অক্টোবর মাস এসে গেল। আজকাল আর ভোর হলে আলো দেখা যায় না। জানলার কাঁচে ফোঁটা ফোঁটা শীত জমে থাকে। আবছা অন্ধকারে গুটিসুটি মেরে জেগে থাকা ফ্যাকাসে নক্ষত্ররা বলে, আরও ঘুমাও খানিক, কি হবে জেগে? যদিও আমি নক্ষত্রের নির্দেশ মানি না। জেগেই থাকি। দেখি কেমন করে শীতরাত ফিকে হয়। মনে পড়ে বাংলা দেশে এখন আশ্বিন মাস। বাংলার আকাশে এখন আগমনী।
পুজো নিয়ে আমার বিশেষ স্মৃতিকাতরতা নেই। প্রতি পুজোতেই ভিড় এড়াতে বাবা-মা বেড়াতে চলে যেতেন আমাদের নিয়ে। ছোটবেলায় দু-একবার অঞ্জলী দিয়েছিলাম বোধহয়। গার্ডেন সিল্কের চকচকে জামা পরে ঘামতে ঘামতে ঠাকুরও দেখেছি বারকয়েক। পায়ের নতুন জুতোয় সদ্যলব্ধ ফোস্কা। সে সব বাদ দিলে দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে আদিখ্যেতা নেই তেমন। ধূপের গন্ধ বেশ লাগে। ভালো লাগে শিউলি ফুল। রেললাইনের ধারে অনাদরে বেড়ে ওঠা কাশের ঝোপ। শরতের নীল আকাশ। আর সবচেয়ে প্রিয় মহালয়ার সকালে নতুন পূজাবার্ষিকীর গন্ধ। বছরের এই সময়টা এইসব আদেখলা অকিঞ্চিৎকর স্মৃতি পোষা বেড়ালের মত পায়ে পায়ে ঘোরে। বকে ধমকেও তাদের এড়ানো যায় না। রোদ উঠুক, ছাই না উঠুক – আগমনীর আলো পথ খুঁজে নেবেই নেবে।
গতবছর এইসময় দিদা চলে গেল। মহালয়ায় নাকি পিতৃপুরুষকে তর্পণ করতে হয়। মেয়েদেরও স্মরণ করার রীতি আছে কিনা কে জানে! মনে তো তাকে পড়েই। যখনই মুগডালে ফোড়ন দিই – জিরে, শুকনোলঙ্কা, আদাবাটা। অথবা কপি-পোস্ত রাঁধি – কড়ায় নেড়ে নেড়ে জলের ছিটে দিয়ে। ভোলার কি উপায় আছে! মানুষ চলে যায়। গন্ধগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে – জব্দ করবে বলে। আগমনীর বাতাসে আজকাল এইসব গন্ধও মিশে থাকে।
পরশু অফিসফেরতা দেখি রোড কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। খামোখা অনেক ঘুরে বাড়ি ফিরতে হল। লাভের মধ্যে ব্লুমিংটনের কিছু রাস্তা ঘোরা হয়ে গেল যেদিকে সচরাচর যাওয়া হয় না। দেখি একটি-দুটি গাছে রঙ ধরেছে। প্রহরশেষের রঙ। আমি অত গাছ চিনি না। আমার কাছে সবাই ম্যাপেল। হেমন্ত এদেশে রঙের ঋতু। পাতা ঝরানোর আগে প্রতিটি গাছ লাল, কমলা, সোনালীতে সেজে ওঠে। সেই রঙের উল্লাস দেখে বোঝার উপায় নেই এ খেলা বেলাশেষের। গোধুলীলগ্নে পরিপাটি সেজে বসে থাকা – সে আসবে। শুভ্র প্রসন্ন শীত। জীবনভোর জমানো সব রঙ নিবেদন তার কাছে। সে নতজানু হয়ে অপেক্ষা করবে তরুমূলে। শীতার্ত সম্মোহিত পাতাগুলো টুপটাপ ঝরে পড়বে তার কোলে। সাদা বালির মত নরম তুষারে ঢেকে যাবে পৃথিবী। ঝিলমিলে সূর্যের আলো সাতরঙা চাদর বিছিয়ে দেবে। তার নিচে শান্তিতে ঘুমোবে বাদামী ম্যাপেল পাতা।
এই নীল আকাশ, কাশের গুচ্ছ, সিলভার ম্যাপেলের পাতায় কমলা ছোপ সেই মোহন প্রীতমের আগমনী গাইছে। “তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর, তুঁহু মম তাপ ঘুচাও। মরণ তু আও রে আও।”
খন্ডিতাদের যাপিত জীবন
2 years ago