আমরা ছোটবেলায় যখন প্রায় প্রতি বছরই শিমূলতলা যেতাম তখন আমাদের বাড়ি দুধ দিয়ে যেত লক্ষণ নামে একটি লোক। এই প্রতি বছর যাওয়ার কথাটা বললেই লোকে জিজ্ঞাসা করে কেন যেতাম, ওখানে আমাদের কেউ ছিল কিনা। তাই সেই উত্তরটা আগে দিয়ে নিই। শিমূলতলায় আমাদের কেউ ছিল না কোনকালে। আমার জন্মের আগে, সম্ভবত সাতাত্তরে আমার বাবা-মা মধুপুর বেড়াতে গেছিল। মধুপুর থেকে ওরা একদিন ট্রেন ধরে আশেপাশে কি আছে দেখতে বেরোয় এবং শিমূলতলা এসে পৌঁছয়। শুনেছি শিমূলতলা স্টেশনের ওভারব্রিজে উঠে চারদিকে ঢেউখেলানো ছোট ছোট পাহাড় দেখে জায়গাটা ভারী মনে ধরে আমার বাবা-মার। পরের দিনই মধুপুরের পাট চুকিয়ে শিমূলতলা এসে পৌঁছয়। এবং তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরে অন্তত একবার শিমূলতলা আসা চলতে থাকে। ছোটনাগপুরের এই অঞ্চলে আগেকার দিনে বাঙালী বাবুরা হাওয়া বদলাতে আসতেন। অনেক বাঙালী বাড়ি আছে এখানে। সারাবছর খালি পড়ে থাকে। মালী (কেয়ারটেকার) দেখাশোনা করে। পুজোর সময় বাঙালীর বেড়াতে যাওয়ার হিড়িক ওঠে। সেই সময়টাতে এইসব বাড়িগুলোতে টুরিস্টের ভিড় হয়। অনেকে কলকাতা থেকেই বুক করে নেয়, অনেকে এখানে এসে মালীর থেকে ভাড়া নেয়। আমরা প্রতিবছরেই যাওয়ার কারনে শিমূলতলার প্রায় সব বাড়িতেই থাকা হয়ে গেছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তবে যে বাড়িতেই থাকা হোক না কেন, লক্ষণ যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন দুধ নেওয়া হত তার কাছ থেকেই। বাবার কাছে শুনেছি, লক্ষণের নাকি বিশ্বাস ছিল দুধে জল মেশালে গরু মরে যাবে। আমার আবছা মনে আছে, ছোটবেলায় আমি লক্ষণের বাড়িতেও গেছি। বুড়ো মত একটা লোক। মাটির বাড়ি। বাবার সাথে কথা বলছিল। এর বেশি কিছু মনে পড়ে না। লক্ষণের ছেলেরা অবশ্য গরু মরে যাওয়ার তত্ত্বে বিশ্বাস করত না। লক্ষণ মারা যাওয়ার পর তাই আমরা যখন যার থেকে সুবিধে দুধ নিয়েছি। জলের পরিমান বিপজ্জনক মাত্রায় বেশি হয়ে গেলে দুধওলা বদলানো হয়েছে। এইভাবেই চলেছে। তবে লক্ষণের জীবদ্দশার আগে ও পরে যেটুকু তফাত তা কিন্তু শুধু দুধে জলের পরিমানেই। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে লক্ষণের ছেলেরা ঠাকুরদেবতায় বিশ্বাস করে না বা কোন কুসংস্কার মানে না। আমি শেষ শিমূলতলা গেছি কুড়ি বছর আগে। বাবা-মা এখনও যান। খুব নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি পুজোপার্বণের চর্চা আগের থেকে বেড়েছে বই কমেনি। দুধে জলের পরিমানও আগের তুলনায় বেড়েই থাকবে। ঈশ্বর যেহেতু পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল, তাই পাপ করে ঈশ্বরের কাছে ষোড়শপচারে মার্জনা চাইলে সেই পাপের থেকে মুক্তি মিলবে এই বিশ্বাসই মূলত অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসীর মূলধন।
আমার খুব চেনা মানুষ আছেন যাঁদের বাড়িতে জাঁকজমক করে পুজো হয়, অথচ সেই আশীর দশকের হিন্দী সিনেমায় ভিলেনদের যেমন দেখা যেত ছলে-বলে-কৌশলে দুর্বল আত্মীয়ের সম্পত্তি গ্রাস করতে তেমন ক্রাইম তাঁরা অবলীলায় করে থাকেন। কৃতজ্ঞতাবশত বচ্ছরকার দিনে দেবীর গায়ে নতুন সোনার গয়নাও নিশ্চয়ই ওঠে। আমার মা প্রবল ধর্মবিশ্বাসী। তাকে যদি বলি - "তুমি আমায় এদের মত ভক্ত হতে বল?", সে আমায় বলবে - "তা কেন, তুমি ভালো হও"। এই ভালো হওয়ার সাথে ভক্তির সম্পর্কটা কোথায় সেটা তো এতদিনেও খুঁজে পেলাম না। লক্ষণের ছেলেদের ভক্তি তাদের বাপের চেয়ে কিছু কম ছিল না। তবু তারা দুধে জল মেশাতে ভয় পেল না কেন?
