আলি জিজ্ঞেস করল, ‘‘এটা কি তোমাদের প্রথম হট এয়ার বেলুন রাইড ?’’ আমরা সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। সে মুচকি হেসে উত্তর দিল, ‘‘আমারও’’। আমি নিশ্চিত রোজ সকালে যাত্রীদের নিয়ে আকাশে ওঠার আগে ও একই কথা বলে। তাও সেদিন ভোরে কাপাদোচিয়া শহরের আশ্চর্য ভূপ্রকৃতিতে আলির কথায় একটা শিহরণ হল।
বেলুনের সাথে লাগানো বেতের ঝুড়িতে আমরা জনা দশেক গা ঘেঁসাঘেঁসি করে দাঁড়িয়েছি। সূর্য তখনও ওঠেনি। বেলুনের ভেতরের হাওয়া গরম হচ্ছে বার্নারে। একটু পরেই সেই গরম হাওয়া বাইরের ঠান্ডা হাওয়ার চেয়ে হালকা হয়ে যাবে। আমাদের নিয়ে বেলুন ভেসে চলবে শিরা-উপশিরার মত জেগে থাকা অজস্র ছোট ছোট পাহাড়ের ওপর দিয়ে। আগ্নেয়গিরির ছাই জমে তৈরি নরম সে পাথর। সেই পাথর কুঁদে অজস্র পায়রার খোপের মত ঘর বানিয়েছে মানুষ, গত সাড়ে তিনহাজার বছর ধরে। যখনই শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে পালানোর দরকার হয়েছে কোনো গোষ্ঠীর, তারা এসে আশ্রয় নিয়েছে এই নরম পাথরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গুহাবাড়িতে। পাথর কেটে আটতলা সমান শহর তৈরি হয়েছে বহিঃশত্রুর চোখের আড়ালে। সেইসব গুহার মুখ, ছোট ছোট কালো বিন্দুর মত দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা। কখনও আলি নিয়ে যাচ্ছিল তাদের খুব কাছে। কখনও ওপরে উঠছিলাম আমরা। আকাশে আরো কত নীল-হলুদ-সাদা বেলুন। ভোরের নতুন আলোয় কাপাদোচিয়া উপত্যকা সোনার মত চকচক করছে। এই ভরন্ত যৌবন দেখে বিশ্বাস হয় না এই পাথর আসলে রক্তেভেজা। সাড়ে তিনহাজার বছরের পাপদীর্ণ।
খ্রিষ্টজন্মের দেড়হাজার বছর আগে আনাতোলিয়া বা এশিয়া মাইনরের এই অঞ্চলে (এশিয়ান তুরস্ক) হিটাইটরা রাজত্ব করত। এখনকার তুরস্ক, সিরিয়া, প্যালেস্তাইন থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাদের রাজত্বের সীমানা। কালের নিয়মে সে সীমানা সংকুচিত হল। দক্ষিণ থেকে মিশরিয়রা, পূর্বে মেসোপটেমিয়া থেকে আসিরিয়ানরা মাঝে মাঝেই হামলা করত। দক্ষিণপূর্ব ইউরোপে কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে সেই সময় আরো কিছু জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে যারা শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। এরকমই কোন গোষ্ঠীর আক্রমণে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে হিটাইট রাজধানী হাতুসা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আন্দাজ করা যায় সেই সময়ের আশেপাশেই ঘরছাড়া মানুষেরা কাপাদোচিয়া অঞ্চলে প্রথম পাথর কেটে মাটির নিচে গুহাবাড়ি বানালো। শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে বেঁচে থাকার এই কৌশল তাদের উত্তরসূরীরাও আয়ত্ত করে নেবে অচিরেই।
