আবার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। এখানে আসতেই হত। এখানে আসবে বলেই ড্রাইভার খুঁজে বার করেছিল আমাকে। ড্রাইভারের সেই প্রথমবার। আর আমি তিনবার ঘুরে এসে অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক। সেবারে ড্রাইভার এসেছিল শীতকালে। বরফে ঢাকা সাউথ রিম। নর্থ রিমের রাস্তা তো বন্ধই থাকে সে সময়। শেষ মুহূর্তে প্ল্যান করেছিল বলে পার্কের ভিতরে থাকার কোন উপায় ছিল না সেবারে ড্রাইভারের। এবারে তাই চেয়েছিলাম দুটোদিন শুধু গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে দিতে। পার্কের ভিতরে থাকতে তো হবেই। নইলে কি করে দেখা যাবে গভীর রাতের ক্যানিয়ন! আগেরবার যখন একা এসেছিলাম, ঘর পেয়েছিলাম ক্যানিয়ন ভিলেজে। সন্ধ্যা নামার পর রিমের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েওছিলাম। কিন্তু সেদিন ছিল জমাট মেঘ। ক্যানিয়নের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে গুমোট বাতাস উঠে আসছিল ওপরে। চাপ চাপ অন্ধকারের মাঝে ওই বাতাসের গুমরানির মুখোমুখি বেশীক্ষণ দাঁড়াতে পারি নি। শাটলবাস যেখানে দাঁড়ায় সেখানে একটা আলো জ্বলছিল। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম সেই আলোর নিচে এসে। এবারেও চিন্তা ছিল – দেখা যাবে কি রাতের ক্যানিয়ন! ভরসা এই, ঐ অন্ধকারের সামনে একা দাঁড়াতে হবে না, সাথে আছে একজন।
আমরা যাচ্ছিলাম পেজ থেকে। I-89 ধ্বস নেমে বন্ধ। অতএব জিপিএস আমাদের তুলে দিল কোন গেরস্ত বাড়ির বাগানে। বাগান অবশ্য নামেই। কাঁকড়ভরা লাল বালি, ধুলো আর যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ঘাসের ঝোপকে কোন অভিধানেই বাগান বলবে না। ঝোপ ডিঙিয়ে আমরা রাস্তায় নামলাম। রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। অনেকদিন ধরে যাওয়া-আসার পরে কিছুটা পথের আভাস এসেছে। জিপিএস দেখাচ্ছে কুড়ি মাইল। ড্রাইভারের চিন্তা কুড়ি মাইল যাওয়ার পর যদি আবিষ্কার করি ভুল রাস্তায় এসেছি, তখন কি হবে। যা হওয়ার হোক ভেবে আমরা এগিয়ে যাই। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় গাড়ি লাফাতে লাফাতে এগোয়। পয়েন্ট টু মাইল, পয়েন্ট থ্রি, হাফ মাইল, এক, দুই, পৌনে চার – গুনতে গুনতে এক সময় কুড়ি মাইল শেষ হয়। আমরা একটা সত্যিকারের রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছই।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন আসতে আসতে বেলা গড়িয়ে দুপুর। প্রতিবার এসে রিমের রেলিং ধরে যখন দাঁড়াই প্রথম দেখার অনুভূতি হয়। কড়া রোদে পাথরের দেওয়াল কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। অনেক নীচে নীল সুতোর মত কলোরাডো। আমরা ক্যানিয়ন ভিলেজে যাই চেক-ইন করতে। পার্ক রেঞ্জারকে জিজ্ঞাসা করি রাতে কোন প্রোগ্রাম আছে কিনা স্টার গেজিং-এর। অবিকল প্রোফেসর শঙ্কুর মত দেখতে ভদ্রলোক দাড়ি নেড়ে বললেন কালকেই পূর্ণিমা ছিল কিনা, আজ তো ক্যানিয়ন আলোয় ভাসবে। তারা আজ দেখতে পাবে না। তবে কিনা চাঁদনী রাতের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে আমাদের গাইডেন্সের দরকার হবে না। ডিনারের পর দুজনে মিলে হাঁটতে বেরিও, যা দেখবে সারা জীবন মনে থাকবে।