আমি যুক্তিবাদী মানুষ। মানুষের যে কোন আচরণের পিছনে কার্যকারনসম্পর্ক খুঁজে বেড়াই। লক্ষণকে আমি বুঝতে পারি। সে তার দেবতায় বিশ্বাস করত। সে ভাবত দেবতা তার ওপর সবসময় নজর রাখছে, যদি কোন পাপ সে করে দেবতার শাস্তি এড়ানোর ক্ষমতা তার নেই। বস্তুত কোন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন তাহলে ব্যাপারটা এমনই হওয়া উচিত। এই সর্বশক্তিমানে আমি বিশ্বাস করব কিনা সেটা পরের কথা। আমি বুঝি না লক্ষণের ছেলেদের। তারাও একই দেবতায় বিশ্বাস করে। কিন্তু তারা ভাবে যদি কোন পাপ করেও ফেলি, ভালো করে পুজো দিলে সে পাপ কেটে যাবে। অর্থাৎ তাদের সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে ঘুষ দিয়ে বশ করা যায়। এমন ঈশ্বরের সাথে মদন মিত্রের তফাত কি? আর আজ তো আমরা জানি মদন মিত্রও সর্বশক্তিমান নন। এমন দেবতায় বিশ্বাস রাখা একেবারেই ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট।
এটা ঠিক যে সকলেই দুধে জল মেশাচ্ছে না বা আত্মীয়ের সম্পত্তি গাপ করছে না। বস্তুত বেশির ভাগ মানুষেরই তো চাওয়াটুকু খুব সামান্য - ছেলেমেয়ে যেন ভালো থাকে, ঘরের মানুষটা যেন ভালো থাকে - এর বেশি আর কি চাওয়া! এই চাওয়াটুকু মেটানোর জন্য নিশ্চয়ই ঈশ্বরকে মদন মিত্র হতে হবে না। কিন্তু আবারও যদি যুক্তি দিয়ে ভাবার চেষ্টা করি - বেছে বেছে শুধু আমার ঘরের মানুষগুলোই কেন ঈশ্বরের কৃপা পাবে? সর্বশক্তিমান যে ঈশ্বর আমার পুজ্য, তিনি নিশ্চয়ই সমদর্শী। নইলে আর তাঁর মহত্ব কিসের! সমদর্শী ঈশ্বর আমার সন্তান আর ফুটপাথে বড় হওয়া বাচ্চাটার তফাত করবেন কি কারণে? সব প্রাণীর তত্বাবধান যিনি করেন, তাঁকে আলাদা করে নিজের কথা মনে করিয়েই বা দিতে হবে কেন? ভালো কাজ করে গেলে নিশ্চয়ই সে হিসেব পৌঁছে যাবে তাঁর কাছে একদিন। "আমার কথাটা মনে রাখবেন স্যার" মদন মিত্রকে বলা যায়, তা বলে সর্বশক্তিমানকেও?
No comments:
Post a Comment