অনেকদিন ধরেই রংকে বলছিলাম সানডে মাসে নিয়ে যাওয়ার কথা। রং আমার চাইনিজ বন্ধু। আমেরিকায় পড়তে আসা বহু চাইনিজ ছেলেমেয়েই প্রতি রবিবার নিয়ম করে চার্চে যায়। প্রথম দিকে ছেলেমেয়েগুলো বিদেশে এসে আরো পাঁচটা নিজের দেশের লোকের সাথে আলাপ করার জন্য চার্চে যেতে শুরু করে। সপ্তাহে একদিন ফ্রি লাঞ্চও পাওয়া যায়। তারপর আস্তে আস্তে ধর্ম ছাড়া বড় হয়ে ওঠা মানুষগুলোর মনে ধর্ম বাসা বাঁধতে থাকে। তারা তাদের বন্ধুদের, আরো নতুন ছেলেমেয়েদের টানতে থাকে নিজের দলে। কমিউনিটি বাড়তে থাকে। কিসের টানে মধ্যকুড়ির ঝকঝকে ছাত্ররা হঠাৎ করে ধার্মিক হয়ে ওঠে সেটা সামনে থেকে দেখার ইচ্ছে ছিল। তাই সানডে মাসে যেতে চাইলাম। রং যায় একটা চাইনিজ চার্চে। সেখানে তো ভাষা বুঝব না, তাই ও নিজেই বলল আমেরিকান চার্চে যাওয়ার কথা। এই চার্চটি আমার বাড়ি থেকে সাত-আট মিনিটের হাঁটা পথ। প্রতি রবিবার এখানে তিনটে ওয়ারশিপ হয়। সকাল সাড়ে আটটায় ট্র্যাডিশনাল ওয়ারশিপ। ন'টা পঁয়তাল্লিশ এবং এগারোটার কনটেম্পোরারী ওয়ারশিপ। রবিবার দিন সাড়ে আটটায় ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব এগারোটার মাসে যাওয়া হবে ঠিক হল। এই চার্চটা বলতে গেলে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মধ্যেই। এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে পৌঁছে দেখলাম বেশ অনেক লোক এসেছে। এদের মধ্যে অনেকেই স্টুডেন্ট। জানি না আমাদের দেশের মন্দিরে যাওয়ার মত চার্চে যেতে হলেও সকালে চান করে নিতে হয় কিনা। আমার তো ঘুম ভেঙেছে সোয়া দশটায়। চানের প্রশ্নই নেই। আমি আর রং ভেতরে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। ঠিক এগারোটায় দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্যাস্টর সবাইকে গুড মর্নিং জানিয়ে প্রথমেই বললেন সবাই তার পাশের জনকে গ্রিট কর। আমাদের বেঞ্চে আরেকজন স্টুডেন্ট ছিল। পেছনের বেঞ্চে এক বয়স্ক দম্পতি। তাদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হলে চার্চের মিউজিক ব্যান্ড গান শুরু করল। সামনেই একটা বড় স্ক্রীনে গানের কথাগুলো ভেসে উঠছে। আমি আগে কখনও মাস অ্যাটেন্ড করি নি। সবকিছুই আমার কাছে নতুন। "দিস ইজ অ্যামেজিং গ্রেস" গাওয়া হচ্ছিল। সঙ্গীত ভালো বুঝি না, কাজেই সে নিয়ে কোন বেফাঁস মন্তব্য করব না। তবে গানটা একেবারেই গুরুগম্ভীর নয়। সুর খুব ক্যাচি। যারা গাইছিল তাদের গলাও খাসা। কথাগুলো ভক্তিমূলক, তবে ঘি চপচপে নয়। খ্রীষ্টধর্মর একটা বড় অ্যাডভান্টেজ হল যিশুকে ভালোবাসা খুব সহজ। যে মানুষটা কিছু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের হাতে খুন হল, তাকে ভালোবাসতে গেলে নিজেকে জাস্টিফাই করতে হয়না। এটা আলাদা প্রসঙ্গ যে সেই মানুষটা নতুন কোন ধর্মপ্রচার করতে চায় নি। তার শহীদত্ব ভাঙিয়ে দলের লোকেরা আরেকটা অচলায়তন খাড়া করেছে। "This is amazing grace/ This is unfailing love/ That You would take my place/ That You would bear my cross/ You lay down Your life/ That I would be set free/ Oh, Jesus, I sing for/ All that You've done for me" এই কথাগুলোকে