গতবার এসে সূর্জাস্তও দেখিনি ভালো করে। আকাশ মেঘে ঢেকেছিল। এবারে দেখার খুব সাধ। পছন্দ মত একটা পাথর খুঁজে জুত করে বসি। ড্রাইভার ছবি তুলে বেড়ায়। আমি মানুষ দেখি, পাথরের খাঁজে ফুটে থাকা সূর্জমুখী দেখি, ঘনিয়ে আসা বিকেলে আলো-ছায়ার খেলা দেখি। ক্যানিয়নের আকাশ জুড়ে রাজত্ব করে ক্যালিফোর্নিয়া কন্ডোর। ড্রাইভার যতই তাকে লেন্সে ধরতে চায়, সে ফাঁকি দিয়ে পালায়। কমলা পাথর ধীরে ধীরে লাল, মেরুন, বেগুনী হয়ে ওঠে। কলোরাডো নদীটা যেখানে দেখা যাচ্ছে সেখানে মফস্বলের সন্ধ্যার মত মনখারাপী কুয়াশা নামে। সেই পাতলা সরের মত কুয়াশা ক্রমশ উঠে আসতে থাকে ক্যানিয়নের চুড়ায় – আমরা যেখানে বসে আছি। সব লোক চলে গেছে। আমরা আর একটি দক্ষিণ ভারতীয় দম্পতি শেষ শাটলের অপেক্ষায়। সন্ধ্যা ঘিরে ধরেছে আমাদের। হঠাৎ করেই ঠান্ডা পড়ে গেছে। আকাশে একটি-দুটি তারা।
ক্যানিয়ন ভিলেজে ডিনার করেই ছুটেছি ম্যাথার পয়েন্টে। নটার সময় চাঁদ উঠবে। তারপরেই আলোয় ভাসবে ক্যানিয়ন। ঘোর কালো আকাশে তারা দেখতে চাইলে মাঝের সময়টুকু ছাড়া গতি নেই। পার্কিং লট ঘুটঘুট করছে। আকাশ ভরা সহস্রকোটি তারা। আন্দাজে হাঁটি রিমের দিকে। আমার কেবলই মনে হয় ড্রাইভার ভুল পথে যাচ্ছে। আর আমি যে পথে যেতে বলি সে পথ শোনার আগেই নাকচ করে দেয় সে। গজগজ করতে করতে কখনও ট্র্যাশক্যানে, কখনও গাছে ধাক্কা খেয়ে এক সময় সত্যিই রিমের সামনে এসে দাঁড়াই। আর তক্ষুনি, ঠিক সিনেমায় যেমনটি হয় তেমন ভাবে, একটা তারা খসে। একটা আলোর ছটা, আলো দিয়ে তৈরী একটা পাখী যেন – আকাশ থেকে নেমে এসে ক্যানিয়নের গভীরে মিশে যায়।
এত তারা কখনও দেখিনি। ছোটবেলায় যখন ফি বছর শিমূলতলা যাওয়া হত লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে কালীপুজো পর্জন্ত সন্ধ্যে হলেই ছাদে উঠে যেতাম। ইউক্যালিপটাসভরা থিকথিকে জোনাকি আর আকাশভরা তারা – এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। কিন্তু এই আকাশ তার চেয়েও নিকশ কালো, তার চেয়েও প্রকান্ড। ইনকাদের গল্পে পড়েছি ওদের কাছে রাতের আকাশ কালো চাদরের ওপর তারার চুমকি বসানো নয়, বরং তার উল্টোটা। আলোর চাদরে একটু একটু যে কালোর নকশা তাই দিয়েই তৈরী ওদের আকাশের গল্প। এমন আকাশই দেখতো ওরা নিশ্চয়ই, এমন ঠাসা বুনোট কাজ, একটু জায়গাও খালি পড়ে নেই। ক্যানিয়ন একটা গভীর কালো গহ্বরের মত হাঁ করে আছে। অনেক নীচে একটা ক্ষীণ আলোর বিন্দু দেখা যায়। ট্রেক করে নেমেছে যারা তাদের ঘাঁটি বুঝি। আশেপাশে আর কোন প্রাণী নেই। যাদের দেখেছিলাম পার্কিং লটে তারা অন্য কোথাও গেছে হয়ত। কত কোটি বছরের পুরনো ক্যানিয়ন, কোটি বছরের পুরনো আকাশ আর ক্ষুদ্র দুটি মানুষ – আমাদের ঘিরে আছে নিস্তবদ্ধতা।
