About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Wednesday, October 4, 2017

ধনঞ্জয় প্রসঙ্গে

 কিছুদিন আগে "পিঙ্ক" দেখে কেঁপে গেছিলাম। "ধনঞ্জয়" সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। অরিন্দম শীলকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই ছবি বানানোর জন্য। যা নিয়ে মানুষের মূল আপত্তি, সেই বিষয়বস্তুতে পরে আসছি। প্রায় ডকুমেন্টরী স্টাইলে বানানো এই ছবি। টানটান চিত্রনাট্য। দুর্দান্ত কাস্টিং। সত্যজিৎ রায় ছাড়া আর কোন বাঙালী পরিচালক এত ভালো কাস্টিং করেছেন বলে এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না। একটা তিরিশ সেকেন্ডের রোলের জন্যও এত যত্নে অভিনেতা নির্বাচন করা যায় এটা বাংলা ছবিতে আমরা ভুলতে বসেছিলাম। তার যোগ্য মর্যাদা রেখেছেন অভিনেতারা। অনির্বাণ ভট্টাচার্য এতটাই ভালো যে এর আগে দুটো সিনেমায় এই অভিনেতাকে দেখা সত্ত্বেও মিঠুন ওকে চিনতে পারেনি। একা অনির্বাণ নয়। প্রত্যেকে অত্যন্ত ভালো অভিনয় করেছেন।

বহু মানুষ এই ছবি দেখতে যাননি বিষয়বস্তুর জন্য। ধনঞ্জয়ের বিচারব্যাবস্থার অসঙ্গতি নিয়ে সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটা আমার পড়া ছিল। প্রবাল চৌধুরী ও দেবাশিস সেনগুপ্তর বইটা এখনও সংগ্রহ করা হয়নি। সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটা আমি অনেককে পড়ানোর চেষ্টা করেছি। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি যাঁদের মুক্তচিন্তার মানুষ বলে জানি তাঁদেরও এক আশ্চর্য রেজিস্টান্স আছে লেখাটা একবার পড়ে দেখতে। তাঁদের কাছে আমার আবার অনুরোধ রইল - পারলে একবার সিনেমাটা দেখুন ফাস্ট ফরওয়ার্ড না করে। কোন হাইপোথেসিস তৈরী না করে খোলামনে দেখুন।

ধনঞ্জয়ের ঘটনা যখন ঘটেছিল খবরের কাগজ পড়ে আমিও ভেবেছিলাম যে এই লোকটা খুনী এবং ধর্ষক। মীরা ভট্টাচার্য ধনঞ্জয়ের ফাঁসীর দাবীতে জনসভা করেছিলেন। খবরের কাগজে ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল। সেইসবই গভীর কৌতূহলের সঙ্গে পড়েছিলাম আমিও। ধনঞ্জয়ের ফাঁসীর পরের দিন, হেতালের স্কুলের মেয়েদের একটি ছবি বেরিয়েছিল কাগজে, তারা আঙুল দিয়ে "ভি" (ভিক্টরি) দেখাচ্ছিল। সেই প্রথম গা সিরসির করেছিল। খুনী এবং ধর্ষক সর্বোচ্চ শাস্তি পেল ঠিক আছে। প্রতিশোধের মৃতুতে হৃদয়ের তাপ জুড়োয়। দ্রৌপদী চুল বেঁধেছিল দুঃশাসনের রক্তে। কিন্তু উল্লাস? সেটা কি কখনও আসা সম্ভব গভীর শোক থেকে?

এর বারো বছর পর সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় জানলাম পোস্টমর্টেম রিপোর্টে যৌন মিলনের কথা ছিল, ধর্ষণের কথা ছিলই না। মৃতের শরীরে যতগুলো আঘাত সবই দেহের উপরিভাগে, নিম্নাঙ্গে কোন আঘাত নেই। সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স ছাড়া আর কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি ধনঞ্জয়ের অপরাধের। সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স হিসেবে জমা পড়েছে অপরাধের সময় পরে থাকা জামা, ঘটনাস্থল থেকে খুঁজে পাওয়া ছেঁড়া বোতাম ও একটি গলার চেন। জামাটি বাজেয়াপ্ত হয় অপরাধীর বাড়ি থেকে ঘটনার দুমাস পরে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া ছেঁড়া বোতামটি নথিভুক্ত হয়েছে জামাটি খুঁজে পাওয়ারও দিন দশেক পরে। চেনটির মালিকানা সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া যায়নি। (দুমাস, দশদিন এই হিসেব গুলো স্মৃতি থেকে লিখছি, সামান্য এদিকওদিক হতে পারে, কিন্তু ক্রনোলজিকাল অর্ডার ঠিক আছে।) সাক্ষীরা বারবার নিজেদের বয়ান বদল করেছেন। এত অসঙ্গতির পরেও একটা মানুষকে ফাঁসীর সাজা দেওয়া যায়?

ছবির শেষে মিনিট দশেকের একটা অংশ আছে যা অনার কিলিং-এর দিকে ইঙ্গিত করে। যাঁরা এই ছবিটি বর্জন করেছেন তাঁরা ছবিটি না দেখেও এই অংশটির কথা জানেন এবং এই অংশটি তাঁদের আপত্তির বড় কারন। প্রবাল চৌধুরী ও দেবাশিস সেনগুপ্তর বইতে অনার কিলিং-এর ইঙ্গিত আছে কিনা আমার জানা নেই। ছবিতেও এটাকে একটা সম্ভাবনামাত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। ছবিটা অনার কিলিং নিয়ে নয়। ধনঞ্জয়ের খুন করা (ধর্ষণ লিখব না, কারন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তা বলে না) যেমন একটা সম্ভাবনা, অনার কিলিংও আরেকটা সম্ভাবনা। ভারতে অনার কিলিং হয় এটা মানেন তো? হেতাল পারেখের খুন কে করেছিল তা জানা যায় নি। ছবিটাও এবিষয়ে কিছু বলছে না। বইটাও বলেনা বলেই জানি। তবে ধনঞ্জয় যে খুন করেনি তা মোটামুটি নিশ্চিত।

