আমার দিদার ছিল গোটা চারেক ভালো শাড়ী। একটা বিয়ের বেনারসী, একটা গরদ, মাঝবয়েসে বেনারস বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে কেনা একটা কড়িয়াল বেনারসী, এছাড়া শেষের দিকে তসরও হয়েছিল। মায়ের প্রথম দামী শাড়ী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোন হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা দুধে আলতা রঙের একটা বালুচরী। পঁচিশ বছর পরেও তার জলুষ অম্লান এবং তার তুল্য একটি দ্বিতীয় বালুচরী আজ পর্যন্ত দেখলাম না। সেই শাড়ীটি কেনার সময়ে মায়ের পনেরো বছর চাকরী করা হয়ে গেছে। তারপরে মুক্ত অর্থনীতি এসে লোকজনের হাতে টাকাপয়সা বেড়েছে। এখন মধ্যবিত্তের ঘরেও বিভিন্ন প্রদেশের একাধিক হ্যান্ডলুম শাড়ী। কিন্তু যারা এই শাড়ীগুলো মধ্যবিত্তের হাতে তুলে দিচ্ছেন তাদের অবস্থা কেমন? এবং এককালে যেসব শাড়ী মানুষ একটা দুটোর বেশি কিনে উঠতে পারত না, তা এমন সহজলভ্যই বা হয়ে উঠছে কি উপায়ে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার আগে সংক্ষেপে হ্যান্ডলুম শাড়ীর নির্মাণ প্রক্রিয়া জানা যাক। হ্যান্ডলুম অর্থাৎ কিনা হাতে বোনা। কাপড় যদি খাদির হয় তাহলে সুতোটাও হাতে তৈরী। বেশীর ভাগ সিল্কের ক্ষেত্রেও তাই। ব্যাঙ্গালোর সিল্কের ক্ষেত্রে সুতো তৈরী হচ্ছে মেশিনে। খাদী ছাড়া অন্য কটন সুতোও মেশিনে তৈরী। যে রকম সুতোই হোক না কেন, প্রাথমিক ভাবে সেটা হবে কোরা রঙের (বিস্কুট কালার)। রঙিন কাপড় চাইলে সেই সুতো প্রথমে ব্লিচ করতে হবে। তারপর তাতে রঙ ধরাতে হবে। অর্থাৎ সাদা কাপড়ের ক্ষেত্রেও যে রঙটা আমরা দেখি তা সুতোর আসল রঙ নয়। ইক্কত গোত্রের কাপড়ের ক্ষেত্রে আবার রঙ করার বিশেষ পদ্ধতি আছে। ইক্কতে যে প্যাটার্ণ তোলা হবে সেই হিসেব মত সুতোর এক একটা অংশ এক এক রকম রঙ করা হয়। রঙ করার শেষে সুতোর গুটি বানিয়ে তুলে রাখা হয় শাড়ী বোনার জন্য।
এবার তাঁত (লুম) প্রস্তুত করতে হবে কাপড় বোনার জন্য। সাধারণ ঢালা শাড়ীর ক্ষেত্রে এটা খুব বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু বালুচরী, বোমকাই, সম্বলপুরী, কাঞ্জীভরমের মত জমকালো শাড়ীর বেলায় লুম তৈরী করতেই লেগে যায় দশ-বারো দিন। একটা শাড়ী বুনতে দুইদিক থেকে সুতো আসে। একটা হরাইজন্টাল বা টানা সুতো। অন্য সুতোটা আসছে ভার্টিকালি। একে বলা হয় পোড়েনের সুতো। বোমকাই, সম্বলপুরী, জামদানী জাতীয় শাড়ীর ক্ষেত্রে জমির নকশা তোলা হয় এই পোড়েনের সুতো দিয়ে। লুম তৈরী করার অর্থ হল প্রতিটা টানার সুতোকে সমান্তরাল ভাবে সূচে ভরে দেওয়া। পাড়ের নকশায় যদি আলাদা রঙের সুতো যায় তাহলে নকশা অনুযায়ী সেই সুতোর গতিবিধি ঠিক করা। এর পর তাঁতী পোড়েনের সুতো চালিয়ে নকশা তুলবে শাড়ীতে। বালুচরী, কাঞ্জীভরম, বেনারসী গোত্রের শাড়ীর ক্ষেত্রে জাকার্ড লুমের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। সেক্ষেত্রে যে ডিজাইন বোনা হবে সেটা কার্ডে তোলা থাকে। সেই কার্ড এবং কোন অংশে কি রঙের সুতো যাবে সেই হিসেব মত লুম তৈরী করা হয়। একবার লুম তৈরী হয়ে গেলে শাড়ী বুনতে খুব বেশী সময় লাগে না। সাধারণ তাঁতের শাড়ীর ক্ষেত্রে একদিনই যথেষ্ট। কাজের সুক্ষ্মতা অনুযায়ী এক থেকে ছয়দিন লাগে শাড়ী বুনতে। যদি একই ডিজাইনের অনেকগুলো শাড়ীর অর্ডার থাকে, তাঁতী সেক্ষেত্রে একই লুমে সবকটা শাড়ী বুনে ফেলতে পারেন। লুম তৈরী করার সময়টা সেক্ষেত্রে বেঁচে গেল।
