About Me

I am like a pebble lying beside the road for ages. I observe and think. Sometimes I want things to be changed. But I am not an active person at all. So I just lie down and watch the play taking place around me. Somehow I enjoy the solitude I live in. I am happy with the package I came with. This beautiful earth, sunshine and rain…

Monday, September 20, 2021

মধুবাতা ঋতয়তে

 আমি ছোটবেলায় দিদার বাড়ি থাকতে খুব ভালোবাসতাম। যে সময়কার কথা আমার স্মৃতিতে ধরা নেই, সেই সময়ে আমায় জোর করে বাড়ি নিয়ে আসলে খানিক পরে ফেরত দিয়ে যেতে হত। দিদার হাতে আমায় দিয়ে বাবা করুণ মুখে বলত - খুব কাঁদছে। দিদার বাড়ির দিনগুলো আরোই স্বর্গপুরীর মত হয়ে উঠত যখন মাঝে মাঝে একজন লম্বা একহারা চেহারার সাদা শাড়ি পরা মহিলা কিছুদিনের জন্য এসে থাকতেন। ইনি আমার মায়ের পিসিমনি। আমার পিসিদিদু। মায়ের বাবাকে আমি কচ বলে ডাকতাম। পিসিদিদু আমায় ডাকতেন কচদিদু। পিসিদিদুর কোলের কাছটা কেমন পুরনো বাড়ির লাল মেঝের মত ঠান্ডা ছিল। আমি অবাক হয়ে দেখতাম এমব্রয়ডারী ফ্রেমের ভিতর কেমন নানা রঙের সুতোয় ফুল পাতার নকশা তুলছে পিসিদিদু। এই জিনিসটা আমার কাছে এক মুগ্ধতার বস্তু ছিল। মা, দিদা কেউই সেলাই করত না। ঠাকুমা খুব ভালো আসন বুনতো, কিন্তু কাঠের ফ্রেমে কাপড় আটকে অভিজাত ফোঁড় তুলতে আমি পিসিদিদু ছাড়া আর কাউকে তখনও দেখিনি।


আমার যবে থেকে মনে আছে তার আগেই পিসিদিদুর জীবন রংহীন হয়ে গেছে। খুবই নিষ্ঠার সাথে সমস্ত আচার পালন করতেন। দূর থেকে গল্প শুনলে হয়ত কৃচ্ছসাধন মনে হবে, কিন্তু তিনি এমনই আনন্দের প্রতিমূর্তি হয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে আচার পালন করতেন যে তাঁকে করুণা করার স্পর্ধা কারোর হবে না। আমি বিশেষ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ি যখন জানতে পারি আমার বাবা-মায়ের অসবর্ণ বিবাহ পরিবারের মধ্যে অল্প যে কয়জন সাদরে মেনে নিয়েছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন পিসিদিদু। যিনি নিজে অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ ছিলেন তাঁর এই উদারতা আমায় অভিভূত করে। বুঝতে পারি, তাঁর আচারনিষ্ঠা গোঁড়ামী ছিল না। এই আচরণ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরেও বিরল মনে হয়। জাতিভেদ সংক্রান্ত নিয়মকানুন হয়ত সময়ের সাথে শিথিল হয়েছে। কিন্তু আমরা এখনও হামেশাই দেখতে পাই প্রথিতযশা অধ্যাপক, বিজ্ঞানীরাও নিজেরা যে মতটিতে বিশ্বাসী তার বাইরে কিছু দেখতে চান না। পিসিদিদু নিজে আচারনিষ্ঠ হয়েও নিয়মের শিকল যেখানে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে মেরে ফেলছে সেখানে শুকনো নিয়মকানুনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।