আমরা যখন কোনকিছু বিশ্বাস করে ফেলি, তখন সেই বিশ্বাসকে ঝেড়ে ফেলতে হলে নিজের কাছেই বোকা হয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে। সেই ঝুঁকিটা আমরা নিতে পছন্দ করি না অনেকসময়। তবে ঝুঁকিটা নিতে পারলে কিন্তু অনেক অজানা বিষয় জানা যায়। আমি মানুষ হিসেবে নিজের বাউন্ডারী বাড়ানোর জন্য বেশী লালায়িত। তার জন্য নিজেকে ভাঙতে চুরতে আমার লজ্জা নেই।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার লিঙ্ক রইল আরেকবার:
http://www.guruchandali.com/defa…/…/08/14/1439569396110.html

------------------------------------------------------------------------------------------------------

Mithun Bhowmick-এর রিভিউ:

ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের বিচার ও ফাঁসিকে কেন্দ্র করে অরিন্দম শীলের বানানো ছবি "ধনঞ্জয়" দেখলাম। এবং অনেকদিন পর বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে একটি সৎ ও সাহসী প্রযোজনা দেখলাম। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের বিচার, মিডিয়ার ভূমিকা এবং অসঙ্গতি নিয়ে আগেই লেখালেখি যা হয়েছে ঠিকঠাক পড়া ছিলোনা, সেইদিক থেকেও ছবিটি খুব দরকারি কাজ হয়েছে।
আমার মতে অরিন্দম শীল গত কয়েক বছরে যা ছবি করেছেন এটিই তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, মনে রাখার মত কাজ। অভিনেতা নির্বাচন থেকে মেদবর্জিত স্ক্রিপ্ট, সঙ্গীতায়োজন সবই খুব মাপা ও যথাযথ। অনির্বান ভট্টাচার্য্য, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুদীপ্তা চক্রবর্তী ভয়ঙ্কর ভালো অভিনয় করেছেন। বিশেষত অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য (ধনঞ্জয়) এবং আর্যা ব্যানার্জ্জির (চন্দ্রা) কাজ অনেকদিন মনে থাকবে।

কিন্তু "ধনঞ্জয়" তো শুধু একটি ছায়াছবি নয়। "ধনঞ্জয়" আধুনিক ভারতের আইনরক্ষক ও বিচারব্যবস্থার নিখুঁত ছবি, কল্পিত তথ্যপ্রমাণের মেকাপ তুলে ফেলার পর কুৎসিত মিডিয়া ট্রায়ালের দাগের ডিটেল যেখানে আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে। আমাদের মধ্যে যে অন্ধকার বাস করে, যা আমাদের মৃত্যুপথযাত্রীর সামাজিক স্ট্যাটাস দেখতে শেখায়, যা আমাদের সেই ব্যাকগ্রাউন্ডে সেলফি তুলতে উদ্বুদ্ধ করে বা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের অপেক্ষা করতে শেখায় -- "ধনঞ্জয়" সেইসব মূল্যবোধের দলিল। শুনলাম ছবিটি তেমনভাবে লোক টানতে পারেনি। পারার কথাও নয়। যেচে কে আর নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়।

"সহজ পাঠের গপ্পো" ছবিটি নিয়ে কী হয়েছে আমরা জানি। বাংলায় আর বেশিদিন হয়ত ভালো ছবি করার শাস্তি পরিচালকেরা নেবেন না।

Tuesday, June 20, 2017

নকশার উল্টো পিঠ

 আমার দিদার ছিল গোটা চারেক ভালো শাড়ী। একটা বিয়ের বেনারসী, একটা গরদ, মাঝবয়েসে বেনারস বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে কেনা একটা কড়িয়াল বেনারসী, এছাড়া শেষের দিকে তসরও হয়েছিল। মায়ের প্রথম দামী শাড়ী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোন হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা দুধে আলতা রঙের একটা বালুচরী। পঁচিশ বছর পরেও তার জলুষ অম্লান এবং তার তুল্য একটি দ্বিতীয় বালুচরী আজ পর্যন্ত দেখলাম না। সেই শাড়ীটি কেনার সময়ে মায়ের পনেরো বছর চাকরী করা হয়ে গেছে। তারপরে মুক্ত অর্থনীতি এসে লোকজনের হাতে টাকাপয়সা বেড়েছে। এখন মধ্যবিত্তের ঘরেও বিভিন্ন প্রদেশের একাধিক হ্যান্ডলুম শাড়ী। কিন্তু যারা এই শাড়ীগুলো মধ্যবিত্তের হাতে তুলে দিচ্ছেন তাদের অবস্থা কেমন? এবং এককালে যেসব শাড়ী মানুষ একটা দুটোর বেশি কিনে উঠতে পারত না, তা এমন সহজলভ্যই বা হয়ে উঠছে কি উপায়ে?

প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার আগে সংক্ষেপে হ্যান্ডলুম শাড়ীর নির্মাণ প্রক্রিয়া জানা যাক। হ্যান্ডলুম অর্থাৎ কিনা হাতে বোনা। কাপড় যদি খাদির হয় তাহলে সুতোটাও হাতে তৈরী। বেশীর ভাগ সিল্কের ক্ষেত্রেও তাই। ব্যাঙ্গালোর সিল্কের ক্ষেত্রে সুতো তৈরী হচ্ছে মেশিনে। খাদী ছাড়া অন্য কটন সুতোও মেশিনে তৈরী। যে রকম সুতোই হোক না কেন, প্রাথমিক ভাবে সেটা হবে কোরা রঙের (বিস্কুট কালার)। রঙিন কাপড় চাইলে সেই সুতো প্রথমে ব্লিচ করতে হবে। তারপর তাতে রঙ ধরাতে হবে। অর্থাৎ সাদা কাপড়ের ক্ষেত্রেও যে রঙটা আমরা দেখি তা সুতোর আসল রঙ নয়। ইক্কত গোত্রের কাপড়ের ক্ষেত্রে আবার রঙ করার বিশেষ পদ্ধতি আছে। ইক্কতে যে প্যাটার্ণ তোলা হবে সেই হিসেব মত সুতোর এক একটা অংশ এক এক রকম রঙ করা হয়। রঙ করার শেষে সুতোর গুটি বানিয়ে তুলে রাখা হয় শাড়ী বোনার জন্য।