সেদিন বেলুন থেকে নেমে আমরা গেলাম গোরেমে ওপেন এয়ার মিউজিয়াম দেখতে। গোরেমে কাপাদোচিয়ার একটা ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রাম কীভাবে ওপেন এয়ার মিউজিয়াম হল তা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে দুহাজার বছর। যিশু নামের এক ইহুদি যুবক তখন সদ্য ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন। জেরুজালেমে রোমান শাসন। সমস্ত বুদ্ধিমান বিদেশি শাসকের মতই তারা শাসিতের ধর্মগুরুদের বিশেষ ঘাঁটায় না। সেই ধর্মগুরুরা যখন এই জনদরদী বিদ্রোহী যুবকটির থেকে আসা সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের নিদান দিল তখন প্রায় বিনা প্রতিবাদেই তা কার্যকর করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। যুবকটির মৃত্যুর পর তাঁর অনুগত গুটিকয় শিষ্য রোমান শাসকের নজর এড়িয়ে পালাল দূর দেশে। সঙ্গে নিল যুবকের মা মেরিকেও। ক্ষুদ্রমেয়াদি জীবনে যেসব প্রশ্ন যুবকটিকে বিচলিত করেছিল তার বীজ তিনি পুঁতে দিয়েছিলেন তাঁর অনুগামীদের মনে। অনুগামীরা যেখানে গেল সেইসব শিক্ষা সহজ কথায় ছড়াতে লাগল স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে। এইভাবে ইহুদি যুবকের মৃত্যুর পর তাঁর অজান্তেই জন্ম নিল এক নতুন ধর্ম। তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মসিহা বলে চিনেছিল। গ্রিক ভাষায় মসিহা হল ক্রিস্টোস। সেখান থেকে এই নতুন ধর্ম পরিচিত হল খ্রিষ্ট ধর্মরূপে।
আব্রাহামের একেশ্বরবাদ তখনও সারা পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীই তখনও পৌত্তলিক। প্রবল প্রতিপত্তিশালী রোমান শাসকেরা পৌত্তলিকতার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। এই অবস্থায় একেশ্বরবাদী নতুন ধর্মটি বেশ কোনঠাসা হয়ে পড়ল। যিশুর মৃত্যুপরবর্তী প্রথম তিনশো বছরে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার পেল শুধুই লোকমুখে। যিশু অনুগামী ছোট ছোট গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষুর আড়ালে কোনমতে নিজেদের টিকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করতে লাগল। এইসময় হেলেনা নামের একটি খ্রিষ্টান মেয়ে কোনওভাবে কনস্টানটিয়াস নামে এক রোমান সিজারের চোখে পড়ে যায়। তাদের বিয়ে হয়। সন্তান হয় যথাক্রমে। এই সন্তান কনস্টানটাইন একদিন রোমান সম্রাট হয়ে কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) নামের শহরের পত্তন করলেন ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থলে। আজকের যুগের হিসেবে কনস্টানটাইনকে সেকুলার বলা চলে। তাঁর রাজ্যে খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিক উভয় জনগোষ্ঠীই তাদের ধর্ম পালনের অনুমতি পেল।
তবে কনস্টানটাইনের আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই গোটা এশিয়া মাইনর জুড়ে ক্রিশ্চান হত্যা থেমে গেল এমন ভাবার কারণ নেই। কাপাদোচিয়া আসার রাস্তায় আমরা ঘুরে এসেছিলাম হিয়েরোপলিস থেকে। খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতকে তৈরি এই বাইজান্টাইন শহরে কিছু প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। তখন থেকেই এই শহর লাক্সারি রিসোর্ট