এবার আমাদের প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। নিজের হাতে সুতো তৈরী করে, কাপড় বুনে তাঁতীরা মজুরী কেমন পান? সম্পুর্ণ হাতে তৈরী একটা শিল্প যে টাকায় কিনে আমরা ঘরে তুলি সেটা কি যথেষ্ট? যদি না হয়, তাহলে কেমন করে চলছে এই বাজার? শেষের দিক থেকে শুরু করা যাক। হ্যান্ড্লুম শাড়ীর রমরমা শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকেই সীমিত অভিজ্ঞতা ও পড়াশোনা নিয়ে বুটিক খুলে বসেছেন। এবং সেখানে অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে একই রকম শাড়ী এক্জন বিক্রি করছেন পাঁচ হাজার টাকায়, অন্যজনের কাছে পাওয়া যাচ্ছে তার অর্ধেক দামে। এটা কি ভাবে সম্ভব হচ্ছে? প্রথম যে কথাটা বলা যায় তাহল বেসরকারী শাড়ীর দোকানে কোন কোয়ালিটি চেক হয় না। ২০১৭ সালে, একটা আসল তসরের থানের দাম পড়ে অন্তত ৩৫০০ টাকা। কিন্তু অনেকেই এর ঢের কমে তসর বিক্রি করছেন। এটা সম্ভব হচ্ছে কারন ভারতীয় তসরের সাথে এসে মিশছে কম দামী কোরিয়ান তসর। এই মিশ্রণ অনভিজ্ঞ চোখে ধরা প্রায় অসম্ভব। একটা কোরিয়ান সুতো, একটা ভারতীয় সুতো দিয়ে বোনা হচ্ছে এই মিশ্র তসর। দাম নেমে আসছে ২৩০০ তে। গত সাত-আট বছরে ঘিচা তসরও খুব জনপ্রিয় হয়েছে। ঘিচা অবশ্য নকল তসর নয়। কিন্তু বনেদী মসৃণ উজ্জ্বল তসরের চেয়ে কিছু নিরেশ। ঘিচার যে দাগ এবং অমসৃণতা এর অ্যাপিল বাড়ায় সেটাই ঘিচার তুলনামূলক কম দামের কারন।
এ তো গেল উপাদানের ভেজাল। পদ্ধতির ভেজালও আছে। অবশ্য তাকে ভেজাল বলতে আমার আপত্তি আছে। যদিও লেখার শুরুতেই বলেছিলাম হ্যান্ডলুম মানেই হাতে তৈরী, আদতে অনেক জায়গায় পাওয়ার লুম ঢুকে গেছে। পাওয়ার লুমের শাড়ীতেও হ্যান্ডলুম এফেক্ট দেওয়া সম্ভব, যদিও অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়বেই। পাওয়ার লুমের শাড়ী অনেক নিখুঁত হবে। হ্যান্ডলুমের যে ছোটখাটো ত্রুটিগুলো প্রতিটা শাড়ীকে অনন্য করে তোলে সেটা পাওয়ার লুমে অনুপস্থিত। নামেই বোঝা যাচ্ছে, পাওয়ার লুমে অনেক তাড়াতাড়ি শাড়ী তৈরী সম্ভব। একটা শাড়ী হাতে বুনতে যেখানে এক বা একাধিক দিন লেগে যায়, পাওয়ার লুমে সেখানে একদিনে অনেকগুলো শাড়ী তৈরী করে ফেলা যাচ্ছে। ফলে সেই শাড়ী কম দামে বিক্রি করাও সম্ভব হচ্ছে। পাওয়ার লুমে তৈরী শাড়ী যদি সেই ট্যাগ সহ বিক্রি হয় আমি তাতে অন্যায় দেখি না, যদিও এই প্রবন্ধ লেখায় আমি যার সাহায্য নিচ্ছি তার মতে পাওয়ার লুমের বহুল প্রচলনের ফলে হ্যান্ডলুম শিল্প একদিন মরে যাবে যেটা একটা অপূরণীয় ক্ষতি। এই যুক্তিটা অনস্বীকার্য। এগুলো যেহেতু বংশপরম্পরায় বাহিত জ্ঞান, হ্যান্ডলুমের মৃত্যুর সাথে সাথে এই জ্ঞানভান্ডারও হারিয়ে যাবে।