এবার তাঁত (লুম) প্রস্তুত করতে হবে কাপড় বোনার জন্য। সাধারণ ঢালা শাড়ীর ক্ষেত্রে এটা খুব বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু বালুচরী, বোমকাই, সম্বলপুরী, কাঞ্জীভরমের মত জমকালো শাড়ীর বেলায় লুম তৈরী করতেই লেগে যায় দশ-বারো দিন। একটা শাড়ী বুনতে দুইদিক থেকে সুতো আসে। একটা হরাইজন্টাল বা টানা সুতো। অন্য সুতোটা আসছে ভার্টিকালি। একে বলা হয় পোড়েনের সুতো। বোমকাই, সম্বলপুরী, জামদানী জাতীয় শাড়ীর ক্ষেত্রে জমির নকশা তোলা হয় এই পোড়েনের সুতো দিয়ে। লুম তৈরী করার অর্থ হল প্রতিটা টানার সুতোকে সমান্তরাল ভাবে সূচে ভরে দেওয়া। পাড়ের নকশায় যদি আলাদা রঙের সুতো যায় তাহলে নকশা অনুযায়ী সেই সুতোর গতিবিধি ঠিক করা। এর পর তাঁতী পোড়েনের সুতো চালিয়ে নকশা তুলবে শাড়ীতে। বালুচরী, কাঞ্জীভরম, বেনারসী গোত্রের শাড়ীর ক্ষেত্রে জাকার্ড লুমের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। সেক্ষেত্রে যে ডিজাইন বোনা হবে সেটা কার্ডে তোলা থাকে। সেই কার্ড এবং কোন অংশে কি রঙের সুতো যাবে সেই হিসেব মত লুম তৈরী করা হয়। একবার লুম তৈরী হয়ে গেলে শাড়ী বুনতে খুব বেশী সময় লাগে না। সাধারণ তাঁতের শাড়ীর ক্ষেত্রে একদিনই যথেষ্ট। কাজের সুক্ষ্মতা অনুযায়ী এক থেকে ছয়দিন লাগে শাড়ী বুনতে। যদি একই ডিজাইনের অনেকগুলো শাড়ীর অর্ডার থাকে, তাঁতী সেক্ষেত্রে একই লুমে সবকটা শাড়ী বুনে ফেলতে পারেন। লুম তৈরী করার সময়টা সেক্ষেত্রে বেঁচে গেল।

এবার আমাদের প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। নিজের হাতে সুতো তৈরী করে, কাপড় বুনে তাঁতীরা মজুরী কেমন পান? সম্পুর্ণ হাতে তৈরী একটা শিল্প যে টাকায় কিনে আমরা ঘরে তুলি সেটা কি যথেষ্ট? যদি না হয়, তাহলে কেমন করে চলছে এই বাজার? শেষের দিক থেকে শুরু করা যাক। হ্যান্ড্লুম শাড়ীর রমরমা শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকেই সীমিত অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনা নিয়ে বুটিক খুলে বসেছেন। এবং সেখানে অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে একই রকম শাড়ী এক্জন বিক্রি করছেন পাঁচ হাজার টাকায়, অন্যজনের কাছে পাওয়া যাচ্ছে তার অর্ধেক দামে। এটা কি ভাবে সম্ভব হচ্ছে? প্রথম যে কথাটা বলা যায় তাহল বেসরকারী শাড়ীর দোকানে কোন কোয়ালিটি চেক হয় না। ২০১৭ সালে, একটা আসল তসরের থানের দাম পড়ে অন্তত ৩৫০০ টাকা। কিন্তু অনেকেই এর ঢের কমে তসর বিক্রি করছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে কারন ভারতীয় তসরের সাথে এসে মিশছে কম দামী কোরিয়ান তসর। এই মিশ্রণ অনভিজ্ঞ চোখে ধরা প্রায় অসম্ভব। একটা কোরিয়ান সুতো, একটা ভারতীয় সুতো দিয়ে বোনা হচ্ছে এই মিশ্র তসর। দাম নেমে আসছে ২৩০০ তে। গত সাত-আট বছরে ঘিচা তসরও খুব জনপ্রিয় হয়েছে। ঘিচা অবশ্য নকল তসর নয়। কিন্তু বনেদী মসৃণ উজ্জ্বল তসরের চেয়ে কিছু নিরেশ। ঘিচার যে দাগ এবং অমসৃণতা এর অ্যাপিল বাড়ায় সেটাই ঘিচার তুলনামূলক কম দামের কারন।

এ তো গেল উপাদানের ভেজাল। পদ্ধতির ভেজালও আছে। অবশ্য তাকে ভেজাল বলতে আমার আপত্তি আছে। যদিও লেখার শুরুতেই বলেছিলাম হ্যান্ডলুম মানেই হাতে তৈরী, আদতে অনেক জায়গায় পাওয়ার লুম ঢুকে গেছে। পাওয়ার লুমের শাড়ীতেও হ্যান্ডলুম এফেক্ট দেওয়া সম্ভব, যদিও অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়বেই। পাওয়ার লুমের শাড়ী অনেক নিখুঁত হবে। হ্যান্ডলুমের যে ছোটখাটো ত্রুটিগুলো প্রতিটা শাড়ীকে অনন্য করে তোলে সেটা পাওয়ার লুমে অনুপস্থিত। নামেই বোঝা যাচ্ছে, পাওয়ার লুমে অনেক তাড়াতাড়ি শাড়ী তৈরী সম্ভব। একটা শাড়ী হাতে বুনতে যেখানে এক বা একাধিক দিন লেগে যায়, পাওয়ার লুমে সেখানে একদিনে অনেকগুলো শাড়ী তৈরী করে ফেলা যাচ্ছে। ফলে সেই শাড়ী কম দামে বিক্রি করাও সম্ভব হচ্ছে। পাওয়ার লুমে তৈরী শাড়ী যদি সেই ট্যাগ সহ বিক্রি হয় আমি তাতে অন্যায় দেখি না, যদিও এই প্রবন্ধ লেখায় আমি যার সাহায্য নিচ্ছি তার মতে পাওয়ার লুমের বহুল প্রচলনের ফলে হ্যান্ডলুম শিল্প একদিন মরে যাবে যেটা একটা অপূরণীয় ক্ষতি। এই যুক্তিটা অনস্বীকার্য। এগুলো যেহেতু বংশপরম্পরায় বাহিত জ্ঞান, হ্যান্ডলুমের মৃত্যুর সাথে সাথে এই জ্ঞানভান্ডারও হারিয়ে যাবে।