হিসেবে বিখ্যাত। এই শহরে খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতকে উল্টো করে ঝুলিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল সেন্ট ফিলিপকে। সেই জায়গায় পরে তৈরি হয়েছে যে চার্চ, সেখানে ঘুরে এসেছি আমরা। আধুনিক চার্চের থেকে গঠনশৈলীতে বেশ আলাদা। একটি খোলামেলা অষ্টভুজাকৃতি মন্দিরের মত সেই চার্চ। খিলানের গায়ে নকশায় বৃত্তের মধ্যে ক্রস চিহ্ন। এই ক্রস আধুনিক ক্রসের মত নয়, যার একটি বাহু অন্যটির চেয়ে বড়। এখানে দুটি বাহু পরস্পরকে সমদ্বিখণ্ডিত করেছে। উৎসাহীরা ‘গ্রিক ক্রস’ নামে খুঁজে দেখতে পারেন। খ্রিষ্টধর্মের সেই তরুণ অধ্যায়ে এই ক্রস বহুল ব্যবহৃত হত। সেই সময়েই রোমান শাসকের চোখ এড়াতে ছোট ছোট খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠী কাপাদোচিয়ায় হিটাইটদের (মতান্তরে ফ্যারেঞ্জিয়ান) ফেলে যাওয়া গুহাবাড়িতে থাকতে শুরু করে। নিজেরাও বানিয়ে নেয় নতুন থাকার জায়গা। গোরেমে গ্রামে তৈরি হয় একাধিক মনস্টারি। পাথুরে এই অঞ্চল চাষবাসের জন্য খুব একটা উপযুক্ত ছিল না। তাই আত্মগোপন হয়েছিল সহজ। তার ওপর যিশুর শিক্ষা অনুসারে দারিদ্র, সংযম, কষ্টসহিষ্ণুতা এসবই ছিল ঈশ্বরকে পাওয়ার মাধ্যম। প্রথম যুগের সেই খ্রিষ্টানরা এই জীবনযুদ্ধকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হিসেবেই নিল। মাটির নিচে গড়ে উঠল আস্ত শহর। গোরেমের চার্চগুলো ভরে উঠল সহজিয়া নকশায়। পাঁচশো বছর পরের খ্রিষ্ট উপাসনাস্থলগুলোর চেয়ে এই চার্চের চরিত্র একেবারেই আলাদা। কিছু কিছু নকশা আজও টিকে আছে দেড় হাজার বছরের রোদজল সয়ে।
৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। একশো বছর হল পৃথিবীর নবতম ধর্মটির জন্ম হয়েছে। এটিও আব্রাহামের অনুসারী একেশ্বরবাদী। নতুন এই ধর্মের নাম ইসলাম, যার অর্থ ‘সমর্পণ’। মহম্মদ এই ধর্মের নবী। জীবন্ত কোন প্রাণীর ছবি আঁকা এই ধর্মে নিষিদ্ধ। ৭৩০ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে বেশ কয়েকবারের মুসলিম আক্রমণে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বিপর্যস্ত। উপরন্তু থেরা দ্বীপে (বর্তমান সান্তোরিনি) একটি আগ্নেয়গিরিতে হঠাৎ করেই অগ্নুৎপাত শুরু হয়েছে। এসব দেখে সম্রাট তৃতীয় লিওর ধারণা হল ভগবান রুষ্ট হয়েছেন এবং তিনি জীবন্ত প্রাণীর ছবি আঁকাকে সেই রোষের কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। বাইজান্টাইন চার্চগুলো যিশুর জীবনের নানা ঘটনা এবং সম্রাটদের চার্চে প্রণামী দেওয়ার মুহূর্তগুলোকে মোজাইক ও ফ্রেস্কোর মাধ্যমে চিত্রিত করার জন্য বিখ্যাত। লিওর আদেশে সব ছবি নষ্ট করে সেই জায়গায় ক্রশ আঁকা হল। কাপাদোচিয়ার লোকবিবর্জিত গণ্ডগ্রামেও রাষ্ট্রীয় আদেশে মানুষের প্রতিমূর্তি আঁকা বন্ধ হল। তবে সেও কিছুকালের জন্য।