মিঠুনকে বিয়ে করার সময় আমার মা-বাবা উভয় পক্ষের দাদু-দিদাই গত হয়েছেন। আমাদের অশেষ ভাগ্য পিসিদিদু, তাঁর পরের ভাই ছোট দাদু এবং ছোট দিদা আমাদের আশীর্বাদ করে গেছেন। ছোট দাদু এক বর্ণময় চরিত্র। আমার মনে হত উনি সব সময় ছোটেন, তাই ওনার নাম ছোটদাদু। তাঁকে নিয়ে লিখতে হবে পরে কখনও। আমাদের বিয়ের পর দিল্লিতে একটি কাজে গিয়ে পিসিদিদুর সাথে দেখা করেছিলাম। রূপোর কয়েন দিয়ে নাতজামাইয়ের মুখ দেখলেন। শীর্ণ শরীর তখন শীর্ণতর ও জীর্ণ হয়েছে। প্রাণখোলা হাসিটি অটুট ছিল। তখন এবং আজও ভেবে অবাক হই - শোক তাঁর আত্মাকে তিক্ত করতে পারেনি। কখনও কোনও অভিযোগ করেছেন বলে শুনিনি মায়ের কাছে। আমাকে তো শুধু আদরই দিয়েছেন। সেবারে পিসিদিদুর ছেলে পাপ্পুমামাকেও দেখেছিলাম। তাঁর সাথে অল্প আলাপেই বোঝা যায় মানুষটি মোটেই সংসারী নন। আমরা ফিরে আসার আগে তিনি মিঠুনকে একটি টাই উপহার দিলেন। সংসার উদাসীন একজন মানুষ নিজে নিজে ভেবে এই কাজটি করলেন এটা আমার মনে থেকে গেছে। পরে আরও একবার দিল্লি যাই এবং একা যাচ্ছি জেনে পিসিদিদু জোর করেন তাঁর কাছে থাকতে। সেটাই শেষ দেখা ছিল। সেদিন ওনার জ্বর এসেছিল। নিষ্ঠাবতী পিসিদিদু পাপ্পুমামাকে রান্নাঘরের গ্যাসে রান্না করে দিতেন। নিজের খাবার বানাতেন ঘরের মধ্যে স্টোভে। আমি গিয়ে দেখলাম পাপ্পুমামা দুধ জ্বাল দিয়েছেন। স্টোভে পাঁউরুটি সেঁকার চেষ্টা করছেন। আমি বললাম - তুমি যাও, আমি করি। ভালোমানুষ পাপ্পুমামাও ছেড়ে দিলেন। মনে আছে, বোধহয় চিমটে খুঁজে না পেয়ে খালি হাতেই পাঁউরুটি এপিঠ ওপিঠ করছিলাম। পাপ্পুমামা বারবার বলছিলেন - তিতুম, বি কেয়ারফুল, হাত পুড়ে যাবে। পাপ্পুমামাকেও আর দেখিনি। দেখবও না। না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

আমার আনন্দস্বরূপা সন্ন্যাসিনীসমা পিসিদিদু শ্রীমতী তৃপ্তি ভট্টাচার্য গত নয়ই সেপ্টেম্বর তাঁর জীর্ণদেহখানি ত্যাগ করলেন। যাওয়ার সময়েও কারোর কোনো অসুবিধার কারণ ঘটালেন না। ছোটদাদু, ছোটদিদা আগেই চলে গেছিলেন। পিসিদিদুর সাথে ভট্টাচার্য পরিবারের একটি প্রজন্মের অবসান হল। গতকাল পারলৌকিক কাজ উপলক্ষে তাঁর ভাইপো-ভাইঝিরা এবং তাঁদের পরিবার একত্রিত হয়ে এই অসামান্য মানুষটির অনন্যসাধারণ জীবনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিলেন।

দিল্লিতে তোলা ছবিখানি খুঁজে পাচ্ছি না। এজন্যই ফেসবুকের এলবামে তুলে রাখি যেখানে যা পাই। হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে কোনোদিন কোনো হার্ডড্রাইভে, হয়ত বৃথা আশা, কালের গর্ভে চিরতরে তলিয়ে গেছে। ততদিন মধু হোক পৃথিবীর ধুলি, মধু হোক বাতাস, নদ ও নদীতে মধুক্ষরণ হোক - মধুবাতা ঋতয়তে, মধুক্ষরন্তি সিন্ধব। যে সুহাসিনী মানুষটি ছিয়াশি বছরের নশ্বর জীবন থেকে সবে মুক্তি পেলেন, মধুময় পৃথিবীতে তিনি মিশে থাকুন। 