এর পর আসি মজুরীর প্রসঙ্গে। মজুরীর ব্যাপারে দক্ষতা অনুযায়ী ভেদাভেদ নেই। যিনি সুতো বানাচ্ছেন, যিনি রঙ করছেন, যিনি বুনছেন, প্রিন্টের ক্ষেত্রে যিনি ব্লক বসাচ্ছেন সবার এক মজুরী। দিনে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো। যে তাঁতী স্বাধীন ভাবে নিজের ঘরে থেকে কাপড় বিক্রি করছেন তিনিও এর বেশী ধরেন না। বরং অনেকসময় তাঁর মজুরী আরোই কম। বহুক্ষেত্রেই এঁদের নিজেদেরই ভালো ধারনা নেই কত মজুরী হওয়া উচিত। ফুলিয়ায় তাঁতীর ঘর থেকে যে শাড়ী চারশো টাকা বা তারও কমে পাইকারী রেটে তুলে আনা হল, তার জন্য একজন তাঁতীর কাঁচামালের খরচই অন্তত সত্তর টাকা। তাহলে মজুরী বাদ দিয়ে লাভ বলতে গেলে নেই। কিন্তু যাঁরা স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করেন তাঁরা কাঁচামালের খরচ উঠে গেলেই খুশি। নিজেদের পরিশ্রমের কতটা মূল্য তা তাঁরা নিজেই জানেন না। আরো একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। ধরা যাক তাঁতী কোন বড় ব্যবাসায়ীর থেকে অর্ডার পেলেন। তখন অর্ডারের শাড়ী হয়ে যাওয়ার পরেও যে কাঁচামাল বাঁচে তাতে তিনি আরো কয়েকটা শাড়ী বুনে ফেলতে পারেন। সেই শাড়ী তখন খুব কম দামে বিক্রি হয়ে গেলেও তাঁতীর লোকসান থাকে না।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তের ঘরে সুলভে হ্যান্ডলুম উঠলেও তাঁতীর ঘরের অবস্থা বিশেষ বদলাচ্ছে না। এবং সুলভ হ্যান্ডলুমের যোগান দিতে গিয়ে ভেজাল শিল্পও লক্ষ্যনীয় ভাবে পুষ্ট হয়ে উঠছে। দুটোই তাঁতশিল্পের জন্য খারাপ খবর। এর থেকে বেরোনোর এক্ষুনি কোন উপায় নেই যদি না তাঁত শিল্পের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো সম্ভব হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের হাতে বোনা শাড়ী আমরা যে আগ্রহ ও ভালোবাসার সাথে সংগ্রহ করি, সেই উৎসাহের কিছুটা সংশ্লিষ্ট শিল্প এবং তার ধারক-বাহকদের জানার জন্য খরচ না করলে নিজেকে শাড়ীপ্রেমিক বলে দাবী করার মানে হয় না। এটা আমাদের বুঝতে হবে প্রতিটা হাতে বোনা শাড়ীই অমূল্য। হস্তশিল্প মেলায় গিয়ে দরদাম করে কেনার জন্য এ জিনিস নয়। নিজে তাঁতীর ঘরে গিয়ে সম্মান দিয়ে একে নিয়ে আসতে হবে। এটা ঠিক, এই আশঙ্কা মনে থাকবেই যে এত দাম দিয়ে যে জিনিস কেনা হচ্ছে তা আসল কিনা। সে জন্য কোয়ালিটি চেকের ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকেই থাকতে হবে। কিন্তু কোয়ালিটি চেকের পর তার দাম দিতে গিয়ে কৃপণতা করলে সেই শিল্পের সাথে জড়িত মানুষদের প্রতি অবিচার করা হবে। আর তাতে মরে যাবে শিল্পটাই। যে তাঁতী দিনে সাড়ে তিনশো টাকা মজুরী পান, তিনি কি চাইবেন তাঁর সন্তানও এই পেশায় আসুক? হয়ত সর্বত্র পাওয়ার লুম এসে গেলে তাঁতীর মজুরী নিয়ে ভাবারই প্রয়োজন ফুরোবে। তাঁতশিল্প মিউজিয়ামে আশ্রয় নেবে। তাঁতীরা চলে যাবেন অন্য পেশায়। তেমনটা হলে খুব খুশি হব বলতে পারি না। তার চেয়ে বরং খুশি থাকতে পারি যদি আমার দিদার মত আমারও সারা জীবনে মোটে গোটা চারেক বলার মত শাড়ী থাকে। দিদার যুগে সম্ভব ছিল না, কিন্তু এযুগে তো সম্ভব আমাদের জীবনের ঐ গুটিকয় শাড়ী যাঁরা বানাবেন তাঁদের খুঁজে বার করা, তাঁদের থেকে শাড়ী তৈরীর গল্পটা জেনে নেওয়া, অমূল্য শিল্পের জন্য যতখানি বেশি সম্ভব পার্থিব মূল্য দিয়ে শাড়ীটি সংগ্রহ করা। আলমারীতে একশোটা শাড়ীর বদলে এই গুটি চার শাড়ীর গল্প জেনে তাকে আপন করে নেওয়া অনেক রোমাঞ্চকর নয় কি?

(এই লেখাটি লিখতে আমায় সাহায্য করেছেন আমার পিসতুতো ভাই ছন্দক জানা। তিনি ন্যাশনাল ইন্সটিটিঊট অফ ফ্যাশন টেকনোলজির স্নাতক ও শাড়ীশিল্পী)