একসময় দেখি আমাদের ডানদিকে ক্যানিয়নের মাথায় এক চিলতে আলোর আভাস। চাঁদ ওঠার কথা আছে জানি। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না টিমটিমে চাঁদের আলোর এত জোর হতে পারে যে মিনিট কয়েক আগের ঘুরঘুট্টি অন্ধকারও এখন ফিকে লাগে। যে সিঁড়ি ধরে নেমে এসেছি রিমে, যে ট্র্যাশক্যানে ধাক্কা খেয়েছিলাম – সব স্পষ্ট দেখা যায়। এমনকি অন্ধকারের চাঙড়ের মত পড়ে ছিল যে ক্যানিয়ন, তার খাঁজখোঁজও আকার নিতে থাকে। বিশাল এক হ্যালোজেন আলোর মত প্রায় পূর্ণ চাঁদ লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে ক্যানিয়নের দেওয়ালের ওপার থেকে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল চুপি চুপি কারোর বাড়ি ঢুকে পড়েছি, এখন আর তা লাগে না। মনে হয় এই জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রি আদি-অনন্ত কাল ধরে শুধু আমাদেরই জন্য অপেক্ষা করেছিল।
খানিক পরে আমরা যখন ভাবছি এবার ফিরব কিনা, দু-এক জনের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। তিনজন ফোটোগ্রাফারের একটি দল ট্রাইপড কাঁধে রিমের এই অংশকেই বেছে নেয় ছবি তোলার জন্য। ড্রাইভার আলাপ জমায়। ফোটোগ্রাফারদের একজন ড্রাইভারের প্রাক্তন স্কুলের। গতকাল রাতে লেক পাওয়েলের ছবি তুলেছে এরা। আজ এসেছে পূর্ণিমারাতের গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নকে ক্যামেরাবন্দী করতে। ওরা লেন্স ঠিক করে, ছবি নেয়, আমাদের দেখতে ডাকে। ক্যামেরার এলসিডি ডিসপ্লেতে ধরা পড়েছে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ, কি অপূর্ব মোহময়ী! কি অদ্ভুত সুন্দর এই পৃথিবী! আমরা ফেরার পথ ধরি।
পরের দিন একটু বেলা করে ওঠা। ক্যানিয়ন ভিলেজে ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি ছুটেছে নর্থ রিমের দিকে। ইস্ট গেটের কাছাকাছি এসে গেছি প্রায়। ড্রাইভার হঠাৎ তার হাতের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে – একি আমার আংটি! অনামিকার ওয়েডিং ব্যাণ্ডের বয়স তখনও একবছরও হয়নি। কোনদিন আংটি না পরা হাতে সাবধানেই ছিল এতদিন। হঠাৎ সেটি উধাও। গাড়ি থামিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। নেই। ফেরা হল ক্যানিয়ন ভিলেজে। যে ঘরে আমরা ছিলাম সে ঘর তখন সাফাইকর্মীরা পরিস্কার করছে। তাদের সাথে খুঁজে দেখা হল ঘর। বরফ নেওয়া হয়েছিল যে মেশিন থেকে তার চারপাশ। ডাইনিং রুম – প্রাতরাশ সেরেছি যেখানে। কোথায় লুকিয়ে রইল বিয়ের আংটি এই বিশাল পার্কে কে জানে! গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের মুখ গম্ভীর। আমার অতটা না। হারাতে হলে তো এখানেই হারানো উচিত ছিল!