Sunday, August 1, 2021

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ

 বেড়াতে যেতে আমার এত ভালো লাগে তার একটা কারণ হল কোথাও গিয়ে একটু চোখকান খোলা রাখলেই এমন মজার সব জিনিস দেখা যায় যেগুলো জ্ঞানী লোকেরা জানলেও আমার মত সাধারণ পড়াশোনা না করা মানুষের পক্ষে নাগাল পাওয়া কঠিন। তেমনটাই হল পোর্তোরিকো এসে। স্বেচ্ছায় মানুষ অনেক কিছুই করে, কিন্তু বাইরে থেকে সেই জিনিসটাই চাপিয়ে দিলে মন বিদ্রোহ করে। এক বছরের ওপর বাড়ি না গিয়ে আগেও থেকেছি। এবারে যেহেতু কোভিডের চক্করে আর আমেরিকান গভর্নমেন্টের নির্দেশে আসা-যাওয়ায় বাধা পড়েছে, তাই কোনোমতেই ঘরে আর মন টিকছে না। পোর্তোরিকোয় এসে প্রথমেই চোখে পড়ল পথঘাট, পাহাড় কৃষ্ণচূড়ায় লাল হয়ে রয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে এই চেনা রং মনের ক্লান্তি ঘুচিয়েছে। এদেশে এই গাছের নাম ফ্ল্যামবয়েন। লাল, হলুদ দুই রঙেরই হয়। আজ এক স্যুভেনির শপে ঢুকেছিলাম। উদ্দেশ্য ফ্ল্যামবয়েনের ছবি কেনা। মিঠুন এই ছবিটা হাতে ধরিয়ে দিল। রাঙা কৃষ্ণচূড়া তো রয়েছে, এই তিনজন মানুষ কারা? দোকানের মালিক বললেন এরা হলেন থ্রি কিংস। জানুয়ারীর ছ'তারিখে এই তিনরাজার উৎসব পালন হয়। পাঁচ তারিখে রাতে বাচ্চারা তিনরাজার জন্য খাবার আর জল রেখে দেয়। ছ'তারিখ সকালে উঠে তারা দেখে রাজারা সেসব খেয়ে তাদের জন্য উপহার রেখে গেছেন। গল্পটা সান্তাক্লজের মত। তবে কি এখানে ক্রিসমাস হয় অর্থোডক্স মতে জানুয়ারী সাতে? যেমনটা হয় গ্রীসে, রাশিয়ায়, প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলোতে? তা-ও নয়। ক্রিসমাস পঁচিশে ডিসেম্বরই হয়, তবে সেদিন উপহার আদান-প্রদান হয় না। হোটেলে এসে সামান্য খুঁজতেই বেরিয়ে গেল এই তিন রাজা আসলে সেই তিন জ্ঞানী মানুষ। মাধ্যমিক আমরা গিফট অফ দ্য ম্যাজাই গল্প পড়েছি। সেই তিন ম্যাজাই। যীশুর জন্মের সময় যাঁরা উপহার নিয়ে এসেছিলেন। পোর্তোরিকো দেশটা বারো মাসে তেরো পার্বনের। তারা সমুদয় আমেরিকার সাথে তাল রেখে পঁচিশে ডিসেম্বরের ক্রিসমাস নিয়েছে, আবার সাতই জানুয়ারীর অর্থোডক্স ক্রিসমাসও কোনোভাবে লৌকিক স্মৃতিতে ঢুকে পড়েছে। এদিকে বরফের দেশের সান্তাক্লজের গল্পটাও এমন ভালোবেসে ফেলেছে যে তার সাথে তিন ম্যাজাই মিলেমিশে একাক্কার। এইসব করতে গিয়ে এদের খেয়ালই নেই জানুয়ারীর ছ'তারিখে ম্যাজাইরা উপহার আনলে, ডিসেম্বরের পঁচিশে যীশুর জন্মদিন উদযাপনে লজিকের একটা বড়সড় গন্ডোগোল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কি! এভাবেই তো যুগে যুগে দেশে দেশে লোক সংস্কৃতির জন্ম হয়। শেষ যেবার বাড়ি যেতে পেরেছিলাম অজন্তা ঘুরতে গেছিলাম। সেখানে দেখেছি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বুদ্ধের গুহাচিত্র। কেমন ভালোবাসলে ঈশ্বরের ছবি নিজের গায়ের রঙে আঁকা যায় সে কি আর আমি বুঝব! এই ছবিতেও যেমন দেখা যায় তিন জ্ঞানী মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন থোকা থোকা লাল ফুলে ভরা কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে। বাস্তবের বেথলেহেমে এ গাছ তো কখনো জন্মায়নি। এর স্থান শুধু শিল্পীর মনোজগতে। যুক্তি আর তথ্যের ভার সরিয়ে সুন্দরের উপাসনা তার কাজ। সুন্দরকে সৃষ্টি করতে না পারলেও, মাঝেমধ্যে তাকে চিনতে পারি। মন তখন ভারী খুশি হয়ে ওঠে। পথে বেরোনো সার্থক হয়।