Tuesday, April 4, 2017

কেন মানিয়ে চলব না

 একথা অস্বীকার করি না যে ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস মানিয়ে নিলে সংসারে বেশ শান্তি থাকে। মায়ের কথামত কপালে সিঁদুর ছোঁয়ানো, শ্বাশুড়ীর কথামত টুকটাক দুয়েকটা উপোস করা, বিয়ের পর নিজের নামের সাথে স্বামীর পদবীটা জুড়ে নেওয়া - শুধু এইটুকুতে কারোর জীবন দুর্বিষহ হয় না। একজন না, দুই দুই জন উচ্চ শিক্ষিত এবং উচ্চ পসারসম্পন্ন আইনজীবি আমায় বলেছিলেন - বিয়ের পরে অটোমেটিকালি মেয়েদের সারনেম বদলে যায়, তোমার শ্বশুরবাড়ীর পদবীই তোমার পদবী। ক্ষতি নেই মেনে নিতে। জীবন অনেক সহজ হয়। সাময়িক ভাবে। একটা মেনে নেওয়ার ল্যাজ ধরে আরো কত মেনে নেওয়া আসবে কেউ জানে না। তাই মুখের ওপর সেই আইনজীবিদের বলা প্রয়োজন ছিল, আপনারা মূর্খ। ভদ্রতাবোধ বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে অনেক কিছুই করব বলেও করা হয় না। এটাও পারি নি। তবে এটুকু জানিয়ে এসেছিলাম যে আইনটা এমন নয়। বিয়ের পর পদবী পরিবর্তন আবশ্যিক নয়। যতই না কেন আপনার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী, মায় আইনজীবিও আপনাকে একথা বোঝানোর চেষ্টা করুক। হ্যাঁ, জন্মের পর নামের সাথে যে পদবী আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষের সাথে জুড়ে আছে তা বাবার পদবী। পিতৃতন্ত্রের সাথে যুদ্ধ করতে চাইলে সে পদবীও ঝেড়ে ফেলার দরকার আছে। আমার বেশ কিছু বন্ধু তাদের সন্তানের পদবী হিসেবে বাবা-মা দুজনের পদবীই দিয়েছে। এদের নাতি-নাতনীর পদবি কতখানি লম্বা হবে সেই ভেবে মাঝে মাঝে চিন্তা হয়, কিন্তু তাও এই উদ্যোগ প্রশংসাযোগ্য। পদবীহীন হতে পারলে বা পদবী হিসেবে জাত-গোত্রর পরিচায়ক নয় এমন কিছু ব্যবহার করতে পারলে সব চেয়ে ভালো হয়। তবে জানি না ভারতে সেটা করা কতটা সহজ।

কেন হঠাৎ করে মাথায় পদবীর ভূত চাপল বলি? আজ সকালে এক বন্ধুর ফেসবুক পোস্টে জানতে পারলাম তার এক আত্মীয়া স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে চলে এসেছেন ছোট মেয়েকে নিয়ে। নতুন স্কুলে ভর্তি করাতে হবে মেয়েকে। এদিকে পুরোনো স্কুল মায়ের হাতে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেবে না। আইন, খুব নিশ্চিতভাবেই জানি, সন্তানের ওপর মায়ের পূর্ণ অভিভাবকত্ব স্বীকার করে এবং স্কুলের সেক্ষেত্রে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট না দেওয়ার কোন কারন নেই। কিন্তু আমাদের দেশের আইনজীবিরাও কতটুকু আইন জানেন বিয়ের পর পদবী পরিবর্তন সম্পর্কে দুই সফল আইনজীবির মন্তব্য থেকেই কিছুটা ধারনা করা যায়। সমস্যা তো আইনে নয়, সমস্যা মানসিকতায়। বিয়ে হলেই একটা মেয়ে শ্বশুরবাড়ীর সম্পত্তি হয়ে যাবে এই ধারনা এখনও প্রবলভাবে বিদ্যমান। অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভর নাকি নড়বড়ে তা দিয়ে অবস্থার খুব একটা তফাত হতে দেখি না। বিয়ের পর একটি মেয়ে তার শ্বশুরবাড়ীর লোকের সাথে যতখানি সময় কাটায়, একটি ছেলে তার শ্বশুরবাড়ীকে ততখানি সময় দেবে এটা এমনকি প্রগতিশীল মানুষেরাও আশা করেন না। নাস্তিকতা-আস্তিকতার তর্কে যাচ্ছি না। ধর্মাচারন ঘরের মধ্যে করতে চাইলে করুন। কিন্তু পুজো দেওয়ার সময় কার গোত্রটা পড়া হয় সেটা জানেন তো? যে লোকাচারগুলো আনন্দের সাথে পালন করেন, সেগুলো রোল রিভার্সাল করে পালন করার চেষ্টা করেছেন কখনও? হ্যাঁ, এগুলো খুব তুচ্ছ জিনিস। এগুলো মানলেই কেউ মধ্যযুগীয় মানসিকতার হয়ে যায় না। সবচেয়ে বড়কথা এগুলো মানলে সংসারে শান্তি থাকে। কিন্তু একবার যদি সেই শান্তিময় সংসার টাল খায়, তাহলে এই সব কিছু ফাঁস হয়ে বসে গলায়। স্কুল একজন মাকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিতে অস্বীকার করার সাহস পায়, কারন আরো হাজারজন মা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে সংসারের শান্তিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ একজন মানুষ মানুষের অধিকারে এ পৃথিবীতে বাস করবে এর জন্য এত জটিলতার দরকার ছিল না।

Friday, March 10, 2017

সন্তানহীনতার অধিকার ও লিঙ্গবৈষম্য

 প্রতিবার আটই মার্চ আসে, ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমেল নানা শুভেচ্ছায় ভরে ওঠে, আর আমি ভাবতে বসি এই শুভেচ্ছাগুলোর কতটুকু আমার প্রয়োজন আছে। ছাত্রাব্স্থায় মেয়ে হিসেবে কখনও অপদস্থ হতে হয় নি, কর্মজীবনে মেয়ে হওয়ার জন্য অকর্মণ্য তকমা লাগেনি, যাকে বিয়ে করেছি সে তুমুল কনজার্ভেটিভ পরিবেশে বড় হয়েও কোনদিন আমায় হতাশ করেনি, বিবাহসূত্রে যে পরিবারের সাথে জড়িয়েছি তাঁরাও নিজেদের সমস্ত সংস্কারের সাথে যুদ্ধ করে উদারতার পরীক্ষায় সসম্মানে পাশ করেছেন। নারীদিবসে যেসব বঞ্চনার গল্প সামনে আসে তার সিংহভাগই জীবনের এই অধ্যায়গুলোর সাথে জড়িত। আমি জানি এই বঞ্চনাগুলো এখনও প্রতিনিয়ত হয়, যাদের সাথে হয় তাদের আমি চিনি, কিন্তু এই গল্পগুলো আমার গল্প নয়। তা বলে এমনও নয় যে মেয়ে হওয়ার জন্য কোন স্যোসাল প্রেশার আমার ওপর নেই। অনেকসময় ভেবেছি এই কথা লিখব না, ভয় হয়েছে অন্য কারোর সংবেদনশীলতায় হয়ত আঘাত করে ফেলব। তবু আজ লিখেই ফেলি।

