আমার একটা কথা মাঝে মাঝে মনে হয় - সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালের দাপটে আমরা অন্য বাঙালি পরিচালকদের বেশ অবহেলা করেছি। আমার ব্যক্তিগত ভাবে ঋত্বিক ও মৃণালের অনেক কাজই পছন্দ নয়। এই তিনজনের মধ্যে সত্যজিৎ সবচেয়ে প্রিয়, কিন্তু সত্যজিতেরও প্রতিটা কাজ খুব ভালো লেগেছে এমন বলতে পারবো না। একজন পরিচালক হয়তো সেটা আশাও করেন না যে তাঁর প্রতিটা কাজই খুব ভালো হবে। এই তিনজনের যে কাজগুলো আমার ভালো লাগে এবং যেগুলো লাগে না তা নিয়ে নানা বিদগ্ধজনের মতামত পড়ার সুযোগ পাই। কখনও মত বদলায়, কখনও নিজের মতই আরো দৃঢ় হয়। কিন্তু এই তিনজনই বাংলা সিনেমার শেষ কথা এ আমার কখনও মনে হয় না। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন প্রতি শনিবারে দূরদর্শনে বাংলা সিনেমা দেখানো হত। সিনেমা দেখার খুব একটা অনুমতি ছিল না, তবে কিছু সাদাকালো বাংলা ছবি আমি সেইসময় দেখেছি। নিজে উপভোগ করেছি, আশেপাশের মানুষদেরও উপভোগ করতে দেখেছি। আমার বাবা-মা যে সবসময় উত্তমকুমারের সিনেমা হলেই টিভি খুলে বসে পড়েছেন এমন নয়। কোন পারিবারিক নস্টালজিয়ার আক্রান্ত হয়ে এই লেখা লিখছি না। বড় হয়ে যখন একা থাকি তখন শনিবারে দেখা সিনেমাগুলো রিভিজিট করেছি এবং আরো অনেক সাদাকালো বাংলা সিনেমাও দেখেছি। কখনও সিডি কিনে দেখেছি। ২০০৫-৬ নাগাদ একটা ফোরামের সদস্য ছিলাম যেখান থেকে অনেক পুরোনো বাংলা সিনেমা ডাউনলোড করেছি। এখন তো ইউটিউবেই দেখা যায়। এই সিনেমাগুলোর অনেকগুলোরই বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে। প্রযুক্তির দিক দিয়ে অত্যন্ত সাধারণ মানের। অভিনয়ের ব্যাপারে এক কথায় বলা যাবে না। এই যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি মুখ - উত্তম-সুচিত্রার প্রথম ছবিগুলোতে অভিনয় বেশ কাঁচা। পরের দিকে অনেক ভালো। আর সব ক্ষেত্রেই আমরা যাঁদের ক্যারেক্টার আর্টিস্ট বলি তাঁদের অভিনয় অনবদ্য। এই সময়ের বেশিরভাগ সিনেমাই গানে ভরা। গানগুলো শুনতে আজও আমার কানে বেশ লাগে। বাকি থাকে গল্প, চিত্রনাট্য। আমার কাছে মূল আকর্ষণ এগুলোই। এই যুগের সিনেমাগুলোর মধ্যে আমার বিশেষ পছন্দ কমেডি সিনেমাগুলো। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের গল্প যেভাবে এই সিনেমাগুলোতে বলা হয়েছে, কথোপকথনের যে ঢংটাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তার আকর্ষণেই আমি বার বার এই সিনেমাগুলো দেখি। পঞ্চাশ-ষাটের দশক কেমন ছিল তা তো আমি জানি না। যাঁরা সেই সময় ছিলেন তাঁরা হয়তো বলতে পারবেন এই চিত্রায়ণ বাস্তবোচিত কিনা। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি এই সিনেমাগুলো দেখলে একটা ঘরে ফেরার, দেশে ফেরার অনুভূতি হয়। খুব একটা সেন্টিমেন্টাল মানুষ নই। তবু এই অনুভূতিটা আমার কাছে অমূল্য। সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণালের ছবিগুলোর মত এই ছবিগুলো নিয়ে যেহেতু কোন আলোচনাই হয় না, তাই অন্যরা কি ভাবেন তা জানার উপায় থাকে না। সেজন্যই আজ এই পোস্ট করছি। আমি আমার পছন্দের কিছু ছবি নিয়ে লিখব। আগ্রহী মানুষ আলোচনাটাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন এই আশা।