Tuesday, June 22, 2021

ক্যাম্পিং

 মাস ছয়েক ধরে একজন ঘ্যানঘ্যান করে চলছে - আমরা কলোরাডো থাকতে থাকতে একবার এসো। কখনো হুমকি দিচ্ছে - আমরাই শুধু যাই, তোমরা আসো না, এবার না এলে আমরাও আর যাবো না। তারপর তো মেসা ভার্দে আর টেলুরাইডে ক্যাম্পসাইট বুক করে ফেলে ঘোষণা করল - আমাদের সাথে না গেলে তোমরা তো কখনো ক্যাম্পিং করবে না, আসতেই হবে তোমাদের। রোজ কানের পোকা নাড়াতে থাকলে কাঁহাতক আর প্রতিরোধ করা যায়! অতএব টিকিট কাটা হল। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে রাত কাটানোর দুশ্চিন্তায় প্রথমে মাড়ি ফুলে গেল, তারপর কোমরে ব্যাথা এবং সেটা চুকতে না চুকতে বগলে ফোঁড়া। হ্যাঁ জানি, শেষেরটি ভদ্রমহিলাদের হওয়া উচিত না। তবু সত্যের পথ বন্ধুর। সবশেষে চেরি অন দ্য কেক যাত্রার দিনে পা মচকানো। ততদিনে আমারও জেদ চেপেছে ক্যাম্পিং না করলেই নয়। বৃহস্পতিবার রাতে কলোরাডো পৌঁছে অভি-পুবালির সিগনেচার ল্যাম্ব বিরিয়ানি দিয়ে ডিনার হল। পরের দিন বিকেলে দুখানা তাঁবু, চারটে স্লিপিং ব্যাগ, এয়ার বেড, খাবারদাবার দিয়ে গাড়ি ভরে বেরোনো। বোল্ডার থেকে মেসা ভার্দে সাড়ে সাতঘন্টা। সেদিন ঘন্টা পাঁচেক গিয়ে একটা মোটেলে রাত্রিবাস করে পরের দিন বাকি পথ যাওয়া হবে। মেসা ভার্দে সত্যি বলতে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে বেশ নিরেস। সাতশো থেকে বারোশো সালের মধ্যে এখানে নেটিভ ইন্ডিয়ানদের একটি বসতি ছিল। সেই সব ঘরবাড়ির কিছু নিদর্শন আছে। খুব অল্প লোক নিয়ে দিনে দুটি রেঞ্জার অপারেটেড ট্যুর হয়। এই ট্যুরে বসতিগুলোর ভিতরে ঢুকে দেখা যায়। দুসপ্তাহ আগে সকাল আটটায় টিকিট রিলিজ হয়। পুবালি আটটা দশে লগিন করে দেখে সব টিকিট শেষ। আমাদের ভাগ্যে তাই মূলত দূর থেকে দেখা, আর কয়েকটি সাইটে ভিতরে ঢোকার সুযোগ। সাঁইত্রিশ ডিগ্রি গরমে সেই অভিজ্ঞতা খুব সুখকর হচ্ছিল না। নাভাহো ইন্ডিয়ানরা নাকি বারোশো সালে খরার চোটে এই চত্ত্বর ছেড়ে পালায়। ওদের মত কষ্টসহিষ্ণু জাতই পারলো না, আমরা তো তুচ্ছ বাঙালি - এই ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। পাঁচটা নাগাদ সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হল আর পারা যাচ্ছে না, এবার ক্যাম্পসাইটে গিয়ে জিরোনো যাক। ন্যাশনাল পার্কের লগক্যাবিনে আমরা বহুবার থেকেছি। কিন্তু ক্যাম্পিং এই প্রথম। পুবালি জোর না করলে কোনোদিনই করতাম না। বাথরুম নিয়ে খুব ভয় ছিল এমন না। এখানে তো এমনকি চানের বন্দোবস্তও আছে। মূল সমস্যা ঘুমের। আমি এবং মিঠুন্দা দুজনেই বহু আরাধনা করে কদাচিত নির্বিঘ্ন ঘুমের আশীর্বাদ পাই।মূলত এই কারণেই ক্যাম্পিংএ রাজি হতে ভয় ছিল। অভি-পুবালি ক্যাম্প অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশনের কাগজপত্র নিয়ে চলল ক্যাম্পসাইট বাছতে। আমাদের দুখানি তাঁবু পড়বে। গাছগাছালি ঘেরা নিরিবিলি একটুকরো জমি বেছে নিয়ে নিমেষের মধ্যে দুই ওস্তাদ তাঁবু খাটিয়ে ফেলল। অভি একছড়া সোলার টুনিবালব কিনে রেখেছিল। তাদেরও ঝুলিয়ে দেওয়া হল গাছের ডালে। আমরা দুইজন এদের জেনারেশন কত স্মার্ট, কত এফিসিয়েন্ট এসব আলোচনা করতে করতে চানে গেলাম। মেইন ক্যাম্প অফিসের কাছে শেয়ারড চানের জায়গা। গাড়ি নিয়ে যেতে হল। টয়লেট অবশ্য ক্যাম্প সাইটেই আছে অনেকগুলো। অল্প দূরে দূরেই। বেশি হাঁটতে হবে না। চান সেরে ফিরে দেখি ওরা নিজেদের তাঁবুও খাটিয়ে ফেলেছে। আমাদের জন্য গাছের ছায়ায় বড় তাঁবু। নিজেরা খোলা আকাশের নিচে ছোট তাঁবু নিয়েছে। আমরা কিনা ওদের তত্ত্বাবধানে গেছি। তাই এসব সর্দারি বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলাম। এবার আগুন জ্বালিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। স্যামন মাছ, পাতলা করে কাটা গরুর মাংস আর আনারস নিয়ে গেছিলাম পোড়ানোর জন্য। অলিভ অয়েল আর গার্লিক সল্টে ভেজানো মাছ-মাংস সেঁকে নেওয়া হল আগুনের আঁচে। তারপর লেবু ছড়িয়ে হুস হাস খাওয়া। শেষপাতে আমাদের অভিভাবকেরা মিষ্টি মার্শমেলো