একটা বয়েসের পরে কর্মক্ষেত্রই হোক বা অন্য কোন সামাজিক ক্ষেত্র, দুজন মহিলার আলাপ শুরু হয় তাদের বাচ্চাদের নিয়ে। ছেলেদের ক্ষেত্রে এটা একেবারেই হয়না এমন নয়, তবে সন্তানপালন এখনও দেশ-জাতি নির্বিশেষে যেহেতু মূলত মেয়েদের দায়িত্ব এবং মা না হওয়াকে অনেকে নারীত্বের অপচয় মনে করেন, তাই মেয়েদের আলোচনায় এই প্রসঙ্গ আসে অনেক বেশি। সেজন্যই বোধহয় আমাদের সন্তানহীনতার জন্য মিঠুনকে তেমন কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না, অথচ আমার জন্য থাকে অনেক প্রশ্ন। সন্তানহীনতার সিদ্ধান্ত আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত। আমাদের দুজনের সামনে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে (যেটা আমাদের বাড়ী থেকে করা হয়েছে) আমরা দুজনেই তার উত্তর দিয়ে থাকি। কিন্তু যেখানে প্রশ্নের মুখোমুখি একা আমি সেখানে তো আমার জীবনসঙ্গীটির কিছু করার থাকে না। আর এই জায়গাটায় এসে আমাদের সচেতন প্রতিরোধ সত্ত্বেও লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

অনেকেই প্রশ্ন করেন কেন সন্তান চাই না। আমরা বর্তমান পৃথিবীকে একটা শিশুর জন্য যথেষ্ট সুস্থ ও নিরাপদ মনে করি না। তাই আমরা সন্তান চাই না। আমরা যখন জন্মেছিলাম তখনও পৃথিবী সুস্থ ছিল না, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তে আমাদের কোন হাত ছিল না। যেটা আমাদের হাতে আছে আমরা বড়জোর সেটুকু করতে পারি। আমরা না জন্মালেও পৃথিবীর কোন ক্ষতি ছিল না। পৃথিবী তার মত চলত, অথবা চলত না। আরো অজস্র পৃথিবীর মত গ্রহ আছে ব্রহ্মাণ্ডে যাতে প্রাণ নেই। তারাও সুন্দর। অবশ্য চেতনা না থাকলে আর সুন্দরই বা কি! এসব দার্শনিক কথা থাক। নিতান্ত বস্তুতান্ত্রিক ভাবনাতেও দেখতে পাই মানুষজন্ম কেমন একটা অনর্থক ব্যাপার। এত বেশী মানুষ হয়ে গেছে পৃথিবীতে, না আছে পর্যাপ্ত খাবার, না আছে পর্যাপ্ত জমানো সম্পদ। সোজা কথা সোজা ভাবেই বলি। ছোট থেকেই শিখেছি খুব ভালো রেজাল্ট করতে হবে, ভালো চাকরী করতে হবে, তারপর একটা ভালো বিয়ে, সন্তান এবং তাদের প্রতিপালন। এই জিনিসগুলোর একটাও এমন লোভনীয় নয় যে তার জন্য জীবনভোর প্রাণপাত পরিশ্রম করা যায়। যারা পারেন তারা করেন। আমরা আরো একটা মানুষকে তার মতামত ছাড়াই নিয়ে এসে এই বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। আর মতামত নেওয়ার তো কোন উপায়ই নেই। একটি শিশুকে জন্ম দিয়ে তাকে তো আর সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করা সম্ভব নয়, তুমি কিভাবে বড় হতে চাও জানাও। নিজেদের মত তার ওপর চাপাতেই হবে, এমনকি তার মধ্যে এমন কিছু মতও থাকবে যা নিজেদেরই নীতিবিরুদ্ধ। যেমন ধরা যাক, বন্ধুস্থানীয় ভারতীয় বাবা-মায়েরা যেভাবে গেটেড কমিউনিটিতে বাসা বেঁধে গেটেড স্কুলে পড়শোনা করিয়ে যতখানি সম্ভব নোংরা পৃথিবীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে বাচ্চা মানুষ করেন, সেটা আমাদের একান্তই অপছন্দ। একটু সমালোচনাই করলাম। তবে এটাও জানি, নিজেদের বাচ্চা থাকলে আমরাও এই পথই নিতাম। আরেকটি মানুষের জীবন নিয়ে বাজি লড়ার সাহস আমাদেরও হত না। আমরা জানি, আপনারা নিরুপায়।

