আমাদের বাড়িতে খুব একটা গান-বাজনা শোনার চল ছিল না। বি এস সি পাশ করার পর আমি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পড়তে আসি। আর তখনই আমার একটি টেপ রেকর্ডার হয়। সুচিত্রা মিত্রের একটা অ্যালবাম ছিল – ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’ – চারটি ক্যাসেট নিয়ে একটা অ্যালবাম – আমার প্রথম অ্যালবাম। তার আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি নি তা নয়। পাড়ার পুজোতে একই সাথে বাজতো ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে’ আর ‘আমার পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে’। আমিও এদের মধ্যে বিশেষ তফাৎ করি নি।
হোস্টেলে আমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে হত খুব সাবধানে। আমার রুমমেট ছিল অবাঙালী। সে ঘরে থাকলে তো কথাই নেই, তার অনুপস্থিতিতে গান চালালেও আমার পাশের ঘরের বাঙালী বন্ধুদের হাহাকার শুরু হয়ে যেত – ঐ দ্যাখ, শুচিস্মিতা আবার কীর্তন চালিয়েছে। বাণীর দিকে খেয়াল না রেখে শুনলে রবীন্দ্রসঙ্গীত যে বেশ স্লো তা আমিও মানি। রবীন্দ্রগানের যা সিগনেচার, অন্যমনস্ক শ্রবণে তাকে মনোটোনাস মনে হতে পারে – এটাও খুব সত্যি। তাই কিছুদিন পরেই দেখা গেল আমার ঘরে কিশোরকুমার আর এ আর রহমানই বাজেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেটে ধুলোর স্তর। তবু ভালো – ‘তুম পাস আয়ে, ইঁয়ু মুসকুরায়ে’র ক্রেজ তখন একটু কমেছে।
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে সিঙ্গল রুম পেলাম। পুরোনো ক্যাসেটের ধুলো ঝাড়া হল। অনেক রাতে ল্যাব থেকে ফিরে লো ভলিউমে চুপি চুপি শুনলাম – ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’। গানটা এর আগেও বেজেছে আমার ঘরে, কিন্তু আমি শুনিনি। সেই প্রথম শোনা। ‘অন্ধকারে অস্ত রবির লিপিলেখা, আমারে তার অর্থ শেখা’ – অর্থ আমিও বুঝলাম না। কিন্তু আঁধার রাতে অবুঝ পাগলের পরশপাথর খুঁজে ফেরা আমাকে আচ্ছন্ন করল। যে ভাবে প্রতিটি ‘বুঝিয়ে দে’ উচ্চারণ করলেন সুচিত্রা মিত্র; যে আর্তি, যে অভিমান এবং যে বিস্ময় ঝরে পড়ল সেখানে – কোনদিন গান না শোনা অশিক্ষিত তাতে বশ হল। সুচিত্রা মিত্রের প্রসঙ্গ উঠলে আমার ‘কৃষ্ণকলি’ মনে পড়ে না। আমার মনে পড়ে ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’। মনে পড়ে ‘আমারে বাঁধবে ধরে এই হবে যার সাধন, সে কি অমনি হবে’। সুচিত্রার গায়কীর বলিষ্ঠতা আর আত্মবিশ্বাস ম্যাজিক লন্ঠনের মত আলো ফেলতে থাকে গানটির ওপর। রাত বাড়ে। এক অচেনা জগত তার দরজা খুলে দেয় আমার সামনে। তিনি গাইতে থাকেন ‘স্বপন-পারের ডাক শুনেছি, জেগে তাই তো ভাবি। কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি’। পরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতেও শুনেছি এই গান। কিন্তু প্রথম শোনার সেই অভিঘাত আজও গেল না। অ্যালবামের সবচেয়ে প্রিয় গানটি ছিল – ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব। ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব’। অ্যালবামের নামও এই গানটির নামে – ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ’। সেসব বহু আগের কথা। পথের দেবতা তখনও নাকাল করেন নি। তবু সুচিত্রা যখন গাইলেন – ‘কত যে গিরি, কত যে নদীতীরে, বেড়ালে বহি ছোট এ বাঁশিটিরে, কত যে তান বাজালে ফিরে ফিরে, কাহারে তাহা কব’ – এক দুর্বোধ্য কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠল। মনে হল এতদিন যা কিছু শুনেছি, পড়েছি, দেখেছি – তার চেয়ে এই অনুভূতি আলাদা। এর আগে যে রবীন্দ্রনাথ পড়ি নি তা নয়। কিন্তু সেটা ছিল বুদ্ধি দিয়ে পড়া। তিনি যে আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা এমনভাবে কখনও বুঝি নি।
সেই রাতের প্রায় ছ’বছর পরের কথা। আমি তখন নিউইয়র্কে। এক বন্ধু জোর করে মিউজিয়াম অফ মর্ডান আর্টসে পাঠাল আমায়। আমি তো যথারীতি মূর্খ। পেইন্টিং-এ কোন আগ্রহই নেই। বন্ধুর গাল খেয়ে চিরতা গেলা মুখ করে ছবি দেখতে এসেছি। শুনলাম ভ্যান ঘঘের একটি বিখ্যাত ছবি নাকি এখানে আছে। ভদ্রলোকের নাম শুনেছিলাম। তাই এনার ছবিই দেখব বলে মনস্থ করলাম। আমার মত আদেখলা আরও অনেক ছিল বোধহয়। আড়াই ফুট বাই তিন ফুট ছোট্ট ক্যানভাসটার সামনে দেখলাম খুব ভিড়। ছবির নাম ‘স্টারি নাইট’। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে ছ’বছর আগের ফেলে আসা রাতকে আবার দেখতে পেলাম। নিঃঝুম ক্যাম্পাস। তোলপাড় করে হাওয়া বইছে। হাওয়ার দাপটে যেন সব কিছু লণ্ডভন্ড হয়ে যায়। পণ্ড হয়ে যায়। ক্লান্ত আর শান্ত হয়ে যায়। তারপর সেই শান্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক মগ্ন শিল্পী গেয়ে ওঠেন – ‘ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব’। সপ্তর্ষিমণ্ডলের কাঁধ থেকে মেঘটা সরে যায়। একে একে সবকটি তারা ফুটে ওঠে আবার। সাইপ্রেস গাছের পিছনে ক্যানভাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোটি হয়ে ঝলমল করেন আমার রবি ঠাকুর। ছ’বছর আগে যে গানটি শুরু হয়েছিল এইখানে এসে তার বিস্তার পূর্ণতা পায়।
সুচিত্রা মিত্র কি আমার সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী? তা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রগানে দীক্ষা তাঁর হাত ধরেই। তাঁর নাকি জন্ম হয়েছিল চলন্ত ট্রেনে। তাই তিনি সারা জীবন ছুটেছেন। অদম্য প্রাণশক্তি তাঁর। অশেষ হওয়ার মন্ত্রও তিনিই শিখিয়ে গেলেন।