পুড়িয়ে দিল। মুখে দিলে গলে যায় আহারে কি সৃষ্টি! খাওয়া দাওয়ার পাট তুলে সবে মাদুর বিছিয়ে বসা হয়েছে টপটপ করে বড় বড় ফোঁটায় বর্ষণ শুরু হল। আমাদের জন্য খাটানো বড় তাঁবুটায় চারজনে ঢুকে পড়লাম। এই প্রথম ক্যাম্পিং, তাই মুগ্ধ হয়ে দেখলাম বাইরের ধুলো-বালি, পোকামাকড়, বৃষ্টি - কিছুই তাঁবুর ভিতরে ঢোকে না। এমনকি আমাদের বড় তাঁবুটাতে ছাউনিসহ নেট লাগানো জানলাও আছে। সেই জানলা খুলে দিতেই ভিজে হাওয়া ঢুকে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিল। হাহাহিহি করে কেটে গেল বেশ অনেকটা সময়। ইতিমধ্যে এক বিপত্তি। টয়লেট থেকে ফেরার পথে পায়ে খোঁচা খেয়ে পুবালির কড়ে আঙুল জখম। অভি ঝটিতি ফার্স্ট এইড বক্স এনে ক্ষত মেরামত করল। আরও কিছু রাত এগোলে ঠিক হল ঘুমের চেষ্টা করা যাক। আমরা দুজনেই জানি চেষ্টা যতই করা হোক, তিনি ধরা দেবেন না। অভি-পুবালি ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেনি। এয়ার বেড বিছিয়ে দিয়েছে। যে যার স্লিপিং ব্যাগে নিজেদের মুড়ে শুতে গিয়ে দেখি মিঠুন্দা বিছানাসহ ডুবে গেলেন, আর আমি মাস্তুলে বসা ফিঙে পাখিটির মত ভেসে রইলাম। পুলকিত হয়ে খোঁজ নিলাম ইদানিং মিঠুন্দার ওজন কেমন যাচ্ছে। আমি কি এতটাই হাল্কা! জানা গেল দৈর্ঘের মত ভারেও এখনো মিঠুন্দাই এগিয়ে। উনি অবশ্য বললেন ওজনটা কারণ নয়, তাঁবু ঢালু জমিতে খাটানো হয়েছে বলেই আমার এমন ফিঙে বিভ্রম। প্রস্তাব দিলাম - পরীক্ষা করেই দেখা যাক। স্থান পরিবর্তন হল। অধ্যাপকের পর্যবেক্ষণ মিথ্যে নয়। এবার মিঠুন্দা ফিঙে, আমি জগদ্দল পাথর। তিনি মাস্তুল আঁকড়ে পড়ে রইলেন। আমিও ঢালের বিপরীত মুখে নিজেকে আটকে রাখার চেষ্টা করলাম প্রাণপণ। একটু চোখ লেগে এসেছিল। স্বপ্ন দেখছিলাম আমার মাস্টার্স স্টুডেন্ট বলছে - আমি তো ফাইল সেভ করতে জানি না, আমি মুখে মুখে বলে যাচ্ছি, তুমি কি কোডটা লিখে নেবে? আতঙ্কে ঘুম ভেঙে দেখি মিঠুন্দা