আমাদের প্রশ্ন হল, এমন হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেও কিসের প্রেরণায় মানুষ সন্তানের জন্ম দেয়? হ্যাঁ, এতদিন পর আমাদেরও উল্টে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। মেয়েদের মা হওয়া, বা না হতে পারলে আক্ষেপ করা এমনই স্বাভাবিক বিষয় যে সন্তানহীনতার জন্য আমিই সব সময় সবার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে এসেছি। এই সামাজিক নির্মাণ এতটাই গভীর যে আমি কখনও কাউকে প্রশ্ন করি নি, কেন সন্তান জন্ম দিতেই হবে? আপনি কেন দিয়েছেন? এই প্রশ্নটা একা আমার নয়, আমাদের দুজনেরই। কিন্তু যেহেতু স্যোসাল প্রেশারটা মূলত আমার ওপরে পড়ছে, তাই আমিই লিখলাম। আরো একটা কারণ হল, আমি চাই আমার স্কুলের বন্ধুরাও নির্দ্বিধায় এই আলোচনায় অংশ নিক। মিঠুন লিখলে হয়ত সেটা হত না। আমার মা, বন্ধুরা অনেকেই জিনের কথা বলে। আমরা জীবনে যা কিছু বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করেছি তা নাকি আমাদের জিনের মাধ্যমে বাহিত হবে, পৃথিবীর কাছে আমাদের ঋণ শোধ হবে এই উপায়ে। জানতে ইচ্ছে করে, যারা সন্তানের জন্ম দেয় তারা সকলেই কি এটা ভাবে? মেয়েদের এখন অপেক্ষাকৃত বেশি বয়েসে বিয়ে হয়। সে কারনেই কিনা জানি না, অনেকেরই মা হতে সমস্যা হয় শুনেছি। কাজের জায়গায় স্ট্রেসের জন্য প্রেগন্যান্সি আসতে দেরী হচ্ছে এটাও খুবই শুনি। নানা দিকে এখন ফার্টিলিটি ক্লিনিকের খুবই রমরমা। অনেক অনেক টাকা খরচ করে সেখানে চিকিৎসা হয় যাতে নিজেদের জিনের ধারাকে বইয়ে দেওয়া যায়। এখানে এসে আমরা হোঁচট খাই। আমরা তো এখনও নিজেদের কাছে এতখানি প্রিয় হয়ে উঠতে পারিনি যে নিজের জিনের অংশ যে কোন মূল্যে পৃথিবীতে না ছড়াতে পারলে চলবেই না। জানি, এ লক্ষ বছরের ইনস্টিঙ্কট। এই প্রবৃত্তি যদি না থাকত তাহলে বিবর্তন হত না, প্রাণ বিলুপ্ত হয়ে যেত। হয়ত মানুষও একদিন বিলুপ্ত হবে এই পথেই। সেজন্যই কি সন্তানহীনতার ওপর এই স্যোসাল প্রেশার? কিছুতেই যাতে আমরা হারিয়ে না যাই? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোলান্ডে, আজ সিরিয়ায় এইজন্যই কি অগণিত শিশুর জন্ম দিতে বুক কাঁপে না, যে একটা-দুটোও যদি বেঁচে থাকে তারা ছড়িয়ে দেবে তাদের পিতৃপুরুষের জিন? কিন্তু সন্তানের জীবনের মূল্যে নিজের জিনের বিস্তার সুরক্ষিত করা কি একরকম স্বার্থপর ভাবনা নয়? আমরা তো দেখতে পাই, পৃথিবীতে কিভাবে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। যুদ্ধ বাধার সম্ভবনা খুব বেশী। যুদ্ধ না বাধলেও সময় বিক্ষুব্ধ, জীবন নিরাপদ নয়। এই পরিস্থিতিতে আরো নতুন নতুন শিশুরা যখন পৃথিবীতে আসে, তারা তো আসে আমাদের আনন্দের ভান্ডার হয়ে, তাদের ঝলমলে তারুণ্যে আমাদের বার্ধক্য বিলম্বিত হয়, কিন্তু তার বদলে আমরা তাদের কি দিতে পারি? নাকি, সন্তানজন্মের জৈবিক তাড়না এমনই যে এ চিন্তা মানুষের মনেই আসে না? যাঁরা জন্ম দেন তাঁদের আনন্দ হয় বুঝতে পারি, কিন্তু যে জন্মাল তার এতে কি উপকার হয়? সন্তানের দিক থেকে ভাবলে তার জন্মের সিদ্ধান্তটা কি আদৌ কোন র‌্যাশনাল সিদ্ধান্ত? নাকি জন্ম দেওয়ার পরে নিজের কাছেও একথা স্বীকার করা কঠিন হয়ে পড়ে যে এ সিদ্ধান্ত আসলে র‌্যাশনাল ছিল না?

এই নিয়ে মতামত জানতে আগ্রহী। কয়েকজনকে ট্যাগ করছি যাদের সাথে এ নিয়ে আমাদের আগে আলোচনা হয়েছে। আরো কয়েকজনকে করছি যাদের সাথে সামনাসামনি আলোচনা হয়ত হয়নি, কিন্তু নানা জায়গায় তাঁদের বক্তব্য পড়ে মনে হয়েছে এ বিষয়ে তাঁদের মতামত থাকতে পারে। এঁদের লিখতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আবার যাঁদের ট্যাগ করলাম না, তাঁদেরও লিখতে কোন বাধা নেই। যার যার ইচ্ছে হবে হাত খুলে লিখুন।

