post a Comment