ইতিমধ্যে কাপাদোচিয়ার রাজনৈতিক চালচিত্রে পরিবর্তন এসেছে। প্রবল পরাক্রান্ত বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে কনস্ট্যান্টিনোপলের গণ্ডিতে। আনাতোলিয়ায় রাজত্ব করছে সেলজুক তুর্কিরা। ১০৮০ সালে সেলজুক সুলতান সুলেইমান শাহ কোনিয়ায় সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। এই সেই কোনিয়া যেখানে জন্ম নেবেন সুফিসাধক মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি। কাপাদোচিয়া আসার পথে আমরা ছুঁয়ে এসেছি রুমির সমাধিও। সেলজুক রাজারা পরধর্ম সহনশীল ছিলেন। অনেক মসজিদ, অনেক মাদ্রাসা, অনেক ক্যারাভ্যানসরাই তৈরি হল আনাতোলিয়া জুড়ে। কিন্তু কাপাদোচিয়ার চার্চগুলোর গায়ে আঁচড় লেগেছিল এমন তথ্য নেই। বরং বাকি পৃথিবী যখন একটার পর একটা ক্রুসেডে মেতে আছে, সেই একাদশ-দ্বাদশ শতক জুড়েই নতুন নতুন ফ্রেস্কো আঁকা হচ্ছে কাপাদোচিয়ায়। অন্ধকার চার্চে টিমটিমে আলোয় দেখতে পাই সেই রঙ আজও অম্লান। ছবি তোলা নিষিদ্ধ – সে মনে হয় ভালোর জন্যই। চার্চের বাইরে যেটুকু ফ্রেস্কো আছে, অথবা যেসব চার্চে ছবি নেই শুধু সেখানেই ক্যামেরা বার করা যায়। একটি চার্চের বাইরে ছবি ছিল যিশু কোলে মেরি এবং দুই অ্যাপোস্টলের। তাদের চোখ খুবলে নেওয়া। মনে পড়ে গেল, এ জিনিস মিশরে দেখেছিলাম আইসিস মন্দিরে। মন্দিরের দেওয়ালে দেবীর ছবির চোখ তুলে নেওয়া হয়েছে। কখনও পুরো মুখই বিকৃত। সেখানে জেনেছিলাম পৌত্তলিক মিশর যখন সবে একেশ্বরবাদী খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষা নিচ্ছে তখন স্থানীয় মানুষেরা এই কাজ করত। তারা তখনও বিশ্বাসের দোলাচলে। নতুন ধর্ম গ্রহণ করার জন্য পুরোনো দেবী রেগে গিয়ে কোন ক্ষতি করবেন কিনা তা নিয়ে ভয় তাদের মনে। তারা তাই দেবীর চোখ খুবলে নিয়ে ভাবে দেবী আর দেখতে পাবেন না। গোরেমের খোবলানো যিশুমুখও সম্ভবত বিশ্বাসের দুনৌকোয় পা দিয়ে চলা কিছু মানুষের কীর্তি।
দুপুরের দিকে গেলাম ওজকোনাক নামের মাটির তলার শহরে। মাটির তলার শহর এই অঞ্চলে আরো আছে। কায়ামাকি, দেরিনকুয়ু – এগুলো সবই বয়েসে সমসাময়িক। বিপদের সময় বটগাছের কোটরের মত আশ্রিতকে লুকিয়ে রাখাই এদের কাজ। দেরিনকুয়ুতে নাকি কুড়ি হাজার লোক লুকিয়ে থাকতে পারে। ওজকোনাকে দেখলাম এক বিশাল গোল পাথর সুড়ঙ্গমুখের পাশে রাখা। এই পাথর ব্যবহার হত দরজা হিসেবে। প্রথমেই গবাদি পশু ও ঘোড়া থাকার জায়গা। তারপর শুরু হয়েছে মূল শহর। শহর না বলে হয়ত আধুনিক গেটেড অ্যাপার্টমেন্ট কমিউনিটি বললে বুঝতে সুবিধে হবে। মাটির ওপরে এরকম একটা জায়গায় যা যা থাকা উচিত তার প্রায় সবই মজুত। সবাই রান্না করবে এমন রান্নাঘর, ওয়াইন বানানোর চৌবাচ্চা, চ্যাপেল, নিজস্ব শোবার ঘর – কিছুই বাদ নেই। দেরিনকুয়ুতে একটা স্কুলও আছে। আমাদের গাইড রজবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম বাথরুম আছে কিনা। সে বলল নিচের তলায় তাও রয়েছে। কিন্তু রিস্টোরেশনের কারণে সে জায়গা বন্ধ। বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যাতায়াতের জন্য টানেল রয়েছে। মাঝে মাঝে সে টানেল খুবই সংকীর্ণ। একটা জায়গা পেরোতে হল হামাগুড়ি দিয়ে। মনে পড়ে, সেই