Monday, February 27, 2017

রবিবার ও ডারউইন

 অনেকদিন ধরেই রংকে বলছিলাম সানডে মাসে নিয়ে যাওয়ার কথা। রং আমার চাইনিজ বন্ধু। আমেরিকায় পড়তে আসা বহু চাইনিজ ছেলেমেয়েই প্রতি রবিবার নিয়ম করে চার্চে যায়। প্রথম দিকে ছেলেমেয়েগুলো বিদেশে এসে আরো পাঁচটা নিজের দেশের লোকের সাথে আলাপ করার জন্য চার্চে যেতে শুরু করে। সপ্তাহে একদিন ফ্রি লাঞ্চও পাওয়া যায়। তারপর আস্তে আস্তে ধর্ম ছাড়া বড় হয়ে ওঠা মানুষগুলোর মনে ধর্ম বাসা বাঁধতে থাকে। তারা তাদের বন্ধুদের, আরো নতুন ছেলেমেয়েদের টানতে থাকে নিজের দলে। কমিউনিটি বাড়তে থাকে। কিসের টানে মধ্যকুড়ির ঝকঝকে ছাত্ররা হঠাৎ করে ধার্মিক হয়ে ওঠে সেটা সামনে থেকে দেখার ইচ্ছে ছিল। তাই সানডে মাসে যেতে চাইলাম। রং যায় একটা চাইনিজ চার্চে। সেখানে তো ভাষা বুঝব না, তাই ও নিজেই বলল আমেরিকান চার্চে যাওয়ার কথা। এই চার্চটি আমার বাড়ি থেকে সাত-আট মিনিটের হাঁটা পথ। প্রতি রবিবার এখানে তিনটে ওয়ারশিপ হয়। সকাল সাড়ে আটটায় ট্র্যাডিশনাল ওয়ারশিপ। ন'টা পঁয়তাল্লিশ এবং এগারোটার কনটেম্পোরারী ওয়ারশিপ। রবিবার দিন সাড়ে আটটায় ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব এগারোটার মাসে যাওয়া হবে ঠিক হল। এই চার্চটা বলতে গেলে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মধ্যেই। এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছে দেখলাম বেশ অনেক লোক এসেছে। এদের মধ্যে অনেকেই স্টুডেন্ট। জানি না আমাদের দেশের মন্দিরে যাওয়ার মত চার্চে যেতে হলেও সকালে চান করে নিতে হয় কিনা। আমার তো ঘুম ভেঙেছে সোয়া দশটায়। চানের প্রশ্নই নেই। আমি আর রং ভেতরে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। ঠিক এগারোটায় দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্যাস্টর সবাইকে গুড মর্নিং জানিয়ে প্রথমেই বললেন সবাই তার পাশের জনকে গ্রিট কর। আমাদের বেঞ্চে আরেকজন স্টুডেন্ট ছিল। পেছনের বেঞ্চে এক বয়স্ক দম্পতি। তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হলে চার্চের মিউজিক ব্যান্ড গান শুরু করল। সামনেই একটা বড় স্ক্রীনে গানের কথাগুলো ভেসে উঠছে। আমি আগে কখনও মাস অ্যাটেন্ড করি নি। সবকিছুই আমার কাছে নতুন। "দিস ইজ অ্যামেজিং গ্রেস" গাওয়া হচ্ছিল। সঙ্গীত ভালো বুঝি না, কাজেই সে নিয়ে কোন বেফাঁস মন্তব্য করব না। তবে গানটা একেবারেই গুরুগম্ভীর নয়। সুর খুব ক্যাচি। যারা গাইছিল তাদের গলাও খাসা। কথাগুলো ভক্তিমূলক, তবে ঘি চপচপে নয়। খ্রীষ্টধর্মর একটা বড় অ্যাডভান্টেজ হল যিশুকে ভালোবাসা খুব সহজ। যে মানুষটা কিছু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের হাতে খুন হল, তাকে ভালোবাসতে গেলে নিজেকে জাস্টিফাই করতে হয়না। এটা আলাদা প্রসঙ্গ যে সেই মানুষটা নতুন কোন ধর্মপ্রচার করতে চায় নি। তার শহীদত্ব ভাঙিয়ে দলের লোকেরা আরেকটা অচলায়তন খাড়া করেছে। "This is amazing grace/ This is unfailing love/ That You would take my place/ That You would bear my cross/ You lay down Your life/ That I would be set free/ Oh, Jesus, I sing for/ All that You've done for me" এই কথাগুলোকে নিছক কৃতজ্ঞতা হিসেবেও দেখা সম্ভব। একজন ধর্ম উদাসীনের মনে এই লাইনগুলো কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী করে না। গান শেষ হওয়ার পর প্যাস্টর মঞ্চে উঠলেন। কোন জোব্বা-টোব্বা নয়, দিব্যি প্যান্ট-শার্ট পরা মানুষ। একজন সাধারণ প্রফেসরের মত চেহারা। জিগ্যেস করলেন, এখানে কে কে সাউথের নয়, এমন কেউ আছে কিনা যার ইংরিজি মাতৃভাষা নয়। সাদার্ন অ্যাকসেন্ট নিয়ে একটু রঙ্গ রসিকতা চলল। ইতিমধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করে বেশ ভালো লাগল। প্যাস্টর যা যা বলছেন, মঞ্চের ডানদিকে দাঁড়ানো একজন মহিলা তার অনুবাদ করে চলেছেন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে। মূক-বধির কেউ ছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তাদের খেয়াল রাখার এই প্রচেষ্টাটা পছন্দ হল। জেনেসিস ৩ঃ৮ "দ্য রুইনড সোল" পড়া হল। প্যাস্টর পড়লেন এবং ব্যাখ্যা করলেন। ভদ্রলোক খুব ভালো বক্তা। তাই প্রতিটি কথাই শুনলাম। ওনার বক্তব্য একেবারেই মনঃপুত হল না। কিন্তু মানুষ কেন চার্চে যায় তার একটা মোটামুটি উত্তর পেয়ে গেলাম। প্রতি রবিবার সকালে যদি ফ্রিতে গান শুনতে পাওয়া যায় আর সেই সাথে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথেও দেখা হয়ে যায় তাহলে মন্দ কি! ইদানীং আমাদের দেশে কিছু ধর্মগুরুর নাম শোনা যায় যাঁরা সহজ ভাষায় ভক্তদের উপদেশ দিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে শ্রী শ্রী রবিশংকর আর সদগুরুর আলোচনা ইউটিউবে শুনেছি। চার্চের প্যাস্টর ভদ্রলোকও এদের মতই। জেনেসিস ৩ঃ৮-এ আপেল খাওয়ার পর আদমের সাথে ঈশ্বরের প্রথম সাক্ষাতের গল্প আছে। ঈশ্বর যে কাজটা করতে বারন করেছিলেন ঠিক সেটা করেই আদম কত ভুল করেছিলেন এবং আমরাও প্রতিনিয়ত কিভাবে ঈশ্বরের অপছন্দের কাজ করে চলেছি সেই কথা বললেন প্যাস্টর। প্রত্যেকটা মানুষ পাপী এবং পাপ থেকে উদ্ধার পেতে যিশুর শরণ নিতে হবে এই ছিল মোদ্দা কথা। তবু এই গতানুগতিকতার মধ্যেও একটা কথা ছিল যেটা উল্লেখ করতেই হবে। প্যাস্টর বললেন প্রতি রবিবার চার্চে এসেই কেউ পাপমুক্ত হবে না, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, ভালো কাজ করতে হবে এইসব। সদগুরুরাও এই ধরনের কথা বলে থাকেন। ইতিমধ্যে রংকে জিগ্যেস করেছিলাম ও ইভোলিউশনে বিশ্বাস করে কিনা। ও বলল, ডারউইনের থিয়োরীটাই তো প্রমাণ করে যে ঈশ্বর আছেন। আমি থতমত খেয়ে বললাম, কি রকম? সাতদিনের গল্পটা তাহলে ঠিক না ভুল? ও বলল, ডারউইন ঠিক, সাতদিনে পৃথিবী তৈরী হয়নি। কিন্তু এই যে এতদিনের বিবর্তনে মানুষ তৈরী হল সেটা প্ল্যান করল কে? প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হল কিভাবে? ইউনিভার্স কোথা থেকে এল? উত্তর আছে তোমার কাছে? আমি বললাম, এখনও নেই, কিন্তু উত্তর পাওয়া যাবে একদিন। কতকিছুরই তো কারণ জানা ছিল না এতদিন, ব্যাখ্যা মিলছে তো ধীরে ধীরে। ও সদ্য কনভার্ট, তাই আমার কথাটা নিয়ে আপাতত একটু চিন্তা করছে। ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে সন্দিগ্ধ হলেও ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো যে নিজেদের বিবর্তনে বিশ্বাসী এটা বেশ টের পাচ্ছি।