এর পর আসি মজুরীর প্রসঙ্গে। মজুরীর ব্যাপারে দক্ষতা অনুযায়ী ভেদাভেদ নেই। যিনি সুতো বানাচ্ছেন, যিনি রঙ করছেন, যিনি বুনছেন, প্রিন্টের ক্ষেত্রে যিনি ব্লক বসাচ্ছেন সবার এক মজুরী। দিনে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো। যে তাঁতী স্বাধীন ভাবে নিজের ঘরে থেকে কাপড় বিক্রি করছেন তিনিও এর বেশী ধরেন না। বরং অনেকসময় তাঁর মজুরী আরোই কম। বহুক্ষেত্রেই এঁদের নিজেদেরই ভালো ধারনা নেই কত মজুরী হওয়া উচিত। ফুলিয়ায় তাঁতীর ঘর থেকে যে শাড়ী চারশো টাকা বা তারও কমে পাইকারী রেটে তুলে আনা হল, তার জন্য একজন তাঁতীর কাঁচামালের খরচই অন্তত সত্তর টাকা। তাহলে মজুরী বাদ দিয়ে লাভ বলতে গেলে নেই। কিন্তু যাঁরা স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করেন তাঁরা কাঁচামালের খরচ উঠে গেলেই খুশি। নিজেদের পরিশ্রমের কতটা মূল্য তা তাঁরা নিজেই জানেন না। আরো একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলা যায়। ধরা যাক তাঁতী কোন বড় ব্যবাসায়ীর থেকে অর্ডার পেলেন। তখন অর্ডারের শাড়ী হয়ে যাওয়ার পরেও যে কাঁচামাল বাঁচে তাতে তিনি আরো কয়েকটা শাড়ী বুনে ফেলতে পারেন। সেই শাড়ী তখন খুব কম দামে বিক্রি হয়ে গেলেও তাঁতীর লোকসান থাকে না।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্তের ঘরে সুলভে হ্যান্ডলুম উঠলেও তাঁতীর ঘরের অবস্থা বিশেষ বদলাচ্ছে না। এবং সুলভ হ্যান্ডলুমের যোগান দিতে গিয়ে ভেজাল শিল্পও লক্ষ্যনীয় ভাবে পুষ্ট হয়ে উঠছে। দুটোই তাঁতশিল্পের জন্য খারাপ খবর। এর থেকে বেরোনোর এক্ষুনি কোন উপায় নেই যদি না তাঁত শিল্পের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী বদলানো সম্ভব হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের হাতে বোনা শাড়ী আমরা যে আগ্রহ ও ভালোবাসার সাথে সংগ্রহ করি, সেই উৎসাহের কিছুটা সংশ্লিষ্ট শিল্প এবং তার ধারক-বাহকদের জানার জন্য খরচ না করলে নিজেকে শাড়ীপ্রেমিক বলে দাবী করার মানে হয় না। এটা আমাদের বুঝতে হবে প্রতিটা হাতে বোনা শাড়ীই অমূল্য। হস্তশিল্প মেলায় গিয়ে দরদাম করে কেনার জন্য এ জিনিস নয়। নিজে তাঁতীর ঘরে গিয়ে সম্মান দিয়ে একে নিয়ে আসতে হবে। এটা ঠিক, এই আশঙ্কা মনে থাকবেই যে এত দাম দিয়ে যে জিনিস কেনা হচ্ছে তা আসল কিনা। সে জন্য কোয়ালিটি চেকের ব্যবস্থা সরকারের তরফ থেকেই থাকতে হবে। কিন্তু কোয়ালিটি চেকের পর তার দাম দিতে গিয়ে কৃপণতা করলে সেই শিল্পের সাথে জড়িত মানুষদের প্রতি অবিচার করা হবে। আর তাতে মরে যাবে শিল্পটাই। যে তাঁতী দিনে সাড়ে তিনশো টাকা মজুরী পান, তিনি কি চাইবেন তাঁর সন্তানও এই পেশায় আসুক? হয়ত সর্বত্র পাওয়ার লুম এসে গেলে তাঁতীর মজুরী নিয়ে ভাবারই প্রয়োজন ফুরোবে। তাঁতশিল্প মিউজিয়ামে আশ্রয় নেবে। তাঁতীরা চলে যাবেন অন্য পেশায়। তেমনটা হলে খুব খুশি হব বলতে পারি না। তার চেয়ে বরং খুশি থাকতে পারি যদি আমার দিদার মত আমারও সারা জীবনে মোটে গোটা চারেক বলার মত শাড়ী থাকে। দিদার যুগে সম্ভব ছিল না, কিন্তু এযুগে তো সম্ভব আমাদের জীবনের ঐ গুটিকয় শাড়ী যাঁরা বানাবেন তাঁদের খুঁজে বার করা, তাঁদের থেকে শাড়ী তৈরীর গল্পটা জেনে নেওয়া, অমূল্য শিল্পের জন্য যতখানি বেশি সম্ভব পার্থিব মূল্য দিয়ে শাড়ীটি সংগ্রহ করা। আলমারীতে একশোটা শাড়ীর বদলে এই গুটি চার শাড়ীর গল্প জেনে তাকে আপন করে নেওয়া অনেক রোমাঞ্চকর নয় কি?
(এই লেখাটি লিখতে আমায় সাহায্য করেছেন আমার পিসতুতো ভাই ছন্দক জানা। তিনি ন্যাশনাল ইন্সটিটিঊট অফ ফ্যাশন টেকনোলজির স্নাতক ও শাড়ীশিল্পী)