জ্যাকেট পরে বসে আছেন। বললেন টয়লেট যাবেন। আমিও সাথে যাবো বলে বেরোলাম। দেখি সারাদিনের মেঘ কেটে গিয়ে আকাশ তারায় ঝলমল করছে। চাঁদ ডুবে গেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে বয়ে চলেছে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ। আমরা দুটিতে কথা হারিয়ে আমাদের ক্লান্ত চোখে সেই রূপসুধা মেখে নিলাম। ঠিক করলাম বাকি রাতটুকু বাইরে বসেই কাটিয়ে দেব। আমাদের নড়াচড়ায় অভি-পুবালিরও ঘুম ভেঙে গেছে। ওরাও বেরিয়ে এল। আকাশ পরিস্কার না থাকার জন্য সারাদিন ধরেই মন খারাপ ছিল। শেষরাতে এমন সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে কে আর জানতো! কিছুক্ষণ গল্প করে আবার ঘুমের চেষ্টা করা হবে ঠিক হল। এবার ভাবলাম এয়ার বেডের হাওয়া বার করে দিয়ে দেখা যাক। খুব একটা উপকার হল না। মিঠুন্দা গাড়িতে শুতে গেলেন। আমি ভুমিশয্যায় এপাশ ওপাশ করে বাকি রাতটা কাটিয়ে দিলাম। নিজস্ব ঘর, এটাচড টয়লেট - এসব যে প্রিভিলেজ তা দিব্যি বুঝি। ঘুমের মধ্যে এপাশ ওপাশ করাও যে প্রিভিলেজ, তার জন্য যে পুরু গদি লাগে তা ভুলে ছিলাম অনেকদিন। এমনটা হওয়ার কথা ছিল না যদিও। পনেরো বছর বয়েসে যে তোষক নিয়ে প্রথম হোস্টেলে ঢুকি, যা আমি ব্যবহার করেছি বাইশ পর্যন্ত এবং আমার পরে আমার ভাই - তার পুরুত্ব অভি-পুবালির দেওয়া স্লিপিং ব্যাগের চেয়ে বেশি ছিল না। এমনকি বিদেশে ছাত্রাবস্থাতেও অফিসে স্লিপিং ব্যাগ পেতে রাত্রিবাসে বাধ্য হয়েছি। সেও সুদূর অতীতের কথা নয়। কিন্তু কে না জানে আরামে অভ্যস্ত হতে সময় লাগে না। অতএব আমার গেছে যে দিন তা একেবারেই গেছে। খোলা আকাশের নিচে নিশ্চিন্ত ঘুম বিদায় নিয়েছে জীবন থেকে। আমাদের তরুণ দুজন সাথী - এখনও জং ধরেনি ওদের পায়ে, এখনও ওরা ফুসফুসে ভরে নিতে পারে তাজা হাওয়া - ওদের মুগ্ধ হয়ে দেখি। পাখিডাকা ভোরে উঠে পড়েছে ওরা। তাঁবু গুছিয়ে গাড়ি ছুটবে পরের গন্তব্যের পথে।