হামাগুড়ি পর্বের শেষে একটুকরো প্রশস্ত জায়গা অপেক্ষা করে ছিল যেখানে এসে দাঁড়াতেই এক ঝলক টাটকা বাতাস এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিল। ভেন্টিলেশনের জন্য এমন সব আশ্চর্য ব্যবস্থা করা আছে সবকটা শহরেই। আর আছে প্রতিটির সংলগ্ন কুয়ো। হবে নাই বা কেন! শুধু সেই প্রথম যুগের পৌত্তলিক শাসকের ভয় তো নয়! বারবার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে মাটির তলার এই শহরগুলোতে। চতুর্দশ শতকে তৈমুর লঙের আক্রমণের সময়, পরবর্তীতে অটোমান সুলতানদের খামখেয়ালিপনা থেকে নিজেদের বাঁচাতে, এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেও আর্মেনিয়ান ক্রিশ্চানরা ব্যবহার করেছে এই সুড়ঙ্গপথ।
এখন এইসব শহর, গোরেমের চার্চ, বলাবাহুল্য, পরিত্যক্ত। তুরস্কের সরকার অবশ্য যত্নসহকারেই রক্ষা করছেন তাঁদের সহস্রাধিক বছরের ইতিহাস। চার্চগুলো এবং বড় বড় গুহা শহরগুলো মিউজিয়াম হয়েছে। বেশ কিছু গুহাবাড়িতে হোটেল হয়েছে, রেস্তোরাঁ হয়েছে। কিছু বাড়ি ধনী মানুষেরা কিনে রেখেছে ছুটি কাটানোর জন্য। এইসব বাড়িতে বিংশ শতকের শুরুতেও যেসব মানুষ থাকত তারা ছড়িয়ে পড়েছে নানা জায়গায়। বেশিরভাগই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। ১৯২৩ সালে গ্রিস ও তুরস্কের মধ্যে নাগরিক বিনিময়ের চুক্তি হয়। বারো লক্ষ আনাতোলিয়ান ক্রিশ্চান চলে আসতে বাধ্য হয় গ্রিসে। সাড়ে তিনলাখ মুসলিম গ্রিককে যেতে হয় তুরস্কে। ভারত-পাকিস্তান ভাগের মতই এই চুক্তিও কেবলমাত্র ধর্মভিত্তিক। ভাষাভিত্তিক বা জনগোষ্ঠীভিত্তিক নয়। ১৯২৩ সালে ইস্তাম্বুল এই চুক্তির বাইরে ছিল। কিন্তু পরবর্তী আট দশকে ইস্তাম্বুলের ক্রিশ্চান জনসংখ্যাও একত্রিশ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে প্রায় শূন্যতে। তবে ভরসার কথা এই, আটানব্বই শতাংশ মুসলিম ধর্মাবলম্বী থাকা সত্ত্বেও তুরস্ক এখনও সেকুলার রাষ্ট্র। যদিও কতদিন তা বজায় থাকবে জানা নেই। কাপাদোচিয়ার নরম আগ্নেয় পাথর সাড়ে তিনহাজার বছর ধরে বাস্তুচ্যুত মানুষকে আশ্রয় দিয়ে এখন মহিমান্বিত জাদুঘরের সম্মান পেয়েছে। তা বলে বাস্তুচ্যুতির যুগের অবসান হয়নি। কখনও ঘুপচি ভ্যানে, কখনও নড়বড়ে নৌকোয় রাষ্ট্রের সতর্ক নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে মানুষের স্রোত ভেসেই চলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। কখনও সে কূল পায়। সব কিছু হারিয়ে, শুধু প্রাণটুকু নিয়ে অন্য দেশে এসে ওঠে। কখনও তার লাশ মাটির উত্তাপটুকুর আশায় কাঙালের মত জড়িয়ে ধরে বেলাভূমি। তবু মানুষের স্বপ্ন অপার। এক জীবনে অজস্র জন্মকে সে দেখে যেতে চায়। তার সেই দর্শনের সুষমা বোতলবন্দি করে ফেলে রেখে যায় ভবিষ্যতের জন্য। কে জানে কোন উত্তরসূরী কোন আগামীতে তার সযত্নঅর্জিত অনুভবের আশ্রয় নেবে! সেই দিনটিকে সামনে রেখে মানুষ পাথর কেটে চলে।
প্রথম প্রকাশঃ https://bengali.indianexpress.com/travel/cappadocia-istanbul-travelogue/