যেহেতু অনেকগুলি সিনেমা নিয়ে লেখার আছে তাই কোনোটাতেই বিশদে যাওয়ার সুযোগ হবে না। সিনেমার নাম, পরিচালক, অভিনেতা আর দুয়েক কথায় কেন ভালো লাগে লিখছি।
প্রথমেই যে সিনেমার কথা মনে আসছে সেটি হল "পলাতক"। মূল গল্প মনোজ বসুর "আংটি চাটুজ্যের ভাই"। আলোকচিত্র সৌমেন্দু রায়। শিল্প নির্দেশনা বংশী চন্দ্রগুপ্ত। সঙ্গীত পরিচালনা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা যাত্রিক, অর্থাৎ কিনা তরুন মজুমদার। মূল চরিত্রে অনুপ কুমার। সাথে সন্ধ্যা রায়, অনুভা গুপ্তা, জহর রায়, রুমা গুহঠাকুরতা, অসিত বরন। আরো অনেকের নাম লিখতে ভুললাম নিশ্চয়ই। গল্পের শুরুতে লেখা থাকে এটি "একটি অবাস্তব, অতিনাটকীয় কাহিনী"। গল্পটা এক ভবঘুরে মানুষকে নিয়ে কোন বাঁধন যাকে আটকে রাখতে পারে না। জমিদার বাড়ির ছেলে, দাদা-বৌদি দুজনেই ভালোবাসে, তবু ঘরে তার মন টেকে না। সে কেবল পালিয়ে বেড়ায়। মনে টইটম্বুর ভালোবাসা, কিন্তু বৃত্ত রচনায় তার প্রবল অনীহা। নাকি ভয়!
https://www.youtube.com/watch?v=H0Zh8GVhrQ8
অনুপ কুমার আর সন্ধ্যা রায়ের কথা যখন উঠেছে তখন এদের আরো দুটি ছবি দিয়ে ফেলি। প্রথমটি তরুন মজুমদারেরই রচনা। বিভূতিভূষনের গল্প নিয়ে তৈরী "নিমন্ত্রণ"। গল্পের স্বাদটি পুরোপুরি রক্ষা পায়নি। তবে সে তো সত্যজিতের অপু ট্রিলজিতেও পায় নি। সে নিয়ে নানা লোকের সাথে তর্ক হওয়ার পরে আমার মনে হয়েছে বিভূতিভূষনকে নিয়ে হয়তো আমি ওভার সেন্সিটিভ। এই সিনেমাতেও বিভূতিভূষনের অনুপস্থিতি হয়তো খুব বেশি লোকে লক্ষ্য করবে না। সিনেমাটা আমার ভালো লাগে অনুপকুমার আর সন্ধ্যা রায়ের জন্য। গ্রামের মেয়েটি, তার তুচ্ছ সুখ, তার দুঃখকে উড়িয়ে দেওয়া হাসি - সিনেমাটি বিভূতিভূষন থেকে বিচ্যুত হলেও, সন্ধ্যা রায় ঠিক যেন উঠে এসেছেন বইয়ের পাতা থেকে। শুধু এই গল্পটা নয়, আরো অনেক গল্প থেকে।
https://www.youtube.com/watch?v=dvlmRizPc7E
অন্য ছবিটি আমার অনেকদিন অদেখা ছিল। বোধহয় গত বছর প্রথম দেখলাম। রাজেন তরফদারের "জীবন কাহিনী"। মূল গল্প শক্তিপদ রাজগুরুর "বাঁচোয়া"। প্রধান চরিত্রে বিকাশ রায়, অনুপ কুমার, সন্ধ্যা রায়। বিকাশ রায় একজন ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট। কায়ক্লেশে দিন চলে। ঘরে একমাত্র মেয়ে সন্ধ্যা রায়। একদিন বাড়ি ফেরার পথে বিকাশ সাথে নিয়ে আসেন অনুপ কুমারকে। অনুপ কুমার আত্মহত্যা করার জন্য হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় বিকাশের সাথে দেখা। বিকাশ তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলেন - আত্মহত্যাই যখন করবে বাপু, তখন আর দুটো দিন সবুর কর। আমার কাছে একটা লাইফ ইন্সিওরেন্স করিয়ে নাও। তারপর একমাস পরে তুমি মরলে আমি টাকাটা পাবো। অনুপ কুমার রাজি হয়ে চলে আসেন বিকাশের বাড়িতে। তারপর ঐ একমাস সন্ধ্যা রায়ের সাথে থেকে, পরিবারটার সুখ-দুঃখের শরিক হয়ে তাঁর আত্মহত্যার ইচ্ছা আস্তে আস্তে উবে যায়। বিকাশ পড়েন মহা বিপদে।
https://www.youtube.com/watch?v=kN6Ko3VXbEQ
এতখানি লিখে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। লেখাটা চলবে। আপনারাও লিখুন আপনাদের পছন্দের ছবির কথা।
--------------------------------------------------------