যে মেয়েটি তার ভালোবাসার ছেলেটির সাথে উৎসব দেখার জন্য মিথ্যে বলে বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে, আজ তার কথা খুব মনে পড়ছে। প্রথম শহরে আসা পুজোর দিনে। রেল স্টেশনের ভিড় পেরিয়ে, বাস স্ট্যান্ডে শেষ মুহুর্তের বিকিকিনির ব্যস্ততা ঠেলে সে যখন নির্ধারিত জায়গাটিতে এসে পৌঁছয় ছেলেটি তখন ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। মেয়েটিকে খুঁজে পাওয়া মাত্র তার চোখ জ্বলে ওঠে। শহরে যাওয়ার বাসের লাইনে এতক্ষণ সবাইকে ছেড়ে দিচ্ছিল সে। এবার সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে সঙ্গিনীকে নিয়ে জানলার ধারের একটা সীটে উঠে পড়ে। ব্রিজ পেরোতেই সময় লাগে ঘন্টাখানেক। তা হোক, এখন তো কোন তাড়া নেই। যদিও ফিরতে হবে সন্ধ্যে নামার আগে, তবু ঘড়ির কাঁটা তো সবে মধ্যাহ্ন পেরিয়েছে। পাশাপাশি বসেছে তারা অনেকদিন পরে। এখন লাগাক ওরা সময় যত খুশি, সময় তো আসলেই স্থির।
উৎসব দেখেনি সে কোনদিন। শহর যখন রঙিন কাপড়ে, জড়োয়া চুমকিতে, মুখ ঢাকা প্রতিমায় সবে সেজে উঠেছে তার ট্রেনের হুইসিল বেজে উঠত। ব্যস্ত, কোলাহল মুখর শহর থেকে হাঁফ ছাড়ার জন্য তারা চলে যেত বহুদূর। ছেলেটি তাকে বহুবার অনুনয় করেছে একটি দিন থেকে যাওয়ার জন্য। ক্ষমতাহীনের কাছে অনুনয় যে বিড়ম্বনার তা জেনেও। এবার সে নিজেই থাকে দূরের দেশে। এবার সে ফিরছে বলে কোলাহল থেকে বিশ্রাম চায়নি কেউ। তাকে চেয়েছে সবাই। তার পুরো স্বত্ত্ব চারদিনের জন্য। সেখান থেকে সময় চুরি করে পালিয়ে এল সে।
বড় আশ্চর্য পুজোমন্ডপ বানিয়েছে নাকি এক ক্লাব। মাটির খুরি - ছোট, বড়, মাঝারি, কিছু আস্ত, কিছু নিপুণ ভাবে কাটা - সেই দিয়ে বানিয়েছে মন্ডপ। মন্ডপের ভিতরে প্রতিমা - সেও নাকি আশ্চর্য সুন্দর। আড়াইটে পার করে তারা সেই অবাক মন্ডপের কাছে এসে পোঁছয়। মন্ডপ থেকে বিশাল লম্বা লাইন বেরিয়েছে এঁকেবেঁকে। তারাও এসে যোগ দেয় সেই ভিড়ে। গল্প করে। এতদিন পরে পাশাপাশি দাঁড়ানোর প্রতিটা মুহূর্ত শুষে নেয়। ঘন্টাখানেক পরে খেয়াল হয় তারা এগিয়েছে বড়জোর ফুট খানেক। তাদের সামনে যত মানুষ পিছনেও তার চেয়ে কম নয়। বৃদ্ধ সরীসৃপের মত স্থবির সে লাইন মেয়েটাকে অশান্ত করে তোলে। ফিরতে হবে সন্ধ্যা নামার আগেই।
তাদের কথাগুলো আর আগের মত থাকে না। অস্থিরতার শয়তান তাদের মাথায় ভর করে। দোষারোপ শুরু হয়। অবিশ্বাস কাঁটা ফোটাতে থাকে। সময় ছুটতে থাকে তেজী ঘোড়ার মত। সাড়ে চারটে পার করে মেয়েটি যখন দেখে সামনের জনসমুদ্র তখনও নিশ্চল, লাইন ছেড়ে বেরিয়ে আসে তারা। ঝলমলানো ভীড়ের মাঝে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায় দুটি প্রাণী। ম্লান। ফেরার সময় আর একসাথে ফেরে না। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গুঁজে দিয়ে ফাঁকা স্লেটের মত দাঁড়িয়ে থাকে সে। স্টেশনে এসে দৌড়য় খুব। তবুও ট্রেন ছেড়ে দেয় প্ল্যাটফর্ম থেকে। ধীরেসুস্থে, যেন সময় আবার ফিরে এসেছে অফুরান, পরের ট্রেনে ওঠে সে। দুটাকার বাদাম কিনে খায়। বাড়ি যখন ফেরে সন্ধ্যা তখন গভীর। তার সাথে কথা বলে না কেউ। চারটে দিন কোনভাবে কাটিয়ে নিজের দেশে ফিরে যায় সে। আর কখনও উৎসবের দিনে বাড়ি ফেরা হয়নি তার।
সেদিনের কোলাহলবিমুখ মানুষেরা আজ ষষ্ঠীপুজোর দিন কলাবউ চান করিয়ে আনে। জীবন তো বদলাবেই। সময় তো আসলেই স্থবির নয়। এমনই অনায়াস সপ্রতিভ তার চলন, তাকে দেখে যতখানি ঘৃণা জাগে, ততখানিই প্রেম। অজগরের মত শ্বাসরোধী প্রেমে কয়েকটি মুহূর্ত জেগে থাকে যার রহস্য ভেদ না করা পর্যন্ত অস্থিরতা ঘোচে না। কি ছিল সেই আশ্চর্য মন্ডপের ভেতরে? কেমন সে মুখ? এত লক্ষ মানুষ দাঁড়িয়েছিল সেদিন তাকে দেখবে বলে। কি দেখেছিল তারা? কোলাহল, দোষারোপ, অবিশ্বাসের শেষে কোন স্থির শান্তির দ্বীপ জেগে ছিল কি? থাকে কি কোথাও?