নিছক কৃতজ্ঞতা হিসেবেও দেখা সম্ভব। একজন ধর্ম উদাসীনের মনে এই লাইনগুলো কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরী করে না। গান শেষ হওয়ার পর প্যাস্টর মঞ্চে উঠলেন। কোন জোব্বা-টোব্বা নয়, দিব্যি প্যান্ট-শার্ট পরা মানুষ। একজন সাধারণ প্রফেসরের মত চেহারা। জিগ্যেস করলেন, এখানে কে কে সাউথের নয়, এমন কেউ আছে কিনা যার ইংরিজি মাতৃভাষা নয়। সাদার্ন অ্যাকসেন্ট নিয়ে একটু রঙ্গ রসিকতা চলল। ইতিমধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করে বেশ ভালো লাগল। প্যাস্টর যা যা বলছেন, মঞ্চের ডানদিকে দাঁড়ানো একজন মহিলা তার অনুবাদ করে চলেছেন সাইন ল্যাঙ্গোয়েজে। মূক-বধির কেউ ছিলেন কিনা জানি না, কিন্তু তাদের খেয়াল রাখার এই প্রচেষ্টাটা পছন্দ হল। জেনেসিস ৩ঃ৮ "দ্য রুইনড সোল" পড়া হল। প্যাস্টর পড়লেন এবং ব্যাখ্যা করলেন। ভদ্রলোক খুব ভালো বক্তা। তাই প্রতিটি কথাই শুনলাম। ওনার বক্তব্য একেবারেই মনঃপুত হল না। কিন্তু মানুষ কেন চার্চে যায় তার একটা মোটামুটি উত্তর পেয়ে গেলাম। প্রতি রবিবার সকালে যদি ফ্রিতে গান শুনতে পাওয়া যায় আর সেই সাথে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবের সাথেও দেখা হয়ে যায় তাহলে মন্দ কি! ইদানীং আমাদের দেশে কিছু ধর্মগুরুর নাম শোনা যায় যাঁরা সহজ ভাষায় ভক্তদের উপদেশ দিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে শ্রী শ্রী রবিশংকর আর সদগুরুর আলোচনা ইউটিউবে শুনেছি। চার্চের প্যাস্টর ভদ্রলোকও এদের মতই। জেনেসিস ৩ঃ৮-এ আপেল খাওয়ার পর আদমের সাথে ঈশ্বরের প্রথম সাক্ষাতের গল্প আছে। ঈশ্বর যে কাজটা করতে বারন করেছিলেন ঠিক সেটা করেই আদম কত ভুল করেছিলেন এবং আমরাও প্রতিনিয়ত কিভাবে ঈশ্বরের অপছন্দের কাজ করে চলেছি সেই কথা বললেন প্যাস্টর। প্রত্যেকটা মানুষ পাপী এবং পাপ থেকে উদ্ধার পেতে যিশুর শরণ নিতে হবে এই ছিল মোদ্দা কথা। তবু এই গতানুগতিকতার মধ্যেও একটা কথা ছিল যেটা উল্লেখ করতেই হবে। প্যাস্টর বললেন প্রতি রবিবার চার্চে এসেই কেউ পাপমুক্ত হবে না, মানুষকে ভালোবাসতে হবে, ভালো কাজ করতে হবে এইসব। সদগুরুরাও এই ধরনের কথা বলে থাকেন। ইতিমধ্যে রংকে জিগ্যেস করেছিলাম ও ইভোলিউশনে বিশ্বাস করে কিনা। ও বলল, ডারউইনের থিয়োরীটাই তো প্রমাণ করে যে ঈশ্বর আছেন। আমি থতমত খেয়ে বললাম, কি রকম? সাতদিনের গল্পটা তাহলে ঠিক না ভুল? ও বলল, ডারউইন ঠিক, সাতদিনে পৃথিবী তৈরী হয়নি। কিন্তু এই যে এতদিনের বিবর্তনে মানুষ তৈরী হল সেটা প্ল্যান করল কে? প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হল কিভাবে? ইউনিভার্স কোথা থেকে এল? উত্তর আছে তোমার কাছে? আমি বললাম, এখনও নেই, কিন্তু উত্তর পাওয়া যাবে একদিন। কতকিছুরই তো কারণ জানা ছিল না এতদিন, ব্যাখ্যা মিলছে তো ধীরে ধীরে। ও সদ্য কনভার্ট, তাই আমার কথাটা নিয়ে আপাতত একটু চিন্তা করছে। ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে সন্দিগ্ধ হলেও ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলো যে নিজেদের বিবর্তনে বিশ্বাসী এটা বেশ টের পাচ্ছি।
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago