স্থান - আইআইটির লেকচার থিয়েটার, পাওয়াই; কাল - অজানা
ক্যাম্পাস প্লেসমেন্টের ফল ঘোষনা হচ্ছিল রিয়েলিটি শোর স্টাইলে। হাজার রকম সাসপেন্স তৈরী করে, চাকরীপ্রার্থী ছাত্রছাত্রীদের হার্টবিট বিপদসীমার ওপরে তুলে দিয়ে, দশজনের বিড়ম্বনার বিনিময়ে একজনের মুখে হাসি ফুটিয়ে টোটাল প্যাকেজ পরিবেশিত হচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধরেই বিরক্ত লাগছিল। আমার নামটা তিন নম্বরে ঘোষনা হয়ে যাওয়ার পর নিজের প্লেসমেন্টটা নিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। চতুর্থজনের নাম নেহা। ফার্স্টনেম ঘোষনা করে কুশলী পরিবেশক সব কজন নেহাকে ডেকে নিলেন। আটজন উঠে দাঁড়াল। গোটা এল টির চোখ তাদের দিকে। এবার পদবী ঘোষনা হবে। আট নেহার মধ্যে একজনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। আমার বিরক্তি সীমা ছাড়ালো। চাকরীটা পেয়ে গিয়ে কনফিডেন্সও বেড়েছে। পরিবেশককে বলে বসলাম, পড়বেন তো মশাই একটা নাম, এত ভ্যানতাড়া কষছেন কেন? আরো কজন সমর্থন জানলো। বাকি নাম ঘোষনা রিয়েলিটি শো উত্তেজনা ছাড়াই সম্পন্ন হল। প্লেসমেন্টের পরে পার্টি। হিরানন্দানীর মর্মর সৌধের যে সিঁড়িটা দেখলেই "পিয়া তু আব তো আজা" নাচতে ইচ্ছে করে সেই খানে মোচ্ছব চলছে। একজন ইজিপ্সিয়ান মানুষ চমৎকার ফ্লার্ট করে মন খুশ করে দিল। সদলবলে বেসুরো গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছি, দেখি এক তলা ডুবে গেছে বন্যার জলে। এক খানা কাঠের বাক্স ভরে গাছের পাতা, শুকনো ফুল, হাবিজাবি জমিয়েছিলাম। জল ডিঙিয়ে ঢুকে ছোঁ মেরে সেই বাক্স তুলে নিয়ে দৌড়চ্ছি পাহাড়ের দিকে। চোখের সামনে একট ইলেক্ট্রিক পোস্টে আগুন ধরে গেল। সবাই ছুটছে চড়াই বেয়ে। আমরা যতই উঠি, জলও ততই ফুঁসে উঠে ধরে ফেলতে চায় আমাদের। দৌড়তে দৌড়তে ভাবি, আজকাল তো চড়াই উঠতে হাঁফ ধরে, আমার সাথে তাল দিতে গিয়ে মিঠুন বেচারাও পিছিয়ে পড়বে। ভাবি ওকে বলব, তুই এগিয়ে যা। খেয়াল হয় ওর সাথে দেখা হতে আরো বছর আষ্টেক দেরী। নাকি আরো বেশি? কারণ ইতিমধ্যে নাজি বাহিনী এসে গেছে। যে পাথরটার গায়ে দাঁড়িয়ে হাঁফ নিচ্ছিলাম সেখান থেকেও তাড়াবে তারা। বাক্সটা কেড়ে নিল হাত থেকে। অন্য কারোর সাথে কাড়াকাড়ির সময় একটা জলের বোতল গড়িয়ে এল। ওদের অলক্ষ্যে সেটা গুঁজে নিলাম মোজার ভেতরে। তখনই চোখে পড়ল আরেকটা মেয়েও একটা বেওয়ারিশ বন্দুক গুঁজে নিচ্ছে তার জামার স্লিভে। নাজিদের তাড়ায় পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকি আমরা। গতবছর গ্রীষ্মে পাহাড়ে বেড়াতে এসে ঘাসের ছাউনি দেওয়া কাঠের ঘরে রাত কাটিয়েছিলাম মনে পড়ে। আর একটু উঠলেই সেই ঘরে পৌঁছব। ঘরের সামনে কাঁচের মত টলটলে লেক। একসময় পৌঁছোই। লেকের জলে মুখ বাড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে যাই, আগুনঘেরা শিল্যুয়েট দেখি। কাঠের ঘর জ্বালিয়ে দিল নাজি বাহিনী। আরো তাড়াবে আমাদের। চড়াই বেয়ে আরো উঠলে ছোট একটা গ্রাম পড়বে জানি। পাহাড়ীরা থাকে সেখানে। গিয়ে দেখি তাদেরও তাড়াচ্ছে। স্লিভে বন্দুক গোঁজা মেয়েটার পিছু পিছু একটা গলিতে ঢুকেছি। মেয়েটা কি কোথাও লুকোনোর প্ল্যান করছে? ওর সাথে জুটে যাব ভাবি। একটা ছোট্ট খুপরির মত পানের দোকানে ঢুকে ঝাঁপ ফেলে দেব ভাবছি, একটা নাজি দেখে ফেলল। সাহসী মেয়েটা ওর স্লিভ থেকে বন্দুক বার করে তাক করেছে নাজির দিকে। লোকটা অবলীলায় ওর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেটা দিয়েই ওর কপাল ফুটো করে দিল। তারপর তো একটা ক্যারেজে তুলে দিয়েছে গাদাগাদি করে। আর একজনের জায়গা বাকি। একটা মধ্য তিরিশের মেয়ে দুই শিশু নিয়ে এসে দাঁড়াল। দুই বছরের ছোটটাকে দিতে চাইছিল আমাদের সাথে। নাজি অফিসার তার বদলে সাত বছরের মেয়েটাকে তুলে নিল। খুব ভয় পাওয়া মেয়েটা বদ্ধ গাড়িতে চেঁচাচ্ছে - দিস ইজ ডার্ক, আই নিড এয়ার, প্লিজ লেট মি গেট আউট অফ হিয়ার। অফিসার কালো কাগজ ঢাকা কাঁচের জানলা ভেঙে মেয়েটার মুখ থেকে বুক পর্যন্ত বাইরে বার করে দিল। একটা হেঁচকি তুলে মেয়েটা থেমে গেল। তারপর এবড়োখেবড়ো রাস্তার অবিরাম ঝাঁকুনিতে ধাক্কা খেতে খেতে ভাঙা জানলা দিয়ে বাকি শরীরটা একসময় টুপ করে খসে পড়ল রাস্তার ওপরে।
------ এখানেই শেষ নয়। আরো একটা ক্যারেজ, একটা মুমূর্ষু মেয়ে, একটা বুড়ো লোক যাকে আমি মোজায় লুকিয়ে রাখা জলের বোতল দেব আর সেটা দেখতে পেয়ে এক নাজি অফিসার জলের বোতলের ঘাড় মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাত বাড়াবে বুড়ো মানুষটার দিকে - কি ভাগ্য ঠিক তক্ষুণি ঘুমটা ভেঙে যায়। কতগুলো বিশ্বযুদ্ধের সিনেমা দেখলে এসব স্বপ্ন মানুষে দেখে? যারা হত্যাদৃশ্য লেখে, গল্পে বা ছবিতে, তাদের কেমন লাগে লেখার পর? সারাদিন ধরে স্বপ্ন এমন তাড়া করছে যে ভাবলাম লিখে ফেলে মুক্ত হই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিখতেও পারলাম না। সিনেমা দেখা বা মেমোয়র পড়া এক রকম। সে হল অন্যের তৈরী করা জিনিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো। এ তো আমার নিজের সৃষ্টি। সাত বছরের মেয়েটাকে নিজের হাতে মেরে ফেললাম!